#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
আব্রাহাম রান্না করছে, আয়াত গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আয়াত’কে রান্না করতে না দেওয়ায়, প্রচুর বিরক্ত আয়াত। আব্রাহাম আয়াতের বিরক্তি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আব্রাহামকে হাসতে দেখে, আয়াত ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলল। আব্রাহাম আয়াতের দু’গলা স্পর্শ করে, গভীর ভাবে আয়াতের দুগালে অধর ছোঁয়ালো। আয়াত স্থীর হয়ে গেল। নড়াচড়া না করে, চুপ করে বসে রইলো। আয়াত’কে শাসিয়ে বলল।
–যতবেশি বিরক্ত হবে। ততবেশি শাস্তি পাবে। তবে তোমাকে এমন শাস্তি দিতে, আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি চাইলে বিরক্ত হতে পারো। আব্রাহামের কথায় একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করল আয়াত। রাগান্বিত হয়ে বলল।
–তোমাকে আমি রান্না করতে বলেছি। আমার হাত নেই। যাও সরো। আমাকে রান্না করতে দাও। বলেই সবজি কাটার জন্য প্রস্তুত হলো। আব্রাহাম আয়াতের হাত থেকে সবজি কেঁড়ে নিয়ে বলল।
–তুমি তো আমাকে রান্না করতে বললে, এখন আবার অস্বীকার যাচ্ছো কেনো?
–সে তো আমি রাগ করে বলেছি।
–তুমি আস্তে একটা গোলাপ ফুল। আর ফুল’কি নষ্ট করার জিনিস। ফুল হচ্ছে, যত্ন সহকারে আগলে রাখার জিনিস। আমি কেনো আমার ফুলকে দিয়ে, কাজ করিয়ে হাতটা’কে নষ্ট করে দিব। আমার যদি রোজকার করার ক্ষমতা না থাকতো, সে আলাদা কথা ছিল। আমার রোজকার করার ক্ষমতা আছে। আমার যতদিন রোজকার আছে। ততদিন তোমাকে কাজ করতে দিব না। যেদিন থেকে, আমার রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। সেদিন থেকে আমি নিজে কাজ করবো। তবু-ও তোমাকে কাজ করতে দিব না। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াতের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। মানুষের মনকে ভালো করে দেওয়ার জন্য, এই ছোট্ট একটা কথাই যথেষ্ট। মানুষটা তাকে ভালো রাখতে পারুক বা না পারুক। তাকে ভরসা দিয়েছে। এটাই অনেক। মানুষটাকে চাইলে’ও দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। তাকে কষ্ট দিতে, আমি বারবার ব্যর্থ হচ্ছি কেনো? ভালোবাসার মানুষ গুলো বুঝি এমনই হয়। তাকে যতটুকু কষ্ট দিব। তার থেকে দিগুণ কষ্ট আমিই পাব। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। আয়াতের ভাবনার মাঝেই, আব্রাহাম গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
–আমাকে দিয়ে, এত রাতে এতগুলো জিনিস কিনিয়ে আনালে, ব্যাপার কি বলো তো?
