#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৮
#নন্দিনী_নীলা
মালদ্বীপ এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখল জায়ান, তৃষ্ণা, আরিফ, ও উর্মি। প্রথমবার দেশের বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করল তৃষ্ণা। সময়গুলো অনেক বেশিই ভালো কেটেছে। নতুন সব কিছুর সাথে পরিচিত হয়েছে। নতুন এক জগত থেকে ঘুরে এসেছে। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারছে না। বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু উপহার এনেছে তৃষ্ণা নিজে পছন্দ করে।
চারজন আলাদা হয়ে গেল এয়ারপোর্ট থেকে। দুটো গাড়িতে উঠে বসল নিজেদের থেকে বিদায় নিয়ে। তৃষ্ণা উত্তেজনায় এটা ওটা বলছে জায়ান কে।
জায়ান তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,,” তৃষ্ণা তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।”
তৃষ্ণা ভ্রু কুটি করে বলল,,” কি সারপ্রাইজ?”
” বাসায় গেলেই দেখতে পাবে।”
” শুনন না আমি না বকুলের জন্য উপহার আনছি। দেব কি করে?”
” কেন তোমার হাত নেই?”
” উফফ সেটা নয়। ওর উপর আমার অনেক রাগ। রাগ নিয়ে উপহার দিতে কেমন জানি লাগছে।”
” তাহলে রাগ ঝেড়ে ফেলে দাও। তাহলে আর কোন রকম লাগবে না।”
” এতো সহজে রাগ ফেলতে পারব না। সত্যি কথা না বলা পর্যন্ত আমার এই রাগ যাবে না।”
” তাহলে সত্যিটা শুনেই না হয় রাগ সরিয়ে নিও।”
” ও এমন চাপা স্বভাবের হতে পারে কোনদিন ভাবিনি। ও সব সময় পাতলা স্বভাবের ছিল জানেন। ও আগে কখনো কোন গোপন কথা আমার থেকে লুকিয়ে রাখতে পারত না।”
জায়ান তৃষ্ণার মলিন মুখটা ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,,” এই মাত্র না আনন্দিত ছিলে। নিমিষেই মলিন করে ফেললে মুখটা। এতো তাড়াতাড়ি মুড পরিবর্তন করো কিভাবে?”
তৃষ্ণা জায়ানের বক্ষস্থলে মাথা ঠেকিয়ে বলল,,”আমার বোনটা কবে আপনার ভাইয়ের হাত থেকে ছাড়া পাবে!”
জায়ান তৃষ্ণাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল,,” হয়ত পেয়ে গেছে।”
তৃষ্ণা ঝট করে মাথা তুলে অবাক চোখে তাকাল জায়ানের দিকে।
” কি বললেন?”
জায়ান অবুঝ স্বরে বলল,,” কি বললাম?”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে।
” শান্ত হয়ে থাকো। এতো জার্নি করেও কোন ক্লান্তি ভাব নাই এই ছোট মুখটায়। কিন্তু বিয়ের দিন গাড়িতে একটুতেই বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলে।”
তৃষ্ণা লজ্জায় কাঁচুমাচু মুখে তাকাল জায়ানের দিকে। জায়ান তৃষ্ণার লাজুক মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলল।
জায়ান তৃষ্ণার লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিতে বলল,,”কেমন আড়চোখে আমাকে গিলে খাচ্ছিলে মনে আছে? লজ্জা তো আমি তাকানোর চান্স ই পাই নি।”
তৃষ্ণা অবাক স্বরে বলল,,,” আপনি তখন লজ্জা পাচ্ছিলেন? কই দেখে তো মনে হচ্ছিল না।”
” আমার মুখ দেখে সব বুঝা যায় না।”
” এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। আপনি তো সব সময় রাগী, গম্ভীর মুখ করে থাকেন। আমি তো আগে ভাবতাম আপনি হাসতেই পারেন না।”
“এখন?”
” এখন তো মাঝে মাঝেই হাসেন। রগচটা গম্ভীর মানুষটার হাসিটা দারুন সুন্দর।”
জায়ান তৃষ্ণার কথা শুনে শব্দ করেই হেসে উঠল।
” প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর?”
