#অপেক্ষারা
৬৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সুখনিবাস ফাউন্ডেশন সমাজকর্মে একুশে পদক পাওয়া একটি এনজিও। ঢাকা শহরজুড়ে এদের ব্যাপক বিস্তৃতি। শহরের আনাচে-কানাচে যেখানেই কোনো শিশু মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে ফেলে, সুখনিবাস তাতে পরম মমতায় আপন করে নেয়। এরপর শিশুটির জন্যে উপযুক্ত হবে এমন দম্পতির কোলেই তাকে তুলে দেওয়া হয়।
ফস্টার হোমের ধারণাটা আমাদের দেশের মানুষের মাঝে এখনো পরিষ্কার নয়। বিদেশে না-কি গলির মোড়ে মোড়ে একটি করে ফস্টার হোমের দেখা মেলে। সন্তানকে তার বাবা-মা ছেড়ে চলে গেলে তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয় না। ফস্টার হোমে চলে গেলে তারাই শিশুকে সযত্নে আগলে রাখবে এবং উপযুক্ত দম্পত্তির কাছে দত্তক দেবে। যাতে পরম মমতা ও স্নেহের চাদরে মুড়িয়ে থাকে শিশুটির ভবিষ্যতের দিনগুলো।
এদেশে এই সুখনিবাস ফাউন্ডেশনই বলতে গেলে ফস্টার হোমের প্রবর্তক। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে এরা খুঁজে বেড়ায় অনাথ এবং অসহায় শিশুদের। যে শিশুর তিন কুলে কেউ নেই, তার জন্যে আছে সুখনিবাস।
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় পাঁচতলাবিশিষ্ট একটি ভবনে গড়ে উঠেছে সুখনিবাস। প্রথম চার তলা পুরোটাই শিশুদের জন্যে। আর ওপরের তলাটা অফিস। দত্তক নেওয়ার আনুষ্ঠানিক কাজগুলো মূলত সেখানেই হয়ে থাকে। সায়েম আপাতত আছে পাঁচতলায়। এখানকার ম্যানেজার সঙ্গে কী নিয়ে যেন আলাপ করছে। শুকনো মুখে কঠিন সব আলাপ শুনতে ভালো লাগছিল না বলেই নাজ নেমে এলো চার তলায়।
বাচ্চাদের খেলার জায়গা এই তলাটা। ছোট ছোট বেশ কয়েকটা ঘর নানান রকম খেলনা দিয়ে সাজানো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল নাজ। তার বাড়িতেই তো ঠিক এমন একটা ঘর আছে। পড়ে আছে কোনো একজনের জন্যে বৃথা প্রতীক্ষায়। হঠাৎ নাজ এসে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালো। পাঁচ-ছয়জন বাচ্চা ছোটাছুটি করছে। নিজেদের মধ্যে সম্ভবত কানামাছি খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কার চোখে কাপড় বাঁধা হবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে চলছে তুমুল তর্কতর্কি।
নাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। মনের অজান্তেই ক্ষীণ এক হাসি বিস্তৃতি পেলো তার ঠোঁটে। প্রকৃতি যেন তার অপার স্নিগ্ধতা ঢেলে দিয়েছে এই শিশুদের মাঝে। পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত। এমন মমতামাখা বাচ্চাগুলোর না-কি পৃথিবীতে কেউ নেই। প্রকৃতি মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই মানুষের সঙ্গে নিষ্ঠুরতম আচরণ করে। কে জানে, প্রকৃতি হয়তো নাজের কাছ থেকে মা হবার ক্ষমতা কেড়েই নিয়েছিল যাতে এমন অনাথ শিশুদের একজন সে আপন করে নিতে পারে।
প্রায় অনেকটা সময় পর নাজ লক্ষ করলো সায়েম এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে।
নাজ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী বলল ওরা?”
সায়েম ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কিছুদিন সময় লাগবে। প্রাইমারি কিছু যাচাই-বাছাই শেষে ওরাই ফোন করবে।”
নাজ ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “কীসের যাচাই-বাছাই?”
সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমরা বাচ্চাকে লালন-পালনের জন্যে প্রস্তুত কিনা, প্রস্তুত হলে এখানে থাকা কোন বাচ্চাটা আমাদের জন্যে পারফেক্ট এসব।”
“কবে ফোন করবে?”
