১.
প্রাক্তন প্রেমিকের ছোট ভাইয়ের বউ হয়ে মাত্রই পা রাখলাম তাদের বাড়িতে। খুব একটা ইচ্ছে করে প্রাক্তনের ভাইকে বিয়ে করিনি। মনের দিক থেকে বাধ্য হয়ে করেছি তবে তা সম্পূর্ণই নিজ স্বার্থে। যতোটা চতুর আমার প্রাক্তন ঠিক ততোটাই বোকা তার ভাই। আর আমারও বিয়ে করাটা জরুরি ছিলো বাবার সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর জন্য । প্রাক্তনের ভাইয়ের মত বোকারাম আমার জন্য বর হিসেবে লটারি স্বরুপ। এক ঢিলে দুই পাখি মারবো বলেই পূর্ণকে মানে প্রাক্তনের ভাইকে বিয়ে করেছি। টানা তিন বছর প্রেম করে হাতে হাত রেখে সময়ে, অসময়ে চুমো খেয়ে সম্পর্কের তিনটা বছর কাটিয়ে প্রাক্তন হঠাৎ একদিন বলল তার বিয়ে ঠিক। অথচ আমি তার জন্য নিজের পরিবার পরিজনকে কত কষ্ট দিয়ে তাদের পছন্দের ছেলেকে রিজেক্ট করে বিয়ে ভেঙেছি। শেষে কিনা সম্পর্ক নষ্ট করতে? কি করে ছেড়ে দেই তাকে প্রতিশোধ না নিয়ে! আর এই পূর্ণ মানে প্রাক্তনের ভাই হাবা হাশমত বহু আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করে । বাড়িতে সবাই ইচ্ছে মতো অপমান করে যখন থেকে শুনেছে অংশ বিয়ে করে ফেলেছে। ইমতিয়াজ আহমেদ অংশ আমার প্রেমিক মানে প্রাক্তন প্রেমিক আমায় ধোঁকা দিয়েছে খবরটা বাবার কানে যেতেই শুরু হলো বাড়িতে তুমুল ঝগড়া । আর সবটাই আমায় নিয়ে। আমার মাথায় ঘুরছে প্রতিশোধ তাই যেচে পড়ে পূর্ণকে কল করে বললাম, “ভালোবাসো আমায়?”
ছেলেটা ব্যাপক হারে ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলো। তারপর আমতা আমতা করে কোন জবাব দিতে গেলে আমিই বললাম, “যদি বাসো তবে তোমাকে একটা চান্স দিতে চাই। এক ঘন্টার মধ্যে কাজী নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির হতে পারলে আমায় পাবে সারাজীবনের জন্য। আর যদি এক মিনিটও দেরি হয় তবে চিরতরে আমায় হারাবে। ইউর টাইম স্টার্ট নাও।”
কথাটা বলেই কল কেটে দিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এই হাবাগোবা ছেলে এক ঘন্টা নিজের ভ্যাবাচেকা ভাব কাটাতেই পার করবে বিয়ে তো পরের ব্যাপার। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে ঠিক এক ঘন্টা পনেরো মিনিট পার করে সত্যিই হাজির হলো কাজী নিয়ে। আসল ভ্যাবাচেকাটা তো আমি খেয়েছিলাম। ওই হাবা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আমায় কল দিয়ে বলল, “আমি কাজী নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি কেউ কি আমায় নিতে আসবে?”
