#অপেক্ষারা
৬০+৬১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
শরীরে কোনো অসুখ এসে বাসা বাঁধলেই আমরা তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই ডাক্তারের কাছে। ওষুধপত্র খেয়ে সুস্থ হওয়ার তাগিদে। কিন্তু মনের অসুখ? এই অসুখটার ধরন বড্ড জটিল। শরীরের অসুখ হলে মানুষ নিজেই তা উপলব্ধি করতে পারে এবং সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। তবে মনের অসুখ হলে মানুষ তা নিজেই বুঝতে পারে না, মুক্তি পাবার চেষ্টাও করে না। প্রশয় পেয়ে অসুখটা ফুলে ফেঁপে বেড়ে ওঠে।
কিন্তু আশপাশের মানুষগুলো তো ঠিকই বোঝে মনের অসুখের গভীরতা। তারা কি পারে না, দুয়েকটা স্নেহের কথা বলে মানুষটাকে সুস্থ করে তুলতে? স্নেহের কথা বলতে না পারলে অন্তত এমন কিছু বলা উচিত নয় যাতে মানুষটার অসুখ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। নাজের প্রিয় মানুষগুলোই শেষমেশ তার মনের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল সায়েম।
মানসিক স্বাস্থ্যকে আমরা বড্ড অবহেলা করি। হতাশাগ্রস্ত বিষন্ন একটা মানুষ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমদের ধারণারও বাইরে। বাকিদের জন্যে সে ভয়াবহ নয়, ভয়াবহ নিজের জন্যে। হতাশাগ্রস্ত মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবে না, নিজের ক্ষতি করতেও কোনপ্রকার দ্বিধা বোধ করে না। আচ্ছা, নাজও যদি হতাশার বশে নিজের কোনো ক্ষতি করে বসে? বাকিটা আর ভাবতে পারলো না সায়েম। দুশ্চিন্তায় তার ব্রহ্মতালু অবদি ঝনঝন করছে।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ওয়ালপেপারে ভেসে ওঠা নাজের ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েম। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। প্রচ্ছন্ন-প্রাণবন্ত এই হাসিটা যেন মেয়েটা তার দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছে। সায়েমের ইচ্ছা হলো অভিমানী স্বরে তাকে বলতে, “নাজ শোনো, তুমি আর কোনদিনও আমাকে চিঠি লিখবে না। যতবারই চিঠি লেখ, একরাশ দূরত্ব এসে বাসা বাঁধে আমাদের মাঝে।”
আশফাক এসে কোমল স্বরে বলল, “কী রে? যাবি না?”
সায়েম কণ্ঠে একরাশ ব্যর্থতা নিয়ে বলল, “কোথায় যাবো?”
আশফাক সায়েমের পাশে বসতে বসতে বলল, “তুই ভেঙে পড়ছিস কেন? তুই ভেঙে পড়লে আমরা ভাবিকে খুঁজে পাবো কী করে?”
সায়েম অসহায় গলায় বলল, “আমার মাথা কাজ করছে না দোস্ত। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। এত বড় একটা শহরে কোথায় খুঁজবো আমি নাজকে? তুই দেখলি না, ও টিকিট কেটেছিল কিন্তু বাসে ওঠেনি। তার মানে সে নিজেই জানে না কোথায় যাবে।”
“শুধু শুধু টেনশন করছিস তুই। দেখিস, আমরা ঠিকই ভাবিকে খুঁজে পাবো। পুলিশ তো আছে আমাদের সঙ্গে।”
পুলিশের কথা মনে পড়তেই সায়েম বলল, “ওসি সাহেব কোথায়?”
