#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(১২)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
__________________
“মেয়ে মানুষের মত এমন রঙ ঢঙ করছেন কেন? আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছেলেটাকে টিচার পড়া ধরেছে। সহজ ভাবে বলে দিলেই হয় সে আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ড। কাপাকাপি করার কি আছে বুঝলাম না!”
জাওয়াদ অবাক হওয়ার দরুণ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে মালিহার পানে তাকিয়ে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা মালিহা বিষয়টা এত সহজভাবে নিবে। যেখানে সে নিজেই….!
জাওয়াদের নড়চড় না দেখে মালিহা বিরক্ত হলো। ভ্রু কুচকে বলল, “অদ্ভত এমন করছেন কেন? কি ভেবেছেন আমি জানবো না? জানাটা কি খুব অস্বাভাবিক বলুন?”
“অস্বাভাবিক বটে। কিন্তু তোমার কেন স্বাভাবিক লাগছে? তার প্রসঙ্গ এবং তাকে কখনও তুমি দেখোনি। তাহলে?”
মালিহা স্মিত হেসে প্রতিত্তোরে বলল, “বলছি! আপনার সব কাজিনদের আমি চিনি। সম্পর্ক আপনার সাথে অস্বাভাবিক থাকলেও তাদের সাথে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ ছিল আমার। বিয়েতে সবাই উপস্থিত ছিল। আপনি নব বধূকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বাকিরা তো ফেলে যাইনি। আফসোস এটাই যে, যার সাথে সম্পর্ক ঠিকঠাক থাকার কথা তার সাথেই আমার যোজন যোজন দুরত্ব ছিল। বিষয়টা কেমন অদ্ভুত না? আর রইল কথা আপনার প্রাণপ্রিয় এক্স গার্লফ্রেন্ডের কথা! মানুষ তার গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডের ছবি এভাবে ফাইলসের শেষ প্রান্তে রাখে। একদম লুকিয়ে চুরিয়ে। এ সম্পর্কের কোন নিশ্চয়তা নেই আর নেই কোন স্বীকৃতি। পরিবারের নিকট জবাবদিহিতার ভয়েও অনেকে এ কাজ করে। তবে যাদের অনেক সাহস তারা শুধু ফোনে না ঘরের দেয়ালেও টানিয়ে রাখতে দ্বিধাবোধ করে না। তবে আপনার সে সাহস নেই। যখন জিজ্ঞাসা করলাম কে এই মেয়ে? আপনি স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক হয়ে গেলেন। খটকা এখানেই লাগলো। আমার ধারণা ভুল নয়। ঠিক বললাম তো স্বোয়ামী ?”
জাওয়াদ কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। মালিহা নামক মেয়েটাকে সে যতটা সহজ মনে করেছিল কিন্তু দিন যাচ্ছে মেয়েটা ততই কঠিন হচ্ছে। কেমন যেন রহস্যময়ী। এসবের পিছে কি তার দোষ! ভাবনা চিন্তা না করে বলল, “জেনেই যেহতু গিয়েছ কি আর করার। তুমি চাইলে চলে যেতে পারো ইবনাত। আর আটকাবো না। আমার জন্য তোমার জীবনটা ধ্বংস হোক চাই না।”
ফুসে উঠলো মালিহা। তেরে আসলো জাওয়াদের দিকে। টিশার্টের কলার ধরে বলল, “মুখ সামলে কথা বলুন। বিয়ে কি আমি প্রতিদিন করবো? আপনার মুখ থেকে এমন অহেতুক অবান্তর কথা শোনার জন্য এতগুলো দিন অপেক্ষা করেছিলাম নাকি? প্রেম করেছিলেন ভালো কথা। এখন ভুলে যান। কখনও যদি এসব নিয়ে কিছু শুনি ধা’রা’লো অ’স্ত্র দিয়ে কু’পি’য়ে মে’রে রেখে যাব। বেডা মানুষ এমন মিনমিন করেন কেন?”
