#পূর্ণশশী
পর্ব-২
ফারহানা আক্তার রুপকথা
_____________________
নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ কোথাও কোন শব্দ নেই। নেই কোন আলোর রেশ। আমি খাটের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে আছি। বিছানার পাশেই বড় একটি জানালা। পর্দা গুলো সরানো তাই বাইরে থেকে অর্ধচাঁদের হালকা রশ্নি বিছানা ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঘরময় অন্ধকার শুধু চাঁদের এই একটুখানি আলো বিছানায়। আলো আঁধারির এই স্নিগ্ধ সময়ে আমি একা। পূর্ণ তখন ওই মেয়েটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমায় নিজের ঘরে রেখে গেছে। তারপর সারা বিকেল আমি চুপচাপ এখানে বসেই কাটিয়েছি। বিকেলে পূর্ণ এলো দু’টো রেডিমেড সুতি সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে । আমি বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছি তাই পূর্ণ এই জামা দু’টো এনেছে। আচ্ছা এই ছেলে কি জানে না একটা মেয়ের শুধু এই তিন কাপড়ে হয় না। ধ্যাৎ, আমিও কি ভাবছিলাম আর তখনি পূর্ণ হাতে একটা বড় ট্রে নিয়ে এলো। দেখেই বুঝতে পারলাম ট্রেতে খাবার নিয়ে এসেছে৷ খাবার গুলো আমার জন্যই এনেছে। সে খেয়ে তারপর নিজেই গুছিয়ে এনেছে। পূর্ণ যাবার পর তার মা মানে সৎ মা এসেছিলো আমাকে খাবার খেতে ডাকতে। আমিই খাবো না বলেছিলাম আর তাই পূর্ণ আসতেই জানিয়ে দিয়েছে৷ আমার সামনে খাবার গুলো রাখতেই খিদেটা যেন যুদ্ধ শুরু করে দিলো৷ পূর্ণ একবার শুধু বলল, “এখানে খাবার আছে খেয়ে নিন।”
আমিও চুপচাপ উঠেই খাওয়া শুরু করলাম। এরপর আর কোন কথা হয়নি আমাদের । আমি খেয়ে একটা ঘুম দিয়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন বুঝতে পারলাম ঘরে কেউ নেই আমি একা। মানে পূর্ণ নেই বাকিরা হবে হয়তো নিজের ঘরে তখনি মনে পড়লো আবার সেই মেয়েটির কথা। কত মায়াময়ী লাগছিলো মেয়েটার মুখ৷ সত্যি বলতে খুবই মিষ্টি মেয়েটা। হঠাৎই মনে হলো মেয়েটা অংশের বউ আমি কেন তাকে মিষ্টি ভাববো! আমি তো ঘৃণা করি অংশকে তবে তার বউকে মিষ্টি কেন বলবো? আর সেই সময় থেকেই মনটা খারাপ করে বসে আছি খাটে হেলান দিয়ে৷ মনে পড়ছে বাড়ির কথা বাবা মায়ের কথা। তাদেরও কি মনে পড়ছে আমার কথা নাকি সত্যিই বাবা খুশি হয়েছেন ঘাড় থেকে নেমেছি বলে। আর অংশ! সে কি জানে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা। মনের তুফান কিছুতেই আজ থামবে বলে মনে হচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে যাবো বলে পা বাড়াতেই দরজায় ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। অন্ধকার ঘরে লাইটের সুইচ কোথায় সেটাও ঠাওর করতে পারছি না। ওয়ালে হাত লাগিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম তখনই লাইট জ্বলে উঠলো। উহুম, জ্বলে উঠেনি জ্বালিয়েছে পূর্ণ৷ তার সাথেই ধাক্কা খেয়েছিলাম।
-কোথাও যাচ্ছিলেন? পূর্ণের প্রশ্ন।
-জ্বি, ওয়াশরুমে..
-“আচ্ছা যান।”
বলেই সে রুমের ভেতরেই কিছু খুঁজতে লাগলো । আমিও বের হয়ে গেলাম৷ ওয়াশরুমে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে মুখে,চোখে পানি দিয়ে বের হতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়ানো অংশ। শরীরের রক্ত যেন বিজলির মত জ্বলে উঠলো আমার। রক্ত প্রবাহ একবার থেমে আবার যেন দ্রত গতিতে হতে লাগলো। এই ঘৃণ্য, জঘন্য ব্যক্তিকে কষ্ট দিতেই তো এসেছি এই বাড়িতে তবে কেন তাকে দেখতেই আমার পৃথিবী থমকে গেল? চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কিছু না বলে সরে আসছিলাম কিন্তু তার আগেই অংশ আমার হাত ধরে নিলো।
“শশী, তুমি এখানে কেন?”