“কী একটা কাজে যেন বেরিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, যে হসপিটালে ভাবির অপারেশন হয়েছে সেখানে একবার খোঁজ নিতে।”
মহাসড়কের চিরচেনা যানজটে থেমে আছে আশফাকের বাইক। মাথার ওপরে চনমনে সূর্যটার তেজ কি আজ সত্যি সত্যিই বেশি, না-কি দুশ্চিন্তার কারণে সায়েমের কাছে বেশি বলে মনে হচ্ছে। শতশত মানুষের আনাগোনা এই সড়কে। তবুও সায়েমের চঞ্চল চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। বলা তো যায় না, ভীড়ের মধ্যেও তো লুকিয়ে থাকতে পারে মেয়েটা।
সায়েমকে হতবাক করে দিয়ে তার চোখের সামনে ঘটে গেল এক সাংঘাতিক ঘটনা। রাস্তার ওপরে থেমে আছে কমলা রঙয়ের পুরোনো একটা বাস। কন্ডাক্টর কুৎসিত স্বরে হাক ডেকে যাত্রী ওঠাচ্ছে বাসে। সায়েম পরিষ্কার দেখতে পেল কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিতা, মাথায় ওড়না দ্বারা ঘোমটা দেওয়া একটি মেয়ে তড়িঘড়ি করে বাসে উঠে গেছে। মেয়েটার মুখ দেখা না গেলেও তার পোশাকটা হুবহু নাজের পোশাকের মতো। কোথাও এক ফোঁটাও অমিল নেই।
সায়েম চাপা এক উত্তেজনা নিয়ে বলল, “নাজ! ওই বাসটায় নাজ উঠেছে।”
আশফাক হতবিহ্বল গলায় বলল, “বলিস কী? তুই শিওর?”
উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা বা প্রয়োজন কোনোটাই সায়েমের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার চোখেমুখে কেবল একটাই তাগিদ। নাজের কাছে যাবার। সায়েম বাইক থেকে উঠে রাস্তার ওপারে যাবে ঠিক তখনই দু পারের রাস্তার ট্রাফিক একসঙ্গে ছেড়ে দিলো। কোনো মানে হয়? প্রায় বিশ মিনিট ধরে এ রাস্তায় বিচরণ, আর কয়েকটা সেকেন্ড থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো?
সায়েম বিরক্ত, হতাশ এবং ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে আবারও বাইকে উঠে বসতে বসতে বলল, “আশফাক, তাড়াতাড়ি বাইক ঘোরা। ওই বাসটাকে ফলো করতে হবে?”
“নম্বরটা খেয়াল করেছিস?”
“হ্যাঁ করেছি, তাড়াতাড়ি ঘোরা তো।”
আশফাক ঘুরিয়ে চলে গেল রাস্তার ওপরপ্রান্তে। বাসের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে তার বাইক। এভাবে চলতে থাকলে বাসটাকে ধরে ফেলতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না তাদের। সায়েমের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। মনে মনে ক্রমশ প্রার্থনা করে যাচ্ছে, এবার যেন নাজকে ফিরে পেতে কোনো বিঘ্নের সম্মুখীন না হতে হয়।
এদিকে শহরের আরেক প্রান্তে ছুটে চলছে ধানমন্ডি থানার পুলিশদের নিজস্ব একটি জিপ। ড্রাইভ করছে এসআই শরীফ এবং তার পাশের সিটে সানগ্লাস চোখে জানালা থেকে মুখ বের করে আয়েশী ভঙ্গিতে রোদ উপভোগ করছেন ওসি হানিফ।
শরীফ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “স্যার, আপনি তো মাশাল্লাহ অনেকগুলো মিসিং কেসই হ্যান্ডেল করেছেন। কী মনে হয়, মিসেস নাজনীনকে খুঁজে পাওয়া যাবে?”
ওসি হানিফ চিন্তিত গলায় বললেন, “বুঝতে পারছি না শরীফ। পৃথিবীর জটিলতম কেসগুলোর মধ্যে মিসিং কেস অন্যতম। মাঝে মাঝে তো খুনের কেসের থেকেও বেশি জটিল।”
“সে কী স্যার?”