জাওয়াদ আস্তে করে নিজের কলার থেকে মালিহার হাতটা সরিয়ে দিল। দুজনে এখন খুব কাছাকাছি। জাওয়াদ কিছু না বলে মালিহা আর তাল মধ্যকার সামান্য দুরত্ব ঘুচিয়ে দিল। দুজনের মাঝে ফাঁকফোকর নেই। মালিহা ঠিক পেয়ে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। লোকটার উদ্দেশ্য তার ভালো ঠেকছে না। চোখের মনিগুলো কেমন নেশালো।
জাওয়াদ মালিহাকে শক্ত করে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। মালিহার মাথাটা ঠিক জাওয়াদের হৃদপিণ্ড বরাবর। মালিহা শুনতে পারছে জাওয়াদের অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলো না মালিহা। প্রিয় মানুষটার বুকে চুপটি করে মাথা ঠেকিয়ে মিশে রইলো।
জাওয়াদ মোহনীয় স্বরে বলল, “ইবনাত জান! এত তেজ কোথায় থেকে আসে? আমি তো ভাবতে পারছি না ইবনাতের এমন তেজস্বী রূপ। বলি! কোমলমতি বউটা আমার আমি আমার জীবনের সব পিছুটার, অতীত ধুয়ে মুছে সাফ করে তোমার কাছে এসেছি। আরও মাস তিনেক আগেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিজেকে আটকে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পর থেকেই যে মেয়েটাকে ইগনোর করে গেছি সে কি বিয়ের মাস তিনেক পরে পরিবর্তিত আমাকে মেনে নিতে পারবে? তোমার খোঁজ খবর ভাবির থেকে নিতাম। একদিন সাহস করে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম চেষ্টা করতে ক্ষতি কোথায়! যদি এই অধমকে ক্ষমা করে সুন্দরী রমনীটি ঠাই দেয়! পরিশেষে তুমি আমি একসাথে। সবসময়ের জন্যই আল্লাহ্ উত্তম ফয়সালাকারী। তিনি বারবার তা প্রমাণ দেন। কিন্তু তুমি কোন আশায় ছিলে? অন্য কেউ হলে কখনোই থাকতো না।”
“আমি সবসময় আল্লাহর সিদ্ধান্ত উত্তম রূপে গ্রহন করেছি। তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমি কষ্ট, দুঃখ যে কম পেয়েছি তা কিন্তু না। খারাপ আমারও লেগেছিল। আমার প্রতিটি মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চাওয়া ছিল তিনি যেন আমার জন্য যা উত্তম সেটাই করেন। অতঃপর ধৈর্যের ফল আপনি আমি আজ এত কাছাকাছি। কিন্তু আমার সব বোনেরা এভাবে ধৈর্য্য ধরতে পারে না। অল্পতেই হাপিয়ে যায়। বিচলিত বোধ করে। ধৈর্যের প্রথম অংশ হচ্ছে মাকাল ফলের চেয়েও তিক্ত। কিন্তু শেষের অংশ মধুর চেয়েও মিষ্টি। আফসোস তারা তিক্ত অংশে অধৈর্য হয়ে পড়ে তাই মিষ্টতার স্বাদ তারা পাই না। আমি ধৈর্য ধরেছি আমি পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ্।”
জাওয়াদও বলল, “আলহামদুলিল্লাহ্। আসলেই তুমি অনন্যা।”
“সবাই আমাকে মালিহা ডাকে অথচ আপনি কেন ইবনাত ডাকেন?”
“আমার ভালো লাগে। তুমি তোমার নামের মতোই সুন্দর। নামের অর্থ জানো?”
“না।”
“মালিহা ইবনাত অর্থ___রূপসী কন্যা। তুমি তো আসলেই তাই।”
“হয়েছে আর ঢপ দিতে হবে না। আমি কেমন সেটা ভালো করেই জানি। মিথ্যা বলে ইমপ্রেস করা লাগবে না। দেখি ছাড়ুন। কাজ আছে।”
“আজকাল সততার দাম নেই। মন থেকে বললাম বিশ্বাস করলে না। তাছাড়া তুমি আমার স্থায়ী সম্পত্তি তোমাকে দু চারটে ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে ইমপ্রেস করবো কেন? আমার কি সেই বয়স আছে? তুমি তো আমারই। হোক সুন্দর বা অসুন্দর। আর কোথাও যাবে না। এভাবেই লেপ্টে থাকবে। শোন মেয়ে স্বামী সেবা আগে। পরে অন্য কাজ।”
মালিহা মন দিয়ে শুনলো সবগুলো কথা। প্রতিত্তোরে নিরব রইলো। মিশে রইলো বক্ষ পিঞ্জরের একদম কাছে। শুকরিয়া আদায় করলো নিভৃতে আল্লাহর কাছে। এমন একটা দিনের আশায় ছিল সে। দেরিতে হলেও পরম দয়ালু মহান আল্লাহ্ তায়ালা তা কবুল করেছেন। মালিহা মহাখুশি।
কিছু সময় পর আস্তে করে বলল, “আমাদের দুঃখগুলো নির্বাসনে পাঠিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা মনে হয় সুখের বাহনে করে এক নিষ্পাপ শিশুর আগমন ঘটাবেন। সিউর না। শুধু মনে হলো।”
কথাগুলো জাওয়াদের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করতেই শরীরে এক অদ্ভূত শিহরণ বয়ে গেল। অবাক গলাই বলল, সত্যি বলছো ইবনাত? তার মানে আমি?”
জাওয়াদের কন্ঠ আটকে যাচ্ছে। অতি খুশিতে সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
মালিহা বলল, “কিছুটা সিউর। আগে থেকে এত লাফাতে হবে না। আমার পিরিয়ড ডেট দুদিন আগে চলে গিয়েছে। বিলম্ব হয় না। তাই মনে হলো আর আপনাকেও জানালাম।”
“আল্লাহ্ যেন সত্যি সত্যি দেন। ইবনাত তুমি বেশি বেশি করে দোয়া করো। তোমার দোয়া আল্লাহ্ বেশি কবুল করবেন।”
“চুপ করুন তো। আল্লাহর কাছে সবাই সমান। তিনি সবার দোয়া কবুল করেন। শুধু দোয়াটা মন থেকে করতে হবে। আসুন আমরা আজ থেকে একসাথে তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করি। আল্লাহর কাছে একটা নেক সন্তানের দরখাস্ত করি। ইনশাআল্লাহ দয়াময় প্রভু ফেরাবেন না।”
জাওয়াদ বলল, “অবশ্যই। ইনশাআল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ্।”
________________
দিন দশেক পরের কথা!
অম্বরে ফুটে উঠেছে নতুন চাঁদ। আজ চাঁদ রাত। পরদিন ঈদ। আলহামদুলিল্লাহ্। ছাদে নিয়ে গিয়েছে মালিহাকে জাওয়াদ। দুজনে মিলে চাঁদ রাত উপভোগ করবে ইনশাআল্লাহ। ঈদের কিছুদিন পরেই জাকিয়ার বিয়ে। ছেলে ইটালিতে সেটেল্ড। সেখানেই নিয়ে যাবে বিয়ের পর জাকিয়াকে। মালিহার ভাসুক আর্মিতে আছেন। সব ঈদ বাড়িতে পালন করার ভাগ্য হয় না তার। এবার হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্। বোনের বিয়ে বড় ভাই থাকবেনা তাই কি হয়!
শূন্য অম্বরের দিকে চেয়ে মালিহা জাওয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সুখি পরিবার তাই না? আমাদের দুঃখগুলো নির্বাসন হচ্ছে!”
জাওয়াদ ছোট্ট করে উত্তর দিল, “হুম আলহামদুলিল্লাহ্।”
মালিহার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,”ভালোবাসি প্রিয়তমা। চাঁদ রাতকে সাক্ষী রেখে বলছি আমার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র খাদ খুজে পাবে না। পুরোটাই খাটি।”
একফোটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে মালিহার। মুচকি হেসে বলল, “ভালোবাসি প্রিয়তম।”
_______সমাপ্ত_________