#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২০|
বড়ো মামার বাড়ির ছাদে মেহেদীর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেখানে ধুমসে চলছে আড্ডার আসর। হলুদের পোশাক বিকেলের দিকে পরিবর্তন করে সবাই খানিকক্ষণ জিড়িয়ে নিয়ে নয়া রূপে, পুরোদস্তর নয়া সাজে সজ্জিত হয়েছি। দিদি একটা সুতির শাড়ি পরে আছে, আর বাকি মেয়েরা, আমরা কুর্তা-সালোয়ার পরে আছি।
আমাদের কাজিনদের মাঝে দিদি সবচেয়ে ভালো মেহেদী দেয়। প্রতিবার গ্রামে এসে আমরা সবাই ওর কাছ থেকে মেহেদী দেবার জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠি। কিন্তু এবার! নিজের বিয়ের মেহেদী নিজের দু’হাতে কী করে দেবে?
তাই আমিই দিচ্ছি। মোটামুটি ভালোই পারি, মেহেদীর নকশা বুনতে। আর কিছু পারি বা না পারি, এসবের প্রতি আগ্রহ থাকে বিধায় বেশ পারি!
ঘণ্টা দুয়েক ধরে দিদির দু’হাতে মেহেদী দিয়ে দিতে লাগলাম। আপি বাকিদের দিয়ে দিচ্ছে। মেহেদী দেবার এক পর্যায়ে রজনী আপিকে উদ্দেশ্য করে আসিফ ভাই প্রশ্ন ছুড়ল, “তুমি মেহেদীও দিতে পারো, রজনী?”
আপি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে এক দল ছেলেদের মাঝে এক কিনারায় বসে থাকা আসিফ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “না পারলে ভালো হতো বুঝি?”
আসিফ ভাই তড়িৎ গতিতে বলে উঠল, “না-না! তা নয়! আসলে তুমি ঝগড়া বাদে যে এসবও পারো, তার ধারণা আমার ছিল না তো!”
আপি এবার পুরোপুরি পিছু মুড়ল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল, “আসিফ! তুমি এখন আমার সাথে কথা বলবে না একদম। নয়তো এটা মেহেদী-আড্ডা থেকে খুনখারাবি হয়ে যাবে, বলে দিলাম!”
আসিফ ভাই দু’ঠোঁটের অগ্র ভাগে তর্জনী আঙ্গুল ঠেকিয়ে দু’কাঁধ নেড়ে বলল, “অ্যাজ ইওয়োর উইশ, মহারানি!”
পরক্ষণেই সকলে দমফেটে হাসতে লাগলাম। আপি মুখ ভেঙিয়ে আবারও নীতিকে মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠল। আমি দিদিকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি আর ফাঁকে ফাঁকে এসবের দিকে নিজের সুক্ষ্ম নজরটি এলিয়ে রাখছি। বড়োরা কেউ এখানে আসেনি। তবে আসবে। কিছুটা সময় বাদে খালামণি আসবে। তাঁকে দু’হাতে, দু’পায়ে ভরে ভরে মেহেদী লাগিয়ে দিতে হবে। পাঁচ ভাই-বোনের মাঝে সবচেয়ে ছোটো হওয়ায় কৈশোর থেকেই ভীষণ শৌখিন সে; এ-বয়সে এসেও যার বিন্দুমাত্র কমেনি। আমি আবারও মেহেদী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম। কুঞ্জ ভাই কোথায়?
সেই-যে! সেএএইই যে দেখা হলো! এরপর থেকে কই গুম হলেন? রান্নাঘর থেকে তখন তড়িঘড়ি করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা লজ্জা, বাকিটা তাঁর মতিগতি বুঝে ফেলার সঙ্কোচে। কিন্তু, আমি কি বলেছি, দূরে যান? বলেছি কি? এখন আমার বদলে, ওই ডায়ারির মেয়েটা হলে কি এমন করতেন? হুহ!
চরম মেজাজ নিয়ে এসব ভেবে ভেবে মেহেদীর নকশা তৈরি করতে লাগলাম, তখনই দিদি হঠাৎ করে আমাকে থামতে বলার পর বলল, “বিয়ে বিয়ে ফিল আসছে না, গাই’স!”
পাশ থেকে আপি বলে ওঠল, “এখন তোমার বিয়ে বিয়ে ফিল পাওয়ানোর জন্য কি নাচতে হবে আমাদের?”