“করবে নাজ। একটু ধৈর্য ধরো, এতগুলো দিন যখন অপেক্ষা করেছি আর কয়েকটা দিন কি অপেক্ষা করতে পারবো না?”
নাজ চুপ করে রইল। যেন সায়েমের করা প্রশ্নটার উত্তর তার কাছে নেই। উত্তর খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত তার সমস্ত অন্তরাত্মা।
সায়েম বলল, “চলো বাসায় যাই।”
নাজ অনুনয়ের সুরে বলল, “আরেকটু থাকি?”
নাজের এই ব্যাকুল ইচ্ছাকে কী করে না বলে সায়েম? কিছুটা সময় ঠিক এভাবেই কেটে গেল। অনাথ ওই বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাজারটা স্বপ্ন বুনছে। আচ্ছা, সত্যিই কি এদের কাউকে আপন করে নিতে পারবে নাজ? না-কি পুরোটাই কেবল ভ্রম?
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে নাজ। কোনো এক অকারণে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা সায়েমের চোখ এড়িয়ে গেল না।
তাই সায়েম কোমল স্বরে বলল, “নাজ?”
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ?”
“এই অ্যাডপ্টশন নিয়ে তুমি খুশি নও?”
নাজ চাপা সংশয় নিয়ে বলল, “খুশি তো! কিন্তু আমার খুব ভয় করছে।”
“কীসের ভয়?”
“আমার বারবার মনে হচ্ছে এ জীবনে কোনোভাবেই মা হতে পারবো না আমি। এবারও কোনো না কোনো একটা বাঁধা এসে দাঁড়াবে।”
সায়েম গাড়ি চালাতে চালাতে দৃঢ় গলায় বলল, “আসুক। তাই বাঁধা-বিঘ্নের ভয়ে চুপ করে ঘরে বসে থাকবো?”
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো নাজের ঠোঁটজুড়ে। জীবনে যতই বাঁধা আসুক, এই মানুষটা পাশে থাকলে তা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য কিছু নয়।
নাজকে তার ওয়্যারহাউসে নামিয়ে সায়েম চলে গেল তার অফিসে। দুজনেই এমন একটা ভাব করছে যেন সব স্বাভাবিক আছে। তবে স্বাভাবিকের মধ্যেও যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে তা অবশ্য দুজনেই বুঝতে পারছে, স্বীকার করতে পারছে না। অস্বাভাবিকতা মনে মনেই। মনের মাঝে চাপা সংশয়টা ক্রমেই বেড়ে চলছে। জীবনে এই বড় সিদ্ধান্তটা আসলেই কি সুখকর হবে, না-কি বয়ে আনবে কোনো নতুন দুর্যোগের ঝড়?
নিজের কেবিনে বসে সতর্ক ভঙ্গিতে একটা চেক লিখছে সায়েম। কোথাও একটা বানান ভুল হলেই হাজারটা ঝামেলা। এক চেকে সর্বোচ্চ সাতটা বানান ভুলের রেকর্ড আছে তার। যেসব জায়গায় বানান ভুল হয়, সেখানে সাক্ষর তো দিতেই হয় তার সঙ্গে আছে ব্যাংকের অনবরত ফোন। সেসব এড়াতেই আজকাল একটু বেশি সতর্ক হয়ে চেক লেখে সায়েম।
হঠাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে হলো তার ধ্যান ভঙ্গ। বিরক্ত ভঙ্গিতে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ভেসে ওঠা মায়ের নাম। এই মুহূর্ত কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তাই ফোনটা রিসিভ না করে আবারও কাজে মনোনিবেশ করলো সায়েম।
কিন্তু সেই মনোনিবেশ আর স্থায়ী হলো না। আবারও এলো হাসনা বেগমের ফোন। হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার ফোন রিসিভ করলো সায়েম।
সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল হাসনা বেগমের উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত কণ্ঠস্বর, “সায়েম? এসব কী শুনছি আমি?”
সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কী শুনেছো?”
“তুই না-কি বাচ্চা দত্তক নিচ্ছিস?”
“একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। এই বাড়ির ড্রইংরুমে কিছু ঘটার আগেই তা তোমরা ময়মনসিংহে বসে শুনতে পাও। দেয়ালের কি সত্যি সত্যিই কান আছে না-কি?”
