কৃষ্ণবেণী পর্ব -৩৬+৩৭

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৬
#নন্দিনী_নীলা

মৌমিতা দিশেহারা হয়ে কল করল আরাফাত কে। আরাফাত কল রিসিভ করে হ্যালো বলতে মৌমিতা কেঁদে উঠল।
” কি হয়েছে কাঁদছ কেন?” অবাক স্বরে বলল আরাফাত।
” আরাফ আই এ্যাম প্রেগন্যান্ট।”
আরাফাত বজ্রপাতের মত চেঁচিয়ে বলল,,” হোয়াট আর ইউ ম্যাড?”
” এখন কি হবে আরাফ বাসায় জানতে পারলে আমাকে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমার খুব ভয় লাগছে।”
” এখন একটাই পথ আছে। বেবি টা নষ্ট করতে হবে।”
মৌমিতা চমকে উঠে বলল,,” এসব কি বলছ। ও আমাদের সন্তান আমি ওকে মারতে পারব না।”
” তুমি কি চাইছ?”
” তুমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসো আরাফ। আমরা বিয়ে করে নেই তাহলে তো আর সমস্যা হবে না সবাই জানলে।”
” হোয়াট কি সব বলছ। আমি এখনি বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়।”
” মানে কি আরাফ প্রেমের শুরুতে তো বিয়ের জন্য পাগল ছিলে। আমি রাজি ছিলাম না বলে কত কথাই বলতে আজ যখন রাজি হচ্ছি মত পরিবর্তন কেন করছ।”
” দেখ মৌমি তুমি আগামীকাল হসপিটালে আসো। যেভাবেই হোক বাচ্চাটা নষ্ট করতে হবে।”
” এক কথা বারবার বলবে না‌। আমার সন্তান আমি মারতে পারব না। তুমি তোমার বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসো।”
” তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছ আমি বললাম তো এখনি বিয়ে করতে পারব না। আমার আরো সময় প্রয়োজন।”
” বিয়ের জন্য কতদিন প্রয়োজন?”
” কমপক্ষে তিনবছর। এখনি বিয়ে করে ঝামেলায় পড়তে চাই না। আমি একটু ইনজয় করতে চাই দেখ প্রেম করছি এভাবেই চলতে দাও না। যখন বিয়ে হবে তখন তো বেবি হবে। এটার জন্য তুমি আমার সাথে ঝামেলা করো না‌‌। কাল সময় মতো সিটি হসপিটালে চলে এসো জান।”
বলেই ফোন কেটে দিল। মৌমিতা পাথরের ন্যায় বসে আছে। কি করবে মাথায় ঢুকছে না। আরাফাত এইভাবে পাল্টে যাবে ও ভাবতে পারছে না। এতো দিন নিজেই বিয়ের কথা বলত এখন যেই ও নিজে চাইছে বিয়ে তখন উল্টো সুর গাইছে। পরদিন হসপিটালে গেল না মৌমিতা তা নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়া হলো।
” কাজটা তুমি ঠিক করলে না মৌমি। সারাটা দিন আমি হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে কল দিয়েছি তুমি ফোন অফ করে রাখলে।”
” আমি বলেছি তো আমি আমার সন্তান মারব না।”
” ওকে ফাইন। তোমার যা খুশি করো। আমি এর ঝামেলা নিতে পারব না।”
” কি বললে তুমি। নিজের সন্তান দের ঝামেলা মনে হচ্ছে এখন?”
” ঝামেলায় তো। শোন এই বেবি যতদিন তুমি না নষ্ট না করবে ততদিন আমার সাথে কোন কন্টাক্ট করবে না।”
সেদিনের পর আর যোগাযোগ করতে পারে নি মৌমিতা আরাফাতের সাথে। আরাফাত এইভাবে ওকে ঠকিয়ে দিবে ও কল্পনাতেও ভাবেনি। চোখে শুধু নোনাজল আসছিল। এদিকে বাসায় ও বিয়ের প্রস্তাব আসছে। তারা ঠিক করে ফেলতে চাইছে। মৌমিতা না কাউকে বলতে পারছে আর না বিয়ে আটকাতে পারছে না। এতো অসহায় লাগছিল। আজ মৌমিতাকে দেখতে এসেছে ও ভেবেই রেখেছে আজ ওর জীবনের শেষ দিন। ভুল মানুষকে ভালবাসার শাস্তি নিজের জীবন দিয়ে চুকাবে।
” আমি বিয়ে করব না মা কেন তোমার আমার কথাটা বুঝতে পারছ না।”
মৌমিতার মা বললেন,” বাইরে আয় তো একবার। দেখ রাজপুত্র এর মতো ছেলে‌। তোর পছন্দ না হলে ভেঙে দেব।”
” সত্যি? আমার পছন্দ না হলে ভেঙে দিবা?” উজ্জ্বল মুখ করে বলল।
” ছেলে তোর পছন্দ হবে আমি শিউর তাই ভাঙার প্রশ্নোই আসে না।”
মৌমিতা ছলছল চোখে তাকিয়ে র‌ইল মায়ের দিকে। মাথায় ঘোমটা টেনে মেয়েকে নিয়ে বাইরে এলেন।
মৌমিতা মাথা নিচু করে বসে আছে।‌
ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
সামনে থেকে কেউ বলল তাদের দিকে তাকাতে। মৌমিতা চোখ মুছে তাকাতেই চোখে কপালে তুলে ফেলল।
বিস্ফোরণ চোখে তাকিয়ে আছে সামনে ওর মুখোমুখী বসে থাকা আরাফাতের দিকে।
এই ছেলেটা বিয়ে করবে না বলে এক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগ করছে না। এখন চলে আসছে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। আসবেই যেহেতু আমার সাথে কেন ঝগড়া করল। সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য নাকি। মলিন মুখটা নিমিষেই আনন্দে ছেয়ে গেল। মৌমিতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরাফাতের দিকে।
ওদের আলাদা কথা বলার জন্য রুমে পাঠানো হলো। মৌমিতা যতটা বিষণ্ণ মুখে বাইরে এসেছিল ততটাই প্রফুল্ল হয়ে ভেতরে এল।
রুমে এসে মৌমিতা আরাফাত কে জড়িয়ে ধরল। আর বলল,
” আরাফ তুমি সত্যি এসেছ। আমি তো বিলিভ করতেই পারছি না। এই সাতদিন আমার কতটা যন্ত্রণায় কেটেছে জানো। তুমি সারপ্রাইজ দিতে এমন করেছ? তাই বলে এতোটা আমি কত কিছু ভেবেছিলাম জানো। একবার আমাদের বেবি নষ্ট ও করতে চাইছিলাম পড়ে ভাবলাম সন্তান বাঁচাতে না পারলে আর নিজে বেঁচে থেকে কি করব। নিজেও আত্নহত্যা করতে চাইছিলাম।”
সাদিকুর বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে মৌমিতার দিকে। সব ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
মৌমিতা সাদিকুর এর হাত ধরে বলল,,” তুমি কথা বলছো না কেন? ”
সাদিকুর ঢোক গিলে বলল,,” আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
মৌমিতা কপাল কুঁচকে বলল,,” মানে! কি ভুল হবে। আর তুমি এমন অপরিচিত দের মতো আপনি করে কথা বলছ কেন?”
” মানে হচ্ছে আমি আপনাকে চিনি না আজকে প্রথম দেখলাম।”
” এটা কি ধরনের ফাজলামো আরাফ। দেখ আমার এমনিতেই এই কয়দিন অনেক কষ্ট কেটেছে আর কষ্ট দিও না।”
বলতে বলতে মৌমিতা সাদিকুর এর হাত পেটের উপর রেখে বলল,,” এখানে আমাদের বাচ্চা আছে আরাফ তুমি তাকে মেরে ফেলতে চাইছিলে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি জানো। এখন আবার আরেকটা মজা শুরু করেছ। আমার এসব ভাল লাগছে না। আমি আজ অনেক হ্যাপি তুমি এসেছ বলে আর কষ্ট দিও না এসব বলে প্লিজ।”
সাদিকুর হাত টান দিয়ে দূরে সরে বলল,,” দেখুন আমি আরাফ নয় আমি সাদিকুর।”
” নামটাও চেঞ্জ করে ফেললে। দেখ এসব মজা আমার ভালো লাগছে না।”
এবার সাদিকুর ধমক দিয়ে বলল,,” আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন। আমি সাদিকুর মজা কেন করব। আপনি হয়তো কারো সাথে আমি গুলিয়ে ফেলেছেন।”
মৌমিতার বুক ধক করে উঠল। ও আরাফ আর ওর একটা ছবি সাদিকুর কে দেখাল।
” এটা তুমি না?”
সাদিকুর ভাল করে ছবিটা দেখে চমকালো।
” না এটা আমার ছোট ভাই আরাফাত। আমরা টুইন।”
মৌমিতা মুখে হাত দিয়ে পিছিয়ে গেল‌। দুজনের কেউই কথা বলতে পারছে না। দুজনেই বিষ্ময় এ হতবিহ্বল হয়ে গেছে।
সাদিকুর বেরিয়ে গেল। মৌমিতা থপ করে ফ্লোরের বসে পড়ল। একটু আগেই যে খুশির জোয়ারে
ভাসছিল নিমিষেই সব নিঃশেষ হয়ে গেল।

