#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১৮|
সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে আর কুঞ্জ ভাই আমার সাথে কথা বলেননি। আমি কিছু বলতে গেলেই উনি কেবল চোখ রাঙিয়েছেন। ব্যাপারটি আমার ছোট্ট ও অবুঝ মস্তিষ্কে ঢুকল না। হয়তো ঢুকবেও না। দেখতে দেখতে দুটো দিন পেরিয়ে গেল। আজ আমার দিদির গায়ে হলুদ। উৎসবের আমেজে পুরো বাড়িটা জমজমাট হয়ে আছে। আব্বুরা কাল রাতেই এসেছে।
এখানে বড়ো মামারা থাকেন না, তবুও বাড়ি করে রেখেছেন। পাশাপাশি তিনটে এক তলা বিল্ডিং, আমার তিন মামার; মাঝখানের উঠোনকে ঘিরে বানানো হয়েছে। ছোটো মামার বাড়িতে অতিথিদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে, বাড়ির অন্যান্য সকলে মেজো মামার বাড়িতে রইল।
আর আমরা, ইয়াং জেনারেশনের সবাই রইলাম বড়ো মামার বাড়িটিতেই। ওহ্, হ্যাঁ! সে রাতে সবাই একসাথে শুয়ে যেই আফসোস করেছিলাম, তা আর করতে হয়নি। আমি, আপি আর রাহী বিগত রাতগুলো রাহীদের বাড়িতে, ওর রুমেই থেকেছি। দিদি, নীতি, সুপ্তি, দিয়া আরেক রুমে। আরেকটিতে কুঞ্জ ভাই, আসিফ ভাই আর আকাশ ভাই।
আমি ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশটা দেখলাম। কী সুন্দর লাগছে সবটা! আমি লোক-সমাগম তেমন সহ্য করতে পারি না, তবুও ভালো লাগছে। উঠোনটা ভীষণ আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো হয়েছে, পুরো বাড়ির মধ্যস্থানে হলুদের আয়োজন। দূরের ওই বাগানের একপাশে দেখা যাচ্ছে, খাবার রান্নার ব্যবস্থা করে হচ্ছে। আমার আর রুমে থাকতে ইচ্ছে হলো না। ঘড়িতে তাকালাম, সময় এখন: ছয়টা বিশ। আলগোছে উঠে পড়লাম। আমার পাশের ঘুমন্ত মহিলাগুলো এখনই উঠবে না। এরা তো ওই ধাঁচেরই না।
উঠে ফ্রেশ হলাম না। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উঠোনের এক কিনারায় নানুমা বসে আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই নানুমা বলে উঠলেন, “কী গো, নানা! এই ব্যাহানায় ঘুম ভাঙল কিয়ারতে? রাইতে ঘুম হয় নাই?”
আমার নানুমা আমাকে আদর করে ‘নানা’ বলে ডাকেন। বড্ড প্রশান্তিময় এই ডাক। আমি সামান্য হেসে বললাম, “ঘুম হয়েছে। বাড়িতে বিয়ে, এত বেলা করে কি ঘুমোনো ঠিক, বলুন?”
নানুমা পানখাওয়া মুখ থেকে মাটিতে পানের পিক ফেলে হেসে বললেন, “পোলাপানগুলা বুঝবারই চায় না। এত এত কাম, হাত লাগাইব তো নাই; নিজেগোর লগে আনন্দ-ফুর্তি করব, তাও করে না।”
“একটু ঘুমাক, এরপর দেখবেন, পুরো বাড়িতে কেমন শোরগোল শুরু হয়ে যায়!”
নানুমা শুধুই হাসলেন। আমি শুধালাম, “নানাভাই কোথায়? ওঠেননি?”
