এক জোড়া নুপুর পর্ব -০৪

#এক_জোড়া_নুপুর (৪)

প্রায় তিন মাস আগে শাহানের সাথে দেখা হয়েছিল নির্বার। ঐ যে আইসক্রিমের দোকানটাতে। এরপর আর দেখা হয় নি। সময় যেন থমকে গিয়েছে। আনমনেই মানুষটার পথ ছেয়ে বসে আছে সে। অথচ মানুষটার দেখা নেই। হেরার কাছ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছে এতে করে তিন মাস ধরেই ঢাকায় আছে শাহান। বাড়ি ফিরে নি। কেন ফিরে নি এই প্রশ্নটা করতে পারছে না বিধায় ওর কান্না পাচ্ছে। ছেলেটার মুখটা ভীষণ মনে পড়ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাড়ি এসে এক চোট কান্না ও করল। তারপরই এল সোশ্যাল মিডিয়াতে। বহু দিন আগেই শাহানের সাথে ফেসবুকে এড হয়েছিল। কিন্তু ম্যাসেজ দেওয়ার মতো সাহস আসে নি। অধৈর্য হয়ে সে লিখল।
“কেন আসেন না আপনি? জানেন কত দিন ধরে আপনাকে দেখি না।”
পর মুহূর্তেই লেখাটা মুছে ফেলল। তার একাউন্টটা ফেইক নামে দেওয়া। তাছাড়া এমন ম্যাসেজ লেখাও যাবে না। তাই ছোট করে একটা ম্যাসেজ দিল। মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা গেল রিপলে আসল না। শাহানের পুরনো ছবি গুলো দেখতে লাগল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই বিশাল চাঁদটা নজরে এল। শাহানের আকাশেও নিশ্চয়ই চাঁদ উঠেছে। এমনই একটা চাঁদ। সে অনেকটা সময় চাঁদ দেখল। হাল্কা বাতাস আসছিল। সেই বাতাসেই চোখটা লেগে গিয়েছে। সেই সময়টায় ম্যাসেজের টুং শব্দ এল। ধরমরিয়ে উঠল নির্বা। এক বুক আশা নিয়ে ম্যাসেজ দেখতে গিয়ে আশাহত হলো। ওর ফেসবুক ফ্রেন্ড টেক্সট পাঠিয়েছে। সীন করেও রিপ্লে করল না। ডাটা অন রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে চমক পেল। শাহান রিপ্লে দিয়েছে! ছোট একটা হ্যালো ম্যাসেজ। এতেই নির্বা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল। সময় দেখল রাত তিনটে সাতাশ মিনিট। ওর এবার মন খারাপ হলো। মানুষটা সেই কখন রিপ্লে দিয়েছে। আর সে কিনা এখন দেখল! রাগ দুঃখ কষ্ট নিয়েই ম্যাসেজ লিখল।
“ঘুম কেমন হলো?”

সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লে আসল। “ভালোই। খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই আমার জীবনে।”

শাহানের প্রহেলিকা কথাবার্তা বুঝল না নির্বা। টুকটাক কথা হলো দুজনের। শাহান যখন অফলাইন হলো নির্বার তখন মন খারাপ। মানুষটা অপরিচিত ভেবে ম্যাসেজ করেছে। এর মানে নিয়মিত অনেক অপরিচিত মানুষের সাথে যোগাযোগ হয় শাহানের। এটা ভাবতেই নির্বার কান্না এল। এত দুঃখ কেন লাগছে?

শাহান প্রায় পাঁচ মাস পর বাড়ি ফিরেছে। কবে নাগাদ ফিরেছে নির্বা জানে না। তবে তাদের দেখা হলো পাঁচ মাস পর। মেলার মধ্যে। প্রতি বছরই বার্ষিক মেলা আয়োজিত হয়। নৌকা বাইচ উপলক্ষ্যে। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নৌকা বাইচ দেখার সময়ই শাহানকে দেখল সে। এত দিন পর দেখে মেয়েটা চোখ সরাতেই পারছে না। মনে হচ্ছে সময়টা থামিয়ে দিয়ে মন প্রাণ ভরে দেখে নিতে। শাহানের শ্যামবর্ণ মুখটা অনেকটা মায়াবী। তার জুগল ভ্রু আরো বেশি আকর্ষণীয়। নির্বা নিষ্পলক তাকিয়ে। এদিকে বাইচ শেষ হয়ে গেছে। সকলে হৈ হৈ করছে। শাহান ও চলে যাচ্ছে। নির্বা ছুটে এল। কেন এল জানে না। এমনকি কি বলবে সেটাও জানে না। প্রায় এক হাত দূরে এসে কথাটা খেয়াল হলো। নির্বার শরীর কাঁপতে লাগল। কি করতে যাচ্ছিল সে?
শাহান বন্ধুদের সাথে মশগুল বিধায় ওকে দেখল না। নীরবে হেঁটে চলেছে। একটু পর পর হাসছে। নির্বার দু চোখ ভরে উঠল। কেন এত অপরাগতা তার মাঝে?