–ব্যাপারটা ক’দিন পরে, তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। হাজার হলে-ও আমি তোমার বউ হই। তোমার কষ্ট কিছুটা কমিয়ে রাখলাম। ক’দিন পরে কাজে দিবে।
–তারমানে আব্বু আম্মুর কথা সেদিন, তুমি’ও শুনেছো? আয়াত জবাব দিল না। নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করল।
আজকে ঘরোয়া ভাবে, আব্রাহাম আর আব্রাহামের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়েছে। কাছের আত্মীয়-স্বজন, আর কিছু প্রতিবেশীদের দাওয়াত করা হয়েছে।
–আব্রাহামের বউটা আব্রাহামের মতোই সুন্দর হয়েছে। এই বাড়ির তিন ছেলের, মধ্যে আব্রাহামই সব থেকে সুন্দর। আব্রাহামের বাবা-মা শ্যাম বর্নের তবে, আব্রাহাম কেনো এত ফর্সা হলো, এটাই তো আমার মাথায় আসে না।
–আপনি-ও তো অনেক কালো আন্টি, আপনার মেয়ে এত ফর্সা হলো কি করে, এটা আমার মাথায়ও আসে না। আজকাল ফর্সা হবার জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্রিম পাওয়া যায়। আপনার মেয়ে কি সেগুলো মেখেই ফর্সা হয়েছে। আবরারের কথায় মুখ বাকালো মহিলাটি। তাচ্ছিল্য করে বলল।
–আমার মেয়ে, এমনিতেই ফর্সা। সবই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই, আমার মেয়ে সুন্দর হয়েছে।
–আপনার মেয়ের বলায় আল্লাহর সৃষ্টি, আমার ভাইয়ের বেলায় এত প্রশ্ন কেনো?
–এত ভাই ভাই করছো? তোমার বড় ভাই কই? সেই যে, পালিয়ে গিয়েছে। আর তো বাড়ি ফিরলো না। শুনে ছিলাম আব্রাহাম নাকি, এই মেয়েকে আঁটকে রেখেছিল। এখন আব্রাহামও তোমাদের ভুলে গেলেই হয়। মহিলাটির কথা শেষ হবার সাথে সাথে সফিউল চৌধুরী বলল।
–সেই সুযোগ আমি দিব না। আব্রাহাম তুই বলেছিলি। আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবি। কতগুলো বছর হয়ে গেল। এখনো আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিলি না কেনো? আহনাফকে যখন পালাতে সাহায্য করেছিলি। তখন মনে ছিল না। যে মানুষ একবার হারিয়ে যায়। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
–বাবা যে, হারিয়ে যায়। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। যে, ইচ্ছে করে লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার ছেলে পালিয়ে গিয়েছে, এতে আমার কি দোষ। সব দোষ আমি কেনো নিব? তোমার ছেলে তো বাচ্চা না। আমি তাকে কোলে করে নিয়ে, পালাতে সাহায্য করি নাই। সে নিজ পায়ে পালিয়ে গিয়েছে। আর অপরাধী আমাকে বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার ছেলেকে নিয়ে আসতে পারি নাই। এর জন্য তুমি আমাকে দোষরোপ করতে পারো না।
–তুই আমার নিজের ছেলে না। সেজন্য প্রতিশোধ নিচ্ছিস। তোর মা মারা যাবার পরে, তোর কোন দিকে কমতি রেখেছি। তোকে বাসায় এনে, নিজের ছেলের পরিচয় দিয়েছি৷ পড়াশোনা করিয়েছি। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে, ডাক্তারি পড়িয়েছি। তার প্রতিদান তুই আমাকে, এভাবে দিলি। আব্রাহাম জানতো সফিউল চৌধুরী এমন কথাই বলবে, সে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সে আজ চুপ থাকবে না। এই বাসা থেকে বের হতে হলে, প্রতিটি কথার জবাব দিয়ে, তারপরে বের হবে। আব্রাহাম রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।
–আপনি ভুল বলছেন। আপনি আপনার টাকায় নয়। আমার বাবার টাকায় আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। আমাকে, আপনার দুই ছেলেকে পড়াশোনা করানোর মতো ক্ষমতা, আদৌও আপনার ছিল। টেনেটুনে সংসার চালাতেন। আপনার মুখে এত বড় বড় কথা মানায় না। আমার বাবা না থাকলে, আজকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতেন। আপনি আজ এত বড় অফিসের মালিক, সেটাও আমার বাবার দান করা। আপনি যে, এত বড় বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। সেটাও আমার বাবার। বাড়িটা আঠারো বছর হয়ে যাবার পরে, আমার নামে হয়ে গিয়েছিল। আপনি ঠিক ষড়যন্ত্র করে, বাড়িটা আপনার নামে, লিখিয়ে নিয়েছেন। তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমার একটাই আফসোস, আপনারা আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। আপনাদের থেকে কি এমন চেয়ে ছিলাম। একটু ভালোবাসাই তো চেয়েছিলাম। সেই ভালোবাসাটাই পাই নাই আমি। যে বয়সে মায়ের সাথে থাকার কথা, সেই বয়সে আমাকে ম্যাচে থাকতে হয়েছে। ম্যাচের বড় ভাইদের হাতে মার খেতে হয়েছে। ম্যাচের বিশ্রী রান্না খেতে হয়েছে। মায়ের হাতে রান্না খাবার জন্য কত, আকুল হয়ে থেকেছি। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ গ্রহণ করতে পারি নাই। তোমরা আমাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে গিয়েছো। কখনো ভালোবাসার হাত মাথায় রেখে, কাছে টেনে নাও নাই। আমি ভেবে ছিলাম। তোমরা হয়তো এই সত্যটা সারাজীবন, তোমাদের মধ্যে রাখবে। এটা বিশ্বাস ছিল। সেদিন সকালে আয়াতের বাসায় তুমি আর খালা মিলে, বুদ্ধি পরামর্শ করছিলে, আমি সেদিনই তোমাদের সব কথা শুনে ছিলাম। মা মারা যাবার পরে, খালারা কোনোদিন মা হয়ে উঠতে পারে না। সেটা আবরার ভাইয়ার আম্মু প্রমাণ করে দিল। কথা দিলাম আজ থেকে তোমাদের আব্বু আম্মু বলে ডাকবো না। যার বাবা-মা পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তার এত কিসের আব্বু আম্মু ডাকতে হবে। কারো থেকে বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা আশা করতে হবে। এখন নিশ্চয়ই বলবে, আমি তোমাদের ছেলে না। বাসা থেকে বেড়িয়ে যা। বাকিটা তোমাদের বলতে হবে না। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। আমার স্ত্রীকে খাওয়ানোর মতো যথেষ্ট সার্মথ্য আমার হয়েছে। ভালো হয়েছে, আয়াতের বাবা-মা এখনো আসে নাই। তারা এসব দেখলে অনেক কষ্ট পেত। আমি তোমাদের নিজের ছেলে, না হতে পারি। আবরার ভাইয়া তোমাদের নিজের ছেলে, তার সংসারে অশান্তি হতে পারে। আবরার ভাইয়া আমার সাথে যতটা অন্যায় করেছে, তার থেকে দিগুণ উপকার করে, আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সব খারাপ মানুষ খারাপ হয় না। মানুষটা আমার ভিষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার জন্য তার ক্ষতি হোক। এটা আমি চাইনা। আয়াতের বাবা-মা আসলে, বলে দিও। আমি তোমাদের সাথে থাকবো না। আয়াতকে নিয়ে আলাদা থাকবো। তাই আয়াতকে নিয়ে নতুন বাসায় চলে গিয়েছি।
–আব্রাহাম তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। এই রাত করে তুই কোথায় যাবি। আমি তোকে কোথাও যেতে দিব না।
–যে, নিজের ভাই না। তার জন্য দরদ উথলে পড়ছে। আর নিজের ভাই এইদিকে লা-পাত্তা সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তাই তো বলি। ভাই ভাইয়ে, বাবা ছেলে, মা ছেলের মধ্যে মিল নেই কেনো? নিজের বোনের ছেলেকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেয়। মানুষ কিভাবে পারে, এত বড় সত্যি গোপন রাখতে। আব্রাহাম আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। বাসার বাহিরে চলে গেল। সে জানে এখন তাকে, কি কি কথা শুনতে হবে। তার আপাতত একটু নিরিবিলি পরিবেশ দরকার। মানুষের কথার আঘাতে সে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। বাসা থেকে একটু দূরে এসে, একটা গাছের নিচে বসে আছে।
প্রতিবেশীরা হাজার রকমের কথা শুনিয়ে চলে গেল। সফিউল চৌধুরী পাথরের ন্যায় বসে আছে। মাথায় হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন সে, সত্যটা জানিয়ে ভুল করল সে, প্রতিবেশীরা ছিঃ ছিঃ করে গেল। যেমনটা ভেবেছিল। সবকিছু উল্টো হয়ে গেল। পাশেই আবরারের মা বসে আছে। রজনী তার বাবা মাকে ফোন করে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। আজাদ শিকদার প্রচন্ড রেগে গিয়েছেন। রজনীকে বাসায় চলে আসতে বলেছেন। রেগে আর চৌধুরী বাড়িতে আসেন নাই। হাসিমাখা পরিবেশটা মুহুর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শরীর কাঁপানো শীতল হওয়া বইয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ সময় নিয়ে বসেছিল আব্রাহাম। হঠাৎ করে পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করল। দু-চোখ মেলে তাকালো। আয়াতকে দেখে হালকা হাসলো। তারপরে মলিন কণ্ঠে বলল।
–এখনো ছেড়ে যাওনি যে! শুনলে না আমি এতিম। আমার কেউ নেই। খালার কাছে মানুষ হয়েছি। এমন একটা ছেলের সাথে সংসার করবে?
–সবাইকে নিজের মতো মনে করো? মানুষকে খারাপ সময়ে একা রেখে পালিয়ে যাব। প্রিয় মানুষের খারাপ সময়ে যদি পাশে থাকতে না পারি। তাহলে কিসের প্রিয় মানুষ আমি। তাছাড়া তোমাকে যদি ছেড়ে যাবারই হতো তাহলে, পাঁচ বছর আগেই চলে যেতাম। পাঁচ বছর আগে আমি’ও অবাক হয়ে ছিলাম। যখন বিয়ের রেজিস্ট্র পেপারে সাইন করতে গিয়ে, তোমার বাবা-মায়ের নামের জায়গায়, অন্য কারো দেখেছিলাম। এতদিন যখন ছেড়ে যাই নাই। বাকি জীবনটাতেও আর যেতে চাই না। আয়াতের কথা শুনে চুপ হয়ে গেল আব্রাহাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। ভেতরে ভেতরে এত কষ্ট হচ্ছে , যা সহ্য করার মতো নয়। কি সুন্দর করে সবার সামনে বলল, তুই আমার ছেলে না। আজ তার নিজের বাবা হলে, এভাবে বলতে পারতো। আজকে ভিষণ করে, মায়ের কথা মনে পড়ছে।
–অনেক রাত হয়েছে। বাসায় যাবে চলো।
–আমি আর ওদের বাসায় যাব না।
–তাহলে আমাদের বাসায় চলো?
–তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে, কি জবাব দিব। আমি যেতে পারবো না। তুমি আজকের রাতটা ওদের বাসায় থাকো। কালকে আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।
–তুমি গাছের নিজে বসে থাকো। আমি গাছে উঠে বসে থাকি। সকাল হলে ডেকে দিও। বসে বসে তোমার ব্যবস্থা দেখবো। আয়াতের কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল আব্রাহাম।
–এই মেয়ে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?
–হ্যাঁ তুমি খারাপ করে দিয়েছো। আজকের রাতটা ঐ বাসায় কাটিয়ে দেয় দেই। সকাল হলেই চলে যাব।ও বাসায় কতগুলো জিনিস আছে। সেগুলো নিতে হবে। আমার স্বামীর টাকার মূল্য নেই নাকি। একটা সুতোও রাখবো না। বলেই আব্রাহামের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
চলবে…..#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
স্থীর হয়ে আছে দু’নয়ন। আয়াত হাত বাড়িয়ে রয়েছে। আব্রাহাম কিছুক্ষণ নিরব রইলো। নিরবতা কাটিয়ে, শান্ত কণ্ঠে বলল। কবর স্থানে যাবে আয়াত? আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াতের চোখ আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত’কে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আব্রাহাম হালকা হাসলো। আয়াতের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় প্রশ্ন করল। কবর স্থানে যাবে আয়াত? এবার আয়াত চুপ থাকলো না। ভীত কণ্ঠে জবাব দিল। আমি যাব না। আমার ভয় লাগে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। এত রাতে কবর স্থানে কে যায়? আয়াতের কথা শুনে আব্রাহাম দু’কদম সামনের দিকে এগোলো। এগোতে এগোতে বলল।
–আমি যাই! কবর স্থান খারাপ জায়গা নাকি। যে, সেখানে রাতে যাওয়া যাবে না। আমরা যে, কবর স্থানকে এত ভয় পাই। অথচ পৃথিবীর সব থেকে পবিত্র জায়গা হচ্ছে, কবর স্থান। সেখানে তুমি, যদি সারাদিন রাত বসে কাটিয়ে দাও। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। একবার চলো না যাই কবর স্থানে? কবর স্থানের দিকে তাকালে, পৃথিবীর সব আয়োজন বৃথা মনে হবে। মনে অহংকার থাকলে, তা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। আজ তারা শুয়ে আছে, কোনো একদিন আমি’ও তাদের পাশে শুইয়ে পড়বো। তাহলে এত ভয় কিসের? মাঝে মধ্যে যখন শান্তি পাবে না। তখন কবর স্থানে যাবে। শান্তি পাবে। বিশ্বাস হয় না। আমার-ও হয়েছিল না আয়াত। কবর স্থান গেলে, এমন এক শীতল হওয়া বইয়ে যায়। মনে হয় বুকটা প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিয়ে গেল। কবর স্থানে গিয়ে, কবর বাসীদের জন্য দোয়া করবে, এতে কবর বাসীরা তোমার জন্য একটু হলে-ও শান্তি পাবে। তোমার মনের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করবে। তোমার কষ্ট গুলো হালকা মনে হবে। আমি তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। আমি নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াতের শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়াতকে ভয় পেতে দেখে, আব্রাহাম হাসলো। আয়াতের কাছে এসে, আয়াতে’র কাঁধে হাত রেখে সামনের দিকে এগোতে এগোতে বলল।
–আমার ওপরে ভরসা আছে?
–নিজেকে’ও এতটা ভরসা করি না! যতটা তোমাকে ভরসা করি।
–তাহলে ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি আছি না। আমি থাকতে, তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিব না৷ কবর স্থানের পাশে, দারোয়ান কাকার বাসা। আমি তোমাকে কাকার বাসায় রেখে আসবো, তুমি ভয় পেও না৷ তোমাকে কষ্ট পেতে দিব না। আয়াত আর কোনো কথা বলল না। আব্রাহামের ডান হাতটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই দু’জন কবর স্থানে পৌঁছে গেল। আব্রাহাম আয়াত’কে একটা বাসার মধ্যে নিয়ে গেল। সেখানে দু’জন বৃদ্ধ থাকে। আয়াত তাদের দেখে অবাক হলো। বৃদ্ধ লোকটি আব্রাহামকে উদ্দেশ্য করে বলল।
–এটা আমাদের আয়াত মা?
–হ্যাঁ এটাই আয়াত, আজকে তোমাদের বাসায় থাকবে। তোমাদের আবার কোনো সমস্যা নেই তো?
–এটা তুমি কোনো কথা বললে, তোমরা এতবড় ঘরের মানুষ এত রাত করে আমাদের বাসায় আসলে, আমি এতরাতে তোমাদের কি খেতে দিব? রাত করে কি বাজারে কিছু পাওয়া যাবে?
–খেতে দিতে হবে না। আমার বউটাকে দেখে রেখো। তাহলেই হবে। আমি মায়ের কবরের কাছে যাব। আয়াত’কে একদম বের হতে দিবে না। কেউ এসে ডাকলে, দরজা খুলবে না। আমি আমার জানটাকে তোমাদের হাতে রেখে যাচ্ছি। দেখেশুনে রাখবে। তোমাদের ওপরে ভরসা আছে। আমার ভরসার মূল্য দিবে। আমার সাথে বেইমানি করলে, কি হয়। সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। আব্রাহামে’র শেষের কথায় বৃদ্ধের পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। আব্রাহাম চলে যেতে লাগলে, আয়াত আব্রাহামের এক হাত আলতো করে ধরলো। তা দেখে আব্রাহাম হেসে বলল।
–ভয় পেও না। আমি এখনই চলে আসবো। আয়াত’কে ভরসা দিয়ে চলে গেল আব্রাহাম। আব্রাহাম চলে যেতেই বৃদ্ধের স্ত্রী আয়াতে’র মাথায় হাত বুলিয়ে ভালো মন্দ প্রশ্ন করতে লাগলো। আয়াত’কে একটা রুমে দিয়ে, তারা ঘুমিয়ে পড়লো। সারারাত আয়াতে’র ঘুম হলো না। অচেনা জায়গায় ঘুম আসবে না এটাই স্বাভাবিক। সারারাত ছটফট করতে করতেই আয়াতে’র সময় কেটে গেল। আব্রাহাম রাতে আর বাসায় ফিরে নাই। এই ছেলের ভয় বলতে কিছু নেই। একটা রাত পুরোটাই কবর স্থানে কাটিয়ে দিল। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আয়াতে’র, কার ওপরে ভরসা করে তাকে এখানে একা রেখে গেল। এরা তো তাকে খুন করে-ও ফেলতে পারতো। নিজের ভাবনাকে নিজেই ধিক্কার জানালো আয়াত। আব্রাহাম যে, কতটা বিচক্ষণ সেটা তার থেকে, ভালো কে জানে? তার জীবনের সবথেকে প্রিয় জিনিসটি নিশ্চয়ই কোনো ভুল মানুষের কাছে রেখে যাবে না।
রাতের আঁধার কেটে গিয়ে, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। আয়াত বৃদ্ধের স্ত্রীর সাথে কবর স্থানে গিয়ে দেখে এসেছে। সেখানে আব্রাহাম নেই। আয়াতে’র মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। কাল রাতে বলে গেল। আমি এখনই চলে আসবো। তারপরে মানুষটা কোথায় উধাও হয়ে গেল। আয়াত মন খারাপ করে, আবার বৃদ্ধের বাসায় চলে আসলো। বৃদ্ধের স্ত্রী আয়াত’কে রুটি আর আলু ভাজি খেতে দিয়েছে। রুটি আয়াত কবে খেয়েছে তার জানা নেই। আয়াতে’র সবথেকে অপছন্দের খাবার হচ্ছে, রুটি। কিন্তু তাদের মন রক্ষা করতে আয়াত একটা রুটি খেল। সারাদিন গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। এখনো আব্রাহামের দেখা মিলল না। আয়াতে’র এবার প্রচুর রাগ হচ্ছে, আয়াত বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। এভাবে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে। আয়াতের ভাবনার মাঝেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল আব্রাহাম। ঘেমে একদম একাকার হয়ে গিয়েছে। কপাল বেয়ে ঘাম গুলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। মানুষটার অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে, আয়াতের সমস্ত রাগ উধাও হয়ে গেল। গোল গোল চোখ করে, আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত’কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল।
–এভাবে বোকার মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো কেনো? কাছে এসে ঘাম গুলো মুছিয়ে দিতে পারছো না। এসব কথা বলে দিতে হয়। স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে শিখো মেয়ে।
–কাল রাত যে, উধাও হলে, আজকে বিকালে এসে জ্ঞান দিচ্ছো? সারাদিন রাত কোথায় ছিলে, তোমার যে একটা বউ আছে। সেটা কি তোমার মনে ছিল। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম আয়াতের দিকে এগিয়ে আসলো। আয়াতে’র শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল।
–কোথায় গিয়ে ছিলাম। সেটা তুমি গেলেই দেখতে পাবে। তারপরে সবার থেকে বিদায় নিয়ে, দু’জন মিলে বেড়িয়ে পড়লো। গাড়িটা এসে একটা বাসার সামনে দাঁড়ালো। বাসা থেকে একটু দূরে আব্রাহামের হসপিটাল দেখা যাচ্ছে, আয়াত আব্রাহামের দিকে তাকালো। মুখটা গম্ভীর করে বলল।
–আমাকে আবার পাগল বানিয়ে দিবে নাকি? আবার হসপিটালে নিয়ে আসলে কেনো? আব্রাহাম আয়াতের কথার উত্তর দিল না। আয়াতের হাত ধরে, সামনের বাসার সামনে নিয়ে গেল। দরজার কাছে আসতেই, আয়াতের হাত ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে ভেতরে যেতেই আয়াতের দু-চোখ আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। অবাক নয়নে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে, আব্রাহামকে দিয়ে সেদিন রাতে যে জিনিস গুলো কিনিয়েছিল। সেই সবকিছু বাসার মধ্যে রয়েছে। আব্রাহাম আয়াতে’র কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে, হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলল।
–আমাদের সংসার, কেমন হয়েছে। নিজ হাতে সাজিয়েছি। এই রাজত্ব তোমার, আর এই রাজ্যের রাজাও তোমার। এখনে শুধু তোমার রাজত্ব চলবে। কেউ তোমাকে কোনো কথা শোনাতে পারবে না। আমরা অনেক ভালো থাকবো আয়াত। আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। আল্লাহ তোমার মাধ্যমে আমাকে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এনে দিয়েছেন। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমার জীবনটা এত সুন্দর করে, গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে কি উপহার দিব। তা আমার জানা নেই। তবে ভালোবেসে আগলে রাখার ক্ষমতা আমার আছে। আমাকে ছেড়ে চলে যেও না আয়াত। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, আমি বড্ড এলোমেলো হয়ে যাব। আয়াতের চোখে মুখে ধরা দিয়েছে খুশির রেখা। মানুষটা এত নিখুত সুন্দর কেনো? সারাটাদিন এত কষ্ট করল। তাকে এতটুকু কষ্ট করতে দিল না। নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে আয়াতে’র। তা না হলে আব্রাহামের মতো জীবন সঙ্গী পায়।
–এটা আমার সংসার। এই রাজ্যের রাণী আমি। আমার অনেক ভালো লাগেছে। তোমার বাবা-মা থাকলে, সংসারটা পরিপূর্ণ হয়ে যেত। শশুর-শাশুড়ি ছাড়া সংসারটা পরিপূর্ণ লাগে না। আয়াতে’র মন খারাপ হয়ে যেতে দেখে, আব্রাহাম শান্ত ভাবেই বলে উঠলো।
–আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন। আমরা যত পারবো। তাদের জন্য দোয়া করবো। এতেই তাদের ভালো হবে। মন খারাপ করো না। আল্লাহ যা করেন ভালো জন্যই করেন। উনার ওপরে আমার অনেক বিশ্বাস আছে। সবাই আমাকে নিরাশ করলে-ও তিনি আমাকে কখনো নিরাশ করেন নাই। আমার থেকে যা কিছু কেঁড়ে নিয়েছেন। তার থেকে দিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আব্রাহামের কথা শুনে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আয়াত।
–বাসাটা অনেক সুন্দর হয়েছে। হসপিটালের কাছে বাসা নিয়েছো। এতে তোমারই ভালো হয়েছে। যাওয়া আসা করতে অসুবিধা হবে না। সারাদিন এত কষ্ট করলে, আমাকে জানাও নাই কেনো?
–তুমি চিন্তা করতে তাই। আবরার ভাইয়ার সাহায্যে, এসব করেছি। রজনী ভাবি নাকি সবকিছু বলে দিয়েছে। তোমার বাবা অনেক রেগে গিয়েছে। রজনী ভাবিকে বাসায় নিয়ে গিয়েছে। তোমাকে আর আমাকে তোমাদের বাসায় যেতে বলেছে। তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে। বাসার জিনিসপত্র তোলা হলেই তোমাদের বাসায় যাব। তুমি চাইলে, ক’টাদিন থেকে আসতে পারো। তোমার ভালো লাগবে। ক’টাদিন হলো, তোমার ওপরে যা যাচ্ছে।
–হ্যাঁ আমি যাব আর তুমি মেয়েদের সাথে আড্ডা দিবে।
–একদম বাজে কথা বলবে না। আমার ঘরে পরী রেখে, আমি কেনো কয়লার দিকে তাকাবো। তোমার এসব কথা শুনবো না দেখে, হসপিটালের কাছে বাসা নিয়েছি। যখন ইচ্ছে হবে। গিয়ে দেখে আসবে। আমি কি করছি। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত হেসে বলল।
–তুমি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো কেনো? আমি তো তোমার সাথে মজা করছি। বাসাটা সুন্দর করে সাজিয়েছো। এখনো অনেক কিছু নিয়ে আসা বাকি আছে।
–আমি জানি নাকি সংসারে কি কি লাগে। আমার যে-সব জানা ছিল। আমি সে-সব এনেছি। তোমার যা যা লাগবে। তুমি আমাকে বলবে, আমি সবকিছু এনে দিব। এখন গিয়ে বিশ্রাম করো। তোমার কাল ঘুম হয় নাই।
–তুমি কোথায় যাবে?
–হসপিটালে যাব।
–কাল থেকে অনেক পরিশ্রম করেছো। আজকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না। বলেই আব্রাহামের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আয়াতে’র দিকে তাকিয়ে আব্রাহাম কোনো কথা বলতে পারলো না। আজকে তার খুব একটা বেশি কাজ নেই। শরীরটাও বেশ খারাপ লাগছে। কোনো কথা না বলে, মাথা চুলকে ওয়াশরুমে চলে গেল। আব্রাহামের কান্ড দেখে, আয়াত হেসে দিল। ভিষণ অবাধ্য ছেলেটাও দিনশেষে কারো কাছে বাঁধা। প্রতিটি মানুষের কথা উপেক্ষা করা মানুষটাও দিনশেষে কারো সব কথা শুনতে বাধ্য। কথায় কথায় রেগে যাওয়া মানুষটাও দিনশেষে কারো কাছে নরম। সবমিলিয়েই তো জীবন।
পরের দিন সকাল বেলা আয়াত’কে সকালে আয়াতদের বাসায় রেখে, আব্রাহাম হসপিটালে চলে গিয়েছে। বিকেলে আসবে সে। আয়াত ড্রয়িং রুমে বসে আছে। আয়াতে’র আব্বু-আম্মু আয়াত’কে ঘিরে ধরে রেখেছে। বাবা-মায়ের চোখে মুখে স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ। আয়াতের হাসিমাখা মুখখানা দেখে রাগ গুলো হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যেতে চাইছে। তবু্ও নিজেদের শক্ত রেখেছে দু’জন। আয়াতের আম্মুর গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো।
–এতকিছু হয়ে গেল, আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না। আমরা কি তোমাদের ফেলে দিতাম। কখনো শুনেছো, মহিষের শিং মহিষের কাছে ভারি হয়েছে। মায়ের কথা শুনে, আয়াত দৃষ্টি নত করে দিল। একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আয়াত কিছু বলতে যাবে। তার আগেই আয়াতে’র দু-চোখ থমকে গেল।
চলবে…..