নীতি বলে ওঠল, “আমিই নাচতাম… কিন্তু হাতে মেহেদী নিয়ে এখন নাচলে মেহেদী ছড়িয়ে যাবে। আচ্ছা। তোমরা এখন এত ইনসিস্ট করছ, না নেচে পারা যায়?”
দিদি তখন বলল, “এএএ! তুই বাদ। তোর নাচা বাদ।”
নীতি ঠোঁট উলটিয়ে বলল, “কেন? কেন? আমি নাচলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, হ্যাঁ?”
“টিকটকারদের পারফরম্যান্স আমার বিয়েতে এলাউ না।”
নীতি ঠোঁট উলটিয়ে তাকাল। আমি হেসে দিয়ে বললাম, “দিদি, একমাস ওর টিকটক বানানো আর দেখা বন্ধ, ভুলে গেছ?”
দিদি ভেবে নিয়েই বলল, “ওহ্, হ্যাঁ! এখন তো তুই সিভিলিয়ান! ওকে! নাচিস।”
নীতি মুখ ফিরিয়ে বলল, “হুহ! জুতো মেরে গোরু দান! আমার বয়েই গেছে নাচতে!”
আপি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “তবে, দুলাভাইকে বলি, এসে নেচে তার বউ-এর মনরঞ্জন করে যেতে!”
আকাশ ভাই সিটি বাজিয়ে বললেন, “সে-ই ভালো হয়, আপি, দিদি, ভাইগন্স অ্যান্ড বইন্স! কী বলো?”
দিদি মেহেদীতে বোনা হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল, “নাহ! সে তো বিয়ের পর প্রতিদিনই নাচাব!”
কিছুক্ষণ দিদির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। আমার হাসি সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সেই হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হতে মোটেও সময় নিল না। এরই মাঝে আকাশ ভাই দ্রুত পা চালিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের ঘর থেকে ওঁর গিটারটা এনে ফেললেন। অভ্যস্ত আঙুলগুলো দ্বারা টুং-টুং শব্দে মাতিয়ে তুললেন পরিবেশ, সাথে আপি আর আসিফ ভাই গান জুড়ে দিল…
প্রেমে হাসিয়া ভাসিয়া উতলা হাওয়ায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
মেঘে উড়িয়া ঘুড়িয়া ভিজিয়া ছলায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
পরানে শয়নে নয়নে নয়নে,
তুমি শুধু মনে।
প্রেমে হাসিয়া ভাসিয়া উতলা হাওয়ায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
মেঘে উড়িয়া ঘুড়িয়া ভিজিয়া ছলায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
গ্রীষ্মের তপ্ত রাতে মাঝে-সাঝে বয়ে চলা শীতল হাওয়ার সাথে কাজিনদের মহা আলাপন চলছে খুবই চমৎকার ভাবে। বাগানের হাসনাহেনা ফুলের সুবাস নিঃশ্বাসের সাথে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে তৈরি করল এক তুমুল নেশা, শান্তি। ভুলিয়ে দিলো দিন-দুনিয়ার পাওয়া না-পাওয়া সকল চাওয়া। একটাই তো জীবন! কেবল উপভোগ করো এই জীবনটিকে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে। শুধু পাওয়া নিয়ে নয়, না-পাওয়া সকল অনুভূতিকে, জাস্ট ইনজয় ইট-না?
বাতাসের তেজে মাথা থেকে ওড়না সরে গেল। কপালের সামনের চুলগুলো এলোমেলো হতে লাগল। দিদির হাতে মেহেদী লাগানো প্রায় শেষ। আমি বাঁ হাত দিয়ে উড়তে থাকা অবাধ্য চুলগুলো অতি সন্তর্পণে কানের পিঠে গুঁজতে গুঁজতে বামে তাকালাম। ঠিক ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হলুদের সেই একই পোশাক পরিহিত কুঞ্জ ভাই। চেহারায় সারাদিনের ক্লান্তি লেপ্টে আছে, এর সাথে অনিমেষনেত্রে ছেয়ে আছে অদ্ভুত সেই দৃষ্টি, যা আমাকে হুটহাট কাঁপিয়ে তোলে। এই যে– যেমনটি এখন হচ্ছে। তাঁর সেই চোখে আমার চোখ পড়তেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল; এ-কি আমার ইচ্ছাকৃত? মোটেও না। গালে সদ্য ফুটে ওঠা রক্তিম আভা বহু চেষ্টায়ও আটকাতে পারলাম না। লূকোনোর জন্য মাথা নিচু করে ফেললাম। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা লাজুক হাসিটা কি ওঁর চোখে পড়েছে?