মৌমিতা ফোনে না পেয়ে মেসেজ করে রাখল আরাফ কে কিন্তু আরাফের কি সেসব দেখার টাইম আছে? মৌমিতা সাদিকুর এর সাথে আলাদা করে দেখা করে সব খুলে বলল।‌ সব শুনে সাদিকুর মাথা নিচু করে ফেলল।
” কি‌ হলো কথা বলছেন না কেন? আপনার ভাইয়ের সন্তান আমার পেটে। আপনারা কি এর কোন ব্যবস্থা নিবেন না? প্লিজ আমাকে সাহায্য করেন আমি ওকে অনেক ভালবাসি। সমাজে আমি মুখ দেখাতে পারব না।”
” আরাফাত অলরেডি বিবাহিত।”
মৌমিতা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল আর কি কি শুনতে হবে।
” আরাফ বিবাহিত। কিন্তু ও যে বলেছিল..
” জানি না কি বলেছিল কিন্তু ও এখন বিবাহিত। আর বিয়েটা করেছে এক সপ্তাহ আগেই।”
” বলেন কি তার মানে আমার সাথে যোগাযোগ অফ করে অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে। অথচ ও বলেছিল এখনি বিয়ে করতে চায় না।”
” আমি এখন কি করব? ওর সাথে একবার দেখা করিয়ে দেবেন প্লিজ।” খুব অসহায় কন্ঠে বলল সাদিকুর রাজি হলো।
সাদিকুর আরাফাতের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেয় মৌমিতা কে। মৌমিতা আরাফাত কে রাজি করাতে পায়ে পর্যন্ত ধরে। বিবাহিত আরাফাত তাও ও সন্তানের জন্য আরাফাতে ব‌উ হতে চায়। সন্তানের পরিচয় ভিক্ষা চায়। আরাফাত সেদিন সবার সামনে ওকে অপমান করে বের করে দেয়। লজ্জা অপমানে মৌমিতা সেদিন‌ই মরতে চায়। এই মুখ নিয়ে আর বাড়ি যাবে না।
সাদিকুর বাঁচায় সেদিন ওকে আর নিজে থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
” আরাফ এর শাস্তি আপনি কেন নিবেন। আপনি ভালো একজন লাইফ পার্টনার ডিজার্ভ করেন। আমি ভুল করেছি এর শাস্তি আমিই ভোগ করব। নিজের জীবন উৎসর্গ করে।”
” আমি আপনার জন্য বিয়ে করতে চাইছি না। আমি চাইছি আমার সন্তানের জন্য। এই সন্তান আমার পরিচয়ে বড় হবে। আপনি ওই বাড়ির ব‌উ হ‌ওয়ার অধিকার রাখেন। আপনার গর্ভে আমার ভাইয়ের সন্তান। তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে বেঁচে থেকে নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়ার। ভাই তাদের বঞ্চিত করলেও আমি চাই না তারা বঞ্চিত হোক। আপনি আমার ব‌উয়ের পরিচয় ওই বাড়ি যাবেন আর নিজের সন্তানদের অধিকার আদায় করে নিবেন।”
” আপনার মতো একজন ভাল মানুষের দেখা কেন আগে পেলাম না। একটা জানোয়ার পাল্লায় পড়ে আমার জীবনটা নরক হয়ে গেল।”
হু হু করে কেঁদে উঠল মৌমিতা।

