#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
২১.
চারদিকের বিয়ের আমেজটা অনেকটা কমে গেছে।কালকের ইভেন্টের পর থেকে আর কোনো কোলাহল থাকবে না।চতুরদিকে নিকষকালো অন্ধকার।ভাদ্রের চাঁদশূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেহেনূর।রোশনি আর রাওনাফের বিয়েটা খুব সুন্দর মতোই সম্পূর্ণ হয়েছে।গতকালের খেলার নিয়ম অনুযায়ী মেহেনূর বলেছিল, আজকে অর্কের টিমকে যেকোনো একটা টাস্ক দিবে।কিন্তু মেহেনূর আজ সকাল থেকে এখন অবধি কোনো টাস্ক তো দিলোই না রবং একবারো সে এ কথা মনেও করে নি।তবে তনিমা বিষয়টি লক্ষ্য করে।ভাবে হয়তো মেহেনূরের মনে নেই।কাজী যখন বিয়ে পড়াচ্ছিল তখন তনিমা মেহেনূরকে খেলার কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়।কিন্তু মেহেনূরের ভাবাবেগে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না।উল্টো মিষ্টি হেসে বললো,”আমি চেয়েছিলাম খেলাটায় আমরা জিতি।খেলায় জেতার পর উনাদের কোনো টাস্ক দিবো বলে খেলি নি।আর আমি উনাদের কি-ই বা করতে বলবো?উনারা সবাই আমার থেকে কত বড়।আমি কাল এমনিতেই বলেছিলাম,যে আজকে বললো।আসলে কালকে তোমরা সবাই আমাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিলে যে, তখন আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।তাই আজকের কথা বলেছিলাম।তবে তোমরা হচ্ছো উনাদের বন্ধু, তোমরা তাঁদের যেকোনো কিছু দিতে পারো,বলতে পারো।কিন্তু আমার সাজে না।” তনিমা বুঝতে পারে মেহেনূর অর্কদের কোনো কিছু বলবে না।ওর শুধু লক্ষ্য ছিল খেলাটায় জেতা আর অর্কদের হারানো।তনিমা কলিকেও মেহেনূরের বলা কথাটা শেয়ার করে।তখন কলিও বললো, মেহেনূরের জন্যই ওরা কালকে জিততে পেরেছিল।এখন মেহেনূরই যখন আগ্রহী নয় সেখানে ওদের এতটা আগ্রহ না দেখানোই ভালো।কলিও তো মেহেনূরেরই মতো।শান্তিপ্রিয় মানুষ।এত হৈচৈ করতে পারে না।তবে কলির এই গুমোট স্বভাব অন্য কারণে।কিন্তু তনিমার খুব ইচ্ছে ছিল অর্কের টিমকে একটু নাকানিচুবানি খাওয়ানোর।সুযোগ পেলেই অয়ন আর দিহাদ খুব জ্বালায় ওকে।অর্ক ডিরেক্ট কিছু বলে না কিন্তু ওরা যখন তনিমাকে খেপায় তখন অর্ক চুপ থাকে।আর চুপ থাকা মানেই বিপক্ষ দলের লোক!
– তুই কি চাস?আমি মরে যাই?