“তোমার নানাভাই তো ফজরের ওয়াক্তে উঠসে। এহন দ্যাহো, পচ্চিমেত্তে গেসে।”
আমি ব্রাশ করতে করতে পশ্চিম দিকে, বাগানের ওদিকে গেলাম। ওখানে আমার আব্বু, বড়ো মামা, খালুজান, নানাভাই, সবাই আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলাম। সবাই হেসে সালামের জবাব দিলেন।
নানাভাই তখন বললেন, “গুড মর্নিং, সুইটহার্ট।”
আমি ছোটো করে হাসলাম। বিনিময়ে বললাম, “সুপ্রভাত, নানাভাই।”
নানাভাই অধর এলিয়ে বিশাল করে হাসলেন, “হু আর ইউ, ডিয়ার লেডি?”
আমি ভ্রু বাঁকা করে ফেললাম। এক সময় আমার নানাভাই গ্রামের স্কুলের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু, বয়সের তালে তালে ইংরেজি সব প্রায় গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছেন। তবুও থামেনি তাঁর ভুলভাল ইংরেজি বলা!
নানাভাইয়ের ‘হু আর ইউ’ শুনে সবাই অবাক চোখে তাকালেও, আব্বু কেশে উঠলেন। শুধরে দিতে বলে উঠলেন, “আব্বা, ওটা ‘হু আর ইউ’ না, ‘হাও আর ইউ’ হবে।”
নানাভাই আব্বুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে হাতের তর্জনী আঙ্গুল তুলে বললেন, “ইউ গণ্ডমূর্খ!”
আব্বু মিটিমিটি হাসলেন এবং বললেন, “আজ্ঞে, শ্বশুরমশাই। এই গণ্ডমূর্খের হাতেই নিজের প্রাণপ্রিয় কন্যাকে তুলে দিয়েছিলেন, ভুলে গেছেন?”
নানাভাই দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললেন, “ইচ্ছা করে করসি? আমারে ভালা মানুষ পাইয়া তো সেই খেলা খেলসিলা। কী মনে করসো? ভুইলা গেসি?”
আমার মনে পড়ে গেল কাহিনি। আব্বু আর নানাভাইয়ের দুষ্ট-মিষ্টি তর্কাতর্কির মাঝে হাসতে হাসতে প্রস্থান ঘটালাম। নানাভাইয়ের প্রিয় মেয়ে ছিল, আমার আম্মু। সেজন্য ছোটো থেকেই ভীষণ আদরে, আবডালে সকল বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখতেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চমাধ্যমিকের কলেজটা ছিল পাশাপাশি। কীভাবে যেন আব্বু উচ্চমাধ্যমিকের পর প্রশংশাপত্র আনতে গিয়ে পাশের স্কুলের সেই মেয়েটিকে (আমার মা) দেখে পিছলে যান। আম্মু তখন সবে অষ্টমের ছাত্রী। এরপর আব্বু নানাভাইয়ের চেয়েও যত্নে আম্মুকে রাখা শুরু করলেন। লোক দিয়ে ব্রেক-টাইমে টিফিনের ব্যবস্থা, সিনিয়র আপুদের বলে রাখা– সমস্যা হচ্ছে কি না খেয়ালে রাখতে, রাস্তাঘাটে যেন কখনও কেউ আম্মুকে উত্যক্ত করার সাহস না পায়, সে ব্যবস্থাও করেছেন।
আব্বুর ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাবার তিনি পরপরই গ্রাম ছেড়ে চলে যান, রেখে যান তাঁর প্রাণনাশিনীকে, আমার আম্মুকে। ধীরে ধীরে আম্মু ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর শহরের একটা ভার্সিটিতে চান্স পেলে, ওখানেই চলে যায়, হোস্টেলে ওঠে। মেয়ে-মন অদ্ভুত, বড্ড অদ্ভুত। সেখানে একটা ছেলের সাথে আম্মুর সম্পর্ক হয়, যখন আম্মু সেকেন্ড ইয়ারে ছিল। এদিকে আব্বুর পড়াশোনা তখন শেষ, একটা জবও পেয়েছেন।
আম্মুর পেছনে যে আব্বু লোক লাগিয়েছিলেন, তার কাছ থেকে আম্মুর প্রেমজনিত বিষয় জানতে পেরেই অফিস থেকে এক সপ্তাহের লিভ নিয়ে টাঙ্গাইল চলে আসেন আব্বু। এসেই নানাভাইকে বলেন, “স্যার, আপনার কাছে কিছু চাইব।”
নানাভাই তখন আব্বুর প্রতি সামান্য দূর্বল, তার উপর নানাভাইয়ের প্রাক্তন প্রিয় ছাত্র ছিলেন আব্বু। এই সুযোগটাই হয়তো আব্বু কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিফলে গেল সেই পরিকল্পনা। নানাভাই বলে দিলেন, “আমার সাধ্যিতে না থাকলে দিবার পারতাম না।”
আব্বু তখন হেসে বললেন, “আমি শুধু চাচ্ছি, দেওয়া না দেওয়াটা আপনার ব্যাপার। আমি প্রেশারাইজড করছি না।”
নানাভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী চাও?”