খুব তাড়াতাড়িই ওদের বিয়েটা হয়ে গেল। আরাফাত হয়তো ভাবেনি মৌমিতা এই বিয়েটা করবে। আরাফাত বিয়ের কয়দিন আগে থেকে মৌমিতা কে কল করে বিয়েটা করতে মানা করছে অনেক। কিন্তু ধোঁকাবাজের কথায় কান দেয়নি মৌমিতা।
বিয়ের কয়দিন পর‌ই সবাই জানতে পারে মৌমিতা প্রেগন্যান্ট সবাই বলছিল এতো আগেই কেন বাচ্চা নিয়েছে। বিপরীতে মৌমিতা উত্তর না দিলেও সাদিকুর উত্তর দেয়। তিনিই চেয়েছেন তাই।
নয় মাস সাদিকুর এতো কেয়ার করেছে ওর ও মুগ্ধ হয়ে যায় মানুষটার উপর। এতো ভাল মানুষ ও হয় বুঝি। এক‌ই বাসায় থাকার ফলে আরাফাত এর সাথে দেখা হয়। ও দেখা হলেই কেমন জানি করে তাকিয়ে থাকে ওকে দেখলে মৌমিতা আরো চিপকে থাকে সাদিকুর এর সাথে।
সাদিকুর এর সাথে ভালো একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু স্ত্রীর অধিকার ও দিতে পারেনি। সাদিকুর ও তেমন জোর করেনি। কিন্তু স্বামী হিসেবে যতটা দায়িত্ব পালন করার তার চেয়েও বেশি করে।
দীর্ঘ নয় মাস পর মৌমিতা যমজ ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু পরিবার জানে আটমাসে বেবি হয়েছে। একেবারে বাপের কার্বন কপি। দেখতে সেম আরাফাতের মতো হয়েছে। মৌমিতা সন্তানের মুখ দেখে কেঁদে ফেলে।
আত্নীয় স্বজনরা বলে উঠে,,” সাদিকুর রে তোর ছেলেরা তো একেবারে তোর মতো হয়েছে।”
সাদিকুর আর আরাফাত যমজ না হলে এই সন্তান দেখে সবাই বলে উঠতো সাদিকুর এর সন্তান আরাফাতের মতো কেন? কিন্তু আল্লাহর তায়ালার অশেষ রহমত।

তিনজন ব্যক্তি ছাড়া দুনিয়ার সবাই জানতে পারবে সন্তান সাদিকুর এর। গোপন থেকে যায় আসল সত্য টা। বিয়ের দুই বছর হয়ে যায় বাচ্চা রা ও বড়ো হয়ে উঠছে এখন হাঁটতে পারে একটু একটু। হঠাৎ করেই আরাফাত আর তন্বীর ডিভোর্স হয়ে যায়। তাদের মধ্যে হঠাৎ করেই বনিবনা কম দেখা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যেত শেষমেশ ডিভোর্স হয়ে যায়। আরাফাত তন্বী কে বিয়ে করেছিল সম্পত্তির লোভে। এদিকে তন্বীর বাবা মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করার জন্য ত্যাজ্য করেছে এজন্য সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আরাফাত এসব জানতে পেরে ঝগড়া করত নিয়মিত। তন্বী এসব সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্সের কথা বলে। দুজনের সিদ্ধান্তে ডিভোর্স হয়ে যায়। তন্বীর বাবা মেয়ের ডিভোর্স এর খবর পেয়ে মেয়েকে নিতে আসে খুশি হয়ে।

