বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব -১৭+১৮

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী

অসীম শূন্যতার পানে তাকিয়ে থাকার মাঝেও কখনো কখনো আলাদা অনুভূতি কাজ করে কুহুর কাছে। আজ যেমন এই অসীম শূন্যতা আলাদা অনুভূতি যোগাচ্ছে। হোস্টেলের রুমের ছোট্ট জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে জীবনের হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করছে অনবরত। কিন্তু বারবার ঐ অসীম শূন্যতার ন্যায় ফলাফল শূন্য আসছে। জানালার সামনে স্বল্প পরিসরের জায়গায় চাঁদের আলো এসে আলোআঁধারির এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে কুহুর মনে এই আলোআঁধারি পরিবেশ কোন ভালো লাগা সৃষ্টি করতে পারেনা। অদ্ভুদ সব ভাবনা থেকে থেকেই মনে হানা দিচ্ছে। কি হতে চলেছে এরপর?
বারবার দিদুন, তাহমিনা আন্টি ফোন করছে। যেতে বলছে ‘ কুঞ্জছায়া’য় ‘। বড়ফুপু, তাহমিনা আন্টি কয়েকদিন এসেছে ওকে ঐ বাসায় নেয়ার জন্য। কিন্তু কুহুর মন আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়েছে। কোন কথা মানতে সে নারাজ। তাইতো বারবার দিদুন আর আন্টির অনুরোধ অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পারছে। অবাধ্য মন প্ররোচনা দিচ্ছে, কেন যাবি ঐ বাসায়? যেখানে চরম অপমানিত হয়েছিস এক সময়! যে তোর মূল্য দেয়নি, তার সামনে, তার বাসায় কেন যেতে হবে? সে সুযোগ পেলে আবার তোকে অপমান করবে। পরক্ষনেই মস্তিষ্ক বলছে, সে তোর কাছে একদিন ক্ষমা চেয়েছিল। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। মন থেকে কেউ ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করতে হয়। তবেই না মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়।
ঠিক তখনই অবাধ্য মন বাঁধ সাধছে। সে বলছে, সেই মানুষটা তোকে করুনা করছে, দয়া দেখাচ্ছে তোর প্রতি। তুই অসহায়, মা নেই, অত্যাচারিত তাই তোর প্রতি সমবেদনা স্বরূপ ক্ষমা চেয়েছে। করুনা কিংবা সমবেদনা কারো জন্য চিরকাল থাকেনা। একসময় বিরক্তিতে রুপান্তরিত হয়।
বারবার নিজের অবাধ্য মনের বি’ষা’ক্ত প্ররোচনার কাছে মস্তিষ্ক হার মানে। কঠিন মন সিদ্ধান্ত নেয় আর কখনোই ‘ কুঞ্জছায়া’র ‘ চৌকাঠে পা রাখবেনা সে।
হার মেনে যায় মা সমতুল্য ফুপুর ভালোবাসা। দিদুনের স্নেহ কিংবা তাহমিনা আন্টির মমতা।

” তাহু, দুই-তিনদিন ধরে তাহমিদকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। ঠিকমত খাচ্ছেনা। কি হয়েছে ওর? তুই কিছু জানিস? ” আফরোজা নাজনীন ডালে ফোঁড়ন দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল তাহমিনা আক্তারকে।
” বড় ভাবি, আমার ছেলের সেইদিনের সেই ভুল ক্ষমা করেছ তুমি? সে যে আজও অনুশোচনায় পু’ড়’ছে। সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে। ”
” তাহু, কি বলছিস এসব! সেইদিন ভুল আমাদেরও ছিল। ওর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল আমাদের। ওর রাগ সেদিন স্বাভাবিক ছিল। হ্যাঁ কিছু কথা ও বলেছিল যেগুলো ঠিক ছিলনা কিন্তু সেইদিনই ওকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। সন্তানের হাজারও অপরাধ কোন মা মনের ভেতর পুষে রাখতে পারেনা। ও আমার সন্তান তাহু। আমার অস্তিত্ব ও। ”
” ভাবি, আমার ছেলে তোমার কাছে কিছু চাইলে তুমি সেটা ওকে দিবে? ও যা চাইবে তাই ওকে দিও। কখনো ফিরিয়ে দিওনা। ফিরিয়ে দিলে আমার ছেলেটা যে বড় আ’ঘা’ত পাবে। ” তাহমিনা আক্তারের গলায় অনুনয় ঝরে পরে।
” তাহু, বারবার আমার ছেলে, আমার ছেলে বলছিস কেন! তাহমিদ কি আমার কেউই নয়? ওকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি আমি। মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়েছি। আমার কি ওর ওপর কোন দাবী নেই! ও কিছু চাইবে আর আমি সেটা দিবনা তা কেমন করে হয়! ”
” ভুল হয়ে গেছে, ভাবি। ও তো তোমারই সন্তান। আমি জানি ওর জন্য ভালো কিছুই তুমি সব সময় ভেবে রাখ। আচ্ছা এসব বাদ। আমার বড় ছেলের বউয়ের সাথে কথা হয়েছে তোমার? সে কবে আসতে চাইছে? আমাকে তো তার ফোন করার সময়ই হয়না। আবার আমি ফোন দিলেও হাজার বাহানা দেখিয়ে অল্প কথা বলেই ফোন কেটে দেয়। ”
” গতকাল কথা হয়েছে। নীরা বলল, বিয়ের দুইদিন আগে আসবে। তাওহীদ ছুটি পাচ্ছেনা বেশিদিনের । সুপ্তির বিয়ের তিনদিন আগে ছুটি পাবে। আর দুইদিন আগে আসবে। ”
” ওর অন্তত আগে চলে আসা উচিত ছিল। তাওহীদ যেদিন ছুটি পাবে সেদিন আসবে। আমরাতো এমন ছিলামনা ভাবি। সারাজীবন শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। পরিবারের প্রয়োজনে সব সময় গুরুজনদের পাশে থেকেছি। তবে কেন আমার ছেলের বউ এমন হল! শ্বশুর বাড়িকে আজও আপন করতে পারলনা। আমারও তো ইচ্ছে করে নাতনিকে খুব কাছে থেকে আদর করতে, ওর বড় হওয়া দেখতে। সারা বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ করবে আমি সেগুলো প্রান ভরে দেখব। কি দোষ ছিল আমাদের? আবার আমি তার কাছে যেয়ে কয়েকটা দিন থাকি সেটাও তার পছন্দ নয়। ” কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পরে তাহমিনার চোখ থেকে।
” কাঁদিসনা তাহু। ধরে নে আমরাই ওকে আপন করে নিতে পারিনি। আমাদের বাঁধনই ঢিলা ছিল। যার ফাঁক গলে আমাদের ভালোবাসা ওর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এবার যখন ওরা আসবে তখন নাতনিকে প্রানভরে আদর করিস। ওরা যে কয়দিন থাকবে তোর কোন কাজ করতে হবেনা। সারাদিন তূরকে কোলে নিয়েই থাকবি। ওকে আদর করবি ওর দৌড়ঝাঁপ দুচোখ ভরে দেখবি। ”
” হুম, আমি সারাদিন তূরকে নিয়েই থাকি আর তুমি কাজ করতে করতে শহীদ হও। থাক আমার এত ভালোবেসে কাজ নেই বাপু। নাতনি যেদিন বুঝবে আমরা ওকে কত ভালোবাসি সেদিন ওকে কেউই আমাদের থেকে দূরে আটকে রাখতে পারবেনা। ” শাড়ির আঁচলে নাক মুছে জবাব দেন তাহমিনা আক্তার।
দুই জা মিলে নানান গল্প, স্মৃতিচারনের মধ্য দিয়ে রান্না করতে থাকেন।