অংশের প্রশ্ন শুনে আমি কোন জবাব দিলাম না। হাত পা কাঁপছে আমার যেন, এই মুহুর্তে আমি মৃগী রোগী হয়ে গেছি। অংশ আবারও প্রশ্ন করলো কিন্তু এবার জবাব সে পেল তবে আমি দেই নি। জবাবটা দিলো তার সৎ মা রানু।
“পূর্ণ বিয়ে করে নিয়ে এসেছে শশীকে।”
আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম আন্টির দিকে। তাকালো অংশও তবে তার চেহারা দেখে মনে হলো সে বিরক্ত জবাব শুনে৷
“হাত ছেড়ে দাও অংশ। পূর্ণ ঘরেই আছে” বলে আন্টি আমাদের একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে অংশের বউ এসে দাঁড়িয়েছে । মেয়েটির নাম জানি না আমি।
“ফাইজলামি করেন আপনি আমার সাথে? আমার বাপের বউ হওয়ার খুশিতে ভুলে গেছেন কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়?”
মুখ বাঁকিয়ে বলল অংশ। আমি তাজ্জব বনে গেলাম এ কোন অংশকে আমি দেখছি এই লোক কখনও বয়সে বড় কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। অথচ আজ এসব কি বলছে! অবশ্য এই অংশকে আমার না চিনলেও চলবে৷ এই অংশ ধোঁকাবাজ, ঠকবাজ একজন মানুষ।
“অংশ মুখ সামলে কথা বলো আর ছেড়ে দাও শশীকে।”
“আরেহ চুপ করুন তো। আর তুমি এখানে কেন এত রাতে?”
অংশ আমার হাত মুঠোয় চেপেই বলল। আমি শুধু বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে৷ তার চোখ মুখ কেমন যেন লাল মনে হচ্ছে৷ চোখের লালাভ অংশ তো মনে হচ্ছে রক্ত ঢেলে দিয়েছো কেউ চোখের ভেতর৷ তার কথা বলার ধরনও ঠিকঠাক লাগছে না। জড়িয়ে আসছে কথা সব।
“হাত ছা ছাড়ুন ভাইয়ার বউয়ের” কাঁপা কাঁপা গলায় পেছন থেকে বলল অংশের বউ। পাশাপাশি আমি নিজেও হাত মুচড়ে বারবার বলছি হাত ছাড়তে কিন্তু কিছুতেই সক্ষম হতে পারলাম না। আর বাইরের চেঁচামেচি শুনে পূর্ণও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম পূর্ণের বাবা এলেন না এখনও। তিনি কি শুনছেন না এসব হৈচৈ?
“ভাইয়া শশীর হাত ছাড়ো” বলেই পূর্ণ অংশ আর আমার একদম মুখোমুখি দাঁড়ালো । অংশের চোখে চোখ রাখতেই সে বুঝে গেল কিছু একটা যা আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না এতক্ষণ । নেশাদ্রব্য নিয়েছে অংশ আর তা পূর্ণ তার দিকে তাকাতেই বুঝে নিয়েছে। আচমকা ঝড়ের বেগে অংশের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দিলো আমায়। ঘটনাটা আকষ্মিক হওয়ায় কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না তবে ভেতর থেকে আমি এতটুকু বুঝেছি অংশ পূর্ণকে মারতে যাচ্ছে আর তার সৎ মা আর অংশের বউ তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে । তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে চেঁচিয়ে তা ঠিক স্পষ্ট নয় আমার কাছে। মিনিট দশেক পর পূর্ণ ঘরে এলো। আমি তার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বিছানায় বসে রইলাম। কি করলাম আমি আজ? ভালোবাসায় প্রতিশোধ টেনে এনেছি। আর এই প্রতিশোধে বলি হচ্ছে এই ছেলেটা। তার ভালোবাসাকে গেইম বানিয়ে দিয়েছি। বাবার সম্পত্তি পাওয়ার লোভও পেয়ে বসেছে আমায়। বাবা তো বলেছিলো আমি যদি বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করি তবেই সম্পত্তি পাবো আমি। কিন্তু পূর্ণ কি বাবার পছন্দের হলো? আমি পাগল হয়ে গেলাম না’তো! আমার ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কখনও ভাবছি প্রতিশোধের কথা কখনও ভাবছি বাবার সম্পত্তির কথা। আমার এখন আসলে কি ভাবা উচিত সেটাই তো আমি জানি না কথাটা ভেবেই দু’চোখ বুজেছি আর তখনই শুনতে পেলাম, “শশী ঘুমাবেন না এখন খাবার আনছি আমি।”
“অসহ্যকর লোক তুমি একটা” চিৎকার করেই বলে বসা থেকে উঠলাম আমি। তার সামনে এগোতেই আমি চুপ হয়ে গেলাম। রক্ত গড়াচ্ছে পূর্ণের ঠোঁটের কোণে। তার মানে অংশ তাকে মেরেছে তাই এত হৈ চৈ লেগেছিলো বাইরে।ইশ,কেমন ছেলে এটা এত বড় হয়েও মার খায়!