” তার থেকেও বেশি।”
“আদর করার মতো?”
” ধ্যাত।”
___________________________
নতুন পরিবেশে ঘুরে বেরিয়েছে ভালোই কেটেছে সময় গুলো। কিন্তু তবুও মনটা বাসার জন্য ছটফট করেছে। সবাইকে মিস করেছে। বাসায় এসে তৃষ্ণা একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এমনটা ফেলেছিল এই বাসা থেকে প্রথমবার ওদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে। তখন এখানে মানিয়ে নিতে পারত না। জায়ানের দিকে তাকিয়ে ভাবল,, তখন এই মানুষটা ভালবাসতো না। কিন্তু এখন সব কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। এই মানুষটাকে ও ভালবাসে। এই বাসার প্রত্যেকটা মানুষকে ও ভালবাসে। বিদেশে গিয়ে ও সবাই অনেক মিস করেছে। সদর দরজা পেরিয়ে যেতে কোথা থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বকুল ওকে। বকুল কে দেখে তৃষ্ণা কিছুক্ষণ থমকে যায়। বকুল তৃষ্ণাকে ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,,” বুবু।”
তৃষ্ণা বিষ্ময় প্রকাশ করতে পারছে না। বকুল সেলোয়ার কামিজ পড়ে দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি।
” বুবু আমার তোমার লগে অনেক কথা আছে।”
তৃষ্ণা নিজের হতভম্ব দৃষ্টি সংযত করে বলল,,” তোর এই বেশ কেন?”
বকুল কিছু বলতে যাবে জায়ান বলে উঠে,,” এখন আমি তোমার বুবু দুজনেই ক্লান্ত বকুল। তোমার কথা কি পড়ে শুনলে চলবে?”
” চলবে দুলাভাই।” বকুল তৃষ্ণাকে ছেড়ে দাঁড়াল।
তৃষ্ণা এখনি সব শুনতে চায় কিন্তু জায়ান সেই সুযোগ দিল না। তৃষ্ণা কে টেনে উপরে নিয়ে এল। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে শুধু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।
” আপনি আমাকে টেনে নিয়ে আসলেন কেন? আমি এখনি সব শুনতে চাই বকুল আমায় যা বলতে চায়।”
জায়ান তৃষ্ণার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল,” চুপ এতো জোর কোথা থেকে আসে হ্যা? তাড়াতাড়ি চলো আগে গোসল করবে, খাবে, ঘুমাবে দেন সব শুনবে। আমিও শুনব।”
তৃষ্ণা প্রতি উত্তর করতে চাইলে জায়ান তৃষ্ণাকে জোর করে এখনি গোসলের জন্য রাজি করায়। তৃষ্ণা জায়ানের সাথে জোরাজুরি করে পারে না।
” আপনি আমার সাথে আসছেন কেন?” তৃষ্ণা জায়ান কে বাথরুমে ঢুকতে দেখে বলল।
জায়ান বলল,,” আজ বউয়ের সাথে গোসল করব।”
” না না একদম না। আপনি বের হোন।”
” তৃষ্ণা আমি খুব ক্লান্ত ওয়েট করতে পারব না।”
তৃষ্ণা বলল,,” আচ্ছা তাহলে আপনি আগে করেন আমি অপেক্ষা করি।”
বলেই তৃষ্ণা বেরিয়ে আসতে চাইল বাথরুম থেকে। জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে টেনে দরজা আটকে বলল,,”আমরা একসাথে শাওয়ার নেব।”
_______________________
তৃষ্ণা জায়ানকে ঠেলে সরিয়ে উঠে বসল। ঘুমাবে না বলেও কখন ঘুমায় গেল। জায়ান খাবার খাইয়ে জোর করেই ওকে জাপ্টে ধরে শুয়ে ছিল। মনে ভেতর উশখুশ করছে সব জানতে। এদিকে ওর বর ওকে আটকে দিচ্ছে শুধু তৃষ্ণা ঘুমন্ত জায়ানের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে নেমে যাবে বিছানা থেকে জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে এক টাকে বুকের উপর ফেলে দেয় তৃষ্ণা চমকে উঠে।
” আপনি ঘুমান নি?”
” তুমি যে ভাবে ধাক্কা দিয়েছ এখনো ঘুম থাকে নাকি? আমার ঘুম নষ্ট করার জন্য তোমার আজকে আর উঠা হবে না।”
” এমন করবেন না। আমি শুনেই চলে আসব প্রমিজ।”
” নো।”
” দয়া করেন আমি এভাবে শান্তি পাচ্ছি না।”
অগত্যা জায়ান উঠে বসে।
” চলো রহস্য উন্মোচন করেই আসি!”
জায়ান আর তৃষ্ণা মালদ্বীপ যাওয়ার দু’দিন পর বাসায় পুলিশ আসে। পুলিশের সাথে আসে উষসীর ভাই।
সাদিকুর বাসায় ছিল না। আয়ান রুমে ছিল। পুলিশ আসার খবর পেতেই ও ভয়ে ঘামতে থাকে। জেসমিন চেঁচিয়ে ডাকছে আয়ান কে। কারণ পুলিশ আয়ান কেই খুঁজছে। আয়ান পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে চায় এদিকে পুলিশে সেই রাস্তা ও ঘেরাও করে ফেলেছে।
আয়ান চোরের মতো মুখ করে বলে,,” আমায় কোন প্রমাণের ভিত্তিতে আপনারা অ্যারেস্ট করতে আসছেন। একবার কিন্তু ছেড়ে দিতে হয়েছিল ভুলে যাবেন না। এবার আমাকে থানায় নেওয়ার চেষ্টা করলে আমি কিন্তু বাবাকে বলে আপনার চাকরি খেয়ে দেব।”
অফিসার কিছু বলল না তাচ্ছিল্য হাসি দিল।
উষসীর ভাই বলল,,” থানায় চল তোর প্রমাণ সেখানেই অপেক্ষা করছে।”
” মানে?”
পুলিশ অফিসার নিজের ফোন বের করে আয়ানকে পায়েল এর ছবি দেখিয়ে বলল,,” দেখুন তো এই মেয়েকে চেনেন নাকি?”
আয়ান চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না। তোতলানো গলায় বলল,,” না কে এই মেয়ে?”
ভয়ে ওর আত্না উড়ে যাবার অবস্থা। পায়েল পুলিশের কাছে গেল কি করে? তাহলে কি উষসীর ভাই এই কাজ করেছে?
পায়েল সন্ধান সেই বের করেছে?
ভয়ে আয়ান ঘামতে শুরু করেছে।
থানায় যাওয়া থেকে কেউ ওকে আটকাতে পারল না। আর জেসমিন ছাড়া আটকানোর কেউ ছিল ও না। বকুল সবটা অবাক নয়নে দেখছিল। আয়ান কে নিয়ে যাওয়ার পরই জোভান ওকে নিয়ে নিজের রুমে আসে আর ওর গায়ে থেকে সাউন্ড ক্যামেরা খুলে ফেলে দেয়।
বকুল বিস্ফোরণ চোখে তাকিয়ে বলল,,” এই যন্ত্র আমার গায়ে আছে আপনি জানলেন কি করে?”
“জায়ান ভাইয়া বলেছে।”
” দুলাভাই জানল কি করে?”
” ভাইয়ার পক্ষে কোন কিছু জানা অসম্ভব নয়।”
” আয়ান কে পুলিশ কেন ধরে নিয়ে গেল?”
জোভান শক্ত গলায় বলল,,” হাজব্যান্ড কে পুলিশ নিয়ে গেল দেখে কি কষ্ট লাগছে?”
বকুল মাথা নিচু করে ফেলল।
অসহায় গলায় বলল,,” ওই যন্ত্র তো ফেলে দিলেন এখন কি আয়ান আর কিছু জানতে পারবে না?”
“না।”
বকুলের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।
” সত্যি?”
” হ্যা।”
বকুল আনন্দের চুটে জোভান কে জড়িয়ে ধরল।
বকুল নিজে থেকেই সরে বলল,,” আমাদের বিয়ে হয়নি।”
জোভান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,”জানি।”
বকুল চোখ কপালে তুলে বলল,,” কিভাবে?”
” জায়ান ভাই বলেছে।”
” দুলাভাই এটাও জানত?”
” হ্যা।”
” আপনি সব জেনেও আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছেন? আমি তো নিরুপায় ছিলাম।”
জোভান বলল,,” আমি দুইদিন আগে জানতে পেরেছি। ভাইয়া বাসায় থাকবে না তাই আমাকে সবটা জানিয়েছে। আর ভাইয়া জানত আমি তোমাকে ভালবাসি তাই.
” দুলাভাই সব জেনেও নিশ্চুপ কেন ছিল?”
” জানিনা।”
” আজ কেন আয়ান কে পুলিশ নিয়ে গেল?”
” উষসী ভাবিকে খুন করেছে।”
বকুল মুখে হাত দিয়ে বলল,,” হায় আল্লাহ।”
জোভান বকুলের মুখটা দুহাতে ধরে বলল,,” তুমি আমার আছো এতেই আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কমেছে। এই কয়টা দিন আমার যে কি অবস্থায় কেটেছে।”
বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলল,,” মানুষ কতটা নিকৃষ্টতম হয় আপনার ভাইকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। দুলাভাই কে দুই চোখে দেখতে পারে না। সব সময় তার মৃত্যু কামনা করে। আর তীব্র হিংসা করে। দুজন যমজ ভাই হয়ে এতোটা বিদ্বেষ ভাবাই যায় না।”
” তোমাকে বউ কেন সাজালো কি উদ্দেশ্য ছিল ওর?” জানার আগ্রহ প্রকাশ করে বলল জোভান।
বকুল ডুকরে কেঁদে উঠল। জোভান ওর চোখে অশ্রু মুছে কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল,,” কেঁদো না। বলো আমার সব।”
বকুল কল্পনায় চলে গেল….
সেদিন সেই অন্ধকার ঘরে ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজেও ঢুকে দরজা আটকে দেয় আয়ান। বকুল ভয়ে জড়সড় হয়ে ফ্লোরে বসে ছিল। হঠাৎ আয়ানের ফোনের ফ্লাশ জ্বলতেই চমকে উঠে।
আয়ান ওর পাশে বসে বলল,,” কিরে ভয় লাগছে?”
বকুল ভয়ে কান্না করে দেয়।
#চলবে….#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৯
#নন্দিনী_নীলা
বকুল ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে আয়ানের দিকে। বকুল জড়ানো গলায় বলছে,,” আমারে এইহানে আনলেন ক্যান?”
আয়ান বকুলের কথায় পাত্তা না দিয়ে উঠে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রুমে কিছু খুঁজতে লাগে।বকুল কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমের দরজার দিকে এক দুই পা করে হেঁটে যাচ্ছে। ওর শরীর মাত্রাতিরিক্ত কাঁপছে। ভয়ে জবোথুবো বুক নিয়ে দরজা কাছাকাছি এল।
” পালিয়ে যাচ্ছিস?”
ভয়ে আঁতকে দাঁড়িয়ে পড়ে বকুল। ভয় ঢোক গিলে বলল,,” আমি বুবুর কাছে যাব।”
আয়ান বাঁকা হেসে এগিয়ে এল। বকুলের সামনে এসে দাঁড়াল। বকুল ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান একটা শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে বকুলের দিকে।
বকুল কিছু বলতে যাবে আয়ান বকুলের মুখে একটা স্পে করতেই বকুল ঠলে পড়ে আয়ানের উপর। আয়ান বকুলকে সবার অগোচরে বের করে আনে।
সবাই তখন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এ ব্যস্ত ছিল সেই সুযোগ টাই কাজে লাগায় আয়ান।
বকুলের যখন জ্ঞান ফিরে ও নিজেকে একটা বিছানায় শোয়া অবস্থায় পেল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ধরফড়িয়ে উঠে বসল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এলোমেলো চোখের পাতা মেলে চারপাশে তাকাল। ভাঙাচোরা একটা চৌকিতে ও শুয়ে আছে। রুমে একটা ভাঙা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। বকুল লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। এটা কোথায়? কিভাবে এল? আয়ানের কথা মাথায় আসতেই ও চমকে উঠল। তাহলে কি তিনিই এখানে নিয়ে এসেছে? কিন্তু কেন? কিভাবে যাবে বুবুর কাছে ও। ভয়ে ঠুকরে উঠল বকুল। দরজার কাছে গিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে বারি দিয়ে,’ কেউ আছেন?দরজা খুলেন দয়া কইরা।’ অসহায় কন্ঠে বলছে লাগে।
খট শব্দ করে দরজা খুলে গেল। বকুল বুকে হাত চেপে পিছিয়ে গেল। ভয়ে ওর সারা শরীর কাঁপছে। আয়ান গটগট পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
” বকুল ফুল।”
বকুল আতঙ্কিত গলায় বলল,,” আপনে আমারে এটা কোথায় নিয়ে আসছেন? আমি বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে যাব। আমি বুবুর কাছে যাব।”
” একসাথে তো দুই জায়গায় নিয়ে যেতে পারবনা।”
” আমাকে বাড়ি দিয়ে আসেন। আমি আর কোন দিন শহরে আসবে না। আমাকে ছাইড়া দেন।” কান্না করে দিয়ে বলল।
আয়ান বলল,,” বকুল ফুল তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। তুমি যদি আমার কথা মতো কাজ করো। তাহলে আমি তোমাকে তোমার বাড়ি দিয়ে আসব। আর যদি না শোন তাহলে তোমাকে মারতে আমার হাতটা একটুও কাঁপবে না। এমনিতেই তোমাকে কিডন্যাপ করে তোমার চোখে খারাপ হয়ে গেছি। তাই তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই।”
মৃত্যুর কথা শুনতেই বকুল আঁতকে উঠে। জন্ম নিলে মৃত্যু অবধারিত। তবুও মৃত্যুর কথা শুনতে অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে সবাই। আর যখন তা দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে তখন তো কথাই নেই।
বকুল ভয়ে ঘামতে শুরু করে দেয়।
” আমারে মারবেন না। আমি কি করছি আমারে মারবেন ক্যান।”
আয়ান বলল,,” তুই কিছু করিস নাই। করছে তোর বোন তৃষ্ণা।”
বকুল চোখ কপালে তুলে বলল,,” বুবু কি করছে?”
” তৃষ্ণার জন্য আমাকে জায়ান এতো কষ্ট দিয়েছে। সামান্য একটু ছুঁয়েছিলাম বলে জায়ান অমানুষিক অত্যাচার করেছে আমায়। আমি আজও ভুলি নাই। একজন কে তার শাস্তি দিয়েছি এখন রয়েছে তোর বোন আর বোন জামাই।” মনে মনে বলল, উষসী কে মেরে তাও মনে জ্বালা একটু হলেও মিটেছে।”
” আমারে মাইরা ফালান। তাও ভালো কিন্তু আমার বুবুর কোন ক্ষতি আমি করতে দিমু না আপনেরে।”
” তুই আটকাবি আমারে?”