” কি রে, ছাতার মিস্ত্রীর বউ। তোর জামাই এখন কার ছাতা ঠিক করছে? ভাগ্যগুনে একটা ছাতার মেকার পাচ্ছিস। আমাদের কারও ছাতা ভাঙলে কোন চিন্তা নেই মিস্ত্রি রেডি আছে। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশী, শহরের প্রত্যেকের ছাতা ঠিক করার দ্বায়িত্ব তোর মিস্ত্রি জামাই বহন করবে। ”
সুপ্তির চুল টেনে দিয়ে বলে তাহমিদ। সুপ্তি নিজ রুমে বসে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল।
” তাহমিদের বাচ্চা, ঐটা ছাতার মেকার হবেনা। ঐটা আর্কিটেক্ট হবে। আমার জামাই আর্কিটেক্ট বুঝলি? হাহ্ নকল করে পাশ করলে যা হয় আরকি। আর্কিটেক্ট আর ছাতার মেকারের পার্থক্য বুঝবি কেমন করে! কি বলতে এসেছিস বলে বিদায় হ এক্ষুনি। তোর আজাইরা প্যাচাল শোনার সময় আমার নেই, বুঝলি? ”
” একটু তো সম্মান কর। হাজার হোক ডাবল আত্নীয় হই। আর দশ মাস পর ডাক্তারের প্রয়োজন পরলে আমার কাছেই সাহায্য চাইবি বুঝলি? ”
” আইছেরে, ডাবল আত্মীয়। এসব একতরফা ডাবল আত্মীয় আমি মানিনা। যাকে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়াবে তাকেই এখনও মানাতে পারলনা শুধু শুধু সবার কাছে আত্মীয়তার গান গেয়ে বেড়ায়। অকর্মার ঢেঁকি একটা। আবার এখন আমার দশমাসের চিন্তা করছে! আমারটা আমিই সামলাবো, তোকে লাগবেনা। ”
সুপ্তির কথা শুনে তাহমিদের হেঁচকি উঠে। চোখদুটো আপনাআপনি রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে গেছে। এই মাইয়া জানলো কেম্নে!
” ঐ বইন, কি কস এগ্লা? তুই যা ভাবছিস সেসব কিছুই না বুঝেছিস? আমি একদম নিষ্পাপ, বাচ্চা একটা ছেলে। আমিতো জাষ্ট মজা করি তোদের সাথে। ”
” হ, সবাইকে ঘাস খাওয়াতে পারলেও আমাকে পারিসনি। আমিতো আর সবার মত গ’রু নই। তুই একদম ফ্রেশ, নিষ্পাপ বাচ্চা তাও আমি জানি। শুধু একটু আমার মামাতো বোনের লগে লাইন মারতে চাস এই যা। ”
” তোর চারটা হাতে-পায়ে ধরি এই কাউকে বলিসনা। আমি না তোর কলিজার ভাই। পিলিজ লাগে বইন। ” তাহমিদের চুপসানো মুখ দেখে সুপ্তির হাসি পায়। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
” সেই তো ভালোইবাসলি তবে সেদিন কেন রিয়্যাক্ট করেছিলি? কম কষ্টতো মেয়েটা পায়নি। এখন কিভাবে রাজি করাবি ওকে? ও কি আদৌ রাজি হবে! ”
” জানিনা সেদিন কি থেকে কি হয়ে গেছিল। সেদিন তোরা সবাই কষ্ট পেয়েছিল আর আজ আমি কষ্ট পাচ্ছি। সবই ঠিক আছে পার্থক্য শুধু সময়ের । তুই আমাকে একটু হেল্প করবি? প্লিজ। ” তাহমিদ অনুরোধ করে সুপ্তিকে।
” কি হেল্প লাগবে বল। বিয়ের আগে যতটুকু পারি হেল্প করি। ”
” ঐটার সাথে দেখা হলে আমাকে দেখলে উল্টো রাস্তা ধরে। ডাক দিলেও কথা বলেনা। ওর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিবি? আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব। প্রয়োজনে ওর পায়ে পরব। ”
” তুই অন্যায় করেছিলি মানছি। কুহু আমার বোন তাও মানছি। কিন্তু তুই ওর পায়ে পরবি এইটা আমি বোন হয়ে মানতে পারছিনা। তুই আমার ভাই। তুই মাথা উঁচু করে বাঁচবি। ভালোবাসিস তারমানে এই নয় যে তুই কারও পায়ে পরবি! যাকে ভালোবেসেছিস তাকে বীরের মত জয় করবি। এতে নিজের গৌরব বাড়ে। কারও পায়ে ধরে ছোট হওয়ার মধ্যে কোন গৌরব নেই। ”
তাহমিদ সুপ্তির কথা শুনে চুপ করে থাকে। ও এতটাই ভালোবেসেছে যে তার কাছে ছোট হতেও কোন অনুশোচনা বোধ করবেনা!
” শোন কাল বিকেলে আমি শপিংয়ে যাব। যাওয়ার সময় কুহুকে ডেকে নিব। তোকে ম্যাসেজ করে দিব কোন শপিংমলে যাব। তুই চলে আসিস। তবে মনে রাখিস কুহু তোর কথা না মানলে কোন সিনক্রিয়েট করবিনা। ” তাহমিদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সুপ্তি আবার বলে।
” থ্যাংকিউ বইন। তোর কথা আমার মনে থাকবে।
কাল ছাতার মিস্ত্রিকেও নাহয় ডেকে নিস। একসাথে কফি খাওয়া যাবে। ”
” হ, আমি দুনিয়া সুদ্ধ মানুষকে জানাই আমার ভাই আমার মামাতো বোনের লগে লাইন মারতে শপিংমলে আসছে। বাপরে শিক্ষিত ভাবা যায়! ”
” হইছে, আর নাক শিটকাতে হবেনা। আমি অক্ষিশিত সেটা সবাই জানে। এখন গেলাম। দেখ তোর ছাতার মিস্ত্রি ফোন দিচ্ছে। রিসিভ করতে দেরি হলে তার হার্ট আবার লাফ দিয়ে মাথায় উঠতে পারে। ” তাহমিদ বেরিয়ে গেলে সুপ্তি ওর ফোনের দিকে তাকায়। সাইলেন্ট থাকায় ও বুঝতে পারেনি ফোন এসেছে।