মিনিট খানেক অতিক্রম হতেই মনের অভ্যন্তরীণ লাজুক রসায়ন সব সাইডে সরিয়ে আবারও বামে তাকালাম সেই ভয়ঙ্কর নজরে দৃষ্টিবদ্ধ করতে, খুবই সন্তর্পণে, খুবই শান্তভাবে, সাথে খানিকটা সংকচ নিয়েই।
ভয় কেবল ভীতিকরই নয়, ভয় সুন্দরও হয়; ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়। আর উনি আমার কাছে ভয়ঙ্কর সুন্দর এক পুরুষ। যার গাঢ় বাদামি চোখের নির্লজ্জ, সুদৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ী দৃষ্টি আমায় বড্ড টানে। ইশ! চোখে চোখ মেললেই আমি লাজবতী লজ্জায় ছেয়ে যাই, স্থান-সময় ব্যয় না করেই দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হই। কিন্তু এমন লজ্জা তো বারেবারেই পেতে ইচ্ছে হয়, খুব করেই!
সেই হিসেবে আবারও চোখ চলে গেল ঠিক সে-জায়গাটায়, যেখানটায় কুঞ্জ ভাইয়ের ক্লান্ত শরীরটা দেয়ালের ভরে দাঁড়িয়ে ছিল; চোখে ছিল তীব্রাকাঙ্ক্ষা; আমার জন্য কি? কিন্তু এবার আর লাজ ধরা দিলো না আমার দু’চোখের পাতায়, বরং চোখদুটো নিমিষেই তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল। ছাদের দরজার এপাশ-ওপাশটায় চোখ বুলালাম।
হুট করে যেভাবে এলেন, সেভাবেই যেন আবারও হারিয়ে গেলেন; মাঝে যে ওঁকে দেখে কেউ চক্ষু তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মরিয়া হয়ে আছে, তার খেয়াল কি রেখেছেন?
খুব নিকটে চেয়ার টানার শব্দ পেতেই আমি সেদিকে চোখ ফেরানোর জন্য মনোনিবেশ করলাম। তার আগেই কর্ণে ভেসে এলো খুব চেনা, খুউব প্রিয় সেই ঘন স্বর, “শ্যামা আপু! তোমার বিয়েটা আরও ক’বছর পরে করা উচিত ছিল, বুঝলে?”
পাশ ফিরে দেখলাম, আমার ঠিক পাশটায় চেয়ার টেনে বসে আছেন কুঞ্জ ভাই। উফফ! তার মানে হারিয়ে যাননি! দিদি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “মাথায় কী ঘুরছে রে? বলে ফেল তো!”
উনি ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। হাসি থামিয়েই বললেন, “বাড়ির মুরুব্বিরা সবাই পারে না আজই আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। কীভাবে যে ফিরলাম ওখান থেকে! উফফ! ছাড়ছিলই না!”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দিদি মুখে হাত রেখে হেসে উঠল। রজনী আপি বলল, “আগে বলবে না, ভাইয়া? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। আম্মু আছে না ওখানে? আম্মুর সামনে জাস্ট একবার তারা মনে করিয়ে দিক, মেয়ে বড়ো হয়েছে! বাকিটা আ’ল ম্যানেজ।”
আসিফ ভাই চোখ পাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এরপর তোমার আম্মু তোমাকে অন্য বাড়িতে দিয়ে আসুক, আর এদিকে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে মুড়ি খাই। তাই-না?”
আপি ভেঙচি দিয়ে বলল, “ব্যাপার নাহ। সবার পছন্দমতো বিয়ে করব। কাউকে হতাশ করব না। আমি ভীষণ বড়ো মনের মানুষ কি না!”
এরই মাঝে দিদি কুঞ্জ ভাইয়ের বাহুতে হালকা থাপড় দিয়ে বলল, “তুই বললে আজই দিয়ে দিই?”