হাসনা বেগম ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “কান থাকলে কী হবে, মুখ তো নেই যে মানুষকে বলে বেড়াবে। তোর বউ ফোন করে কনাকে বলেছে, আর কনা আমাকে।”
“ও এই ব্যাপার!”
“তুই কিন্তু আমার কথার উত্তর দিসনি।”
সায়েম হেয়ালির স্বরে বলল, “কোন কথার?”
হাসনা বেগম বিরক্ত গলায় বললেন, “ফাজলামি করছিস আমার সঙ্গে? সত্যি করে বলতো সায়েম, তোরা আসলেই বাচ্চা দত্তক নিচ্ছিস?”
সায়েম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ নিচ্ছি। তো?”
হাসনা বেগম হতবাক গলায় বললেন, “হায় আল্লাহ! তোর মাথাটা কি একেবারে খারাপ হয়ে গেল সায়েম? একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটাবারও ভেবে নিবি না?”
“ভাবার কী আছে? একটা সময়ের পর প্রতিটা মানুষেরই বাচ্চার দরকার পড়ে। আমাদেরও পড়েছে।
“তাই বলে বাইরের একটা বাচ্চা?”
“এছাড়া তো কোনো পথ খোলা নেই মা। আর তাছাড়া অ্যাডপ্ট করার পর ও আর বাইরের কেউ থাকবে না, হবে আমাদের নিজেদের সন্তান।”
“এসব কি বলছিস তুই? বাইরের একটা বাচ্চা তোদের নিজেদের হবে কী করে?”
“চাইলেই হবে মা। তুমিই একবার ভেবে দেখো যে বাচ্চাটার পৃথিবীতে কেউ নেই তাকে আপন করে নেওয়ার মতো পূণ্য আর কীই বা হতে পারে?”
“না, না। আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমাদের বংশধর হবে বাইরের কেউ? এটা কোনোদিন সম্ভব? তোর কোনোদিন ধারণা আছে কেমন বাচ্চাদের দত্তক দেওয়া হয়? বংশপরিচয়ের কোনো ঠিক আছে ওদের?”
সায়েম কড়া গলায় বলল, “বংশপরিচয়ের ঠিক থাকলে তো আর তাদের দত্তক নেওয়ার প্রয়োজন হতো না মা। ওই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোর মধ্যে তো বিন্দুমাত্র অশুদ্ধতা নেই।”
“তুই এটা করতে পারিস না সায়েম। লোকে কী বলবে?”
“যা খুশি তাই বলুক। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আশেই অন্যের জীবনে নাক গলাতে। আমরা অলরেডি অ্যাডপ্টশনের প্রসেস শুরু হয়ে গেছে।”
হাসনা বেগম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “ও তার মানে ওই অ্যাডপ্টশনের কাজ শুরুও হয়ে গেছে? এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি অথচ আমাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলি না?”
“প্রয়োজন মনে করলে কী হতো? তোমার যে মত নেই সেটা তো আমি ভালো করেই জানি।”
“তবুও এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি?”
সায়েম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী আর করা মা? জীবনটা তো আমাদের, আমাদের মতো করেই না হয় বাঁচি।”
হাসনা বেগম থমথমে গলায় বললেন, “যা ইচ্ছা তাই কর, কিন্তু মনে রাখবি ওই বাচ্চাকে কোনোদিন আমি নিজের নাতি বলে মেনে নেব না।”
সায়েম আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দিলেন হাসনা বেগম। রাগে তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। পাশ থেকে মা-ছেলের কথোপকথন শুনছিলেন শওকত সাহেব।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, “ছি ছি, কনার মা। ছেলেটার সঙ্গে এমন বাজে ব্যবহার করলে?”
হাসনা বেগম হতাশ গলায় বললেন, “তো কী করবো, তুমিই বলো। দিন দিন ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাইরের একটা বাচ্চাকে বলে দত্তক নেবে। নিজের সন্তান আর বাইরের মানুষের মধ্যে তো জমিন-আসমান তফাৎ!”
“আমার মনে হয় সায়েম ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে।”
হাসনা বেগম অবিশ্বাসের স্বরে বললেন, “তার মানে তুমিও ছেলের এই পাগলামিকে সাপোর্ট করছো?”