কুহু আর সুপ্তি শপিংয়ে এসেছে। দুজনে ঘুরেঘুরে দেখছে আর এটাসেটা কিনছে। অবশ্য যা কেনার সুপ্তিই কিনছে। কুহু শুধু ওর সাথ দিচ্ছে। সুপ্তি ম্যাসেজ করে তাহমিদকে জানিয়ে দিয়েছে ওরা কোথায় আছে।
একটা শাড়ির দোকানে বসে শাড়ি দেখতে ব্যাস্ত সুপ্তি। এত শাড়ি দেখেছে যে ওর সামনে শাড়ির স্তুপ হয়ে গেছে। তবুও কোনটাই ওর পছন্দ হচ্ছেনা। এদিকে কুহু যেই শাড়িই দেখছে সেটাই পছন্দ হচ্ছে।
” আপু, এতগুলো শাড়ির মধ্যে একটাও তোমার পছন্দ হচ্ছেনা! দেখ, ঐ বেগুনি রঙের শাড়িটা কি সুন্দর। তোমাকে খুব মানবে। ”
” ঐ শাড়িটা এই ছাতার মিস্ত্রির বউকে নয়, আমার বউকে মানাবে। আমার বউয়ের জন্য সিলেক্ট করলাম শাড়িটা। ভাই, বেগুনি রঙের শাড়িটা প্যাক করেন। ” তাহমিদ কুহুর পাশের চেয়ারে বসে দোকানীকে নির্দেশ দেয় ।
এদিকে কুহু শপিংমলে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। ও এখানে তাহমিদকে কিছুতেই আশা করেনি।
” আপু, তোমার যা প্রয়োজন কিনো। আমি হোস্টেলে যাব। ”
” এক থা’প্প’ড় দিব, ফা’জি’ল। আমার সাথে এসেছিস, আমার সাথেই যাবি৷ আমার ভাইটা কি ফেলনা নাকি? ওকে দেখেই উঠে যেতে চাচ্ছিস! চুপচাপ বস আর আমার জন্য শাড়ি পছন্দ কর৷ ”
কুহু সুপ্তির ধমক খেয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
তাহমিদ কয়েকটা শাড়ি সুপ্তিকে পছন্দ করে দেয়।
কুহুর জন্য থ্রীপিস কিনতে ওরা আরেক দোকানে আসে। কুহু বারবার না বলা স্বত্বেও সুপ্তি ওকে নিয়ে থ্রীপিস কিনতে আসে। কিন্তু এখানে এসে কুহু কোন কিছু পছন্দ না করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাধ্য হয়ে তাহমিদ আর সুপ্তি মিলে পাঁচটা থ্রীপিস পছন্দ করে কিনে। কিন্তু একটারও দাম তাহমিদ সুপ্তিকে দিতে দেয়না। কুহুর অগোচরে তাহমিদ সুপ্তির কাছে টাকা দেয়।
আরও কিছু কেনাকাটা করে ওরা একটা কফিশপে বসে। সুপ্তি তিনজনের জন্য স্ন্যাকস আর কফির অর্ডার দেয়। কফিশপ মোটামুটি ফাঁকাই বলা চলে। কফি রেডি হতে কয়েক মিনিট লাগবে। তাই ওরা অপেক্ষা করছে। ঠিক তখনই সুপ্তির ফোন বেজে ওঠে। ওর হবু স্বামী রাহাতের ফোন এসেছে। সুপ্তি ফোন রিসিভ করে কফিশপের পেছনে একটু ফাঁকামত জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে।
কুহু আর তাহমিদ টেবিলের দুই প্রান্তের দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে। কুহু সব সময়ের মত মাথা নিচু করে আছে। আর তাহমিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। ওদের টেবিল এক কোনায় হওয়ায় কেউ ওদের দেখছেওনা আবার ওদের কথাও শোনা যাবেনা।
” কুহু, একটু তাকাবে আমার দিকে। ” তাহমিদের অনুনয় কুহুর কানে ঠিক পৌঁছায়। কিন্তু তবুও ও মাথা নিচু করে থাকে।
” প্লিজ কুহু, আমার কথা একটু মনযোগ দিয়ে শোন। তোমার সাথে কিছু কথা আছে যেগুলো তোমাকে না বললে আমি ঠিক থাকতে পারবনা। ”
কুহু ভাবছে, এই মানুষটার আবার কি কথা থাকতে পারে! তাও আবার আমার সাথে!
” কি বলবেন বলুন। যা বলার আজকেই বলুন অযথা রাস্তাঘাটে মানুষের সামনে ডাকবেননা। এতে আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। ”
তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কথা গুছিয়ে নেয়।
” কুহু, সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য আমি সরি। জানি সরি বললেও তোমার ক্ষত একটুও কমবেনা। তোমার দুঃখও মুছবেনা। কিন্তু আমি তোমার কাছে ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা। বিবেকের কাছে প্রতিনিয়ত দং’শি’ত হচ্ছি। আমাকে একটিবার ক্ষমা করা যায়না। ”
” আপনি নিজেকে আমার কাছে ছোট করছেন কেন? আপনি সেদিন ভুল কিছুই বলেননি। আমি আসলেই যোগ্য নই। আপনি কোন ভুল করেননি অথচ আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন, বিষয়টা পরস্পর বিরোধী হয়ে গেলনা! ” কুহুর গলায় রাগ, অভিমান কিংবা জেদ স্পষ্ট। যা তাহমিদের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়না।
” আমি অবশ্যই ভুল করেছি। বড়দের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত ছিল। কিন্তু আমি বাবা-মা’র অবাধ্য সন্তান। তাই সেদিন তাদের অপমান করেছি সেই সাথে তোমাকেও। শাস্তি আমার অবশ্যই প্রাপ্য। যদি তুমি মনে কর আমাকে শাস্তি দিবে, সেটাও আমি মাথা পেতে নিব। ”
” আমি বারবার বলছি আপনি অন্যায় করেননি তবে কেন এত কথা বলছেন। যেগুলো শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগছেনা। ”
” ওকে, আমি যদি অন্যায় নাই করে থাকি তবে তুমি কেন আমাদের বাসায় যাচ্ছনা? বড়মা প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছে। মনমরা হয়ে থাকছে সব সময়। আমি বড়মার কষ্ট আর দেখতে পারছিনা। প্লিজ, আমাদের বাসায় চলো। সুপ্তির বিয়েতে সবাই আনন্দ করবে কিন্তু সেখানে তুমি থাকবেনা এটা আমি মানতে পারবনা। বড়মাও খুশি হবে। ”
” সরি, আমি কোথাও যাবনা। কোথাও যাবনা বলছি কেন! আমি কমিউনিটি সেন্টারে যাবতো। ”
” কিন্তু বাসায় কেন নয়? তাহলে কি ধরে নিব তুমি আমাকে মিথ্যা বলছ? আমি অন্যায় করেছি এবং তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি এটাই সত্যি? ”
” আপনার যা ইচ্ছে তাই ভাবুন। তবে একটা কথা শুনে রাখুন আমি আপনাদের বাসায় যাচ্ছিনা। আর এই বিষয়ে কথা না বললেই আমার ভালো লাগবে। ”
কুহুর শেষের কথা তাহমিদের মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়। ঠিক তখনই ওয়েটার আসে। স্ন্যাকস, কফি টেবিলে রেখে যায়। কিন্তু কারোরই এখন সেগুলো খাওয়ার মুড নেই।