চাপা করুণ স্বরে বলা কথাটা কানে আওয়াজ হতেই চমকে উঠলো মেহেনূর।তবে ভয় পেয়ে নয়।ছাদে অন্যকারোর অস্তিত্ব আছে,এটা ভেবে।মিনিট দুয়েক আছেই ছাদে এসেছে ও।ঘুমানোর আগে,যদি আকাশে চাঁদ থাকে তাহলে চাঁদনী বিলাশ আর চাঁদ না থাকলে শুধু গগন বিলাশ করে মেহেনূর।এটা ওর নিত্যদিনের ঘটনা।যদিও আজ মেহেনূরের শরীরটা অনেক ক্লান্ত।একবার ভেবেছিল শুয়ে পড়বে।তাও অভ্যাসটাকে প্রশ্রয় দিয়ে আজও ছাদে এসেছে।এই অভ্যাসে ভীষণ ভাবে আসক্ত ও।নিশুতি পাখির মতো রাতের আধারে ডুবে থাকতে মন চায় ওর।চাঁদ তারাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের আকাশ দেখা আর রাতের খোলা আকাশের নিচে ফাঁকা রাস্তায় হাটা, ওর অনেকগুলো প্রিয় কাজের মধ্যে দুটি।
মেহেনূর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তে ফিরে গেলো,”তুই কি চাস?আমি মরে যাই” পরিষ্কার গলায় বলা কথাটা কোনো পুরুষ মানুষের।
– বল কি চাস?
মুখে হাসি ফুটিয়ে চটজলদি চোখ খুললো মেহেনূর।সত্যিই ছাদে কেউ আছে।পরিষ্কার কন্ঠটা আবার শুনতে পেয়েছে ও।হয়তো তারা দুজন আছে এখানে, নয়তো কেউ একজন কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।মেহেনূর এদিক সেদিক চোখ বুলালো।কিন্তু এত অন্ধকারে দৃষ্টি কোথাও স্থির করতে পারছে না।মেহেনূর ছাদে আসলে কখনো ছাদের লাইট দেয় না।কৃত্রিম আলো প্রখরতায় আকাশের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না।তাই মেহেনূর ছাদের লাইট দেয় নি।ঘর থেকে আসার সময় ফোনটাও সাথে নিয়ে বের হয় নি।ফোনটা সাথে থাকলে হয়তো প্রাণের অস্তিত্বের অনুসন্ধান করতে সহজ হত।মেহেনূর শুনেছে অন্ধদের ঘ্রাণশক্তি আর শ্রবণশক্তি নাকি প্রখর হয়।এই মুহুর্তে মেহেনূরের ঘ্রাণশক্তির প্রখর হওয়ার দরকার নেই।শুধু শ্রবণশক্তিটা একটু কাজ করলেই হলো।মেহেনূর শূন্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির রেখে কান খাড়া করলো।কারোর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করার স্পষ্ট আওয়াজ মেহেনূরের কানে এসে বারি খেলো।কান্নার শব্দ অনুসরণ করে পা টিপেটিপে এগোয় ছাদের দক্ষিণ পশ্চিম কোণ বরাবর।শব্দটা ক্ষীণ হয়ে যায়।অর্থাৎ ও ভুল দিকে যাচ্ছে।মেহেনূর পিছিয়ে যায় কয়েক কদম।এবার এগোয় সোজা পূব দিকে।
ছাদের এই পূর্ব দিকটায় মেহেনূর এখন আর খুব একটা আসে না।পাশেই তো অর্কের ব্যালকনি তারপরে রুম।ওইদিনের পর থেকে ছাদের পশ্চিম দিকটায় একমাত্র জায়গা করে নিয়েছে মেহেনূর।মেহরাব সাহেব মেয়েকে একটা দোলনাও বানিয়ে দিয়েছেন ওখানে।মেহেনূরদের দক্ষিণমুখী বাড়িটার মাঝখানে ছাদের সিঁড়ি।মেহেনূর ডানে বামে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে সোজা ছাদের পশ্চিম দিকেই চলে যায়।তখন খেয়াল করে নি ছাদে আরো কেউ আছে।মেহেনূর সর্পিল গতিতে এগোচ্ছে।সামনেই দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে।ছায়া অবয়ব বলে দিচ্ছে একজন ছেলে অপরজন মেয়ে।তবে মেহেনূর ঠিক চিনতে পারছে না কে বা কারা আছে এখানে।মেহেনূর দাঁড়িয়ে যায় তাদের কন্ঠস্বর আরেকটু খেয়াল করে শোনার জন্য।যদি চিনতে পারে।
– দেখ কলি, একদম কাঁদবি না।দশ মিনিট ধরে দেখছি শুধু কেঁদেই যাচ্ছিস।আরে ইয়ার কিছু তো বল।বল তুই কি চাস?মরে যাবো আমি?
মেহেনূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।ওর স্পষ্ট শুনতে পাওয়া পুরুষালী কন্ঠটি দিহাদের।তার বিপরীতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কলি।পর পরেই শুনতে পেলো কলির করুণ কন্ঠস্বর,
– আমি অনাথ একটা মেয়ে।শুনেছি,বাবা মা ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন।দুজনের পরিবার থেকেই কেউ তাঁদেরকে মেনে নেয় নি।বাবা মায়ের একজন কমন ফ্রেন্ড ছিলেন।তার মাধ্যমে চড়ুইভাতির সংসার পাতে এই অচেনা শহরে এসে।বাবা একটা প্রাইভেট জব করতে শুরু করেন।এখানে আসার আড়াই মাস পরেই জানতে পারেন তাঁরা বাবা মা হতে চলেছেন।বাবা মা খুব সুখী ছিলেন তাঁদের দাম্পত্য জীবনে।মায়ের গর্ভে আমার বয়স যখন নয় মাস তখন বাবা মারা যান৷ আমার জন্মের ঠিক একঘন্টা পরেই আমাকে একা ফেলে রেখে মাও চলে যায় না ফেরার দেশে।উনার ভালোবাসার মানুষটির কাছে।নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় একা রয়ে গেলাম।তখন মাহবুব আঙ্কেল যাকে তোরা আমার বাবা বলে জানিস উনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান।তিনিই বাবা মায়ের কমন ফ্রেন্ড ছিলেন।মাহবুব আঙ্কেল যেদিন আমাকে বাড়ি নিয়ে আসেন সেদিন আন্টি খুব রাগারাগি করেছিলেন।পরের সন্তানকে উনি কেন লালন পালন করবেন?ঠিকই তো আমাকে উনি কেন লালন করতে যাবেন,যে জায়গায় আমার নিজের বাবা মা’ই আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে।অবশ্য তখন তাঁদের সংসারেও টানাপোড়ন।নিরুপায় হয়ে মাহবুব আঙ্কেল আমাকে রেখে আসেন একটা অনাথ আশ্রমে।প্রত্যেকদিন আমাকে দেখে আসতেন।আস্তে আস্তে যখন বুঝতে শিখি তখন মা বাবার কথা মনে করে খুব কান্নাকাটি করতাম।যখন আশ্রমের বাচ্চাদেরকে ওদের আত্মীয় স্বজনরা দেখতে আসতো তখন আমিও পথ চেয়ে বসে থাকতাম।এই বুঝি আমার মা এসেছে,ওই তো আমার বাবা আসছে।কিন্তু কেউ আসতো না।আমি তখনও জানতাম না যে,আমার মা বাবা মারা গেছেন। মাহবুব আঙ্কেলও তখন যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন।মাসে একবার নয়তো পনেরো দিনে একবার আসতেন।তারও তো ব্যস্ততা থাকত।যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে হবে তখন আঙ্কেলের কাছে খুব কান্নাকাটি করে বলি, আমাকে বাহিরের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য।তখন জানতে পারলাম আমি অনাথ।এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই।আঙ্কেল আমাকে উনাদের মেয়ের পরিচয়েই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।বছর দুয়েক পরে অনাথ আশ্রম থেকে আঙ্কেল আবার তার বাড়ি নিয়ে যান আমায়।অবশ্য আমিই জোর করেছিলাম।কি করতাম বল?কখনো তো বাবার আদর পায় নি,মায়ের ভালোবাসা পায় নি।আঙ্কেলের মধ্যে আমার বাবার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতাম।ভাবতাম আমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমাকে এইভাবেই আদর করতেন।হয়তো তার আদরের মাত্রা কয়েক লক্ষ গুণ বেশি হতো।বাসায় আন্টি জানতেন না যে আমি তাদের পরিচয়ে পড়াশোনা করছি।এটা জানার পর তিনি আবার চেঁচামেচি করেন।ভাবেন, পরিচয়ের সাথে আঙ্কেল হয়তো আমার খরচও বহন করেন।কিন্তু আন্টি এটা জানতে না যে,আমি তাঁদের বাড়ি থাকতে গেছি ঠিকই কিন্তু আমি আমার নিজের উপর শর্তও রেখেছি।”আমার যাবতীয় খরচ নিজেই বহন করবো আর কয়েকদিন পর থেকে বাসা ভাড়াও দিবো।যখন রান্না করতে পারবো তখন থেকে নিজের খাবার নিজেই রান্না করবো।বিনিময়ে আমার একটা পরিবার চাই, আমি শুধু তাদের সাথে থাকতে চাই।”আমার এ কথায় শুনে আঙ্কেল রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।আর আন্টিও আর রাগারাগি চেঁচামেচি করেন নি।ছাত্রী হিসেবে ততটাও খারাপ ছিলাম না।ক্লাস সেভেন থেকে টিউশনি শুরু করি।আস্তে আস্তে উপরের ক্লাসে উঠছি আর টিউশনির পরিমাণও বাড়িয়ে দিচ্ছি।তখন নিজের রান্নাটাও নিজে করতে শিখে গেছি।স্কুল শেষ করলাম।তোরা হুটহাট আমার বাসায় চলে যেতি।এতে আন্টি বিরক্ত হতেন।যদিও আঙ্কেলের সামনে কিছু বলতেন না। তাও আমি ঠিক বুঝতে পারতাম।তাই বাসায় আন্টিকে বলে রাখতাম, আমার বন্ধুরা বাসায় আসলে তাদেরকে যাতে আপ্যায়ন করে।খরচের পরিমাণটা আমি পরে দিয়ে দেবো।কলেজ শেষ হলো এডমিশন যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর জীবনের মায়া ছেড়েই দিয়েছিলাম।বাসায় টুকটাক আন্টিকে সাহায্য করা,নিজের সব কাজ গুছিয়ে আবার নিজের জন্য রান্না করা,নিজের পড়াশোনা,টিউশনি করতে যাওয়া , নিজের টিউশন, ভার্সিটি সব মিলিয়ে আমি কুলিয়ে উঠতে পারতাম না।মাস শেষে হিমশিম খেতে হতো।সারাদিন এটা ওটা করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরার পর মুখে মিষ্টি হাসিটা রেখেই কলিং বেলটা চাপতে হতো।বালিশে মুখ গুজে কত রাত কেঁদেছি।অসুস্থ হয়েছো?ঔষধ খাও ভালো হয়ে যাবে।সবাই শুধু এই কথাটাই বলতো।কিন্তু তারা তো আর বুঝতো না,সব রোগ ঔষধে ভালো হয়ে যায় না। কেউ এটা বলতো না,কলি তোর কি হয়েছে?শরীর খারাপ লাগছে?আয় আমার কোলে মাথা রেখে শুইয়ে থাক,মাথায় হাত বুলিয়ে দেই আরাম পাবি।কে বলবে?কে করবে এইরকম? যাদের করার কথা তারা তো স্বার্থপরের মতো আমায় ছেড়ে চলে গেছে, সেই কবেই।জীবনের এত বাস্তবতা আর নিতে পাচ্ছিলাম না।মনে হতো সব ছেড়ে চলে যাই বাবা মায়ের কাছে।বাবা মা ছাড়া অনেক ছেলে মেয়েই বড় হয়েছে,হয়।তবে ওদের কাছের অন্য মানুষগুলো ওদের পাশে থাকে।ওরা জীবনে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পায়, ভরসা পায়।কিন্তু আমার তো সেই জায়গাটাই ছিল না।আপন মানুষ গুলোর কেউই ছিল না আমার পাশে। তাহলে আমি কেন বেঁচে থাকতাম বল?আমার তো কোনা মায়া কোনো পিছুটানও ছিল না।আত্মহত্যা পাপ জেনেও চেষ্টা করেছি বহুবার!তবে মাঝে মাঝে মনে হতো জীবনের মানেটা না হয় নিজেই খুঁজে নেই।পৃথিবীটা খুব সুন্দর।চাইলেই এখান থেকে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু ফিরে আসা তো যায় না।মনকে বুঝাই নিজের জন্যই না হয় বেঁচে রইলাম।শেষে স্কলারশিপ পেয়ে পড়াটা কমপ্লিট করলাম।এত দৌড়ঝাপ, উত্থান-পতন, অনেক সময় না খেয়ে,কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েও আমি দিব্যি ছিলাম,আছি।এই তো আমি!