আব্বু কোনো ভনিতা না করেই বলেছিলেন, “আপনার বড়ো মেয়ে, নীলুকে চাই।”
নানাভাই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে দেন। তার মতে, তিনি রাজি ছিলেন, কিন্তু আব্বুকে সামান্য ঘাটাতে চান। নানাভাই একবাক্যে ‘না’ করে দেওয়াতে আব্বু আম্মুর প্রেমঘটিত ব্যাপারটি নানাভাইয়ের কাছে খুলে বললেন। অবশেষে জানালেন, “মেয়েকে যদি এরপর চোখের দেখা দেখতে চান, তবে বিয়ে দিয়ে দিন নয়তো আমি গুম করে দেব। পরে আমাকে পুলিশে দিলেও মেয়ের খোঁজ আপনি পাবেন না।”
অতঃপর মেয়েভীতু নানাভাই আমার আব্বুর ব্যাপারটা ভেবে মনে মনে খানিকটা প্রসন্ন হেসেই বিয়ের প্রপোজাল একসেপ্ট করে ফেলেন। প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়াটা যে শুধু হুমকির জন্য ছিল, তা নয়। মেয়ে যথেষ্ট বড়ো হয়েছে, ছেলেও ভালো; তার চেনা; তার প্রিয়। অথচ মেয়ে তার বড্ড বোকামি করে ফেলেছে, অবুঝ-সরল মেয়েটা একটা টাউট শ্রেণীর ছেলের প্রেমে পড়েছে। এরপর আম্মুকে জানানো হলে, আম্মু বিয়েতে নাকচ করে। আব্বু একপ্রকার তুলে নিয়েই বিয়েটা করেন। আব্বুর ভাষ্যমতে, আম্মু যদি ভালো কোনো ছেলের সাথে প্রেম করত, তবে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতেন। কিন্তু আম্মু তো একটা নেশাখোর, জুয়ারি, বখাটের প্রেমে পড়েছিল। এর হাতে তো আর নিজের প্রাণ তুলে দিতে পারেন না!