ওসি সাহেব বিজ্ঞের মতো বলে উঠলেন, “খুনের কেসে অনেকগুলো ক্লু থাকে। একটা ডেড বডি থাকে, খুনের কোনো না কোনো লক্ষণ থাকে। আমাদের কাজ খুনিকে খুঁজে বের করা। কিন্তু মিসিং কেসের বেলায় কোনো ক্লুই থাকে না। যে মানুষটা নিখোঁজ সে চাইলে যেকোনো জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পারে। ঢাকায় আছে, না ঢাকায় বাইরে আছে না-কি আবার দেশের বাইরে আছে আমরা কিছুই জানি না। আন্দাজে ঢিল ছোড়ার মতো খুঁজে বেড়াই মানুষটাকে। তার থেকেও বড় ঝামেলা হলো নিখোঁজ মানুষটা নিজেই তার গন্তব্য জানে না। টিকিট কাটলো কিন্তু বাসে উঠলো না, আমার মনে হয় মেয়েটা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। আপন মানুষদের দেওয়া আঘাতগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”
“টিকিট কেটেও বাসে না ওঠার একটা যুক্তি আমি বের করেছি স্যার।”
“কী যুক্তি?”
শরীফ গুছিয়ে বলল, “মিসেস নাজনীনের ফোনটা পাওয়ায় বেশ সুবিধাই হয়েছে স্যার। ওই নম্বর থেকে শেষ কলটা এসেছে তার মায়ের কাছ থেকে, গত রাতে। মায়ের সঙ্গে মেয়ের কথোপকথন তেমন সুবিধাজনক মনে হলো না। মেয়ে ডিপ্রেসড আর মা তার ডিপ্রেসন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নাজনীন একটা সময়ে রেগেমেগে ফোন কেটে দেন। আজ সকালে বাড়িতে থেকে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে কিছু না ভেবেই তিনি চলে গেলেন বাস স্টেশনে। তাড়াহুড়োর মধ্যেই টিকিট কাটলেন। পরে মনে পড়লো, গ্রামের বাড়ি ফিরে গেলে তো নিজের মাকেও পাশে পাবেন না। তাই বাসে না উঠে বেরিয়ে এলেন।”
“হতে পারে। তোমার পর্যবেক্ষণ ভালো শরীফ।”
শরীফ প্রংশায় বিগলিত হয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”
“আচ্ছা শরীফ, আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?”
“ইডেন কলেজে। নাজনীনের এক ঘনিষ্ট বান্ধবী এখানে পড়ে। গত মাসে তিনি এই বান্ধবীকে এসএমএস করে বলেন আজ মানে তেরোই মার্চ তার ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা করবেন।”
“বলো কী? এই কথা এতক্ষণ বলোনি কেন? তার মানে ওখানে গেলে নাজনীনকে পাওয়া যেতেও পারে।”
“আবার নাও পারে স্যার।”
“কেন?”
“কারণ গত মাসে তার জীবনে কোনো সমস্যাই ছিল না। অথচ আজ এতশত সমস্যার ভীড়ে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার কথা মনে আছে কি-না কিংবা মনে থাকলেও সেই ইচ্ছাটা অবশিষ্ট আছে কি-না সেটাই চিন্তার বিষয়।”
ইডেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তুষি। এই কয়েক বছরে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষণীয় তার মাঝে। আগেকার সেই হ্যাংলামো, লেখাপড়ায় অবহেলা, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো – সেসব কোথায় যে উধাও হয়ে গেছে কে জানে। তুষি এখন নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রীদের একজন সে কারণেই অধ্যক্ষের অফিসে পুলিশ তার খোঁজ করতেই ভড়কে গেলেন তিনি। নিতান্ত সাধারণ একজন ছাত্রীকে হঠাৎ পুলিশ খুঁজতে যাবে কেন?