দিহাদ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে ওর।কলি অনাথ, এটা শোনার পরেও এতটা ধাক্কা লাগে নি,যতটা না কলির ভয়ংকর জীবনের গল্প শুনে লেগেছে।কলি চুপচাপ থাকতো সবসময়ই,ওরা ভাবতো কলি স্বভাবতই এমন।ওরা কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি,কলির জীবনের গল্পটা এতটা নির্মম।মানুষ এতটা স্বার্থপর কি করে হয়?সবাই শুধু সুযোগ নিতে চায়। স্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে মেহেনূরকে।মেহেনূর খুব শক্ত মনের,কথায় কথায় তো দূর!অতি সহজেও ওর চোখে পানি আসে না।সেই বাধ্যগত অশ্রুর দু ফোঁটা আজ অবাধ্য হয়ে ঠেলেঠুলে ওই নীলাদ্রি চোখ বেঁয়ে বেড়িয়ে এসেছে।কলির বলা প্রত্যেকটা কথা মনে দাগ কেটেছে গভীরভাবে।মেয়েটা কত দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে দিব্যি মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘুরে বেডায়।দেখলে বুঝায় যায় ওর অতীত আর বর্তমানটা এতটা শোচনীয়।চটজলদি হাতের পিঠে চোখ মুছে নেয় মেহেনূর।মুখ ফুলিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে সংযত করে মেহেনূর।কলি দিহাদকে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
– আমার জীবনের হিসাবটা মিলবার নয়।কারণ আমার জীবনের অংকটা অন্যদের মতো সরল নয়।আমি চাই না আমাকে কেউ করুণা করুক।তাই এই কথাগুলো কখনো কাউকে বলি নি।জন্মের পর হয়তো নিঃসঙ্গতাই আমার ভবিতব্য ছিল।জীবনের অর্ধেক সময় তো পার করেই দিয়েছি বাকি জীবনটাও না হয় এইভাবেই কাটিয়ে দেবো।বেশ তো আছি!কোনো চিন্তা নেই ভাবনা নেই, আশা, আকাঙ্ক্ষা,চাওয়া-পাওয়া কিচ্ছু নেই।
– আর ভালোবাসা?সেটাও কি নেই?আমি কি তোর কাছে তোর অতীত জানতে চেয়েছি।আমি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছি।আমার আব্বু আম্মু বিদেশে অথচ আমি এখানে।তাঁদের একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আমি তাঁদের সাথে না থেকে এখানে কেন পড়ে থাকি?তুই কি বুঝিস না? নাকি বুঝেও না বুঝার অভিনয় করিস?
দিহাদ কলির দুইবাহুতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে।রাগে ওর চোখ রক্তজবার মতো লাল হয়ে গেছে।কপালের দুইটা রগ ফুলে গেছে।চোয়াল শক্ত করে কলির দিকে তাকিয়ে আছে দিহাদ।কলি ওর বাহুদ্বয় থেকে দিহাদের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
– আমার কিচ্ছু বুঝার নেই দিহাদ।পথ ছাড়,যেতে দে আমা…….