বাচ্চাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। বাসায় বড়ো করে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। এর মাঝে সাদিকুর এর সাথে মৌমিতার স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সহজ হয়ে উঠেছে। একটা সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করছে ওরা। মৌমিতা এখন শুধু একটা কথাই ভাবে আরাফাত সেদিন ওকে মেনে না নিয়ে ভালোই করেছে। ওর মতো জানোয়ার সাথে ঘর করার থেকে মৃত্যু শেয় এর মধ্যে আরাফাত আরো একটা বিয়ে করেছিল কিন্তু সেটাও টিকে নি। টিকবে কি করে ওর যে চরিত্র কোন মেয়ে জেনে শুনে ওর সাথে সংসার করবে নাকি। অসংখ্য মেয়েদের সাথে ওর চলাফেরা। আর কত মেয়ের সাথে যে খারাপ সম্পর্কে আছে আল্লাহ তাআলা জানেন।
এই বাসায় এসে ওর চালচলন দেখে মৌমিতা খুব প্রশান্তি অনুভব করে। ওর মতো শয়তানের থেকে ও বেঁচে গেছে।
কিন্তু শয়তান টা এখন আবার ওর দিকে কু নজর দিয়ে তাকায়। মাঝে মাঝে একা পেলে ক্ষমা চায়। মন চায় তখন ঠাঁটিয়ে দেই। কিন্তু মৌমিতা কথা বলে না। যতটা বলা দরকার সবার সামনে বলে দেবর হিসাবে।
জায়ান আয়ানের দিকে ইদানিং আরাফাতের খুব মায়া বেড়েছে। মাঝে মাঝেই দেখি ওদের কোলে তুলে আদর করছে। ওদের কাছে যেতে দেখলেই মৌমিতা ওদের টেনে নিয়ে যায়।
” ওরা কিন্তু আমার ও সন্তান তুমি এইভাবে ওদের আমার থেকে দূরে রাখতে পারো না।”
মৌমিতা রক্ত চোখে তাকিয়ে ঠাস করে থাপ্পড় দিয়ে বলল,,” ওরা সাদিকুর এর সন্তান। এটাই সত্যি এটাই সত্য হয়ে থাকবে।”বলেই চলে গেল।
মৌমিতা চিন্তায় বিভোর ছিল তখনি সাদিকুর এর কথায় ঘোর কাটে ও সাদিকুর এর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।
জন্মদিনের কেক কেটে দুজনেই বাবা মাকে খাইয়ে দেয়। ভীড়ের মধ্যে থেকে আরাফাত মৌমিতা কে টেনে আড়ালে টেনে নিয়ে আসে।
” এসব কি ধরনের অসভ্যতামি? আপনি আমাকে টেনে এখানে নিয়ে এলেন কেন ছাড়েন বলছি।”
” তুমি আমার কাছে ফিরে না এলে সবাইকে জানিয়ে দেব জায়ান, আয়ানের বাবা আমি। প্রমাণ হিসেবে টেস্ট করাবো।”
রাগে মৌমিতা ঠাস করে থাপ্পড় মারতে চাইল। আরাফাত হাত ধরে বলল,,” ভুল করেও আমায় মারার চেষ্টা করবে না। আমি কিন্তু সব ফাঁস করে দেব তখন দেখব মুখ কিভাবে দেখাও। তার থেকে ভাল আমার কথায় রাজি হয়ে যাও। আমি তুমি আর আমাদের সন্তান সবাই মিলে সুখের সংসার করব।”
” মনে আছে আপনার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিলাম আপনি কীভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।”
” তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না। তোমার মর্ম বুঝি নি। এখন তো চাইছি তুমি ফিরে আসো প্লিজ।”
” জীবনে ও না। আমি সাদিকুর কে ভালবাসি।”
আরাফাত মৌমিতা কে জোর করে রুমে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। জোর করে মৌমিতার হাতে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। মৌমিতা চিৎকার করছে। কিন্তু বাইরে জোরে জোরে গান বাজছে
মৌমিতার চিৎকার কারো কানে যাচ্ছে না।
ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আরাফাত মৌমিতার শাড়ি টেনে খোলে ফেলে। মৌমিতা কোন উপায় পাচ্ছে না কিভাবে নিজেকে এই নরপশুর হাত থেকে বাঁচাবে।
তখনি দেখতে পায় ট্রি টেবিলের উপর গ্লাস মৌমিতা সেটা আস্তে করে হাতে নেয়। আরাফাত তখন ওর ব্লাউজ খোলার চেষ্টা করছে। ও গ্লাস নিয়ে জোরে আরাফাতের মাথায় বারি দেয়। আরাফাত বারি খেয়ে মৌমিতার গায়ের উপর থেকে সরে এসে উঠে বসে মাথায় হাত দিয়ে। মৌমিতা দরজা খুলতে গিয়ে ও পারে না শয়তানটা আবার ছুটে এসে ওকে আটকায়। পাশ থেকে ফুলদানি নিয়ে আরাফাতের দিকে ছুড়ে মারে। আরাফাতের কপাল বেয়ে গলগলিয়ে পড়ছে ও ওভাবেই বসে পড়ে বিড়বিড় করে বলে,,” আমি সবাইকে জানিয়ে দেব জায়ান আয়ান তোর অবৈধ সন্তান সবাই তোর আর তোর সন্তানের দিক থুথু ফেলবে।”
দরজা খুলতে গিয়েও মৌমিতা থেমে যায়। এগিয়ে এসে আরাফাত কে বলে,,” আমার সন্তানদের সুখ কেড়ে নিতে চাস? পারবি না তুই বেঁচে থাকলে না সবাই জানবে। আজ তোকে নিজ হাতে খুন করব আমি। দেখি কিভাবে আমার ছেলেদের দিকে নজর দিস।”
সন্তানের জন্য একজন মা কতটা সাহসী হতে পারে আরাফাত বুঝতে পারে নি। ও হাসছে মারার কথা শুনে।
এদিকে মৌমিতা টেবিল লাইট দিয়ে জোরে আরাফাতের মাথায় আঘাত করে। আরাফাত বসা থেকে ঠাস করে শুয়ে পড়ে। নিভু নিভু চোখ তাকিয়ে আছে মৌমিতার দিকে। মৌমিতা বিছানায় বসে তাকিয়ে আছে আরাফাতের দিকে।
” আমি খুন করেছি। শয়তান নিঃশেষে করেছি। ভাল কাজ করেছি।”
জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে সমস্ত ঘটনা দেখে জায়ান চিৎকার করে উঠল। সাদিকুর এসে ছেলের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। জায়ান ভয়ে কাঁপছে। হাত দিয়ে মা মা খুন এসব বলছে। সাদিকুর দরজা ভেঙে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মৌমিতা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে ওকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,,” ওকে আমি খুন করে ফেলেছি ও কি বলছিল জানো সন্তানের আসল পরিচয় জানিয়ে দিবে। এটা হতে দেওয়া যায় না বলো। আমি ঠিক করেছি না।”
সাদিকুর মৌমিতার শরীরে শাড়ি জড়িয়ে বলল,,” তাই বলে মেরে ফেললে আমার ভাইকে।”
সাদিকুর এর বাবা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেয়।
” বাবা আপনি পুলিশে কেন খবর দিলেন।”
” আমার ছেলের খুনিকে আমি পুলিশে দেব।”
” ও আমার স্ত্রী।”
” তোমার স্ত্রী বলে তো আমি আমার ছেলের খুনিকে ছেড়ে দিতে পারি না।”
সেই মুহূর্তেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায় মৌমিতা কে। মৌমিতা পাগলের তো খালি বলছিল বিড়বিড় করে,, আমি একদম ঠিক করেছি। আমি খুন করেছি। কাউকে আমার সন্তানের সুখ কেড়ে নিতে দেব না।
নিজের মুখে স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য বড়ো শাস্তি না হলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু এক মাসের মধ্যে সবাই বুঝতে পারে মৌমিতা আর স্বাভাবিক নাই।‌ নিজের হাতে খুন করলেও ও এতো বড়ো শক নিতে পারেনি ও পাগলের মতো আচরণ করতে লাগে। তখন ও মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করা হয় এসব দেখে অনেক কষ্টে সাদিকুর চিকিৎসা বাসায় রেখে করতে চায় বলে জানায়। অনেক ছুটাছুটির উপরমহল থেকে রাজি হয়।বাসায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসা ও চলছিল তারপর হঠাৎ,,,”
জায়ান থেমে গেছে।
তৃষ্ণা জায়ানের হাত ধরে বলল,,” চিকিৎসা তো চলছিল তারপর কি হয়েছিল। চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন কেন?”
“খুব ঘুম পাচ্ছে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না।”
তৃষ্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” আচ্ছা এখানে না রুমে আসুন।”