“আমি অসহ্যকর মানুষই। আপনি বসুন আসছি আমি” বলেই চলে গেল হাবা হাশমত। ফিরে এলো ঠিক গুণে গুণে দশ মিনিট পর। আবারও হাতে ট্রে আর তাতে খাবার। আমি আর কিছু না বলে খাবারের ঢাকনা খুলে দেখে নিলাম।। ভাত,সবজি আর ডাল? আমার মাথা গরম হয়ে গেল। এসব কি! আমি নতুন বউ আজকে বিকেলে একটা মাত্র মাছের তরকারি দিয়েছিলো ভাতের সাথে আর ডাল। এখন আবার মাছও নেই কি ফালতু এরা, হুহ। কিন্তু পেটে তো আবারও খিদে যন্ত্রণা দিচ্ছে কি করি!
“খাবার পছন্দ না হলে দুঃখিত আজকে ভাবী রান্না করেছে তাই এর চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব হয়নি।”
“অংশের বউ রেধেছে” কথাটা শুনেই কেমন গা গুলিয়ে এলো আমার। অংশের বউ! আমার থাকার জায়গায় এখন অন্য কেউ৷ আবার কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর কোথাও। আজকে দিনটা কাটলো এমন কষ্ট আর রাগ মিশ্রিত অনুভূতিতে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে। এ খাবার গলা দিয়ে নামবে না আমার। পূর্ণদৃষ্টি নিয়ে একবার তাকিয়ে পূর্ণের দিকে তারপর সোজা চলে গেলাম লাইট অফ করতে। পূর্ণ হতভম্ব সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আর আমি লাইট অফ করে ধপ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। হাবাগোবা ছেলেটা হয়তো কিছুক্ষণ ওভাবেই ছিলো তারপর ঘর ছেড়ে চলে গেছে । আমিও কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না৷
সকাল হতেই ঘুম ভাঙলো রানু আন্টির ডাকে৷চোখ কঁচলে আড়মোড়া ভেঙে তাকাতেই ভড়কে গেলাম। আমার সামনে রানু আন্টি,পূর্ণের বাবা, আর একজন বৃদ্ধা মহিলা। বয়সটা পূর্ণের বাবার চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে। কিন্তু এ কেমন কথা আমি ঘুমিয়ে আছি তারা এ ঘরে কেন এসেছে এভাবে৷ হঠাৎ খেয়াল হলো আমার গায়ে ওড়না কোথায়? নিজের দিকে তাকাতেই দেখলাম ওড়না গলায়ই আছে তবে ঠিকঠাক নেই আবার আমার ওপর কম্বলও আছে। এটা কখন নিলাম আমি!
“এ্যাই মাইয়া এত ঘুমাও ক্যা?” কর্কশ গলায় বলে উঠলেন বৃদ্ধা মহিলাটি৷
-জ্বি!
“জ্বি আবার কি! তুমি নাকি আমাগো পূর্ণের বউ? তয় বউ যে হইলা কারে জিগাইয়া হইছো?”
-জ্বি! আমি এবার বেশ আশ্চর্য হলাম।
“এ্যাই মাইয়া জ্বি জ্বি করে ক্যা ইনায়েত তর পোলা কারে বিয়া করছে এইডা?”
মহিলা মুখ বাঁকিয়ে পূর্ণের বাবার উদ্দেশ্যে বলল কথাটা। আমার ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি ঠিক মত। আমি মহিলার কথা শুনে তেমন একটা গায়ে নিচ্ছি না৷ এই মুহুর্তে ঘুম থেকে উঠেছি আমার এখন আরো কিছু সময় দরকার রেস্ট করার৷ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত অনেকটা। কিন্তু রানু আন্টি বোধ হয় খুব ভয়ে আছেন কোন কারণে। তিনি বারবার বলছেন, “আপা শশীকে তো দেখলেন এবার চলেন আমরা ড্রয়িংরুমে যাই। আগে নাস্তা করি পরে না হয় ওর সাথে কথা বলবেন।”
রানু আন্টির কথায় মনে হলো মহিলা পূর্ণের ফুপু হবেন হয়তো। কিন্তু তারা ঘরে প্রবেশ করলো কি করে? আমি কি দরজা না লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলাম? আর পূর্ণ কোথায় কাল না আমাদের বাসর ছিলো!
চলবে
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম)