অপেক্ষারা পর্ব -৩৭+৩৮

#অপেক্ষারা
৩৭+৩৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বিছানার ওপরে বসে ল্যাপটপে গুরুত্বপূর্ণ একটা ইমেইল টাইপ করছে সায়েম। নাজ সুটকেস থেকে কাপড়গুলো বের করে গুছিয়ে রাখছে আর টুক টুক করে গল্প করছে তার সঙ্গে। মেয়েটার কণ্ঠস্বরে একটা রিনরিনে ভাব আছে। যখনই কথা বলে, মনে হয় যেন রিনরিন শব্দ করে বেজে উঠছে কিছু একটা।

“এমন চালাক আপনার বোন! আমি যাতে আপনাকে সন্দেহ না করি, সেজন্যে জোর গলায় বলল পার্সেলটা পাঠিয়েছে প্রত্যয়।”

সায়েম তার চোখদুটো ল্যাপটপের ওপর থেকে সরিয়ে নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রত্যয়?”

“আমাদের স্কুলের একটা হ্যাংলা টাইপ ছেলে। সারাদিন আমার পেছনে পড়ে থাকতো! সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো কনা কীভাবে আমার সাথে এত বড় একটা নাটক করতে পারলো? অন্য সবাই না হয় করেছে, তাই বলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডও। এর থেকে তো তুষিই ভালো!”

“তুষিটা আবার কে?”

“আমার কলেজের বান্ধবী। আপনার বোন যেখানে দিনের পর দিন আমার সঙ্গে অভিনয় চালিয়ে গেছে, তুষি সেখানে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে আপনার গার্লফ্রেন্ডকে পর্যন্ত খুঁজে বের করেছে।”

সায়েম আঁতকে উঠে বলল, “কী? আমার গার্লফ্রেন্ড মানে?”

“আপনার অফিসের কলিগ, সব পোস্টে আবার কমেন্টও করে। কী যেন নাম! অদিতি! তুষি মনে করেছিল ওই মেয়েটাই আপনার গার্লফ্রেন্ড।”

“এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! এই তুষিই কি সে যার সঙ্গে তুমি লাইব্রেরিতে তেলাপোকা ছেড়ে সাসপেন্ড হয়েছিলে।”

“হুঁ।”

সায়েম থমথমে গলায়, “নাজ! তোমাকে না কতবার বলেছি এসব বাজে সঙ্গ ত্যাগ করতে?”

“আপনি কিন্তু কথা ঘোরাচ্ছেন? সত্যিই কি ওই মেয়েটার সঙ্গে আপনার প্রেম ছিল?”

“ফেসবুকে কমেন্ট করলেই প্রেম হয়ে যায় না? সেই হিসাবে তো ওই প্রত্যয় না ফ্রত্যয়ও তো তোমার বয়ফ্রেন্ড।”

নাজ চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “মোটেই না! আমি জীবনে একটা তো দূরের কথা, আধাটা প্রেমও করিনি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে এলাকার যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।”

হুট করে ঘরে এল কনা। উৎফুল্ল গলায় বলল, “ভাবি সাহেবা, আপনার কপাল পুড়েছে।”

“মানে?”

“রাজ্যের সব আত্মীয়-স্বজন একটু পর খেতে বসবে। মা বলেছে তোকেই না সবাইকে পরিবেশন করতে হবে।”

নাজ স্বাভাবিক গলায় বলল, “তো করবো! সমস্যা কোথায়?”

কনা আক্ষেপের স্বরে বলল, “এই নাজ? তোর হঠাৎ কী হলো বল তো? আমাদের ফেল্টুস দল থেকে বেরিয়ে হয়ে গেলি জিপিএ ফাইভ। আবার আমাদেরই কামচোর দল থেকে বেরিয়ে হয়ে গেলি লক্ষ্মী মেয়ে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“বুঝতে হবেও না।”

নাজ এবার সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন, আপনি খাবেন না?”

সায়েম কিছু বলে ওঠার আগেই কনা বলল, “ভাইয়া আবার এতগুলো মানুষের সঙ্গে খেতে বসবে? এ যেন দশম আশ্চর্য!”

সায়েম ভ্রুযুগল সামান্য কুঁচকে বলল, “হয়েছে আর পাকামো করতে হবে না, নিজের কাজে যা!”

“একজন বলে বুঝতে হবে না, আরেকজন বলে পাকামো করতে হবে না! আমি কি দুনিয়ায় হওয়া খেতে এসেছি?”

পুরো বাড়িটা জুড়ে অতিথিরা গিজগিজ করছে। এখানে ওখানে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। এত অতিথির খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ঘরের ভেতরে করা সম্ভব হয়নি। তাই ডেকোরেটরের কাছ থেকে প্রকান্ড এক টেবিল ভাড়া করে আনা হয়েছে। সেই টেবিল উঠানে রেখে সেখানেই সকল ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রাতের আয়োজন না-কি এর থেকেও ব্যাপক। বাবুর্চি দল এসে রান্নাবান্না করবে। অতিথির সংখ্যাও না-কি হবে দ্বিগুণ।পাড়া-প্রতিবেশী, নাজের আত্মীয়-স্বজন সকলকে নিমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে সেই আয়োজনে।

নাজ বেশ আগ্রহ নিয়েই সকলে খাবার পরিবেশ করছে। অতিরিক্ত আহ্লাদে সকলের প্লেটে তরকারি তুলে দিচ্ছে, একটু পর পর আঁতকে উঠে বলছে, “একি! আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না। আরেকটা মাছ তো খেতেই হবে।” নিজেকে আজ সত্যিকার অর্থেই বাড়ির বৌ বলে মনে হচ্ছে।

সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষে প্লেটগুলো রান্নাঘরে নিয়ে রাখছে কনা আর মালা। মেয়ে দুটো কাল থেকে এই আয়োজন উপলক্ষে ছোটাছুটি করছে। নিজেরা এইচএসসি পরীক্ষায় তেমন সাফল্যের মুখ না দেখলেও আক্ষেপ নেই। প্রাণের বান্ধবীর সাফল্যই যেন তার অপূর্ণতাকে পূরণ করে দিয়েছে।

নাজ তাদের সাহায্য করতে এলে মালা ঠাট্টার ছলে বলল, “আরে জিপিএ ফাইভ আপা! আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন কেন?”

নাজও হাসতে হাসতে বলল, “ভাবলাম বেচারীদের ওপর একটু দয়া করি।”

“দয়া কর আর যাই কর, তোর ওপরে কিন্তু আমি প্রচন্ড রেগে আছি। সবে আজ এসেছিস বলে কিছু বলছি না।”

“আমি আবার কী করলাম?”

“শিউলির বিয়েতে এলি না কেন? তোকে ছাড়া তো আমরা ঠিকমত মজাই করতে পারিনি।”

নাজ ফিকে গলায় বলল, “ওই সময়ে আমি আনন্দ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না রে। তোকে বোঝাতে পারবো না আমার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছিল। আমার জায়গায় তুই থাকলে হয়তো বুঝতি।”

মালা বিরক্ত গলায় বলল, “আচ্ছা, বিয়ের পর কী সব মেয়েরাই এমন কঠিন কঠিন কথা বলে। তুই একদিকে কঠিন কথা বলছিস, শিউলিকে ফোন দিলেও ঠিক এভাবেই কথা বলে। বিবাহিত মহিলাদের কথার মাথামুন্ডু আমি কিছুই বুঝি না।”

“শিউলি কেমন আছে রে? পরীক্ষা কেমন দিয়েছে?”

“পরীক্ষা দেয়ইনি।”

নাজ অবাক গলায় বলল, “মানে?”

“ওর শাশুড়ির অবস্থা বেশ খারাপ, যায় যায় অবস্থা। তাই ঠিক করেছে এ বছর পরীক্ষা না দিয়েছে শাশুড়ির সেবাযত্ন করবে।”

“নিজের ইচ্ছাতেই ঠিক করেছে?”

“তাই তো মনে হলো!”

সন্ধ্যার পর পর কনা আর মালা মিলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো নাজকে। বেশি একটা সাজগোজ নাজ এমনিতেই পছন্দ করে না। চোখে গাঢ় করে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। ব্যস, এতটুকুই তার সাজ। সামান্য সাজেই যে একটা মেয়েকে এত সুন্দর লাগতে পারে, কে জানত!

কনা তার চুলগুলো আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “ইস! চুলগুলো কেটে কী অবস্থা করেছিস? অমন সুন্দর চুল কেউ এভাবে কাটে?”

মালা বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, “নাজকে সম্ভবত ভূতে ধরেছিল বুঝলি! ভূতটাই কারণেই এসব উদ্ভট কান্ড বাঁধিয়েছে।”

“আমার তো মনে হয় সেই ভূতটাই জিপিএ ফাইভ পাইয়ে দিয়েছে।”

দুজনে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল। চুপ করে রইল নাজ। আসলেই তো! কষ্ট নামের ভূত একবার কারো ওপরে চেপে বসলে, দীর্ঘদিন ভোগায়। ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে সমগ্র অন্তরাত্মাকে। স্বাভাবিক কর্মকান্ডের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সে দিনগুলোর কথা ভেবে শিউরে উঠলো নাজ।

সাজ-গোজ শেষে নিজেদের ঘরে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ি পড়ছে সায়েম। ধবধবে সাদা শার্ট, গাঢ় নীল জিন্স আর পরিপাটি চুলগুলোতে তাকে রাজপুত্রের থেকে কোনো অংশে কম বলে মনে হচ্ছে না। কে জানে হয়তো রাজপুত্ররাও এতটা সুদর্শন হয় না। আয়নার মধ্যে তাকে এক নজর দেখতেই বুকটা ধক করে উঠল নাজের। মনটা মানতেই চায় না ওই মানুষটা আজ তার নিজস্ব। বারবার মনে হয় যেন, এসবই তার কল্পনা।

নাজ উৎফুল্ল গলায় বলল, “দেখুন তো! আমাকে কেমন লাগছে?”

সায়েম এবার ঘুরে তাকালো তার দিকে। নাজের পরনে সায়েমের পাঠানো সেই আকাশি রঙা শাড়ি। শুধু শাড়িটাই নয়, তার হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার মালা সবকিছুই সায়েমের দেওয়া। মনে মনে ঠিক এভাবেই নাজকে সাজিয়েছিল সায়েম। মেয়েটাকে এই রূপে দেখার ভীষণ লোভ ছিল তার। এক পর্যায়ে লোভ সামলে রাখতে না পেরে অজ্ঞাত কেউ সেজে জিনিসগুলো পাঠিয়েও দিল। তাতে অবশ্য লাভের লাভ কিছুই হলো না। নাজ সেই শাড়ি ছুঁয়েই দেখলো না। আজ পড়েছে। সায়েমের দীর্ঘদিনের চাওয়াটা অবশেষে পূর্ণতা পেল।

নাজের দিকে সেই কখন থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়েম। এদিকে মেয়েটা যে লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে তার খেয়ালই নেই। সায়েম ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। নাজের একবার মনে হলো ছুটে পালায়, কিন্তু পারলো না। হিমবাহের মতো এক জায়গায় জমে দাঁড়িয়ে রইল।

সায়েম নাজের ডান গালে হাত রেখে তার নেশালো কণ্ঠে বলল, “তুমি কি সত্যিই এক্সিস্ট করো?”

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “মানে?”

“মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি বাস্তবের কেউ নও, শুধুই আমার কল্পনা। কল্পনা না হলে একটা মানুষ এতটা নিখুঁত কী করে হতে পারে?”

নাজ কী বলবে ভেবে পেল না। সায়েম ঘোরলাগা নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ক্রমেই যেন সেই ডুবে যাচ্ছে নাজ। লজ্জায় চোখমুখ খিঁচে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা।

আচমকাই নাজের সমস্ত অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তুলে সায়েম তার কপালে এঁকে দিল নিজের শীতল ঠোঁটদ্বয়ের আলতো স্পর্শ। বিদ্যুতের গতিতে শিহরণ জেঁকে ধরলো নাজকে। এটা কী হয়ে গেল? ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটোলো যে নাজ কিছুই বুঝতে পারলো না। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

সায়েম এবার পরম আবেগে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নাজকে। লজ্জায় গুটিশুটি মেরে তার বুকে পড়ে আছে নাজ। এই মানুষটার মাঝে এত মমতা, এত ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল?

সায়েমের হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়েই যাচ্ছে। এমন মধুর তালে একেকবার স্পন্দিত হচ্ছে তার হৃদয়, নাজের ইচ্ছে হয় যেন আজীবন কান পেতে শুনুক সেই ধ্বনি। সেই স্পন্দন আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে নাজ আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কয়েক মিনিট এভাবেই কেটে গেল। নিঃশব্দে, ভালোবাসায়।

সায়েম হুট করে ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “চলো! এভাবে জড়াজড়ি করে ঘরে বসে থাকি।”

নাজ লজ্জায় কাবু হয়ে বলল, “আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল না-কি? মানুষ কী ভাববে?”

“যা ভাবার ভাবুক। তুমি মাকে গিয়ে বলে এসো আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। আমি সকলের সামনে যেতে পারবো না, তাই তুমিও যাবে না।”

“বললেই হলো? আমি তো যাবোই, সঙ্গে আপনাকেও যেতে হবে।”

নাজের কথার মধ্যে বিচিত্র এক অধিকারবোধ খুঁজে পেল সায়েম। ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে এই অধিকারবোধ হয়তো আপনাতেই চলে আসে।

নাজ গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “এবার ছাড়ুন তো, এসবের জন্যে পরে সময় পাওয়া যাবে।”

সায়েম অন্যরকম কণ্ঠে বলল, “সত্যিই পাওয়া যাবে?”

নাজ বোধহয় এবার সত্যিই মরে যাবে লজ্জায়। মানুষটার বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছুটে পালালো ঘর থেকে।

পার্টিতে নাজের জন্যে বেশ কয়েকটা চমক অপেক্ষা করছিল। প্রথম চমক আট কেজি ওজনের প্রকান্ড এক তিনতলা কেক। কেকের ওপরে একটি মেয়ের পুতুল, পুতুলটাও সম্ভবত কেকের তৈরি। কেকের গায়ে লেখা, “কনগ্রাচুলেশনস অন প্রুভিং ইউর্সেলফ নাজ।”

কনা ফিসফিস করে বলল, “বলতো কেকের ডিজাইনটা কার?”

“তোর যে না সেটা বুঝতেই পারছি। তুই ডিজাইন করলে কেকের দিকে ফিরে তাকানো যেত না।”

কনা থমথমে গলায় বলল, “যে করেছে তার আর আমার শরীরে কিন্তু একই রক্ত বইছে।”

“মানে?”

“এখনো বুঝতে পারলি না গাধা? ভাইয়া করেছে!”

নাজের বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “উনি? উনি এসব কখন করলো?”

“দুদিন আগে ভাইয়া কেকের ডিজাইন আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই অনুযায়ীই বেকারি থেকে বানিয়েছি। সুন্দর হয়েছে না?”

মানুষ যাকে ভালোবেসে, তার সকল আশেপাশের সকল কিছুকেই বাসে। সায়েম ডিজাইন করেছে জানার পর থেকে এই কেকের প্রতি আগ্রহ আর আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে গেল নাজের।

বাড়ি ভর্তি মানুষ যেখানে আনন্দে মেতে আছে, সায়েম সেখানে ঘরের এক কোণে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোবাইলের দিকে। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না বলে ছোটবেলা থেকে কতবার যে তাকে ‘বেয়াদব’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে তার হিসাব নেই। মানুষের কথায় কী আসে যায়? শত চেষ্টায়ও তাদের বোঝানো যাবে না সোশ্যাল এনজাইটি কোনো বেয়াদবি নয়।

একটা রাজহাঁসকে পানির ওপর চলতে দেখলে মনে হয় সুস্থির গতিতে এগিয়ে যাওয়া শান্ত এক প্রাণী। তবে পানির নিচ থেকে কেউ নজর করে দেখে না একের পর এক অনবরত পদক্ষেপ ফেলার কারণেই তার এই এগিয়ে চলা। সায়েমের ব্যাপারটাও এমনই। ছেলেটাকে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় অনুভূতিহীন, গম্ভীর এক মূর্তি। প্রকৃত সায়েমকে যারা চেনে তারাই কেবল বুঝতে পারে সে নিজেকে যত না প্রকাশ করে তার থেকে ঢের বেশি আড়াল করে রাখে। যার তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করে লাভ কী? নিজেকে শুধুমাত্র প্রকাশ করে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে।

নাজের জন্যে দ্বিতীয় চমক হলো ছোটখাটো এক কনসার্ট। বসার ঘরে যে স্টেজ করা হয়েছে সেখানে গান গাইতে শুরু করলো এক শিল্পী। সবগুলো গানই নাজের পছন্দের। এই শিল্পীর গান সে আগে শুনেছে ইউটিউবে। তাকে যে এভাবে নাজের ভালো রেজাল্ট করার পার্টিতে আনা হবে কল্পনাও করতে পারেনি।

ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে কথা বলছে নাজ। বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সকল অতিথিরা। বসার ঘর থেকে এগিয়ে ডাইনিংয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ কানে এলো দুই মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলার কথোপকথন। নাজ পেছনে থাকায় এক মুহূর্তের জন্যেও তার উপস্থিতি টের পেল না তারা।

প্রথম জন সতর্ক গলায় বললেন, “যে মেয়ে মেট্রিকে জিপিএ তিন পায়, সে আবার ইন্টারে গোল্ডেন পায় কী করে?”

দ্বিতীয়জন বললেন, “শুধু কি গোল্ডেন? নিজের কলেজেও না-কি ফার্স্ট হয়েছে!”

“হুঁহ! কলেজে ফার্স্ট হলে কী হবে? আমাদের সায়েম এসএসসিতে পুরো বোর্ডে হয়েছিল চতুর্থ, এইচএসসিতে সপ্তম। সেখানে তো এই এই মেয়ে কিছুই না।”

আনমনেই হেসে উঠল নাজ। তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো মন খারাপ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিতো। নাজ বলেই হাসছে। কারণ সে ভালো করেই জানে মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি কেউ ওপরে উঠলেই তাকে টেনে-হিচড়ে কী করে নিচে নামবে! শত টানাটানি করলেও চাঁদকে কি আর মাটিতে এনে ফেলা যায়? চাঁদ তো থাকবে তো তার নির্দিষ্ট জায়গাতেই।

সায়েম সেই কখন থেকে কোণার দিকের সোফাটায় বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। নাজ নিঃসংকোচে গিয়ে বসলো তার পাশে। যে মানুষটাকে এত ভালোবাসে, তার পাশে বসতে আবার সংকোচ কীসের। আশেপাশের মানুষগুলোর যা ভাবার ভাবুক।

নাজ মিষ্টি গলায় বলল, “একা একা বসে আছেন কেন? সকলের সঙ্গে কথা-টথা বললেও তো পারেন।”

সায়েম ক্লান্ত গলায় বলল, “ইম্পসিবল! এসব মানুষের সঙ্গে কথা বললে আমার গা ঘিনঘিন করবে।”

“কথা বলতে সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা আছে। একটু আগে আমার চাচা এসে কী জিজ্ঞেস করলো জানো?”

“কী?”

“তুই কত স্যালারি পাস রে? মানুষের মধ্যে নূন্যতম কমন সেন্স নেই যে এমন পার্সোনাল প্রশ্ন কাউকে করা যায় না।”

নাজ খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আপনার মতো স্যালারি আমি পেলে পুরো এলাকায় মাইকিং করে জানতাম।”

নাজের এই হাসিটা যেন সম্পূর্ন এক ঘোরের জগতে নিয়ে গেল সায়েমকে। এই হাসিটাই পৃথিবীতে তার সবথেকে প্রিয় দৃশ্য। কতদিন যে তাকে এভাবে হাসতে দেখেনি!

সায়েম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অসহায় গলায় বলল, “আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে নাজ?”

মানুষটার এই কথায় হঠাৎ ভড়কে গিয়ে নাজ বলল, “হ্যাঁ?”

“আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে হয়তো দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবো। এক্ষনি পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে, যাবে আমার সঙ্গে?”

এগুলো মানুষ আজ জড়ো হয়েছে নাজের জন্যে। এদের রেখে পালিয়ে যাওয়াটা নিতান্তই অভদ্রতা। তবে সেই অভদ্রতাটা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করলো না। সায়েমের এই আবেদনকে না করে কী করে?

সকলের অগোচরে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল দুই মানব-মানবী। রাত বেশি একটা হয়নি, মোটে সাড়ে আটটা। তবুও রাস্তায় লোক নেই। থাকবে কী করে? এলকাসুদ্ধ মানুষ যেন আজ সায়েমদের বাড়িতে। হাতে হাত রেখে রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে নাজ আর সায়েম।

নাজের একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, “আমরা যাচ্ছি কোথায়?”। জিজ্ঞেস করতে গিয়েই করলো না। কী হবে গন্তব্য জেনে? মানুষটার পাশে হাঁটতে পারছে এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কী বা হতে পারে?

হাঁটতে হাঁটতেই তারা চলে এল নাজদের বাড়ির সামনে। সায়েম তাদের বাড়ির গেটে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

“একি? এখানে যাচ্ছি কেন?”

“গেলেই দেখতে পারে।”

নাজের হাত ধরে টেনে তাকে বাড়ির পেছনে পুকুরের দিকটায় নিয়ে এলো সায়েম। নাজের বিস্ময়ের সকল সীমা যেন ছাড়িয়ে গেল। রং-বেরংয়ের মোমবাতি আর বেলুন দিয়ে সাজানো জায়গাটা। সঙ্গে আরও একটা জিনিস আছে, শত শত নীল অপরাজিতা। কে বলেছে মানুষ কেবল গোলাপ দিয়েই ভালোবাসার প্রকাশ করতে পারে?

একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল তাদের নৌকাটা অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো। সম্ভবত নতুন করে রং করা হয়েছে। নৌকারও ওপরেও নীল অপরাজিতার ছড়াছড়ি। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে চারপাশ থেকে। অপরাজিতা ফুলে তো গন্ধ নেই, তবে এই মিষ্টি সুঘ্রাণ কীসের?

নাজ মুগ্ধ গলায় বলল, “কখন করলেন এতকিছু?”

সায়েম শান্ত গলায় বলল, “দিনের বেলায়। পছন্দ হয়েছে?”

“হয়েছে! ভীষন পছন্দ হয়েছে।”

“চলো নৌকার ওপরে গিয়ে বসি। তোমার না চাঁদটার ঠিক নিচে নৌকার ওপরে বসে জোছনাবিলাস করতে ভালো লাগে!”

“মনে আছে এখনো?”

সায়েম তার হাতটা ধরে সাবধানে নিয়ে বসলো নৌকার ওপরে। অদ্ভুত এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মাথার ঠিক ওপরে পূর্ণিমার চাঁদ, পুকুরের স্বচ্ছ জলে তার প্রতিচ্ছবি আর পাশে প্রিয় মানুষটা। এমন খুব কম মুহূর্তই আসে, যখন বেঁচে থাকাকে সার্থক বলে মনে হয়।

“নাজ? তোমার হাতটা দাও তো!”

“কেন?”

“দাও না! এত প্রশ্ন করো কেন?”