#চলবে……#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৭(১)
#নন্দিনী_নীলা

তৃষ্ণা নিচ থেকে এক মগ কফি নিয়ে উপরে এলো। মাথা ব্যথা করছে সারারাত জেগে থেকে ওর মাথা ধরে আছে। জায়ান সকাল সকাল উঠেই কোথায় যেন চলে গেছে। তৃষ্ণা রাতভর জায়ানের মাথার কাছে জেগে বসে ছিল। রুমে ঢুকতেই চমকে উঠল। বকুল ভয়ার্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল,,” তুই এখানে কি করছিস?”
বকুল ভয়ের জন্য কথা বলতে পারছে না। তোতলাতে তোতলাতে বলল,” বুবু তোমারেই খুঁজতে আইছিলাম।”
তৃষ্ণা বকুলের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,”আমার কাছে তোর কি কাজ?”
বকুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
” মিথ্যা বলবি না সত্যি করে বল কি জন্যে এই রুমে এসেছি।”
বকুল বলল,,” হাছা বুবু শুধুই কথা বলতে আইছিলাম।”
” তাইলে এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?”
বকুল নিজের ভয় কাটানোর চেষ্টা করে বলল,,” ক‌ই ভয় পাচ্ছি না‌তো?”
” আমার চোখে ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ নয়। আমি তোর বুবু। আমি তোর নাড়ি নক্ষত্র বহুদিন ধরেই চিনি‌। তাই মিথ্যে বানোয়াট কথা না বলে সত্যটাই বল।”
বকুল অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” বের হ আমার রুম থেকে আর কখনো আসবি না। যদি আসিস আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না মনে রাখিস।”
বকুল কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এল।
বাইরে এসে ওর দেখা হলো জোভানের সাথে। জোভান কে দেখে কান্নার গতি আরো বেড়ে গেল। জোভান শক্ত চোখে চাহনি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল জোভান কে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ জোভান ওর হাত ধরে আটকে দেয়। বকুলের বুক ধক করে উঠে। ও অবাক চোখে ফিরে তাকাল জোভানের দিকে।
জোভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,” তুমি যেহেতু আয়ান ভাইকেই ভালবাসো আমাকে কেন পোড়ালে? যার সাথে আমার বড় ভাইয়ের সম্পর্ক তার দিকে অন্তত নজর দিতাম না। কেন আমায় এই যন্ত্রণায় ছটফট করতে হচ্ছে বলো।”
” ছাড়ুন।” বকুল হাতের দিকে তাকিয়ে বলল। ও ভয়ে ঘামছে‌‌।
জোভান বকুলের অশ্রুসিক্ত নয়নে দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল হাত ছাড়িয়ে নিতে মোচড়া মোচড়ি করছে। জোভান হাত ছেড়ে দিল। বকুল এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল।
_________________________

জায়ানের আগমন ঘটে এগারোটার দিকে এসেই ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে ভাবছে লোকটা সাতসকালে উঠে গেছিল কোথায়?
জিজ্ঞেস করবে ভেবেও করতে পারছে না। সাহস সঞ্চায় করে করেই ফেলল,,” আপনি কোথায় গেছিলেন?”
” মায়ের সাথে দেখা করতে!” চোখ বন্ধ রেখে বলল জায়ান।
” আমাকে নিয়ে গেলেন না কেন?” অবাক স্বরে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান বলল,,” এক পাগলের সামনে যেতেই ভয় পাও। এখন তো হাজার পাগলের সাথে তার বসবাস। ওখানে তুমি থাকতে পারতে না।”
” ঠিক পারতাম। আপনি আমাকেও নিয়ে যাবেন।” নাছোড়বান্দা গলায় বলল।

জায়ান বলল,,” বকুল এই রুমে এসেছিল?”
তৃষ্ণা চমকানো গলায় বলল,,” আপনি জানলেন কি করে?”
জায়ান বাঁকা হেসে বলল,,” এই রুমে একটা সিসি ক্যামেরা আছে তুমি ভুলে গেছ।”
তৃষ্ণা চমকে বলল,,” বকুল আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল বলেছে।”
” তোমাকে মিথ্যে বলেছে। ও এসেছিল চুরি করতে!” মুখমন্ডল কঠিন করে বলল।
তৃষ্ণা বিস্ফোরণ চোখে তাকাল জায়ানের দিকে।
” কি সব বলছেন আমার বোন আর যাইহোক চোর না।”
” তোমার বোন চোর না হলেও আমার ভাই চোর। আর এই চুরির কাছে পাঠিয়েছিল ওই ই।”
” আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”
” তোমাকে একটা গুড নিউজ দেই। তোমার হাজব্যান্ড এমপি হবে। বাবা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। তার জায়গায় আমাকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।”
” বাবা কেন দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে?”
” আয়ান নাকি এমপি হতে চায়। বাবাকে অনেক ভাবে বুঝিয়েছে তার জায়গা আয়ান কে দিতে। কিন্তু আয়ানের আশায় জল ঠেলে আমাকে দিয়েছে এটা আয়ান সহ্য করতে পারছে না। তাই তোমার বোনকে কাজে লাগিয়ে কাগজ হাতিয়ার করতে চাইযেছে।”
” তাহলে এই কারণেই আমার বোনকে বিয়ে করেছে। নিজের স্বার্থ হাসিল করতে?”
” আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। শোন তুমি বকুল কে এতো কিছু জিজ্ঞেস করো না। ওর গায়ে সব সময় সাউন্ড ক্যামেরা লাগানো থাকে। যার মাধ্যমে আয়ান যেখানে থাকুক বকুল কার সাথে কি কথা বলছে সব শুনতে পায়। বকুল চাইলেও এজন্য আয়ানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না।”
” আপনি এতো কিছু কি করে জানলেন?”
” অনেক কিছুই তো জেনেছি তৃষ্ণা তোমাকে যে বলতে পারছি না।” বিড়বিড় করল জায়ান।
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে প্রশ্নতুক চোখে তাকিয়ে আছে।
জায়ান তৃষ্ণা কে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে চুলে নাক ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে র‌ইল।
” খাবেন না?”
” একেবারে লাঞ্চ করব।”
______________________

আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে আছে রাগী চক্ষে। আর বলল,,”তুই আমাকে না বলেই ওই রুমে গিয়েছিলি কেন?”
বকুল ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল,,” আমি তো আপনের ভালোর জন্য গেছিলাম। ওই ফাইল আনতে আর একটু হলে নিয়েই চলে আসতাম। কিন্তু সময় মতো বুবু চলে আসার জন্য পারলাম না।”
আয়ান বকুলের চুলের মুঠি ধরে বলল,,” তুমি ইচ্ছে করে গেছিস যাতে জায়ান সব বুঝতে পারে তাই না।”
বকুল কান্না করে দিয়ে বলল,,” না তার লিগা না। আমি তারাতাড়ি ফাইল এনে দিয়ে আপনার থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম। সত্যি আমি দুলাভাইকে কিছু জানাতে এসব করি নাই।”
” ওই রুমে ক্যামেরা আছে। ফাঁকা রুমে গেলেও সব জেনে যাবে জায়ান।”
” আমারে ক্ষমা ক‌ইরা দেন। আমি জানতাম না এসব।”
” আমার আদেশ ছাড়া কিছু করবি তো তোরে জানে মেরে দিমু। হা’রাম’জাদি।”
আয়ান বকুলকে রুমে থেকে বের হতে বারণ করে চলে গেল।
আয়ান টেনশনে আছে। দুইদিন ধরে পায়েল এর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা গেল কোথায়। এখনি পায়েলের ঠিকানায় যেতে হবে এটাকে মেরে ফেললেই আর টেনশন নিয়ে থাকতে হতো না। রুপের মোহে পড়ে এখন বিপদ ডেকে আনল। আয়ানের গলা শুকিয়ে আসছে। কোন ভাবে পায়েল জায়ানের হাতে পড়ল ওর সব ভেস্তে যাবে।
দুই ঘন্টা ড্রাইভ করে হোটেলে এসে পৌঁছাল। এখানে এসে ও পায়েলের সন্ধান পেল না। হোটেলে কর্মকর্তা কে ধরে আয়ান কতক্ষণ মারল‌।
” স্যার ম্যাম তো গত পরশু মার্কেট গিয়েছিল তারপর আর ফিরে আসে নাই।”
” তোরা আমারে দুই দিন বাদে খবর দিলি ক্যান?”
” আপনার ভয়ে খবর দিতে সাহস পাই নাই‌।”
আয়ান রাগারাগী করে বেরিয়ে এল।
_______________________

তৃষ্ণা আর জায়ান বসে আছে তৃষ্ণা ভাই ভাবির ছোট বাসায়। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু গলায় বলল,,” আমরা এখানে কেন এসেছি?”
জায়ান উত্তর দিল না। তৃষ্ণার ভাবি ওদের জন্য হালকা নাস্তা তৈরি করছে। তৃষ্ণা জায়ানের থেকে উত্তর না পেয়ে রাগ করে উঠে চলে গেল। জায়ান তৃষ্ণাকে যেতে দেখেই তৃষ্ণার ভাইয়ের সাথে কিছু জরুরী কথা বলতে লাগল।
” ভাবি কেমন আছ?”
” আছি কোনরকম। তোমার কি খবর?”
” ভালোই আছি।”
” বকুল কেমন আছে?”
তৃষ্ণা মুখটা গম্ভীর করে বলল,,” জানি না।”
” থাক মন খারাপ কর না। এমন কাজ বকুল করবে আমরা ও ভাবতে পারি নাই।”
তৃষ্ণা আর কথা বলার কিছু পেল না চুপ করে দাঁড়িয়ে র‌ইল।
ট্রে হাতে বের‌ হতেই তৃষ্ণা বলল,,” এই রুমে তালা কেন? তোমাদের বাসা তো এমনিতেই ছোট এই রুম বন্ধ করে রাখে কেন আবার।”
তৃষ্ণার ভাবি মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,,” ওই আসলে কিছু দরকার জিনিস পত্র রাখা হয়েছে তো তাই।”
” দুজনেই থাকো আবার তালার কি প্রয়োজন?”
তৃষ্ণা সন্দেহ চোখে তাকিয়ে ছিল রুমটার দিকে।

তৃষ্ণা, আর ওর ভাবি আসতেই দুজনে আবার থেমে গেল। তৃষ্ণা ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল ভাই ঘামছে। মুখটা শুকিয়ে আছে। কি নিয়ে কথা বলছিল দুজনের মুখের ভঙ্গি এমন হলো কেন?
জায়ান তৃষ্ণাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” তৃষ্ণা চলো বের হবো।”
” এখনি? একটু বসব না।?”
” অনেক তো বসলাম। এবার যাওয়া যাক।”
গাড়িতে উঠে তৃষ্ণা নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছে না। এদিকে জায়ান কে প্রশ্ন ও করতে পারছে না।
জায়ান তৃষ্ণার দিকে না তাকিয়ে বলল,,” এভাবে তাকিয়ে থাকলে ড্রাইভ করতে পারব না। আজ মনে হচ্ছে ড্রাইভার না নিয়ে এসে ভুল হয়েছে। ব‌উ এতো রোমান্টিক হয়েছে আগে বুঝি নি।”
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে বলল,,” আপনি ভাইয়ের বাসায় কেন গেছিলেন?”
” ঘুরতে। নাকি তোমার ভাইয়ের বাসায় যেতেও পারব না।”
” আপনারা কিছু লুকাচ্ছেন আমার থেকে।”
বলতে বলতে তৃষ্ণা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই রোডের কিনার দিয়ে কাউকে হেঁটে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল,,”গাড়ি থামান।”
আচমকা তৃষ্ণার চিৎকার শুনে জায়ান চমকে গাড়ি ব্রেক করে।
#চলবে……#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৭(২)
#নন্দিনী_নীলা

তৃষ্ণার ভাই সুলাইমান চিন্তিত মুখে বসে আছে। বিথী স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,” হঠাৎ তৃষ্ণা ওর জামাই নিয়ে এখানে কেন এসেছিল?”
সুলাইমান বলল,,” একটা ঝামেলা করে ফেলেছি!”
” মানে কি করেছ?”
” গত মাসে একজায়গায় চুরি করতে গেছিলাম। সেটা নাকি তৃষ্ণার জামাইয়ের পরিচিত কারো বাসা।
তাদের বাসায় সিসি ক্যামেরা ছিল আমাদের সবার মুখ নাকি স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে। সেটা দেখেছে জায়ান।”
বিথী মুখে হাত দিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল,,” কি সর্বনাশ করলে! এজন্য বলেছিলাম কাজ ক‌ইরা খাও‌ । না তোমার তো কাজ করলে পোষায় না এখন মানসম্মান সব তো গেলো জেলে যাবার জন্য অপেক্ষা করো।”
” এমনিতেই চিন্তায় আছি আর চিন্তা বাড়ায় ও না।”
” আমার কথা শোন জায়ানের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাও‌। আর চুরি ডাকাতির কাজ বাদ দাও।”
দরজায় ঠাস ঠাস শব্দ শুনে বিথী বিরক্তি হয়ে উঠে দরজা খোলে দিল।
ভেতরে থেকে সুজন চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল।
” এতোক্ষণ কেউ বন্দি করে রাখে। উফ ওই ঘরে এতো গন্ধ ক্যান আর একটু হলে দম আটকে মরতাম।”
সুলাইমান বলল,,” আজ যদি তৃষ্ণা দেখত তুই আমাদের লগে থাকিস কি হতো ভাবতো। তোর ব‌উ মরার সব দোষ তর ঘাড়ে পড়ছে। সেটা ভুলে গেছিস?”
” কিন্তু তোমরা তো জানো আমি খুন করি নাই।”
” পলাই না আসলে হয়ত এটা বিশ্বাস করত কিন্তু এখন আর কেউ করবে না।”
” মালতি ক্যান আত্নহত্যা করল আজ ও বুঝলাম না‌ মাঝখানে থেকে দোষী হয়ে রইলাম সবার চোখে।”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুজন।
___________________________

” কি হয়েছে? গাড়ি মাথায় নিলে কেন থামানোর জন্য!”
তৃষ্ণা হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,,” ওটা মিহির ভাই না?”
জায়ান তাকাল হ্যা মিহির হেঁটে যাচ্ছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে‌। সুস্থ হ‌ওয়ার পর ওর পা আর ঠিক হয়নি এক পা খুড়িয়ে হাঁটতে হয়।
জায়ান গম্ভীর গলায় বলল,,” হ্যা। ওর জন্য থামাতে বললে?”
” হ্যা দেখুন কি অবস্থা হয়েছে। অন্যায় করে কখনো কেউ সুখী হতে পারে না। উনার অবস্থা দেখে সত্যি খারাপ লাগছে। শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে আবার পা ও ঠিক নাই হাঁটতে পারছে না ঠিকমতো।”
” দেখা হলে এবার যাওয়া যাক নাকি কথা বলবে!”
” আরে না। উনার সাথে কি কথা বলব।”
বাসায় এসে দেখল উর্মি আর আরিফ এসেছে।
দুজনে হানিমুনে যাবে সেটাই জানতে এসেছে। জায়ান আর তৃষ্ণা কে ও টেনে সোফায় বসাল উর্মি।
” ভাইয়া তোমাদের বিয়ের বছর হয়ে গেল এখনো হানিমুন করতে পারলে না। এদিকে আমরা চলে যাচ্ছি।”
আরিফ বলল,,” ভাইয়া আমাদের তরফ থেকে একটা অফার আছে প্লিজ না করবেন না।”
জায়ান প্রশ্নতোক চোখে তাকিয়ে বলল,” কিসের অফার?”
” আমাদের সাথে আপনাদের হানিমুন যাওয়ার প্লান করে ফেলেছি।”
উর্মি কানে কানে তৃষ্ণার কিছু বলল তৃষ্ণা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
জায়ান বলল,” এখন আমরা কোথাও যেতে পারব না‌। অনেক কাজ সামনে পড়ে যাব।”
উর্মি বলল,,” উফ ভাইয়া তোমার পড়ে মানে যাবাই না। আমাদের সাথেই যাবে। এটাই ফাইনাল কি বলো ভাবি তুমি কিছু অন্তত বলো তোমার কথা আর যাইহোক ভাইয়া ফেলতে পারবে না।”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে উর্মির দিকে ও কি বলবে আবার।
টিকিট জোর করে জায়ানের হাতে দিয়ে উর্মি আর আরিফ চলে এল। জায়ান রাতে তৃষ্ণা কে জিজ্ঞেস করল,,” তুমি কি যেতে চাও?”
তৃষ্ণা বলল,,” কোথায়?”
” হানিমুন!”
” না আমি প্লেন দেখলে অনেক ভয় পাই আমি ওসবে উঠতে পারব না।”
তৃষ্ণার কথা শুনে জায়ান না হেসে পারল না।
” তোমার কি আমার সাথে একাকী কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে না?”
তৃষ্ণা লাজুক গলায় বলল,,” করে করবে না কেন?”
” তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন আমি তো আছিই। আমি থাকতে আমার ব‌উয়ের কিছু কি হতে পারবে?”
তৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে না বুঝল।
জায়ান বলল,,” তুমি কি যেতে চাও? তুমি যেতে চাইলে সব কাজ ফেলে চলে যাব।”
” উর্মি আপু যেহেতু এতো করে বলেছে তাই যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বকুল কে আপনারা ভাইয়ের সাথে রেখে আমার যেতে ভয় করে। যদি আমার বোনের কোন ক্ষতি করে দেয়। উষসী ভাবির মতো কিছু করে যদি।”
” বকুলের কোন ক্ষতি করবে না আয়ান। ওকে জাস্ট টোপ হিসেবে রেখেছে।”
” সত্যি?”
” আমাকে বিশ্বাস করো তো?”
” অনেক।”
” তাহলে নিশ্চিন্তে থাকো।”