এতসব কথা আমি দাদিবুবুর কাছ থেকে জেনেছি। আব্বু অনেকটা বুদ্ধি ও গায়ের সংমিশ্রিত জোর খাটিয়েই আমার আম্মুকে বিয়ে করেন। নানাভাই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন, তবে একটা শর্তও দিয়েছিলেন। শর্তটি ছিল— ‘আমার মেয়েকে রাজি করাতে হবে’। আব্বু প্রচেষ্টা করেছিলেন, আম্মু মানেননি। তাই জোরপূর্বক বিয়েটা হয়েছিল। এজন্য আজও নানাভাই ক্ষেপে আছেন।
হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ভেতরের দিকটায় চলে এলাম। দূরের এক জাম গাছের কাছে কিছু নজরে পড়ল। এগিয়ে যেতেই চোখের ক্যানভাসে ধরা দিলো এক সুঠাম দেহের পুরুষের পৃষ্ঠদেশের অবয়ব। বাঁ পাশের বাহুটা গাছের উপর হেলে প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা এবং ডান হাতটা কানে, যার মাঝে মুঠোফোনটা আঁকড়ে রাখা আছে। পরনে শুভ্র রঙা টি-শার্ট আর গাঢ় নীল ট্রাউজার। আরও কিছুটা এগোতেই মুঠোফোনের ফাঁকফোকর দিয়ে আমার সম্মুখে কুঞ্জ ভাইয়ের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি বিশিষ্ট গালের আংশিক নজরে এলো। সূর্যের কিরণ পিঠে পড়েছে ওঁর। পকেটে পুরে নেওয়া হাতটা উঠিয়ে মাথার পেছনের চুলগুলো আলতো হাতে চুলকে নিলেন। এত গম্ভীর ও থমথমে মুখে কার সাথে কথা বলছেন, বুঝতে পারলাম না।
কিছুটা এগোতেই কানে এলো ওঁর কথাবার্তার কিছু অংশ। ভয় পেয়ে গেলাম। এভাবে কাকে শাসাচ্ছেন?
আবারও ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিকে বললেন, “তোদের দিয়ে কিছুই হচ্ছে না। আমি না থাকলেই কেন এরকম হয়? ঘাস খাচ্ছিস তোরা? হ্যাঁ? ঘাস খাচ্ছিস? আই সোয়্যার অরুণ, তোদের সবকটাকে আমি পুঁতে ফেলব!”
ভয়ে শুকনো ঢোক গিললাম। তাঁর এমন চওড়া মেজাজ, কণ্ঠের দৃঢ়তা আমায় ভীত করছে। এগিয়ে যাব না কি পালাব, বুঝে উঠতে পারলাম না, এর আগেই কুঞ্জ ভাই সামান্য ডানে মুড়তেই আড়চোখে আমার উপস্থিতি লক্ষ করলেন। তবে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অরুণ নামের ওই লোকটিকে পুনরায় বললেন, “আই’ল কল ইউ ব্যাক, লেটা(র)। জাস্ট হ্যান্ডেল ইট, আনটিল আই কাম।”
কুঞ্জ ভাই পুরোপুরি মুড়লেন না। কল রেখে সেভাবেই দু’হাত পকেটে পুড়ে জামগাছটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সামান্য কিছু সময় অতিবাহিত হতেই আমার কর্ণে ভেসে এলো প্রিয় পুরুষের গম্ভীর-ভরাট স্বর, “অন্যের পার্সোনাল কনভার্সেশন শোনা উচিত নয়, উইদাউট পার্মিশন তো একদমই নয়।”
হুট করে বলা এমন কথার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এভাবে যে বলবেন, তাও বুঝতে পারিনি। কথাটা আমার সামান্য খারাপও লেগেছে। তবুও ব্যক্ত করলাম না আমার মন খারাপের রেশটা। মিনমিনে কণ্ঠে কেবল বলে গেলাম, “স্যরি। আমি ইনটেনশ্যনালি কথাগুলো শুনিনি। আসলে, মানে, আব্…”
“নো এক্সকিউজ, প্লিজ!”