ওসি সাহেব শান্ত ভঙ্গিতে সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পুঙ্খানপুঙ্খভাবে তুলে ধরলেন তুষির কাছে। তুষিও বিনা বাক্যব্যয়ে শুনলো পুরোটা।
ওসি হানিফ জিজ্ঞেস করলেন, “আজ তো আপনাদের দেখা করার কথা ছিল তাই না?”
তুষি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “জি। নাজ বলেছিল আজ বারোটায় আমাদের ক্যাম্পাসে আসবে। কী একটা বিজনেস আইডিয়া ওর মাথায় এসেছে, সেটা নিয়েই আলাপ করবে।”
“আশ্চর্য ব্যাপার! বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করলে তার বাসায় যাবে, কিংবা একসঙ্গে ফুচকা খেতে যাবে, শপিং মলে ঘুরতে যাবে। বান্ধবীর ক্যাম্পাসে আসার লজিকটা কি?”
“আমাদের এই ক্যাম্পাস নাজের ভীষণ পছন্দের। মাসে দু মাসে একবার এসে এখানে ঘুরে বেড়ায়।”
ওসি সাহেব সন্দিহান গলায় বললেন, “সে মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চমৎকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তার আবার অন্য ক্যাম্পাস পছন্দের হবে কেন?”
সবকিছু বদলে গেলেও তুষির চিরচেনা ঠোঁটকাটা স্বভাবটা এখনো রয়ে গেছে। সেই স্বভাব ধরে রেখেই সে বলল, “কিছু মনে করবেন না স্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চমৎকার ইউনিভার্সিটি হলেও পৃথিবীর সেরা নয়। আমাদের এই ক্যাম্পাস অন্যান্য যেকোনো ক্যাম্পাসের তুলনায় কম কিছু নয়।”
“ঠিক, ঠিক। একদম ঠিক। আচ্ছা আপনাদের বন্ধুত্ব হয় কী করে?”
“আমরা একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। নাজ ঢাকায় এসে প্রথমে আমার কলেজেই ভর্তি হয়।”
“তা এত বছরের বন্ধুত্ব আপনাদের, আপনার কী মনে হয়? আপনার বান্ধবী হুট করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?”
তুষি ইতস্তত করে বলল, “নিতেও পারে। ডিপ্রেশনে চলে গেলে নাজের মাথা ঠিক থাকে না। ঝোঁকের বশে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।”
“তার মানে এর আগেও তাকে ডিপ্রেশনে পড়তে দেখেছেন আপনি?”
“সেটা নাজের পার্সোনাল ব্যাপার। ওর অনুমতি ছাড়া ওই ব্যাপারে কথা বলা ঠিক হবে না।”
ওসি সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “তা তো বটেই। আচ্ছা, আপনার বান্ধবী কোথায় লুকিয়ে আছেন?”
তুষি অবাক গলায় বলল, “আমি কি করে বলবো?”
“এই শহরে আপনার থেকে ভালো বান্ধবী তার দ্বিতীয়টি নেই। তাছাড়াও আজ আপনার সঙ্গেই দেখা হওয়ার কথা ছিল।”
“কিন্তু আমি তো বললাম, নাজ আসেনি এখানে।”
“কে জানে? অন্য কোথায় আছে হয়তো! হয়তো আপনিই যত্ন করে নিজের প্রিয় বান্ধবীকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন।”
তুষি হকচকিয়ে গিয়ে প্রতিবাদের স্বরে বলল, “আমি শুধু শুধু ওকে লুকিয়ে রাখতে যাবো কেন?”
তুষি আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওসি সাহেব নির্দেশের স্বরে বললেন, “শরীফ! উনার কথাবার্তা সন্দেহজনক। আমার ধারণা নাজনীন তার বাড়িতেই লুকিয়ে আছে।”
শরীফ বলল, “তাহলে কী করবো স্যার?”