” কিরে তোরা এমন স্ট্যাচু হয়ে বসে আছিস কেন? কফিতো ঠান্ডা হয়ে গেছে! ” সুপ্তি চেয়ারে বসে ওদের জিজ্ঞেস করে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নেয় সুপ্তি।
” হুম, কি বললি? ও আচ্ছা কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে! আমি আবার অর্ডার দিচ্ছি। ” তাহমিদ উঠতে গেলেই সুপ্তি ওর হাত ধরে বসিয়ে দেয়।
” কুহু, শোন জীবন যে কত কঠিন তা তোর থেকে বেশি কেউ জানেনা। তুই জীবনের যত দিক দেখেছিস তার একশো ভাগের একভাগও আমরা দেখিনি। আর দেখিনি জন্যই তাহমিদ সেদিন সেই ভুলটা করে বসেছিল। ও যদি তোর মত জীবনের সব ভালোমন্দ দিক বুঝত তবে সেদিন নির্দিধায় বড়দের কথা মেনে নিত। কিন্তু আজ যখন ও সেই ভুল শোধরাতে চাইছে তখন তুই এত জিদ করছিস কেন! তুই বুদ্ধিমতি আমি তাই জানতাম। কিন্তু তোর বর্তমানের আচরণ আমাকে হতাশ করছে। তুই আমার বোন, তাহমিদ আমার ভাই। তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান। কেউ যদি ভুল করে এবং পরে অনুতপ্ত হয় তখন তাকে ক্ষমা করা উচিত। আমি কি বলতে চেয়েছি তুই নিশ্চয়ই বুঝেছিস? ”
কুহু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। সুপ্তির কথা মনযোগ দিয়ে ভাবছে। সত্যিই আমি জিদ করছি! আমিতো কখনো জেদি ছিলামনা। কেউ কখনো জেদি তকমা আমার নামের আগে বসায়নি। তবে আজ কেন জেদি তকমা পেলাম! আমার ভেতরে মনুষ্যত্বের বদলে রা’গ কেন মাথাচাড়া দিল! আমি কেন সেদিনের কথাগুলো ভুলতে পারছিনা। ছোটমাও তো বহুবার আমাকে অ’প’মা’ন করেছে, আ’ঘা’ত করেছে, অ’স’ম্মা’ন করেছে কই তার উপর কখনো এমনভাবে রে’গে থাকিনি তো! ছোটমা কখনোই আমার কাছে ক্ষমা চায়নি তবুও বারবার বেহায়ার মত তার সাথে যেচে কথা বলি। কিন্তু এই মানুষটা ক্ষমা চাইছে, অনুশোচনা করছে তবুও তাকে কেন ক্ষমা করতে পারছিনা! আমার কি হয়েছে!
” আপু তোমাদের যেতে দেরি হবে বোধহয়? আমি আর থাকতে পারছিনা। তোমরা থাক আমি গেলাম। ” সুপ্তির কথার কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে কুহু চলে যেতে চায়।
কুহুর যাওয়ার কথা শুনে তাহমিদ অসহায় চোখে সুপ্তির দিকে তাকায়।
” খুব বড় হয়ে গেছিস দেখছি আজকাল! আমার কথা শেষই হলোনা কিন্তু তুই চলে যাচ্ছিস! অহংকার এতটাই গ্রাস করেছে তোকে! ”
” আমাকে ভুল বুঝনা আপু। আমি আগে যেমন ছিলাম, এখনও তেমনিই আছি। অহংকারকে নিজের ভেতরে ঠাঁই দেয়ার মত দুঃসাহস আমার কখনোই হবেনা। তোমরা আমার পাশে না থাকলে এতদিন কোন ন’র’কে পঁ’চে ম’র’তা’ম। তোমার বলা কথাগুলোর কোন জবাব আমার কাছে নেই, তাই আমি চলে যেতে চাইছি। আর ভুলের কথাই যদি বলো, সেদিন তাহমিদ ভাইয়া কোন ভুল করেনি। তাই এখানে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই আসেনা। তিনি সত্যি কথাগুলোই সেদিন বলেছিলেন। তার পাশে দাঁড়ানোর কোন যোগ্যতাই আমার নেই, এটা আমার কাছে চিরন্তন সত্য। তবে আমি চাইছিনা বা চাইনা কেউ আমাকে দয়া অথবা করুনা করুক। হয়তো সেদিনের কথাগুলো বলার পর তার মনে আমার জন্য করুনা জন্মেছে। একটা মা হীনা মেয়েকে কেন এভাবে বলেছে, সেটাই বোধহয় এই করুনা জন্মানোর মূল কারণ। কিংবা দিনের পর দিন কিভাবে সৎমায়ের দ্বারা অ’ত্যা’চা’রি’ত হয়েছি এটা জানার পর দয়া দেখাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমিতো কারো দয়া অথবা করুনা চাইনা। তাই আমার প্রতি কোন দয়া কিংবা করুনা না দেখালে, আমাকে আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতে দিলে তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তুমি তাকে বলে দাও রাস্তাঘাটে আমাকে ডাকাডাকি না করলে আমার জন্য ভালো হয়। তার এত করুনার আমার প্রয়োজন নেই। কে চাইছে তার এত করুনা! ”
” কুহু তুই এসব কি ব….
” ব্যাস, অনেক হয়েছে সুপ্তি। আমি সব শুনেছি। তবে তোর বোনকে বলে দিস আজকের বলা কথাগুলোর জন্য ভবিষ্যতে তাকে যেন অনুশোচনা করতে না হয়। আমি আর তাকে রাস্তাঘাটে ডাকবনা। আর এটাও বলে দিস কোন দয়া অথবা করুনা তাকে আমি কখনোই করিনি। তার জন্য আমার কি অনুভূতি ছিল বা আছে তা যদি সে জানত তবে আজ এসব বলতে পারতনা। আজ থেকে তার ভালো থাকার দিন শুরু হলো। আশা করছি যেখানে তাহমিদের ছায়া পরবেনা সেখানে সে মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারবে। ” সুপ্তির কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে তাহমিদ কথাগুলো বলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে অবশ্য বিল মিটিয়ে যায়।
কুহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্তি স্তব্ধ হয়ে তাহমিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেল ও বুঝতেই পারছেনা।