“পাগলামির কী দেখলে তুমি? এতিম শিশুকে আপন করে নেওয়া তো পুণ্যের কাজ। তুমিই একবার ভেবে দেখো। আল্লাহর রহমতে আমরা দুই দুইবার বাবা-মা হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সায়েম আর বৌমার সেই সৌভাগ্য হয়নি, তাই বলে কি বাবা কিংবা মা ডাকটা শোনার অধিকার ওদের নেই?”
হাসনা বেগম কোনপ্রকার জবাব দিলেন না। যেন বিচিত্র এক গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার সমস্ত চেতনা।
(চলবে)
[একটু পর বোনাস পর্ব লিখতে বসবো, লেখা শেষ হলেই পেয়ে যাবেন। ❤️]#অপেক্ষারা
৬৫ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
শুক্রবারের আলসেমিঘেরা দুপুর। যেকোনো কাজপাগল মানুষের জন্যেও এই দুপুরটা আলসেমির চাদরে মোড়ানো। সপ্তাহে এই তো একটা দিন, যেদিন থাকে না কাজের কোনো চাপ। ব্যস্ততা ভুলে খানিকটা সস্তির নিশ্বাস ফেলা যায়। অনেকে আবার এই দিনটিকেও আলাদা করে রাখে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে। কিন্তু সায়েমের পক্ষে তা সম্ভব নয়। একটা মাত্র ছুটির দিন যদি বেচারা ঘুরে-বেড়িয়েই কাটিয়ে দেয়, তাহলে বিশ্রাম করবে কখন? তাই বলে যে সে ঘুরে বেড়ায় না তা নয়। নাজকে নিয়ে প্রায় দিনই অফিস শেষে ঘুরতে বের হয়।
সায়েমের কাছে এই দিনটা যতটা আলসেমির, নাজের কাছে ততটাই ব্যস্ততার। আজকের দিনে বেচারির দম ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। সারা সপ্তাহে জমিয়ে রাখা কাজগুলো আজকের দিনেই ঘাড়ে এসে পড়ে। যদিও জরিনা প্রতিদিন সকালে কাজে আসে, তবুও সংসারের এমন কিছু দায়িত্ব আছে যা অন্যের হাতে ছাড়া যায় না। এছাড়াও আজ সারাদিন সায়েম বাসায় থাকবে। তার পছন্দের সব খাবারগুলোও যত্ন নিয়ে রান্না করছে নাজ।
বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে সায়েম। এই বাড়িতে খবরের কাগজের একটাই ব্যবহার, পুরনো কিছু মুড়িয়ে রাখা। নাজের খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস নেই, সায়েমও সময় করে উঠতে পারে না। প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শিরোনামে চোখ বোলানো পর্যন্তই তার পড়া। তবে আজকের এই দিনটায় সায়েম বেছে প্রতিবেদনগুলোও পড়ে।
নাজ হঠাৎ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, “সায়েম! তোমার আলসেমির জন্যে এবার আমরা গরমে মরে যাবো।”
সায়েম ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সে কী কেন?”
“সেই কবে বলেছিলাম এসিটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে ঠিক করিয়ে নাও। আমার কথাটা তো কানেই নিলে না। পরে যখন গরম পড়বে তখন কিন্তু আমাকে বলতে পারবে না, নাজ! এসি কাজ করছে না কেন?”
সায়েম হাই তুলতে তুলতে বলল, “কী হয়েছে এসির?”
নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “আমি কী করে বলবো কী হয়েছে? আমি কী ইলেকট্রিশিয়ান?”
সায়েম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “কই, দেখি তো!”
নাজ কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে বলল, “দেখি তো মানে? তুমি দেখে কী বুঝবে?”
নাজের কথার কোনো জবাব না দিয়ে সায়েম চলে গেল শোবার ঘরে। নাজও এলো তার পিছু। সায়েম লক্ষ করলো যে সুইচ দিয়ে এসিতে বিদ্যুৎ আসে, সে সুইচটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। সায়েম চট করে নাজের পড়ার টেবিলের থেকে চেয়ারটা এনে তার ওপরে উঠে দাঁড়ালো, সুইচটা অন করবে বলে।
নাজ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “এই তুমি কী করছো? তোমাকে এটার ওপর উঠতে কে বলেছে?”
সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আরে বাবা, সুইচটা বন্ধ হয়ে আছে। অন করলেই হয়ে যাবে, এর জন্যে আবার ইলেকট্রিশিয়ান লাগে না-কি?”