দিহাদ কলিকে শক্ত করে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।আকস্মিক দিহাদের এহেন কান্ডে কলি হকচকিয়ে যায়।চোখ খিঁচে বন্ধ করে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নেয়।জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের সংস্পর্শে অপ্রীতিকর ঘটনা, অস্বস্তি লাগছে খুব।দিহাদ কাতর গলায় বললো,
– তোকে চাই আমার।আমি তোকে ভালোবাসি।তোকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না কলি,মরেই যাবো আমি।বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে।আমার শুধু তোকেই চাই,শুধু তোকেই চা…..
– দিহাদ,ছাড় আমায়।কেউ দেখতে পেলে খারাপ ভাববে।
– দেখতে পাক!ভাবুক খারাপ!ছাড়ার জন্য তো তোকে আমি ধরি নি।আমি তোকে ভালোবাসি,তাই তোকে ধরেছি।
– দিহাদ পাগলামি করিস না।ছাড় আমায়।
– ছাড়বো না।
– ছাড় বলছি।
– আগে বল তুইও আমাকে ভালোবাসিস না?বল তুই আমায় ভালোবাসিস না?
– হ্যাঁ ভালোবাসি।
কলি এক ঝটকায় দিহাদের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফের বললো,
– ভালোবাসি আমি তোকে।তবে শুধু একজন বন্ধু হিসেবে।তুই আমার কাছে এর থেকে বেশি কিছুই না।শুধু একজন ভালো বন্ধু তুই আমার।
– কলি এইভাবে বলিস না।কষ্ট হয় আমার।সহ্য হয় না রে।আমি কিন্তু সত্যিই মরেই যাবো!
– মরে যা তুই!চলে যা এখান থেকে।জীবনেও আর আমার চোখের সামনে আসবি না তুই।
– বেশ!তবে তাই হোক।চলে যাচ্ছি আমি।যাকে চেয়েছি তাকে না পেলে এ জীবন রেখেই বা কি করবো আমি।চলে যাচ্ছি আমি,সারাজীবনের জন্য।এই মুখ তোকে আর দেখতে হবে না।
– দাঁড়ান দিহাদ ভাইয়া।
মেহেনূরের কন্ঠ শুনে দিহাদ কলি দুজনেই চমকে উঠে।দিহাদ ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো।মেহেনূর দেখে ফেলার আগেই অন্যদিক ফিরে চোখের পানিটা মুছে ফেলে।কলি অপ্রস্তুত হয়ে একটু সামনে এগিয়ে যায়।হাতের পিঠে চোখ মুখ মুছে খুব দ্রুততার সাথে।মেহেনূর এক পলক কলিকে দেখে নিয়ে দিহাদের দিকে তাকায়।দিহাদ এখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেহেনূর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় কলির দিকে।মেহেনূর কলির বাহুদ্বয় ধরতেই ওর দিকে তাকায় কলি।মেহেনূর আঙুল উঁচিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করলো।কলি অবাক হয়ে তাকায় আকাশের দিকে।মেহেনূর বললো,
– মেঘমুক্ত চাঁদহীন লক্ষ তারাখচিত সীমাহীন আকাশটা কি অদ্ভুত সুন্দর তাই না?সুন্দর তবে কত ভয়ংকর তার রূপ!পৃথিবী থেকে কত লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা ওই নক্ষত্রগুলো পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে কাউকে না কাউকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার প্রশান্তি দিচ্ছে প্রতিনিয়তই।পৃথিবী থেকে ওদের দূরত্ব এতটাই যে চাইলেই তাদের কাছে ছুটে যাওয়া যায় না,একটু ছুঁয়ে দেখা যায় না।তারা স্থির তাদের নিজস্ব অবস্থানে,নিজস্ব পরিক্রমায়।