(আপনারা অনেকেই বড় পার্ট কিংবা তারাতারি গল্প দিতে বলেন। আমি চেষ্টা করি ২৪ ঘন্টার মাঝেই গল্প দিতে। কিন্তু সংসার, সন্তান, স্বামী সব কিছু সামলাতে যেয়ে লিখতে দেরি হয়, পার্টগুলো ছোট হয়। আমিও খুব করে চাই তারাতারি গল্প দিতে। কিন্তু আমি নিরুপায়।)

চলবে..#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী

‘ কুঞ্জছায়া ‘ লোকজনের পদচারণায় মুখরিত। আত্মীয় স্বজনরা সবাই আনন্দে মেতেছে। তিনদিন পর সুপ্তির বিয়ে।
আজ মেহেদী উৎসব। সকলে কমিউনিটি সেন্টারে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে।
আজ দুপুরের দিকে কায়েস তার পুরো পরিবার নিয়ে বড় বোনের বাসায় এসেছে।
সিক্তা, আরোশি, তনয়া, দৃষ্টি খুশিতে লাফালাফি করছে। অনুষ্ঠানে কে কি পড়বে সেই নিয়ে তোড়জোড় চলছে।
আনান, তাহমিদ আর নাজমা পারভিনের ছেলে নিহান যাবতীয় দ্বায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
সামিউল রাশেদিন পরিবার নিয়ে দেশে এসেছেন কয়েকদিন হলো। তিনি বড় ভাইকে বিয়ের সকল দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেই সব দেখাশোনা করছেন।

বিকেলে সবাই কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে যায়।
কুহুও এসেছে একটু আগেই। পার্লার থেকে তিনজন বিউটিশিয়ান এসেছে সুপ্তিকে সাজাতে।
সিক্তা, আরোশি, তনয়া বায়না ধরেছে তারাও সাজবে। আফরোজা নাজনীন বাচ্চাদের আবদার মেনে নেন। বিউটিশিয়ানদের বলে দেন যারা যারা সাজতে চায় তাদের সবাইকে সাজিয়ে দিতে। সেই সাথে তিনি কুহুকে ধরে এনে বলে দেন সাজাতে। কুহুর ইচ্ছে ছিলনা সাজার কিন্তু ফুপু কষ্ট পাবে ভেবে রাজি হয়।