“সায়েম, তুমি খবরদার ওখানে হাত দেবে না। ইলেকট্রিক শক খাবে!”
“শুধু শুধু শক খেতে যাবো কেন?”
নিমিষেই গলা শুকিয়ে গেল নাজের। শক খাওয়ার যে যথাযোগ্য কারণ আছে তা সায়েমকে বলতে পারছে না। এই শীতের মধ্যে একদিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একদিন ওই সুইচটায় অসাবধানতাবশত তার হাত লাগে। ভয়ঙ্কর এক শক লেগেছিল সেদিন। তারপর থেকেই সুইচটা বন্ধ করে রাখে নাজ। এই খবর আবার সায়েম জানে না, জানলে আস্ত রাখবে না তাকে।
নাজ ভীত গলায় বলল, “সায়েম তুমি নেমে এসো তো, তোমাকে এসি ঠিক করতে না।”
“আহ্ নাজ! বিরক্ত কোরো না তো।”
নাজ কিছু একটা বলতে যাবে তখনই বেজে উঠলো সায়েমের ফোনের রিংটোন। ফোনটা খাটের পাশে থাকা সাইড টেবিলের ওপর চার্জে রাখা।
নাজ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই! তোমার ফোন বাজছে। নেমে এসো তো।”
“কে ফোন করেছে?”
নাজ সায়েমের ফোনের ওপর উঁকি দিয়ে বলল, “বুঝতে পারছি না। আননোন নম্বর।”
সায়েম এসির তার নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দাও।”
নাজ হতবিহ্বল গলায় বলল, “মানে? তুমি ওই ওপর থেকে কথা বলবে?”
সায়েম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তাছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না।”
নাজ ফোনটা রিসিভ করতে করতে ক্রুব্ধ গলায় বলল, “যা ইচ্ছা করো!”
ফোন রিসিভ করতেই শোনা গেল অপরিচিত এক পুরুষ কণ্ঠস্বর, “হ্যালো, আমি কী মিস্টার সায়েম চৌধুরীর সাথে কথা বলছি?”
সায়েম চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে থেকেই উঁচু গলায় বলল, “হ্যাঁ, আপনি?”
“আমি সুখনিবাস ফাউন্ডেশন থেকে বলছি। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”
নাজ তো এ ঘর থেকে চলেই যাচ্ছিল। সুখনিবাসের নামটা শুনে ছুটে ফিরে এলো। সায়েমও আর এক মুহূর্তও অপচয় করলো না। তৎক্ষণাৎ নেমে এলো চেয়ার থেকে।
সায়েম ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “বলুন, কী জরুরি কথা।”
“আমাদের এখানে গতরাতে একটা মেয়ে শিশু এসেছে। মেয়েটার বয়স তিনদিন। তাকে জন্ম দেওয়ার পরেই তার মা অসুস্থ হয়ে যায়। অসুস্থ মাকে নিয়ে তার বাবা ঢাকায় আসছিলেন, কিন্তু একটা বাস অ্যাক্সিডেন্টে তারা মারা যান। শিশুটির আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। একজন দুঃসম্পর্কের খালাকে পাওয়া গেছে, কিন্তু সে কোনপ্রকার দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। আমরা গতকাল বাচ্চাটিকে যশোর থেকে উদ্ধার করে আমাদের এখানে নিয়ে আসি। আপনারা কি তাকে অ্যাডপ্ট করতে চান?”
সায়েম কথাটার জবাব দিতে পারলো। বিস্ময়ে থ বনে চলে গেছে ছেলেটা। বিস্ময় খেলে বেড়াচ্ছে নাজের মনেও। দুজনে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে।
আবারও শোনা গেল সেই পুরুষকণ্ঠ, “হ্যালো? মিস্টার সায়েম?”