চটপটির দোকানটায় এত ভীড়। নির্বা ও তার বান্ধবীরা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে। প্রায় ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে গেল। শাহান ও তার বন্ধুরা এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। চুমকি ডাক দিল।
“শাহান ভাই,কেমন আছেন?”

“ভালো। তোমাদের কি খবর?”

“ঠিক ঠাক। কোথায় যাচ্ছেন?”

“বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।”

“চটপটি খাবেন?”

“তোমরা খাও। সন্ধ্যায় আমাদের পিকনিক আছে। তাই খাওয়া দাওয়া অফ রেখেছি।”

শাহান হেসে চলে গেল। নির্বা বড়ো অশান্ত। আর একটু থাকল না কেন? মানুষটা ঝড়ের মতো আসে ঝড়ের মতোই পালিয়ে যায়!

বার্ষিক পরীক্ষাটা যেন চোখের পলকে হয়ে গেল। গুড স্টুডেন্ট নির্বার রেজাল্ট বরাবরের মতোই ভালো। মা বাবা ভীষণ খুশি হয়ে মিষ্টি বিলি করেছেন। নির্বা এই সুযোগে তার জন্য একটা ফোন চাইল। কতদিন মায়ের ফোন লুকিয়ে চালাবে? ভালো রেজাল্ট করাতে বাবা দ্বিমত করেন নি। পরদিনই বাজার থেকে মেয়ের জন্যে স্মার্টফোন এনে দেন। সেটা পেয়ে যে নির্বার কি খুশি। সে সদ্য জন্ম নেওয়া প্রজাপতির মতো উড়তে লাগল। তার এই খুশি দেখে হাসলেন সুমিতা। ডেকে এনে মাথায় তেল দিয়ে দিলেন। তেল নিয়ে নির্বার আবার ভীষণ সমস্যা। সে চুলে তেল দিতে চায় না।
“ও মা, তেল কেন দিয়ে দিলে। আমার ভীষণ চুলকোয়।”

“দু তিন ঘন্টা রেখে শ্যাম্পু করে নিস।”

নির্বা উঠে এল। বাড়ির পাশেই বিশাল ধানের ক্ষেত। শীতের মৌসুম হওয়ায় ক্ষেতে সর্ষে লাগানো হয়েছে। হলুদ হয়ে আছে চারপাশ। ক্ষেতের আল ধরে ছুটতে লাগল নির্বা। কিছু ফুল ছিঁড়ে ছিটিয়ে দিল উপরের দিকে। এলাকার কিছু ছেলে গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করছিল। নির্বার ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু মা করতে দেন না। আজ সুযোগ পেয়েছে বিধায় বেশ খুশি হলো। গুলতি নিয়ে নিশানা করল, একটুর জন্যে বেঁচে গেল পাখিটা। নির্বা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ভালো লাগছে বেশ। পর পর আরো কয়েকটা নিশানা করল। কিন্তু কোনোটাই লাগল না। শেষবারের মতো নিশানা করতেই একটা কণ্ঠ শুনতে পেল। সম্ভবত কারো শরীরে লেগেছে। নির্বা সহ বাকি সব ছেলেরাই ভো দৌড়। নির্বা এতটাই বেখেয়ালে ছিল যে সামনে থাকা বিশাল ব্যক্তিটিকে নজরেও পড়ল না। সে একে বারে তার উপর গিয়ে পড়ল! চটপট উঠে পড়ল মেয়েটি। সামনের ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং শাহান! ওর কান গরম হয়ে এল। শাহান নিজের শরীর পরিষ্কার করছে।
“দৌড়াচ্ছ কেন?”

“জী,এমনি।”

“তাই বলে মানুষ দেখবে না?”

“সরি।”

“আর একটু হলে তো আমায় মে রেই ফেলতে।”

লজ্জায় লাল হয়ে এল নির্বা। মাথাটা নিচু করে বলল, “সরি আমি একদমই খেয়াল করি নি।”

“এখন সরি বলেই বা কি?”

চিন্তিত হয়ে পড়ল নির্বা। শাহানের কণ্ঠটা কিছুটা রুক্ষ। এমন কেন শোনাচ্ছে? খুব রেগে গেল কি? ওর করুণ অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসল শাহান। তারপর বলল, “পাগল মেয়ে। পরের বার সাবধানে দৌড়াবে।”

শাহান চলে গেলেও নির্বা তাকিয়ে রইল। তার মন প্রাণ কোথাও হারিয়ে গেছে। একটু আগে ছেলেটার সাথে স্পর্শ লেগেছে তার! এ ও সম্ভব?

পুরো এক সপ্তাহ বাসা থেকে বের হলো না নির্বা। এমনকি স্কুলেও গেল না। তার মনে শুধু শাহান ঘুরতে লাগল। একদিন সকালে মা টেনে তুললেন। ভয় দেখালেন ফোন নিয়ে যাবেন বলে। তাই নির্বাকে যেতে হলো। ওর মনের ভেতর অসুখ করেছে। সেই অসুখটা কাউকে দেখাতেও পারছে না। এ যে কি পরিমাণে যন্ত্রণা! স্কুলে গিয়ে হেরার মুখোমুখি হলো। লজ্জায় লাল হয়ে গেল মুখ্রশী। ওর এই অনাকাঙ্ক্ষিত লজ্জার হেতু বুঝতে পারল না হেরা। মেয়েটার মাথাটা নষ্ট হয়ে গেল না তো?

“এই নির্বা, শোন।”

“শুনছি বলতে থাক।”

“তোকে হেডস্যার ডাকছেন।”

“হেডস্যার কেন ডাকছেন?”

“আমি কেমন করে বলব! গিয়ে দেখ।”

ছেলেটা কথাটা শেষ করেই চলে গেল। নির্বা ভয় নিয়ে হ্যাড স্যারের কক্ষে এলেন। এত দিন স্কুলে না আসার জন্য দরখাস্ত তো দিয়েছেই। তবে কেন ডাকলেন?
“স্যার আসব?”

“হ্যাঁ আসো। শরীর কেমন এখন?”

“জী ভালো।”

“শোনো,তোমার জন্য দারুণ একটা নিউজ আছে।”

“আমার জন্য!”

“হুম। তুমি যে স্টেজে গান গেয়েছিলে সেই গান পছন্দ হয়েছে সিদ্ধান্ত হকের। সে অফার করেছে একটা গানে কো সিঙ্গার হিসেবে গাওয়ার জন্যে। ভাগ্য ভালো হলে হয়ত পরবর্তীতে সিঙ্গার হিসেবেও গান গাইতে পারবে। বলা যায় না কি হয়।”

কথা গুলো নির্বার বিশ্বাসই হচ্ছে না। সে গান কে ভলোবাসে। তাই মোটামুটি চর্চা করে। তাই বলে প্রফেশনালি গান গাইবে স্বপ্নেও ভাবে নি! নির্বার শরীর থরথর করে কাঁপছে। হেড স্যার একটা খাম দিলেন। যেটাতে ডিটেলস দেওয়া আছে। বাড়ি ফিরে এ খবর দিতেই নির্বার মা বাবা ভীষণ খুশি হলেন। মেয়ের সাফল্য দেখে চোখে জল চলে এল সুমিতার।
“আমার লক্ষী মা।”

“ভয় হচ্ছে মা।”

“কেন? ভয় পাওয়ার কি আছে।”

“যদি আমার গান ওদের ভালো না লাগে।”

“ভালো কেন লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। তাছাড়া সরাসরি কো সিঙ্গার হিসেবে গাইতে পারছিস এটাই বা কম কিসের? ভাগ্যে থাকলে আরও ভালো কিছু হবে।”

নির্বা কিছু বলল না। তার ভেতরটা কেমন করছে। এ যেন স্বপ্ন। একটু পরই মা টেনে তুলবেন। আর নির্বার সবটুকু মোহ মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে।

চলবে……
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**গল্পটায় আমি ভিন্ন কিছু দেওয়া চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ অবধি না পড়ে কেউ বাজে মন্তব্য করবেন না।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here