বাড়িতে পাটায় গাছের টাটকা মেহেদী পাতা বেটেছেন কয়েকজন মিলে। বাটা মেহেদী পাতা সুপ্তির হাতে দিবে। আবার এখান থেকেই কিছু বাটা পাতা বরের বাসায় যাবে। বরকে ছোঁয়ানো হবে এই বাটা পাতা।
আবার বরপক্ষও আসবে সুপ্তিকে মেহেদী পড়াতে।
সন্ধ্যার পর মেহেদী উৎসব শুরু হয়েছে। মেয়েরা সবাই হাতে মেহেদী দিয়ে রানীর ন্যায় বসে আছে। তাদের পড়নে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি। আর ছেলেরা পড়েছে হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী সাথে কালো জিন্স।
কুহু সেন্টারে আসার পর থেকে তাহমিদ ওর সামনে আসেনি। কুহু খেয়াল করল তাহমিদ ওর থেকে দূরে দূরে থাকছে। এমনকি ওর দিকে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। কুহু হাঁফ ছাড়ে।

হলরুমে সুপ্তির বন্ধুরা নাচ-গানে মেতেছে। ওদের সাথে তাল মেলাচ্ছে সিক্তা, আরোশি, তনয়া, দৃষ্টি, সুপ্তির ছোট চাচ্চুর মেয়েরা এমনকি সুপ্তির বড় দুই বোনও।
একটু পরেই বরকে মেহেদী পড়াতে যাবে কনে পক্ষ। ভেতরে ডালা সাজাচ্ছেন বড়রা। কুহু এতক্ষণ ভেতরেই ছিল। সেখানে অত্যধিক চেঁচামেচিতে ওর মাথা ব্যথা করছে বিধায় ও বাগানে এসে দাঁড়ায়। বাগানে হরেকরকম ফুল গাছ। কতক গাছে থোকায় থোকায় ফুল ফুটেছে।
কুহু লক্ষ্য করল বাগানের এককোণে মাঝারি উচ্চতার একটা নাগচাঁপা গাছে ফুলে ছেয়ে গেছে। রাতের আঁধারে সাদা সাদা ফুলগুলো তারার ন্যায় জ্বলছে। কুহুর খুব ইচ্ছে করছে ফুলগুলো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সেগুলো ওর নাগালের বাইরে। কুহু বাধ্য লাফ দেয় ফুলগুলো ছুঁতে। কিন্তু কুহু ব্যর্থ হয়। তবুও পুনরায় চেষ্টা করতে থাকে। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন পারলনা, তখন মন খারাপ করে চলে আসতেই কয়েকটা ফুল ওর মাথায় পরল। অবাক হয়ে পেছনে ফিরতেই দেখল তাহমিদ নাগচাঁপার একটা ডাল ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে । আর তাতেই ফুল ঝরে পরছে কুহুর উপর। জোরেসোরে আরেকটা ঝাঁকুনি দিতেই আরও কয়েকটা ফুল এসে পরল কুহুর শরীরে। যেমনভাবে এসেছিল ঠিক তেমনভাবে স্থান ত্যাগ করে তাহমিদ। একটাবারও কুহুর দিকে তাকায়না। কুহু এতসব চিন্তা না করে মাটিতে পরে থাকা ফুলগুলো কুড়াতে থাকে। ওর ঠোঁটের কোনে অস্পষ্ট হাঁসির আভাস। কিন্তু কেন এই হাসি তা সে বুঝতে পারেনা। লোকটা এত খেয়াল রাখে ওর! কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল কুহু, তাহমিদ ওর দিকে একবারও তাকায়নি। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিল!

কুহুরা কয়েকজন মিলে বরের বাসায় যায় মেহেদী পড়াতে। সাথে তাহমিদ, আনান, নিহানও আছে। ওরা সব কাজিনরা এক গাড়িতে বসেছে। সারাটা পথ হাসিঠাট্টা, গান গেয়ে অতিক্রম করে।বরের বাসায় পৌঁছতেই ওদের ফুলেল বর্ষনে স্বাগত জানায় বরপক্ষ।

কুহু বেশ কিছুক্ষণ থেকেই খেয়াল করছে বরপক্ষের একটা ছেলে ওর চারপাশে ঘুরঘুর করছে। কুহু ছেলেটাকে পাত্তা না দিয়ে সিক্তার কাছে আসে।
” হ্যালো, আমি সিফাত। রাহাত ভাইয়ার কাজিন। আপনি সুপ্তি ভাবির কে হন? ” সেই ছেলেটা কুহুর সামনে এসে জিজ্ঞেস করে।
কুহু সামনে তাকিয়ে দৃষ্টিকে দেখল। ওর বুকের ভিতর ভয়ে ধুকপুক করছে। দৃষ্টি যদি ছোটমাকে বলে দেয়, তবে ছোটমা ওকে আস্ত রাখবেনা।
তবে সিক্তা কুহুর মনোভাব বুঝতে পারে।
” হ্যালো, ভাইয়া। আমি সিক্তা আপনার সুপ্তি ভাবির ছোট বোন। আর ও আমার কাজিন। ”
” কিন্তু আমিতো উনাকে জিজ্ঞেস করেছি! উনার কি রা’গ হয়েছে? ”
” নাহ্ রাগ হবে কেন! ও একটু এমনই। ” বলেই সিক্তা কুহুর হাত ধরে স্টেজের একপাশে নিয়ে আসে।
দূর থেকে এতক্ষণ সব লক্ষ্য করছিল তাহমিদ। এমনকি ওদের এখানে আসার পর থেকেই ছেলেটা যে কুহুকে ফলো করছিল সেটাও লক্ষ্য করেছে।
তাহমিদ ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় সিফাতের পাশে।
” এক্সকিউজ মি, ব্রাদার। আমি তাহমিদ, সিক্তার ভাই প্লাস বন্ধু। ঐযে কোমড় ছাড়ানো চুলের মায়াবিনী কন্যাকে দেখছেন না, ও আমার উডবি। ও আবার একটু লাজুক কিনা। তাই অচেনা কারও সাথে কথা বলতে চায়না। ওর এমন আচরণে কিছু মনে করবেননা। ওর তরফ থেকে আমি সরি বলছি। ” সিফাত নামক ছেলেটাকে তব্দা খাইয়ে পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে প্রস্থান করে তাহমিদ।
কিছুক্ষণ পর থেকে কুহু লক্ষ্য করল সিফাত ওর দিকে আর তাকাচ্ছেনা। কুহুর একটু খটকা লাগে। আসার পর থেকেই যে ছেলেটা ওর পিছে পরে ছিল সে হঠাৎ করেই ওর দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছেনা। কিছু ঘটেছে নাকি! কুহু আল্লাহ আল্লাহ করছে, এখান থেকে যেতে পারলেই ও বাঁচে৷