সায়েম এবার সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল গলায় বলল, “জি, আমরা অ্যাডপ্ট করবো।”
“তাহলে এক্ষনি আমাদের ফাউন্ডেশনে চলে আসুন।”
সুখনিবাস ফাউন্ডেশনের দোতলায় নবজাতক কিংবা একেবারে ছোট্ট বাচ্চাদের থাকার ব্যবস্থা। যেসব বাচ্চারা নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারে না, সার্বক্ষণিক যত্নের প্রয়োজন হয় তারাই এখানে থাকে।
তাকে না-কি রাখা হয়েছে দুইশ তিন নম্বর রুমে। নাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘরটা। কোনো এক অজানা অস্থিরতায় একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে তার হৃদস্পন্দন। মাথাটা খানিকক্ষণের জন্যে কাজ করতে ভুলে গেছে। নাজ বুঝতে পারছে না, আনন্দে চিৎকার করবে না-কি সুখময় অশ্রুতে গাল ভেজাবে।
এদিকে নাজের পিছু পিছু সায়েমও খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘরটা। ঘর খোঁজার দুশ্চিন্তার থেকেও বড় দুশ্চিন্তা নাজকে নিয়ে। মেয়েটা যেভাবে হাঁটছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি হোঁচোট খেয়ে পড়ে যাবে।
নাজকে সাবধান করতে সায়েম কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখনি তারা খুঁজে পেলো সেই কাঙ্ক্ষিত দুইশ তিন নম্বর রুম। ভেতর থেকে একটা বাচ্চার তীব্র আর্তনাদের আওয়াজ ভেসে আসছে। নাজ আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে।
একজন নার্স বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তবে সেই চেষ্টা সম্ভবত বৃথা। নার্স যতই তাকে থামতে বলছেন, ততই তীব্র হচ্ছে তার কান্না। নাজ ঘরে ঢুকে কতক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। যেন কী করবে বুঝতে পারছে না। একবার মনে হলো নার্সকে কিছু বলা উচিত, কিন্তু কী বলবে তাও মাথায় খেলছে না।
শেষমেশ নার্স নিজেই নাজের সকল অনিশ্চয়তা দূর করে মিষ্টি গলায় বললেন, “আপু অ্যাডপ্টশনের জন্যে এসেছেন?”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালো।
“ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এদিকে আসুন।”
নাজ ধীর পায়ে এগিয়ে এলো নার্সের কাছে। নার্সের হাতে গোলাপী টাওয়েলে মোড়ানো একটা পদ্মফুলের মতো দেবশিশু। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল নাজ। কান্নারত একটা মানুষকে দেখতে যে এত অপূর্ব লাগে, কে জানত!
নার্স হাসিমুখে বললেন, “এই ম্যাডাম কাল রাত থেকে এক ফোঁটাও ঘুমায়নি বুঝলেন। কেঁদে কেঁদে আমাদের সবাইকে পাগল করে দিয়েছে।”
নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “আমি কি ওকে কোলে নিতে পারি?”
“অবশ্যই!”
প্রকৃতির অদ্ভুত কিছু নিয়ম রয়েছে। যে নিয়মগুলোর কোনো সংজ্ঞা নেই, নেই কোনো ব্যাখ্যা। সেই নিয়মের কাতারে পড়েই অদ্ভুতভাবে নাজের কোলে উঠতেই থেমে গেল তার সমস্ত কান্না। তার বিস্মিত চোখদুটো নাজের ওপরেই আটকে আছে। বাচ্চারা না-কি আগেভাগেই টের ভবিষ্যতকে। সেও হয়তো টের পেয়ে গেছে, যার কোলে উঠেছে সেই তার সবথেকে আপনজন।
এতক্ষণে তার আরেক আপনজন এসে দাঁড়িয়েছে নাজের পাশে। সায়েম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে। নাজের চোখদুটো বেয়ে কেবল অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটার ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি, তবে চোখে অশ্রু। এই দৃশ্যটাকে ক্যামেরা-বন্দী করে রাখতে পারলে বেশ হতো। থাক! মনের ক্যামেরায় বন্দী হয়ে গেছে এই অনেক।
সায়েম নাজের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল, “এই বোকা মেয়ে! কাঁদছো কেন?”
বোকা মেয়েটা কাঁদবেই না-ই বা কেন? তাকে যে ডাক্তার বলে দিয়েছিল, “আপনি আর কোনোদিন মা হতে পারবেন না”। ডাক্তারদের এই এক দোষ। না জেনেশুনে ভবিষ্যৎবাণী করে দেওয়া। তারা কী জানত, কোনোদিন মা হতে না পারা মেয়েটাও একদিন মা হয়ে যাবে?
(চলবে)
[পরের পর্বটাই শেষ পর্ব হবে ❤️]