আমি চুপ মেরে গেলাম। অবাধ্য মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। এভাবে বলার কী আছে? এদিক-সেদিক চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে আসা অশ্রুকণা আলগোছে শুষে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম, সফল অবশ্য হলামও। তবে এখানে থাকার সকল প্রকার আগ্রহ-অনাগ্রহ যা আমার ছোট্ট হৃদয়টিতে বসত গেড়েছিল, তা ঝেড়ে ফেলে প্রস্থান করার জন্য পা বাড়ালাম।
তখনই কুঞ্জ ভাই পিছু মুড়লেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই নজরে বহ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে আমার হৃদয়জনিত সকল সমস্যা। এই সমস্যাগুলোর ভস্মরূপ কি আমার-ওঁর জন্য ঠিক? হয়তো না।
#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১৯|
“ওই! অসহায়ের মতো মুখ লেটকিয়ে বসে আছিস কেন রে? রেডি হ। বি ফাস্ট, নবু।”
আপির কথায় আমি চোখ তুলে দর্পণের দিকে নজরবদ্ধ করলাম। আপি নাকের নথ ঠিক করতে করতে উক্ত বাক্যটি বলেছে। তার গায়ে সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি। পাশে রাহী আর সুপ্তিও আছে, তাদের পরনেও একই শাড়ি। নীতি আর খালামণি দিদির সাথে পার্লারে গেছে। তারা ওখান থেকেই সেজে আসবে। কেবল দিদির শাড়িটা গোলাপি পাড়ের হলুদ কাতান। বাকিদের একরকম দেখতে শাড়ি। সবার সাজও একই রকম।
আমি চোখ দুটো ভরে আপিকে দেখতে লাগলাম। কী সুন্দর লাগছে আমার আপিকে! ইশ! পুরোই চোখ ধাঁধানো। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে আপি চোখজোড়া সামান্য কুঁচকে ফেলল, পরপরই একই অবস্থায় হেসে দিয়ে রাহীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এর কী হলো, দ্যাখ রে, রাহু! তৈরি হয়ে নিতে বল তো!”
রাহী আপিকে বলল, “আমার মনে হয় কী রজনীপু, জানো? এর ঘুম পাচ্ছে।”
আপি বোধহয় রাহীর কথাটা মেনে নিল। তাই তো বলল, “এ্যাই, নবু! ভুলেও না। ঘুমাবি না একদম। বেড সাইড টেবিলের উপর দ্যাখ একটা ব্যাগ আছে। ওখানে তোর শাড়ি আর অর্নামেন্টস সব রাখা আছে। জলদি রেডি হ।”
আপি আমাকে আরও কিছু কথা বলতে বলতেই আম্মুর ডাক এলো। আপি চলে গেল। এদিকে রাহী আর সুপ্তিরও হয়ে গেছে। ওরা ছবি তুলতে বাগানে চলে গেল। আমি উঠে ব্যাগটা থেকে আমার শাড়ি বের করলাম। সেদিন মলে সবাই সেইম শাড়ি কিনলেও, আমার চোখ গিয়ে আটকায় সেই কাঁচা হলুদ রঙের জামদানি শাড়ির উপর। কিনেও নিলাম এটা। মুচকি হেসে শাড়িটা পরে নিলাম, অবশ্যই আটপৌরে করে, কনুই অবধি স্লিভের লাল ব্লাউজের সাথে। মাঝসিঁথি করে খোপা করা চুলের এক পাশে গুঁজে নিলাম তিনটা লালগোলাপ, একটু আগেই দিয়াকে দিয়ে বাগান থেকে ফুলগুলো আনিয়েছি।
ঠোঁটে লাল টকটকা লিপস্টিক, চোখ ভর্তি কাজল, মুখে মেকআপের সামান্য কারুকার্য, কানের দু’পাশ থেকে আলগোছে নেচে বেড়ানো ক’গাছি চুল, পায়ে নূপুর, হাতে মোটা বালা, কানে ভারি কানপাশা, গলায় সরু চিক, খোপায় বড়ো কাঁটা, কপালে লাল টিপ আর নাকে একটা টানা নথ। নিজেকে আয়নায় দেখে চোখ ফেরাতে পারছি না। ইশ, নবু! ইশ! আজকে তো তোর কুঞ্জ ভাই শ্যাষ। এক্কেবারে তালব্য শ, এ-কার— শেষ! সেদিন কুঞ্জ ভাইয়ের ওমন কাজ আমি মোটেও ভুলিনি। এর শাস্তি তো পাবেনই উনি।
___________
সময়টা দ্বিপ্রহর। উঠোনের একদম মাঝখানেতে বসে আছে দিদি। সবাই আলতো হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। আর “কাল সাজবে বধু” আজ লাজে রাঙা হচ্ছে। গোলাপি পাড়ের হলুদ শাড়ির সাথে ম্যাচিং আর্টিফিশিয়াল ফ্লাউয়ারের অর্নামেন্টসে দিদিকে চমৎকার লাগছে। ভেবেই মুচকি হেসে রাহীকে খুঁজতে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম কুঞ্জ ভাইয়ের কথা। সেই যে সকালে ওভাবে রাগ দেখালেন, এরপর তো আর দেখাই দিলেন না! এভাবে কীভাবে একটা মানুষ বাচ্চা মেয়েকে রাগ দেখায়? দয়া-মায়া হয় না?