সব কাজিনরা মিলে রাহাতকে মেহেদী পড়ায়। এরপর স্টেইজে কিছুক্ষণ হৈ-হুল্লোড় করে। কুহু বাদে সবাই নানান ভঙ্গিমায় সেলফি নিতে ব্যস্ত। কুহু শুধু অসহায়ের ন্যায় দেখতে থাকে ওদের কাজকর্ম। তবে এতকিছুর মাঝে কুহুর নজরে আসে এখানকার কয়েকটা মেয়ে তাহমিদের মনযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করছে। ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। যেচে তাহমিদের সাথে কথা বলছে আবার কারনে-অকারনে হাসতে হাসতে তাহমিদের গায়ে ঢলে পরছে। এসব দেখে কুহু খুব মজা পাচ্ছে। তার তাহমিদ বেচারা চিপায় পরেছে। সে যেখানেই যাচ্ছে মেয়েগুলো ওর সাথে সাথেই থাকছে।
বিষয়টা সিক্তা, আরোশিও লক্ষ্য করে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
” কি ভাই, খুব মজা লুটছ দেখছি! আহা, কি চাঁদ কপাল তোমার। না চাইতেও ললনারা তোমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। আর আমাকে দেখ, এত অ্যাটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। আনান এই পো’ড়া কপাল মানুষকে দেখাবি কেম্নে! হায়রে নি’ষ্ঠু’র ললনা, তোমাদের কি একটুও দয়ামায়া হয়না এই অবোধ পুরুষের ওপর! ” আনানের কথা শুনে তনয়া হো হো করে হেসে উঠে।
” এই ছেমরি, চুপ। এভাবে হাসিসনা। তোর বি’ক’ট হাসির শব্দে বিয়ে বাড়ির সব আত্মীয় স্বজনরা পালাবে। আমি কাঁদছি দুঃখে, আর সে চিল-চিৎকারের সাথে হাসছে। ” আনানের ধমকও তনয়ার হাসি থামাতে পারেনা।
” ওহে, বৎস। এত উদাস হইয়োনা। দেখে নিও ললনারা না আসলেও তাহাদের দাদি-নানি ঠিকই তোমার টানে ছুটিয়া আসিবে। ” তাহমিদের এতটুকু কথাই আনানের ফুঁসে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল।
” ভাই! এটা তুমি কি বললে? কোথায় আমি যেখানে যাই সেখানেই তোমার জন্য একটা ফুটফুটে ভাবি খুঁজে সময় নষ্ট করি। আর সেই তুমি কিনা আমার জন্য নানি-দাদিকে সিলেক্ট করছ! এটা অন্যায়, মহা অন্যায়। এ আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা। ”
” শোন দেবদাস, আমার জন্য যেখানে সেখানে ফুটফুটে ভাবি না খুঁজে একটা শ্যামাঙ্গীনি ভাবি খোঁজ। দেখবি অতি সহজেই পেয়ে যাবি। এবার যা, কোন ললনা পোষবার মত বয়স এখনো তোর হয়নি। আগে নিজের মনকে বশ মানাতে শিখ, তখন দেখবি ললনারাও তোকে দেখে অটোমেটিক বশ মানবে। ”
” অপমান করলে নাকি উপদেশ দিলে! কিছুই তো বুঝলামনা! ”
” তুই যে অর্থে নিবি সেটাই। এখন এসব বাদ দিয়ে ঐটার খাওয়ার ব্যবস্থা কর। তোরা সবাই খেলি কিন্তু সে মাথা ব্যথার অযুহাতে কিছুই খায়নি। আবারতো সে হোস্টেলে ফিরে যাবে। সেখানে গিয়ে খাবার পাবেনা কিন্তু। ” তাহমিদের কথায় আনানের মনে পরল আসলেই তো কুহু কিছু খায়নি! এখন ওর জন্য খাবার কোথায় থেকে আনি? মেয়েটা নিশ্চয়ই ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে! ও যেমন মেয়ে ক্ষুধায় ম’রে গেলেও কারও কাছেই বলবেনা৷ এখন কার কাছে যাই খাবার আনতে? চিন্তায় মাথা চুলকাতে থাকে আনান। ঠিক তখনই তাহমিদ একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে হাজির হয়।
” এই নে, ঐটাকে দিয়ে ওর পাশে বসে থাকবি। ওর খাওয়া হলে তবেই আসবি। ” তাহমিদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। ওর আরেক হাতে থাকা প্লেট থেকে খেতে শুরু করেছে।
আনান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাহমিদের দিকে। ভাই, সব সময়ই ওর খেয়াল রাখে। এতদিন কিছু মনে না হলেও আজ স’ন্দে’হ উঁকি দিচ্ছে মনে। ভাই কিছুক্ষণ আগে বলল, ফুটফুটে ভাবি নয় তার শ্যামাঙ্গীনি চাই। আবার সব সময়ই বলে সে তার ডাবল আত্মীয়। এভাবেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলে আনান।
” এই যে জামাই মিঞা, এভাবে বউয়ের বড় ভাইকে রেখে গোগ্রাসে গিলছ, তোমার লজ্জা করছেনা? একটুতো সম্মান করতে শিখ। এভাবে অসম্মান করলে আমার বোন তোমার কাছে দিবনা। আর তুমি একটু আগে কি বললে? আমার ললনা পোষবার মত বয়স হয়নি! আমি ভার্সিটির স্টুডেন্ট বুঝলে? একটা নয় দশটা ললনা পোষবার ক্ষমতা আমার আছে। ” আনান কৌতুহলী হয়ে এক ভুরু উঁচিয়ে তাহমিদকে খোঁ’চা দেয়।
” কানের নিচে দিব একটা। আমার বউকে না দেয়ার তুই কে। তোকে যা বলেছি সেটা কর। সম্মান পরে চাইতে আসিস। তখন ভেবে দেখব তোকে সম্মান করা যায় কিনা। এখন একটু খেতে দে। আর কি বললি যেন? তুই ললনা পুষবি মানে? ললনা কি পোষবার জিনিস! ওদের যত ভালোবাসা দিবি, দেখবি এমনিতেই পোষ মেনে যাবে, আলাদা করে পোষবার প্রয়োজন পরবেনা৷ ” তাহমিদের কথা শুনে আনানের সব ভাব ফুস করে হাওয়ায় মিলায়। ভাই এভাবে পাল্টি মারল কেন! সেই বলল পোষ মানাবার কথা এখন সেই আবার উল্টা গান গাচ্ছে! বিরস বদনে কুহুর নিকট আসে। ওর হাতে প্লেট ধরিয়ে দিয়ে একটা চেয়ার এনে দেয়। কুহুর খাওয়া না হওয়া পর্যন্ত বসে বসে পাহারা দেয়।
” ভাইয়া, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আড্ডা ফেলে মুখ কালো করে আছো! ঘটনা কি ভাইয়া? ”
” এই মাইয়া, তুই চুপচাপ খা কইলাম। আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে তোকে এখানে রেখে আড্ডা দিতে যাব! শেষে দেখা যাবে গার্লফ্রেন্ডকে দেখানোর জন্য এই চুল ভর্তি মাথাটাই থাকলনা। ”
” আমি কি জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি কি উত্তর দিলে! তোমার বোধকরি মাথার ব্যামো হয়েছে। ”
” ঐ চুপ কর কইলাম। আমি পাঁচ মিনিট আগ পর্যন্ত ঠিকই ছিলাম। কিন্তু এখন মাথা আউলায় গেছে। আচ্ছা কুহু, একটা কথা বলত। কি করলে একটা ছেলে কোন মেয়ের প্রেমে পরে? ” ফিসফিসিয়ে জানতে চায় আনান।
” আমিতো জানিনা ভাইয়া। এ বিষয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। ”
” খালি ঢং করস? এদিকে পাব্লিক ঠিকই হা’বু’ডু’বু খাচ্ছে। তোর মত বোকা মাইয়া! এসব কেম্নে কি! ”
আনানের কথার কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনা কুহু। ও শুধু ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে। আবার কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছে। যদি ধমক দেয়।
” ঐ মাইয়া, তারাতারি খা। চেটেপুটে খাবি কইলাম। তাছাড়া দেখা যাবে প্লেট মুছে আমারই তোকে খাওয়ানোর হুকুমজারি হলো। আর ভাল্লাগেনা। কি বোকা আমি! এতদিন কিচ্ছুটি বুঝিনি! এত জল কোথায় রাখিস, তোরা মাইয়ারা! যে পাব্লিক ডু’বে’ডু’বে সেই জল পান করে? ”
” ছিহ্ ভাইয়া এসব কি বলছ? আমি তোমার ছোট বোন হই। লজ্জা-শরম কি বিকিয়ে দিয়েছ? ”
” যে ঝটকা খাইলাম। এখন লজ্জা-শরমও কাছে আসতে লজ্জা পাইতাছে। ” কথা মাঝেই আনানের চোখ যায় কিছুদূর সামনে দাঁড়ানো তাহমিদের দিকে। তাহমিদ চোখ পাকিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে কুহুর খাওয়া শেষ। আনান কুহুর হাত থেকে প্লেট নিয়ে ডাষ্টবিনে ফেলে এসে বলে,
” শোন আমার কলিজার বইন, তোর যখন যা লাগবে আমাকে বলবি। সাথে সাথে আমি সেগুলো হাজির করার চেষ্টা করব। মনে রাখবি এই অধম ভাই সব সময়ই তোর পাশে আছে। ” আনানের ভাষন দেয়ার ভঙ্গিতে বলা কথা শুনে কুহু হাসতে থাকে। আনান ইশারায় কুহুকে সিক্তাদের কাছে যেতে বলে। কুহু চলে গেলে আনানও তাহমিদের কাছে আসে।
” আমি পাশ করেছি, ভাই? দশে দশ পেয়েছি তো? ”
” দশে পঞ্চাশ পেয়েছিস। এবার চল, অনেক রাত হয়েছে। বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নে। ”
” কবে থেকে এসব চলছে, ভাই? আমার চোখে ধুলো দিয়ে আমার সামনেই সবকিছু চালিয়ে গেলে! ”
” কিসব চলছে! তোর চোখে কোন ধুলা দেখতে পাচ্ছিনা আমি। বেশি কথা না বলে চল। আর শোন এখন কাউকে কিছুই বলিসনা। যা দেখছিস সব একতরফা। ” তাহমিদের কথা শুনে আরেকবার ঝটকা খায় আনান। একতরফাতেই এত খেয়াল, এত কেয়ার! বাপরে বাপ, এত ভালোবাসা কই থেকে আসে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here