নাজ ইতস্তত করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো সায়েমের দিকে। সায়েম আলতো স্পর্শে হাতটা ধরে অনামিকা আঙুলে কী যেন পরিয়ে দিলো। নাজ ভালো করে লক্ষ করে বুঝতে পারলো, হীরের আংটি। অন্যান্য আংটির মতো মধ্যিখানে বড় একটা পাথর নেই, বরং গোটা আংটি জুড়েই ছোট ছোট পাথর।মানুষটার রুচি আছে বলতে হবে!

নাজ প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বলল, “এটা কী? ভালো রেজাল্টের গিফট?”

“উহুঁ।”

“তাহলে?”

সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “অ্যাপোলজি গিফট। ভালো রেজাল্ট করাতে গিয়ে তোমাকে একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।”

নাজ কৃত্রিম অভিমান নিয়ে বলল, “একটু?”

“অনেক! অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি তাই না?”

নাজ চাপা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। ওই একটা দীর্ঘশ্বাসেই সায়েম পেয়ে গেছে তার কাঙ্খিত উত্তর।

সায়েম অসহায় কণ্ঠে বলল, “আমি জানি কষ্টগুলো তোমার মনে পার্মানেন্ট ড্যামেজ করে তুলেছে নাজ। তবুও আমাকে প্লিজ একটা সুযোগ দাও চিরস্থায়ী ওই ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলার। আই প্রমিজ এই জীবনে আর কোনোদিন কষ্ট পেতে দেবো না তোমায়।”

এক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পুকুরের পানিতে ভেসে ওঠা চাঁদটার দিকে। তার চোখভর্তি জল, প্রাণপণ চেষ্টা করছে তা মানুষটার থেকে আড়াল করে রাখতে।

“তুমি কি আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে নাজ?”

“না পারার সাধ্য বুঝি আমার আছে!”

সায়েম সাবধানে নাজের গালে বুড়ো আঙুল স্পর্শ করে মুছিয়ে দিলো চোখ জল। জীবনের সেরা এই মুহূর্তটাকে কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাইছে না নাজ।

তাই গলার স্বর প্রাণপণ স্বাভাবিক রেখে বলল, “তাই বলে ভাববেন না আপনি বেঁচে যাচ্ছেন। কঠিন একটা শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে!”

সায়েম হেসে বলল, “বলুন কী শাস্তি ম্যাডাম?”

“এখন থেকে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনি আমার সামনে আধ ঘন্টা অনবরত কথা বলবেন।”

“কথা বলবো? কী কথা?”

“সেটা আপনার ব্যাপার। কথা হলেই হলো!”

“এটা আবার কেমন শাস্তি?”

“অতসব বলতে পারবো না। শাস্তি পেয়েছেন যখন, বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করুন।”

“তা না হয় করলাম, কিন্তু শাস্তিটা এক্সপ্লেন তো করতে হবে।”

নাজ একরাশ লজ্জা নিয়ে বলল, “আপনার কথা বলার ধরন আমার ভীষণ ভালো লাগে। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন আপনি! মনে হয়, যেন কোন শব্দের পর কোন শব্দটা বলবেন তা আগে থেকেই ঠিক করা। মনে আছে একদিন বারান্দায় বসে আপনার ছোটবেলায় প্রথম সিগারেট খাওয়ার গল্পটা বলেছিলেন? সেদিন তো ইচ্ছা করছিল ভয়েস রেকর্ডারে রেকর্ড করে রাখি আপনার…”

কথাটা আর শেষ করার সুযোগ পেল না নাজ। তার আগেই ঘটে গেল সর্বনাশ! সায়েম তার ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো নাজের ঠোঁটে। মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর এক শিহরণ খেলে গেল তার সমস্ত শরীরে। যেন সায়েম নামের প্রবল এক স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচানোর ছিটেফোঁটা ইচ্ছে নেই নাজের মাঝে, ক্রমশ ভেসে যাচ্ছে স্রোতে বয়ে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here