ওই মুহুর্তে টের পেলাম আমার হার্ট বিট করছে না আমি অর্ধমৃত প্রায়। হাবা হাশমত সত্যিই হাজির হয়েছে। আজ আমি সকালে উঠে একদফা ন্যাকা কান্না কেঁদেছিলাম আর তাই বাবা আমায় প্রচুর বকেছে আর এও বলেছে আমি যেন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। আমার মত মেয়ের থাকা না থাকা সমান কথা। এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো আমি বাবার সাথে লড়াই করে সে বিয়ে ভেঙেছিলাম। বলেছিলাম অংশ ওই ইঞ্জিনিয়ারের চেয়েও বেস্ট। কি হলো শেষমেশ বেস্ট ছেলেই ধোঁকা দিয়েছে। তাই এ নিয়ে রোজই ঝগড়া হয় বাড়িতে আর আমি রাগে প্রতিবারই উল্টো পাল্টা কথা বলে ফেলি আজও বলেছি । আজকের কথাটা ছিলো আজকেই আমি বিয়ে করে বের হয়ে যাবো এই বাড়ি থেকে। বাবা বলেছিলো, “ছেলে কি গাছ থেকে টুপ করে পড়বে নাকি আজকে বিয়ের জন্য আমিও দেখবো কে করে তোকে বিয়ে।”
ব্যস, মুখের বাণী সত্যি করতে কল দিলাম এই পূর্ণ হাবাকে। মাথায় ছিলো এই হাবা কে বিয়ে করতে পারলে বাবার বাড়িও ছাড়তে পারবো আবার অংশের উপর প্রতিশোধও নিবো৷ হয়ে যাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তবে মনে সংশয় ছিলো পূর্ণ আজই রাজি হবে না বিয়ে করতে। কিন্তু এ তো দেখলাম মেঘ না চাইতেই জল। আমার কাজ হয়ে গেল নিজেই গিয়ে এগিয়ে আনলাম কাজি আর বরকে। বাবা বাড়িতেই থাকায় গলা উঁচিয়ে বললাম, “আমি বিয়ে করছি বর আর কাজি এসে গেছে। আমার এখন স্বাক্ষী লাগবে বাড়ির মানুষ গুলোর দয়া হলে যেন একটু ড্রয়িংরুমে আসে।” তারপর…..
তারপর আর কি? বাবা সেই রেগে বেরিয়ে এলেন নিজের ঘর থেকে ভেবেছিলেন আবার বকবেন আমার এই ফালতু কাজের জন্য । কিন্তু সবটাই পাল্টে গেল হঠাৎ করে। বাবা পূর্ণকে দেখেই চুপ হয়ে বললেন, “বিয়ে কি এখন হবে?”
কি আশ্চর্য ব্যাপার! আমার বাবা আমার সাথে কত্তো গরম হয়ে কথা বলে অথচ এই হাবার সাথে কত্তো সফটলি বলল। আর কি বলল, “বিয়ে কি এখন করবে!”
ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল আর বিদায়ও। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ালেন স্বাক্ষী হিসেবে বাবা আর প্রতিবেশি একজন মুরুব্বি ছিলো। মা চুপচাপ শো দেখলেন আমাদের সবার তিনি বাকরুদ্ধ। কাজী সাহেবও বোকা বনে ছিলেন কিন্তু তিনি টাকা পেয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করে চলে গেলেন। বিয়ে শেষ হতেই বাবা কোন কথা ছাড়াই বলে উঠলেন, “মিষ্টার পূর্ণ আপনি এখন আপনার বউকে নিয়ে বিদায় হন।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম বাবার কথায়। এ পর্যায়ে একটু কষ্ট অনুভব হলো আমার। এতদিন বাবা রাগে-ক্ষোভে কত বলতেন, “আমার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যা তোর মত মেয়ের দরকার নেই।” তখনও আমার খারাপ লাগতো না মনে করতাম বাবার রাগটা যৌক্তিক । কিন্তু আজকের ওই কথাটা একদম কলিজায় তীরের মত লাগলো। কোনদিকে না তাকিয়ে বের হয়ে গেলাম বাড়ি থেকে পেছনে পেছনে আসলো পূর্ণ। ঘন্টাখানেকের মাঝেই এসে দাঁড়ালাম শ্বশুড়বাড়ির গেইটে। এতক্ষণ শুধু ছিলাম অন্য দুনিয়ায় আর এখন আছি আমার নতুন দুনিয়ায়। পাশে আছে পূর্ণ আমার বর আমার প্রাক্তনের ভাই। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে এসেছি৷ পরনে ছিলো গোলাপি রঙের সুতি সেলোয়ার-কামিজ। চুল গুলো বেনী করা কিছু চুল এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে এসেছে বেনী থেকে। পায়ে একজোড়া স্লিপার, কানে,গলায় কিছুই নেই। পূর্ণ আমায় নিয়ে গেইট পেরিয়ে মেইন ডোরে কলিংবেল বাজালো কেউ খুলছে না। সে বার কয়েক বেল বাজিয়ে মোবাইল বের করলো। হয়তো বাড়ির কাউকে কল করবে। আমার বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দে ভেতরটা তোলপাড় করছে। তুফান শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে। বারবার মনে হচ্ছে ভুল করেছি খুব বড় ভুল করেছি। ভালোবাসায় প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। যেখানে প্রতিশোধের প্রশ্ন আসে সেখানে ভালোবাসা ছিলোই না বলতে হবে। তবে কি আমি নিজেকে চিনতে ভুল করেছি? অংশ কে ভালোবাসার ঢং করে এসেছি এতকাল! যদি তাই হয় তবে ভালোবাসি কেন বলতাম? আর যদি ভালোই বাসতাম তবে কি মনে মনে প্রতিশোধ নিতে চাইতাম? এ কেমন দ্বিধায় পড়লাম আমি!
ভেতর থেকে দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম এক মধ্যবয়সী নারীকে। আমার ধারণা ভুল না হলে ইনি অংশের সৎ মা। ধুর ওই বদটার নাম কেন নিচ্ছি বারবার।
“মেয়েটা শশী তাই না পূর্ণ?” মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে পূর্ণকে প্রশ্ন করলো।
“জ্বি! ইনি শশী আমার বউ।”
পূর্ণের তটস্থ জবাব। আমি বেশ বিষ্ময়ে তাকালাম একবার পূর্ণের দিকে একবার মহিলাটির দিকে। তাদের কথা বলার ধরণ এত স্বাভাবিক কেন? কোন উত্তেজনা নেই না কোন চিন্তা। বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে মহিলাটির উচিত ছিলো উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করা, “তুমি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছো?”
কিন্তু নাহ, রিয়াকশন একদম হ্যাপি হ্যাপি দিলো৷ আর ওনার কথায় মনে হলো তিনি শুধু আমার নাম জানতেন না আমায় দেখেছেনও। কিন্তু কি করে সম্ভব! অংশ কি তবে আমার ছবিও দেখিয়েছিলো বাড়িতে? পূর্ণ তো আমায় ব্যাচমেট হিসেবে চিনতো। তার ভাইয়ের সাথে বহুবার দেখেছে তাই পরিচিত৷
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছোট্ট একটা ড্রয়িংরুম। বাড়িটা মোটামুটি বড়। আমি আগে এ বাড়িতে কখনও আসিনি কিন্তু অংশের মুখে শুনেছিলাম এই আশি শতকের তৈরি বাড়িটির কথা৷ বাড়িটিতে বেড রুম অনেক তবে বাথরুম মাত্র তিনটা। একটা গেস্ট রুমে, একটা তার বাবার রুমে আর একটা বাইরে কিচেন সংলগ্ন । বাড়িটির নির্দিষ্ট কোন ডিজাইন না করেই অংশের দাদা নিজ বুদ্ধিতে এমন করে বানিয়েছেন৷ দাদার ধারণা ছিলো বেড রুম বেশি হওয়া জরুরি হলরুম না হলেও চলে। আর তাই ড্রয়িংরুমটা এতো ছোট। আর বাথরুমও নিজ পছন্দে মাত্র তিনটা৷ আমি যখন ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম তখন কিচেন সংলগ্ন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো এক কিশোরী মেয়ে। পরনে তার আটপৌরে শাড়ি৷ গায়ের রং আমার চেয়েও বেশ উজ্জ্বল আর খুব বোকা বোকা মায়াবী চেহারা। নাকে মাঝারি সাইজের একটা নাকফুল। বুঝতে বেগ পেতে হয়নি এই মেয়েটই তবে অংশের বউ। বুকের ভেতর আবার একটা ব্যাথার সৃষ্টি হলো।
শশী! পূর্ণ ধীর গলায় ডাকলো আমায়।
জ্বি!
-ইনি আমার ভাবী যদিও বয়সে আমার চেয়ে ছোট।
ওহ! আমি ছোট্ট করে বললাম পূর্ণের কথায়।
-ইনি কে ভাইয়া? মেয়েটির প্রশ্ন।
“আমার স্ত্রী শশী।” পূর্ণের এ জবাব শুনেই মেয়েটির মুখের রং কেমন পাল্টে গেল মুহুর্তে। যেন সে এই মুহুর্তে জীবনের সবচেয়ে খারাপ সংবাদটি শুনতে পেল। হয়তো এই সংবাদটি তার জীবন থেকে সুখ টেনে হিঁচড়ে বের করে নিচ্ছে। এমন কেন মনে হচ্ছে?
চলবে
#পূর্ণশশী (রিপোষ্ট)
ফারহানা আক্তার রুপকথা
( বছর দুই আগের লেখা। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)