কুঞ্জ ভাই তৎক্ষনাৎ আমার দিকে তাকালেন। চোখে চোখ মেলল, সময় থমকে গেল। ঠিক কতটা সময় এই নয়নে নয়নে সাক্ষাৎকার চলল, হিসেব করিনি। তবে আগে উনিই চোখ ফেরালেন। মাথা সামান্য নিচু করলেন, সেকেন্ড তিনেক পরপরই আবারও আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা আগে করা দিদির প্রশ্নটির উত্তর হিসেবে মাতালকরা সেই আওয়াজটা মেলে বললেন, “বউটা বাচ্চা। আমার রাগ বোঝে, অভিমান বোঝে না। আমার শাসন বোঝে, কিন্তু সেটা যে তাকে আগলে রাখার কারণমাত্র; তা বোঝে না। ও প্রেমিকা ম্যাটারিয়াল, দাম্পত্য জীবনের কী বুঝবে? সেই তো, দু’দিন যেতেই বিচ্ছেদের বাহানা খুঁজে নেবে, বুঝলে? তার চেয়ে ভালো, ও বড়ো হোক, আর একটু ম্যাচ্যিউরড হোক! ও প্রেমে পড়ার মতোই মেয়ে। অনেকটা অবুঝ, অভিমানী, প্রেমময়ী! অথচ বউদের তো অনেক দায়িত্ব; সংসার না বুঝলেও, স্বামীকে একটু বুঝুক। এইটুকু বড়ো অন্তত হোক। এরপর না হয়…”
মুহূর্তেই সবাই হৈচৈ করে উঠল। কেবল, কেবল মাত্র আমিই অবুঝ পানে তাকিয়ে রইলাম। ওঁর কথাটা আমার বোধগম্য হলো না। বউ কে? বাই এনি চান্স, উনি সেই ডায়েরিওয়ালির কথা বলছেন না তো? এটা ভাবতেই আমার রাগ হলো। আমার সামনেই আমার ‘না হওয়া সতীন’-কে নিয়ে কীভাবে বলছে এসব? মানে? লজ্জা-শরম সব গুলে খেয়েছে নাকি?
চোখের সামনে উড়ে বেড়ানো চুলগুলো এবার একটু বেশিই বিরক্ত করছে। বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে হাত উঠিয়ে চুল ঠিক করার পূর্বেই এক দমকা হাওয়া আমার মুখশ্রীতে এসে লাগল, বড্ড আদুরে ভাবে। চোখ দুটো বুজে এলো প্রশান্তিতে। হাওয়ার উৎস বোঝার জন্য চোখ খুলতেই সম্মুখে কুঞ্জ ভাইকে অদ্ভুত নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকটা ধুক করে উঠল। তড়িঘড়ি করে এদিক-ওদিল চাইলাম। নাহ! কেউ দেখেনি।
চলবে…#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২১|
প্রাদশা প্রহর। গ্রীষ্মের তপ্ততা যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে আছে। দিদির হাতে-পায়ে মেহেদী লাগানোর পরপর দিয়া আর সুপ্তির হাতেও লাগিয়ে দিয়েছি। এখন আমার হাতের অর্ধমৃত অবস্থা। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি চেপে ধরে, ছাদের রেলিঙের উপরটায় দু’পা তুলে চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। ইদে তো দিদি একাই সবটা সামলে নেয়, কিন্তু এখন! ধ্যাৎ! কেমন লাগে! গা’টা ম্যাচ ম্যাচ করছে। খিদেও পেয়েছে। কিন্তু আলস্যতা যে জেঁকে বসেছে আমার উপর! উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।
আড্ডা-গান চলছে সমানতালে। এরই মাঝে যোগ হয়েছে আরও কিছু মানুষ— পাশের বাড়ির ভাইয়েরা, আপুরা, দিদির মামার বাড়ির ভাই-বোন, আরও অনেকেই। খানিকক্ষণ আগেই সবাই আলাদা আলাদাভাবে গিয়ে রাতের খাবার সেড়ে এসেছে; আমি, রাহী আর আপি বাদে। ঘণ্টাখানেক হয়েছে, কুঞ্জ ভাই গেছেন। মিনিট পাঁচেক আগেই মেজমা এসে সুপ্তিকে নিয়ে গেলেন।
“নবু, এদিকে ঘোর তো!”
পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়ে রয়ে সয়ে ঠিক করে উঠে বসলাম। তাকিয়ে দেখলাম, হাতে ভাতের থালা নিয়ে কুঞ্জ ভাই বসে আছেন। রাহীকে আমার পাশে এসে বসতে বলে আপিকে বললেন, “অনেক রাত হচ্ছে, রজনী। যাও, খেয়ে এসো। কাকিমণি ডাকছে তোমায়।”
আপি বলল, “মেজমা ডাকছে!”
“হুম। খেতে।”
“আচ্ছা, যাচ্ছি। আসিফ খেয়েছে?”
কুঞ্জ ভাই মাথা দু’দিকে নেড়ে বলল, “মুরুব্বিদের মাঝে ফেঁসে গেছে, গিয়ে উদ্ধার করে একসাথে খেতে বোসো।”
আপি যেন এক প্রকার ছুটেই পালাল। কুঞ্জ ভাই রাহীকে ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়ে বললেন, “বেশি রাত জাগবি না। এক ঘণ্টা পরেই ঘুমোবি। কাল সকালে উঠতে হবে।”
রাহী চিবাতে চিবাতেই বলল, “আচ্ছা, ভাইয়া।”
এরই মাঝে কুঞ্জ ভাই আমার মুখের সামনে খাবার আনতেই আমি মুখ পিছিয়ে নিলাম, এতে উনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে শুধালেন, “কী?”
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আড়চোখে তাকিয়েই বললাম, “আমার হাত আছে, আমি একাই খেতে পারি। এত আদিক্ষেতা দেখানোর কিছু নেই।”
কুঞ্জ ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কত খেতে পারবি, জানা আছে। হাতের যে অবস্থা! ফুপি আর ফুপাও ব্যস্ত, তোকে খাইয়ে দিতে পারবে না। চুপচাপ খেয়ে নে।”
আমি পূর্বের ভঙ্গিতেই বললাম, “খাব না।”
“কেন?”
আমার কাছে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, আমি ঈর্ষান্বিত। আমার পুরুষটা যখন আমারই সামনে পরনারীর প্রশংসায় মত্ত থাকে, তখন তার হাতের ছোঁয়াও যেন জ্বলন্ত অগ্নি-কাঠ লাগে। লাগবে না সেই পুরুষ, যে আমার হয়েও আমার না। আংশিক কিছুতে তৃপ্ত না আমি। আর অতৃপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই ঢের ভালো।
আমার মুখ থেকে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না উনি। এরই পূর্বে মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলে এনে বললেন, “পাশের জন তোর বেস্টফ্রেন্ড হলেও, আমার আপন ছোটো বোন। সিন ক্রিয়েট না করে চুপচাপ গিলে ফেল।”
একবার রাহীর দিকে তাকালাম। দু-হাত ভর্তি মেহেদী। ডান হাতে সদ্য লাগানো আর বাঁ হাতেরটা শুকনো, সেই শুকনো হাত দিয়েই ফোন চাপছে, কানে হেডফোন লাগানো। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকালাম, এই মেয়েটা হেডফোন কখন লাগাল?
কুঞ্জ ভাই আমার অবাক হওয়ার ছোট্ট হা-টাতে ভাত পুড়ে দিলেন। আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম ওঁর দিকে। এতে যেন ওঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের মতো খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছেন।
খাওয়ানোর মাঝেই ওখানে খালামণির আগমন ঘটল। ধীরপায়ে ছাদের কর্ণারের এদিকটায় একদম আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি বিষয়টা বুঝতে পারার পরপরই বুক ফেটে একটা অশ্রবণীয় চিৎকার বেরিয়ে এলো— “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।”
খালামণি একটা চেয়ার টেনে আমার কাছে বসতেই বলে উঠল, “বাহ! কুঞ্জ! কী সুন্দর দুই বোনকে খাইয়ে দিচ্ছ!”
কুঞ্জ ভাই কথাটা শুনতেই থালা থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন বড্ড অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে, ওঁর চাহনিতে বিষয়টা বোধগম্য হলো আমার। ভেতর থেকে ‘নায়ায়ায়ায়ায়া, এএএএ হতেএএএএ পারেএএএ নায়ায়ায়ায়া’ এর সাথে বেরিয়ে এলো বিষম। রাহীর পাশ থেকে পানির বোতলটা দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে দিলেন উনি। আমি পানি খেতে খেতে লক্ষ করলাম রাহীর ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে।
“কী এত ভাবো, খাবার সময়? একটু শান্তিমতো খাবে না? এখনই তো খাবার গলায় আটকে যাচ্ছিল!”