শুনেছি যারা ভালো মানুষ তারা নাকি মারা যাওয়ার পর আকাশের তারা হয়ে যায়?তোমার বাবা মা-ও হয়তো আছেন ওদের ভীড়ে।
চকিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মেহেনূরের দিকে তাকালো কলি আর দিহাদ।মেহেনূর স্মিত হেসে বললো,
– আমি অনেকক্ষণ আগেই ছাদে এসেছি।জানতাম না আপনারাও এখানে আছেন।আমি আপনাদের দুজনের সব কথাই শুনেছি।
কলি দৃষ্টি সড়িয়ে নেয় শূন্যে।দিহাদও তাই করলো।মেহেনূর কলির দুগাল ধরে বললো,
– কেন শুধু শুধু দিহাদ ভাইয়াকে কষ্ট দিচ্ছো আর নিজেও কষ্ট পাচ্ছো।তাকে ভালোবাসতো নাকি?চোখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি।আল্লাহ না করুক,এখন যদি দিহাদ ভাইয়া মারা যায় না তাহলে উনিও কিন্তু আকাশের তারা হয়ে যাবেন।তখন চাইলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।কাছে যেতে পারবে না,তাকে ছুঁতেও পারবে না।দিহাদ ভাইয়া নিঃসন্দেহে একজন ভালোমানুষ।সে শুধু তোমাকে ভালোবাসে,তোমাকে চায়।তুমি যেমন, তেমন ভাবেই তোমাকে চায়।
– মেহেনূর তুমি ছোট মানুষ।সবকিছু এইভাবে হয় না।হ্যাঁ তবে তুমি আমাদের থেকে বহুগুণে বেশি জ্ঞানী।কিন্তু তুমি বাস্তবতাটা দেখতে চাইছো না।চালচুলোহীন একটা অনাথ মেয়েকে কেন কেউ তাদের ছেলের বউ করতে চাইবে?
– তাহলে স্বীকার করছো তো যে,তুমিও ভালোবাসো?
– না!এই কথা আমি কখন বললাম?
– এই তো এক্ষুনি।দিহাদ ভাইয়া আঙ্কেল আন্টি জানি কোথায় থাকেন?
– কানাডায়।
– কানাডায়?কোন জায়গায়?আঙ্কেল আন্টির ফোন নাম্বারটা দেন তো।
– টরোন্টো শহরে।
– তাই?
– হ্যাঁ।
মেহেনূর গিয়ে দিহাদের কাছ থেকে ওর ফোনটা নিয়ে দিহাদের আব্বু আম্মুর ফোন নাম্বারগুলো মেহেনূরের ফোনে টেক্সট করে পাঠিয়ে দেয়।দিহাদ আর কলি হতভম্ব হয়ে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়ে এইসব কি বলছে? কি করছে কিছুই ওদের মাথায় ঢুকছে না।মেহেনূর দিহাদের ফোনটা ফেরত দিয়ে আবার কলির কাছে যায়।কলির হাত ধরে সোজা ছাদ থেকে নেমে যায়।দিহাদ হা করে শুধু ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়েই আছে।পরক্ষণেই মেহেনূর আবার ফিরে আসে।সিঁড়ির কাছ থেকেই গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– দিহাদ ভাইয়া,কাল সকাল এগারোটায় আপনার সব বন্ধুদের নিয়ে একটু কাজী অফিসে আসিয়েন তো!
মেহেনূরের কথায় দিহাদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– কেন?
– কালকে একটা বিয়ের আছে,ক’জন সাক্ষী লাগবে।
– কার বিয়ে?
– গেলেই দেখতে পারবেন।ঠিক সকাল এগারোটা মনে থাকবে তো?
– হ্যাঁ।
– গুড,সময় মতো চলে আসবেন কিন্তু।
চলবে………