“বোকার মতো প্রশ্ন করবে না। কী করবো মানে? এক্ষুনি এই মেয়েটার বাসায় যাবো।”
তুষি কিছু একটা বলতে গিয়েই থেমে গেল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার সমানে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুলিশ অফিসারের দিকে। তুষির কথাবার্তায় সন্দেহজনকের কী ছিল কে জানে?
আশফাকের বাইক প্রায় ধরেই ফেলেছে বাসটিকে। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্ব। তবে এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে বাসকে কী করে থামানো যায়। আশফাক কী বাইকের স্পিড বাড়িয়ে বাসের সম্মুখে নিয়ে আড়াআড়িভাবে থামিয়ে দেবে? না-কি উচ্চস্বরে বাসের ড্রাইভারকে থামতে বলবে? মাথায় কিছুই কাজ করছে।
সায়েম আবার অতশত ভাবছে না। তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো স্থির হয়ে আটকে আছে বাসের দিকে। এই তৃষ্ণা তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে অন্তত একনজর দেখার।
বাসের ড্রাইভারের সিটের ঠিক পাশাপাশি এসে
আশফাক উঁচু গলায় বলল, “এই! গাড়ি থামাও।”
ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে পানের পিক ফেলতে ফেলতে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “থামামু মানে? আপনে কেডা?”
আশফাক কড়া গলায় বলল, “ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেব পাঠিয়েছে। থামাও নাহলে গাড়ি সহ হাজতে যেতে হবে।”
চলন্ত বাসটা থেমে গেল মহাসড়কের বুকে। সায়েম তড়িঘড়ি করে উঠে গেল তাতে, তার পিছু পিছু উঠল আশফাকও। দুই আগন্তুকের আকস্মিক আগমনে যাত্রীদের বিস্মিত চোখদুটো তাদের দিকেই আটকে আছে। সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে, তবে দেখতে পাচ্ছে না নাজকে। কোথায় গেল মেয়েটা? কোনো এক ফাঁকে বাস থেকে নেমে যায়নি তো? তা তো হবার কথা নয়। সেই তখন থেকে এই বাস সায়েমের নজরবন্দি।
বিস্মিত মুখগুলোর মাঝে সায়েমের চোখ পড়লো সেই কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিতা নারীর দিকে। চোখ পড়তেই একরাশ হতাশা ছেয়ে গেল তার মাঝে। এটা নাজ নয়! আশাভঙ্গের পর সৃষ্ট হতাশার তীব্রতা ভয়াবহ।
এত বড় একটা ভুল কী করে করলো সায়েম? তার সবথেকে প্রিয় মানুষটাকেই চিনতে ভুল করলো?
অবশ্য বেচারাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে মানুষের চোখে ভ্রান্তিরা খেলে বেড়ায়। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেই ভ্রান্তিকেই সত্য বলে মনে হয়।
ইডেন কলেজ থেকে তুষির বাড়ির দূরত্ব মাত্র কয়েক মিনিটের। দুই বেডরুমের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে কেবল তুষি এবং তার মায়ের বসবাস। বাবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ব্যবসার তাগিদে। দুপুরের এই সময়টায় মেয়ের ভার্সিটি থাকার কথা। তাকে এই সময়ে বাড়িতে দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন শিরিন সুলতানা। তার থেকেও বেশি অবাক হলেন তার সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসারকে দেখে। মধ্যবিত্তদের প্রতিদিনকার জীবনে যেখানে উল্লেখযোগ্য করার মতো তেমন কিছুই ঘটে না, সেখানে পুলিশের আকস্মিক আগমন যেন
উল্লেখযোগ্যেরও বেশি।
শিরিন সুলতানা অসহায় গলায় বললেন, “ওসি সাহেব? আমার মেয়ে কী করেছে?”
ওসি হানিফ হাই তুলতে তুলতে বললেন, “তেমন কিছু না। একজনকে লুকিয়ে রেখেছে, আমরা তাকেই খুঁজতে এসেছি।”
শিরিন সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “এই তুষি! উনারা কী বলেছেন এসব? কাকে লুকিয়ে রেখেছিস তুই?”