বিপরীতে কেউ কিছু বলল না। তবে আমার খুউব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘তোমার জন্যই তো হলো! আমার কী দোষ? এভাবে যাকে তাকে ভাই বানিয়ে দেবার কোনো মানে আছে, হু? আমাকে ওঁর বোন নয়, বলো— বউ। বুঝলে?’
কিন্তু বলার সুযোগটা না দিয়েই খালামণি আবারও বলে উঠল, “কুঞ্জ তো খাইয়ে দিচ্ছে তোমাকে। তুমি বরং খেতে খেতে আমায় মেহেদী লাগিয়ে দাও দেখি।”
এই ভয়টাই তো পাচ্ছিলাম। খালামণিকে ‘না’ বলতে পারছিলাম না। তাই তো মেকি হাসি দিলাম তার দিকে তাকিয়ে। ওরপরই কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলাম চোখ দ্বারা।
কুঞ্জ ভাই ঝটপট খাওয়ানো শেষ করে বললেন, “না না, মামনি। ও নয়। আজ তো তোমাকে মেহেদী আমি লাগিয়ে দেব।”
খালামণি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “তুমি পারো?”
“অবশ্যই। ভুলে গেছ, কুঞ্জ মাল্টিট্যালেন্টেড!”
“বেশ বেশ! দাও তবে। এই যে, হাতের কনুই দেখছ না? এর উপর থেকে শুরু করবে। আর তালুতে মানডালা করবে। আঙুলগুলোর প্রথম কর ফিলআপ করে দেবে। আর এইখানটায় ‘N’ লিখে দেবে। তোমার ফুপার নামের ফার্স্ট লেটার। ঠিকাছে?”
কুঞ্জ ভাই এতসব বুঝলেন কি না— জানা নেই। সামান্য ঘাড় নেড়ে বললেন, “আমি ফ্লাওয়ার অ্যান্ড টাউন ডিজাইনের মাঝে হালকা ন্যাচার মেশাতে বেশ ভালো পারি। দেখতেও ভালো লাগে। দিয়ে দিই?”
এরকম ডিজাইনের নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি, ঠিক তেমনই খালামণিও কোনোদিন শোনেনি। আমি তার মুখভঙ্গি দেখে যতদূর বুঝলাম, তার কাছে এই ডিজাইনটা বড্ড ইউনিক লেগেছে। অ্যান্ড অভ্যিয়েসলি, খালা আমার ইউনিক দেখাতে ভীষণ ভালোবাসে। তাই তো, খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে রাজি হয়ে গেল। এদিকে আমি আর রাহীতো বুঝলাম, ওঁর মেহেদী ডিজাইনটা; সেবছর ইদে এক্সামের প্রিপারেশনের জন্য যখন বাড়ি আসতে পারলাম না আমি আর রাহী, তখন কুঞ্জ ভাই এমনই এক ডিজাইন এঁকেছিলেন আমার হাতে। রাহীকে আমিই লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ডান হাতটায় ওর ভাই লাগিয়ে দিয়েছিল। এঁকেছিল— তিন পাপড়ির ফুল, জোঁকের মতো পাতা, ধানখেত, সূর্য, আকাশ, সাঁইসাঁই করে উড়ে বেরানো সুতোর মতো বাতাস, কয়েকটা দালান, ছয়-সাতটা দাগ দিয়ে বানানো চুলবিশিষ্ট একটা মেয়ের দড়িলাফ খেলার দৃশ্য, একটা মই (কী কাজে যে ধানখেতের মাঝে রাখা হয়েছিল, জানি না), সুতোর মতো প্যাঁচানো কিছু ছিল ( ডিএনএ-র ক্রোমোজম হবে), আর খালি জায়গাগুলোতে ছোট্টো ছোট্টো অসংখ্য ফোঁটা (খুব সম্ভবত এত ইউনিক ডিজাইনে আমার উপর যাতে নজর না লাগে, সেজন্য দেওয়া)। ভাবতেই পেট ফেটে হাসি পেল। কুঞ্জ ভাইয়ের সেই মহান কারুকার্য এখন দ্বিতীয় বারের মতো পরিলক্ষিত হতে যাচ্ছে। আহা! আনন্দ! মহানন্দ! তবে এখানে বেশিক্ষণ থাকা বিপজ্জনক, অতিদ্রুত প্রস্থান ঘটালাম।