ফোনের মৃদু কলিং ট্যুনে সচকিত হয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। স্ক্রিনে ভেসে আসছে একটি নাম— মেহেদী ভাই!
রিসিভ করেই বিশাল বড়ো একখান সালাম দিলাম মেহেদী ভাইকে। সে সালামের জবাব দিয়ে আমাকে শুধাল, “ওপাশের খবর কী, ছোটো বউ?”
আমি ব্যাপারটা ধরে ফেলে বললাম, “উহুম! উহুম! ওপাশের না কি কেবল দিদির?”
সে সামান্য হেসে বলল, “দিদিরটাই বলো।”
“ভালো গো, ভীষণ ভালো। তবে আজ প্রচুর লজ্জা পাচ্ছে তোমার বউটা।”
“ইশ রে! এখন তো দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“অবুঝ হয়ো না, দেখার জন্যই তো কল দিয়েছ। কী ভেবেছ, বুঝি না কিছুই?”
“হুম, হুম। বুঝদার মেয়ে! এখন আমার বউটার দর্শন দাও তো!”
আমি খিলখিল করে হেসে বললাম, “ভিডিয়ো কল দিচ্ছি।”
কল কেটে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়ো কল দিলাম। মেহেদী ভাই আমাকে দেখেই বলল, “বাহ! এত সাজ! আজ তো তোমার জন্য হাজব্যান্ড মহাশয় খোঁজার এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব না নিলে চলেই না।”
“এহ, নাহ! আমার বর রেডি আছে, খুঁজতে হবে না। তুমি তোমার বউকে দ্যাখো।”
“দেখাও। চোখ দুটো তোমার দিদিকে দেখার জন্য চকচক করছে রে, ভাই।”
আমি হেসে ব্যাক ক্যামেরায় দিদিকে দেখালাম। দিদি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বলল, “কী?”
আমি জোরেশোরেই বললাম, “ছবি তুলছি গো। একটু হাসো-না!”
দিদির লাজ ভাবটা কমে এলো এলো করেও কমল না। চটজলদি লাজের মিথ্যে ভান করে পোজ দিতে লাগল। এপাশে মেহেদী ভাই মুগ্ধ নয়নে নিজের হবু বউকে দেখতে লাগল। যেন, এ দেখার শেষ নেই। হঠাৎ টুটটুট শব্দ করে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। ফোনটাও আজ বেঈমানী করল! দিদির দিকে মেকি হাসি ছুড়ে দিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম, এখনই চার্জার কানেক্ট করতে হবে। দু’পা এগোতেই দৃষ্টি গেল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় পুরুষটির নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে থাকা নেত্রপানে। পরনে হলুদ কুর্তা, সাদা পাজামা, হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করা, বাঁ হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ আর অনিমেষ নেত্রপানে ছেয়ে আছে এক অন্তরীক্ষ সমান মুগ্ধতা। এক দৃষ্টিতে এটুকু দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি তাকাক আমার দিকে, তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ গলে যাক; আমার কী? সকালে যখন ওমন ব্যবহার করলেন, তখন মনে ছিল না? মনে ছিল না যে, আমিহীনা তাঁর গন্তব্য নেই। অদৃশ্য ভেঙচি কেটে আমি আবারও পা বাড়ালাম। ওমনিই পেছন থেকে মেজো মায়ের ডাক শোনা গেল, “নবনী!”
আমি পেছন ফিরে বললাম, “জি, মেজো মা! বলো।”
“কই যাইতেছ?”
“এই তো, এখানেই।”
“একটু কাজ কইরা দেও তো, মা।”
“হ্যাঁ, করছি। বলো।”
“আমাদের রান্নাঘরে দ্যাখো, পানের ডালা আছে। আইনা দেও একটু কষ্ট কইরা।”
আমি পা বাড়ালাম সেদিকেই। রান্নাঘরে যেতেই পেছন পেছন আরও একজোড়া পা সেখানে প্রবেশ করল। ম্যানলি স্মেলটার জন্য বুঝতে বেগ পোহাতে হয়নি, এটা কে। তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালামা না। ডালা হাতে তুলতে তুলতে একবার উনার দিকে তাকালাম। তাঁর চাহনি আমি ভীষণ ইনজয় করছি। বহুত রাগ ঝেড়েছ, বাছা! আজ আর নবু তোমার কাছ ঘেঁষবে না। সো, বসে বসে মুড়ি খাও।
কুঞ্জ ভাই হয়তো কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করছেন, কিন্তু বলতে তো পারছেন না। আমিও পানডালা নিয়ে সরে যেতে উদ্যত হলাম। উনি কিছু একটা ভাবছেন, খেয়াল করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার রাস্তা আটকালেন। আমি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বা পাশের খোলা অংশ দিয়ে বেরোতে লাগলাম। উনি এতেও সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি আবারও ডানে এলাম। এবারও একই কাজ করতেই আমি আমার তীক্ষ্ণ চাহনি ওঁর অক্ষিপটে বদ্ধ করলাম। সেখানে আছে তীব্রাকাঙ্ক্ষা!
কঠোর কণ্ঠে বললাম, “যেতে দিন।”
ওপাশ থেকে এবার প্রিয় পুরুষটির অপরিচিত, অচেনা, অন্যরকম এক আওয়াজ এলো, যা এর আগে কখনোই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছয়নি, “ধরে রেখেছি কি?”
বড্ড শীতল, মোহাচ্ছন্ন সেই আওয়াজে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললাম, “উঁহু, পথ আটকেছেন।”
“উঁহু, মন আটকেছি।”
“মন?”
“হু। তোমার মন।”
“কীভাবে?”
“মনের সাথে মনের সন্ধি ঘটিয়ে। আর…”
“আর?”
“বোঝো না?”
“না।”
“অবুঝ তুমি?”
“খানিকটা।”
“তবে তো বোঝাতেই হয়।”
“কী বোঝাবেন?”
“প্রে-ম…”
“ছি! ছি!”
কুঞ্জ ভাই তার ঘোর লাগানো দৃষ্টি সরিয়ে এবার বেশ শব্দ করেই হাসলেন। হয়তো তাঁর ঘোর লাগানো সেই দৃষ্টি আমার মাঝে কনভার্ট হলো। আমাকে তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুঞ্জ ভাইয়ের হাসি থেমে গেল। দু’কদম এগিয়ে এসে বললেন, “কী দেখছ?”
আমার সহজসরল স্বীকারোক্তি, “আপনাকে।”
“দেখে?”
“প্রেম বুনছি।”
“আর, কত?”
“এই তো, সামান্য!”
“বুনন শেষ কবে হবে?”
আমি এবার আরও এক কদম এগিয়ে ওঁর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললাম, “যবে সে প্রেম-নিবেদন করবে।”
“বিনিময়ে কী পাবে?”
“বিনিময়ে আমি তাঁকে এত যত্নে বোনা এই প্রেম দেব।”
উনি আর কিছু বললেন না। আড়চোখে দেখলাম, উনি মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসছেন। আমি প্রস্থান ঘটাতে চাইলাম, তখনই কানে মাতাল করা সেই ঘন স্বরটা এলো, “তবে তা-ই হোক…”
চলবে…
চলবে…
[