পরদিন জায়ান তৃষ্ণাকে নিয়ে মার্কেটে গেল। জায়ান নিজ পছন্দে তৃষ্ণা কে কিছু লেডিস, টপস, প্যান্ট, কোর্ট কিনে দিল। তৃষ্ণা তো চোখ কপালে তুলে ছিল এসব ও জীবনে পড়ে নাই। এসব পড়বে কি করে। কিন্তু জায়ান বলেছে সেখানে গিয়ে এসব পড়তে হবে।
তৃষ্ণা বিছানায় বসে ব্যাগ প্যাক করছে। হঠাৎ উঠে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল।
বকুল রান্না করে খাবার বাড়ছিল। তৃষ্ণা বকুলের হাত ধরে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,, কিরে কেমন আছিস?”
বকুল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
” কি হলো বল!”
” ভালো। তুমি কেমন আছ?”
” আমি তো খুব ভালো আছি রে। আগামীকাল আমি আর তোর দুলাভাই হানিমুন যাচ্ছি। কোথায় জানিস?”
” কোথায় বুবু?”
” মালদ্বীপ বিদেশ যাব। আমি প্লেনে উঠব আমার তো খুব ভয় করছে রে কিন্তু তোর দুলাভাই আছে তাই সাহস পাচ্ছি।”
” সাবধানে যেও বুবু।”
” হুম ভালো থাকিস। আর চোখ কান খোলা রাখিস।”
বকুল আচমকাই জড়িয়ে ধরল তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
” আমি জানি এখন তুই আর আমাকে আপন ভাবিস না তোর আপন ওই আয়ান দেবর। যাইহোক স্বামী নিয়ে সুখে থাক।”
তৃষ্ণা চলে এল। বকুল তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল অনেক দিন পর বুবু ওর সাথে একটু ভাল করে কথা বলল।
_______________________________

আয়ান জায়ানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বাগানে।
আয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে।
জায়ান বলল,,” বল কি জরুরী কথা?”
আয়ান রাগান্বিত গলায় বলল,,” পায়েল কোথায়?”
জায়ান কপালে কুঁচকে বলল,,” পায়েল কে?”
” মিথ্যা বলবি না। আমি জানি তোর কাছেই আছে পায়েল‌। ওকে দিয়ে তুই আমাকে ফাঁসাতে চাইছিস তাই তো?”
” তোকে ফাঁসাতে কোন মেয়ে দরকার হবে না। তুই এমনিতেই ফেঁসে আছিস।”
” দেখ জায়ান আমার মাথা গরম করবি না। ভালো মতো জিজ্ঞেস করছি পায়েল কোথায় বল।”
” তোর মাথা গরমের ধার আমি ধারি না। আর শোন আমি কোন পায়েল কে চিনি না।”
” উষসীর নার্সকে চিনিস তো?” রাগে ফেটে পড়ে বলল।
” হ্যা ওকে আমি এখনো খুঁজছি পাইনি। পেয়ে গেলে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না মনে রাখিস।”
আঙুল উঠিয়ে বলল জায়ান। আয়ান হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে জায়ান ভেতরে চলে গেল।
আয়ান বাগানেই লাথি মেরে বলল,,” পায়েল জায়ানের কাছে না থাকলে আছে কার কাছে। কে ওকে উঠিয়ে নিল। কেন যে ওটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আমার সব না ঘেটে দেয়।”
ভয়ে আয়ান ঘামতে লাগে।
কয়েকজন কে কল‌ করে পায়েল এর খোঁজ নিতে বলে রুমে আসে। বকুল ফ্লোরে বিছানা করে শুতে নিচ্ছিল। আয়ান এসে রাগান্বিত গলায় বলল,,,” বের হ আমার রুম থেকে। অন্য রুমে যা আমার রুমে তোকে যেন না দেখি।”
ভয়ে বকুল রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আয়ান একটা কাজের মহিলাকে ডেকে অন্য রুমে নিয়ে যেতে বলে বকুল কে।
পায়েল কোথায় আছে সেই টেনশনে আয়ানের দিশেহারা অবস্থা। আর কিছুই ও ভাবতে পারছে না।
_________________________

“তুমি পাগলটা কে দেখতে গিয়েছিলে?” জেসমিন জহুরি নজরে চেয়ে বললেন।
সাদিকুর বললেন,,” হ্যা খুব কান্না করল। ওখানে নাকি অনেক কষ্ট দেয়।”
” পাগল ভাল হলে তুমি আমায় তালাক দিবে?”
” মানে কি?”
” দুই ব‌উ নিয়ে সংসার করবে?”
” দেখ মেজাজ খারাপ করো না।”
” দেখো আমি জানি তুমি তারে ভালবাসেন। কিন্তু তুমি ভুলে যাবে না আমি তোমার
সন্তানের মা। আমি জায়ান আর আয়ান কে মানুষ করছি। ওরা আমার সন্তান না হলেও আমি ওদের নিজের সন্তানের থেকে বেশি আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছি‌। সে ফিরে আসলে তুমি আমার প্রতি অন্যায় করতে পারো না। আমার অধিকার আমি ছাড়ব না একটু ও না।”
সাদিকুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” দয়া করে থামো‌। তোমার অধিকার কেউ কেড়ে নিবে না। আর মৌমিতার প্রতি নিজের হিংসা জমা রেখো না।”
” কি বললে আমি হিংসা করি। ওই পাগলকে আমি হিংসা করতে যাব কোন দুঃখে। কি আছে ওর?”রাগে চেঁচিয়ে উঠল জেসমিন‌। সাদিকুর ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে রুম থেকেই বেরিয়ে এল। তার নজরে পড়ল বকুল বালিশ নিয়ে অন্য রুমে যাচ্ছে। তিনি কিছু একটা চিন্তা করে আয়ানের কাছে গেল।
” আসব।”
” বাবা আসো। কিছু বলবে?”
” সত্যি করে বলতো তুই বড় ব‌উমার বোনকে বিয়ে কেন করছিস?”
আয়ান বলল,,” ভালবেসে বাবা। আমি বকুল কে ভালবাসি তাই বিয়ে করছি।”
” একা একা করলি কেন আমাদের জানালে কি হতো।”
” জায়ান ও তো একাই করেছিল!”
” সব কিছুতে জায়ান কে ফলো করিস লজ্জা করে না। নিজের বলতে কিছু কি নাই?” আয়ান লাল চোখে তাকাল সাদিকুর এর দিকে। বাপকেও এখন অসহ্য লাগছে ওর।
#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here