___________
রাত বাড়ছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সবাই ছাদেই মাদুর পেতে রয়ে গেছে। কিন্তু আমি! আমি সেই যে নিচে নামলাম! আর উপরে গেলামই না। কেন যেন আর সেখানে যেতে ইচ্ছে হলো না। সর্বাঙ্গে তুমুলভাবে আলস্যতার রাজত্ব চলল।
খুব করে মনে পড়ল, ছোটোবেলার সেসকল কাণ্ড! ইশ্! কী জ্বালাতাম আমি কুঞ্জ ভাইকে! রাহী হচ্ছে ভীতু আর পড়াকু মেয়ে। ওর কাজ সারাটাক্ষণ রুমবন্দি হয়ে নিঃশব্দে পড়াশোনা করা। কিন্তু আমি! একগুঁয়ে হলেও, কিছু মানুষের কাছে খুবই বাচাল, অতি চঞ্চল, দুষ্টুমিতে পারদর্শী আর শ্যেইমলেস একটা মেয়ে। লাস্ট বিশেষণটি কার দেওয়া, এটা নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই?
ছেলেবেলায় আমি খুব, খু-ব বেশিই অগোছালো ছিলাম। আর কুঞ্জ ভাই ছিলেন একদম আমার বিপরীত। আমি যতবার মণির বাসায় যেতাম, ততবারই আমার পদার্পণ হতো কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে। আর সব সময়ই সেই রুমে ঢুকে একটা কাজই করতাম! এলোমেলো!
আমার বের হবার পর যেই রুমে ঢুকত, সেই বিরক্তির শীর্ষে চলে যেত। কুঞ্জ ভাই এই নিয়ে আমাকে কখনই কিছু বলতেন না। খুব আগলে রাখতেন কি না! সেজন্যই তো তার উপর পিছলে গেছি। আর উনি যে কখন অন্য নারীতে মত্ত হলেন, তা ভাবনায় রাখার সময় পাইনি।
ভাবতে ভাবতেই হাসি-খুশি মুখটা উদাস হয়ে গেল।
“উফফ! ভেবেছিলাম অলসরানিটা ঘুমিয়ে গেছে। যাক বাবা! জেগে আছিস।”
আওয়াজটা কর্ণে পৌঁছতেই সর্বাঙ্গে ভালো লাগা ছেয়ে গেল। এই মুহূর্তে ওঁকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। পাশে কুঞ্জ ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। উনি পা চালিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বাহুতে ধরে টেনে নিয়ে বসালেন খাটে। উনি হাতের মেহেদীকোণ দিয়ে আমার ডান হাতের তালুতে মেহেদী লাগাতে লাগলেন। আমি জানি, উনি কেমন লাগাবেন। তবুও আজ বাঁধা দিলাম না। এক দৃষ্টিতে কেবল ওঁকে দেখে যেতেই লাগলাম।
বড়ো বড়ো চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবসময় ক্লিন শেভ করা থাকেন। তবে আজ গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। এতেও ভালো লাগছে। বাতাসে চুলগুলো খুব জ্বালাচ্ছে ওঁকে। কিছু না ভেবেই অন্য হাতটা দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিলাম। উনি আমার হাত থেকে দৃষ্টি সরালেন। আমার চোখে চোখ স্থির রেখে অধর প্রসারিত করে সামান্য হাসলেন। আমিও মুচকি হাসলাম।
মিনিট বিশেক যেতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দেখো তো, কেমন হচ্ছে?”
আমি ওঁর কথা শুনে হাতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। মুহূর্তেই বিস্ফোরিত নেত্রে ওঁর দিকে তাকিয়ে জোরেসোরেই বলে উঠলাম, “শিখলেন কবে?”
উনি মাথা চুলকে হাসলেন। নত মাথা থেকে দৃষ্টি আমার চোখের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখে বললেন, “যাতে তাকে কোনোবার নিজের মেহেদী নিজে লাগাতে না পারার জন্য আফসোস করা না লাগে, এজন্য সেবারই শিখে রেখেছিলাম।”
আবারও হাতের দিকে তাকালাম। কী সুন্দর!
চলবে…