তুষি কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ওসি সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন, “আহা! আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার মেয়ে কোনো ক্রিমিনালকে লুকিয়ে রাখেনি। শরীফ! চিঠি লিখে নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া কী কোনো ক্রাইম?”
শরীফ ইতস্তত করে বলল, “এটা তো বলতে পারবো না স্যার।”
“মান-সম্মান কিছুই রাখলে না! দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও খোঁজা শুরু করো।”
বাড়ির ছাদের চিলেকোঠা, বারান্দার সঙ্গে থাকা ছোট্ট ঘর, রান্নাঘরের সঙ্গে থাকা বাথরুম – বলতে গেলে বাড়ির কোনো একটা কোণেও খুঁজতে বাকি রাখলো না শরীফ। এমনকি বাড়ির নিচতলার বাগানেও একদফা খোঁজাখুঁজি হলো। কোথাও নাজের বিন্দুমাত্র চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
ওসি সাহেব মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিলেন, আর কোথাও না হলেও তুষির বাড়িতে ঠিকই পাওয়া যাবে নাজকে। এসব কী হচ্ছে? একটা মানুষ নিশ্চয়ই হুট করে উধাও হয়ে যেতে পারে না। ওসি সাহেবের মাথায় হাজাররকম চিন্তারা আনাগোনা শুরু করেছে। চেনা পরিচিত কোথাও নাজ নেই। আচ্ছা, কোনো বদ লোকের পাল্লায় পড়লো না তো নাজ? তাহলে তো খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আশেপাশের সবগুলো থানায় ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে নাজের ছবি। তাকে দেখা মাত্র জানিয়ে দেওয়া হবে। তবুও ঠিক ভরসা করতে পারছেন না ওসি হানিফ।
এতক্ষণ মনে হচ্ছিল ইচ্ছা করেই কোথাও একটা লুকিয়ে আছে নাজ। তবে হুট করে মনে কু ডাকের আগমন ঘটেছে। যে মানুষটা ইচ্ছা করে লুকিয়ে থাকে তাকে নাহয় হাজার চেষ্টা করে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে যে মানুষটা কোনো বদ লোক দ্বারা লুকিয়ে রাখা হয়, তাকে খুঁজবে কী করে পুলিশ?
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা ভয়ঙ্কর এক অস্থিরতায় কাটলো। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শপিং মল, বান্ধবীদের বাড়ি – প্রত্যেকটা জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালো সায়েম। একেক জায়গায় যাচ্ছে, মনের ভেতর তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে আর কিছুক্ষণ বাদেই নাজকে দেখতে পাবে সে। পারবে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু নাজকে কোথাও পাওয়া গেল না।
তীব্র এক আর্তনাদ বেজে উঠেছে সায়েমের মনে – “কোথায় তুমি নাজ? প্লিজ ফিরে এসো আমার কাছে।” মানুষের মনের কথাগুলো তো আর দূর থেকে কেউ বুঝতে পারে না। পারলে নাজ যেখানেই থাকুক, ছুটে চলে আসতো সায়েমের কাছে।
আচ্ছা, মেয়েটা এত বোকা কেন? নাজ কি একবারের জন্যেও বুঝতে পারলো না, যে সে পাশে থাকলে সায়েমের আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। তার জন্যে পৃথিবী সুদ্ধ সকলের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করবে না সায়েম। নাজ কি করে ভাবতে পারলো, তার উপস্থিতি সায়েমের কষ্টের কারণ। তার অনুপস্থিতিতে ছেলেটা যে মরে যাবে, এটা একবারও মাথায় এলো না তার?
দুপুর পর্যন্ত মনের মাঝে একটা চাপা উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তামিশ্রিত অনুভূতি কাজ করলেও এখন সেসবের কিছুই নেই। মনটা জুড়ে কেবল তীব্র সংশয়ের আনাগোনা। বারবার প্রশ্ন করছে সায়েম নিজেকে, আবার কখনো কি দেখতে পাবে তার ভালোবাসার মানুষটার দু চোখ ভরে? হাজারো স্মৃতিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে। সুখময় স্মৃতি, যেখানে রয়েছে কেবল সায়েম এবং নাজ। নেই কোনো ভয়, নেই কোনো দুশ্চিন্তা, নেই কোনো কিছু হারানোর আক্ষেপ। কী ভয়ঙ্কর সুন্দর মুহূর্ত ছিল সেগুলো। তখন যদি একবারও সায়েম বুঝতে পারতো, আজকের দিনটার মুখোমুখি হতে হবে, তাহলে হয়তো চিরকাল ধরে রাখতো মুহূর্তটাকে।
আচ্ছা, নাজের সঙ্গে তার শেষ কথোপকথনটা যেন কী ছিল? কিছুতেই মনে করতে পারছে সায়েম। পারবে কী করে? তখন কি আর সে জানে, ওটাই তাদের শেষ কথোপকথন?
বিয়ের পর তো অনেকটা দিন নিজেদের মাঝ অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি করে নাজকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সায়েম। তবুও এই শূন্যতার অনুভূতি অনুভব হয়নি তখন। তখন তো চাইলেই দেখা যেত মেয়েটার ত্রি-কাল ভুলানি হাসি, কারণে অকারণে রাগিয়ে দেওয়া যেত। ভালোবাসার প্রকাশস্বরূপ দুয়েকটা ধমকও দেওয়া যেত। অথচ আজ?
সায়েমের বুকের মাঝে এক তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এই ব্যথার তীব্রতা পরিমাপ করার সাধ্য আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের নেই। তবে নিবারণের ক্ষমতা আছে, কেবল একজনেরই। সেই একজনটা না জানি কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সায়েম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল, একবার পেয়ে যাক নাজকে, এ জীবনে আর হারিয়ে যেতে দেবে না। শক্ত করে তার হাতদুটো ধরে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা।
রাত সাড়ে এগারোটা। থানায় ওসি হানিফ সাহেবের মুখোমুখি বসে আছে সায়েম এবং আশফাক। সকলের চোখেমুখেই দুশ্চিন্তা আর হতাশার প্রতিচ্ছবি।
ওসি সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, “সায়েম সাহেব?”
সায়েমের অন্তরাত্মা যেন এ জগতে নেই, বেড়াচ্ছে ভিন্ন এক ঘোরের জগতে। ওসি সাহেবের ডাক তার কর্ণকুহরে পৌঁছালো না। আনমনে ভেবে যাচ্ছে নাজের কথা।
ওসি সাহেব আবারও বললেন, “সায়েম সাহেব? শুনছেন?”
সায়েম সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “জি?”
ওসি সাহেব যথাসম্ভব নরম গলায় বললেন, “সারাটাদিন কম খোঁজাখুঁজি তো করলাম তো। আশেপাশের সব থানায় আপনার স্ত্রীর ছবি পাঠানো হয়েছে, ট্রাফিক পুলিশের কাছেও পাঠানো হয়। সন্দেজনক জায়গাগুলোতে আমি নিজে গিয়ে সার্চ করেছি। আপনারাও তো সারাদিন কম ছোটাছুটি করলেন না। খুঁজে পাওয়ার হলে তো এতক্ষণে পেয়েই যেতাম বলুন। আমি বলি কী, আজকের মতো আমরা রেস্ট নিই। কাল সকাল থেকে নতুন উদ্যমে খোঁজা শুরু করবো। কী বলেন?”
সায়েম চুপ করে রইল। পুলিশও শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। তবে সে তো হাল ছাড়ার মানুষ নয়। কেউ পাশে থাকুক কিংবা না থাকুক, নাজকে না নিয়ে সায়েম বাড়ি ফিরে যাবে না।
(চলবে)