” দুলাভাই রে আমি সব বইলা দিমু।”
” হাহাহাহা কি করবে? কিচ্ছু করতে পারবে না। আর শোন তোর বোনের আমি কোন ক্ষতি করব না আর না তোর দুলাভাইয়ের শুধু আমারে একটা ফাইল এনে দিবি। তোকে আমি বউ সাজাই নিয়ে যাব বাসায়। সবাইরে বিশ্বাস করাবি তুই আমার বউ। আর বিশেষ করে তোর বোনকে। ওর সাথে মিশে জায়ানের রুম থেকে লাল একটা ফাইল আছে ওটা এনে দিবি। আমিই এই কাজ করতে পারতাম কিন্তু জায়ানের রুমে ঢুকার অনুমতি আমার নাই। আমি ঢুকতেই পারব না। কিন্তু তুই পারবি কারণ তোর বোন আছে।”
” কিসের ফাইল? সেটার জন্য এতো নাটক করতে হবে কেন? আমি আপনার বউ সাজতে পারমু না।” রাগী গলায় বলল বকুল। কোন কিছু বিনিময়ে বুবুর ক্ষতি ও করতে দিবে না।
আয়ান বকুলের গলা চেপে ধরে বলল,,” আমার কথা তো তোকে শুনতেই হবে। যদি না শুনিস মরতে হবে।”
“আমারে মাইরা ফেলেন। আমি আমার বুবু আর দুলাভাই এর কোন ক্ষতি নিজে করতে পারব না।” হাঁসফাঁস করতে করতে বলল। এতো জোরে গলা চেপে ধরেছে যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ উল্টিয়ে ফেলছি তখন আয়ান বকুলের গলা থেকে হাত সরিয়ে বলল,,” জানতাম তুই এতো সহজে রাজি হবি না। তোকে রাজি করানোর অস্ত্র ও আমার হাতে আছে। ওয়েট।”
আয়ান ফোনে কাউকে ভিডিও কল করল। তারপর স্ক্রিনে ভেসে উঠল বকুলের বাবা মায়ের প্রতিচ্ছবি। দুজন অপরিচিত লোক তাদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে। বকুল ভয়ে চিৎকার করে উঠল,,” আব্বা আম্মা।”
আয়ান ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,,” বাবা মায়ের খুনের কারণ হতে চাও? নাকি আমার কথায় রাজি হবে বকুল ফুল? সিদ্ধান্ত তোমার তুমি রাজি হলে তোমার বাবা মায়ের প্রাণ বেঁচে যাবে। আর সাথে তুমি ও ছাড়া পেয়ে যাবে কাজ শেষ এ। শুধু মুখটা বন্ধ রাখতে হবে।কারো ক্ষতি হবে না।”
বকুল ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,” ছিহ আপনে এতো খারাপ!”
” এই বড় বড় কথা বলবি না। রাজি কিনা বল।আমার হাতে বেশি সময় নাই।”
বকুল বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা অনেক কথাই বলছে বকুল কিছুই বলতে পারছে না। কারণ আয়ান শয়তান সাউন্ড অফ করে রেখেছে।
বকুল কান্না করতে করতে নিচে বসে পড়ল। এসব কি হচ্ছে ওর সাথে। এসব দেখার জন্য বুঝি এতো আনন্দ নিয়ে এসেছিল শহরে। উনার বউ সেজে ওই বাড়ি গেলে জোভান কে আমি মুখ দেখাব কি করে? আর বুবু এসব শুনে কি পরিমান রাগ করবে। আল্লাহ আমার তো মনে হচ্ছে এখন মরে যাওয়াই ভাল কিন্তু বাবা মায়ের মৃত্যুর কারণ আমি কিভাবে হবো?
আয়ান ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,,” বকুল ফুল তুমি একটু বেশি করেই কাঁদো। বাবা মায়ের মৃত্যুর শোক পালন করা শুরু করে দাও।”
বকুল আঁতকে উঠে কান্না থামিয়ে বলল,,” না না আমার আব্বা আম্মা রে ছাইরা দেন। আপনি যা বলবেন আমি সব করমু। তাদের কোন ক্ষতি করবেন না দয়া কইরা।”
বকুল জানে না ওই ফাইল দিয়ে কি করবে কিন্তু বুঝতে পারছে ওটা কোন দরকারি জিনিস।
বকুল রাজি হতেই আয়ান খুশিতে রুম ত্যাগ করে। আর বকুলের বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,” আপনাদের ছোট মেয়ে আমার কাছে বন্দি ভুলেও এসব তৃষ্ণা বা জায়ান কে জানাতে যাবেন না। যদি জানিয়েছেন কাউকে তাহলে আমি কিন্তু আপনাদের আদরের মেয়ে বকুল কে খুন করে ফেলব। তখন সারাজীবন এর জন্য মেয়েকে হারাবেন। বাসায় বউ করে নিয়ে যাব তখন এসে একটু ফ্যামিলি ড্রামা করে যাবেন। ওকে। আমার কথা মতো চললে আপনার মেয়েও ভালো থাকবে। আপনারা ও ভাল থাকবেন।”
তৃষ্ণার বাবা মা ভয়ে স্বীকার করতে লাগে। এমন পরিবারে তাদের তৃষ্ণা কে বউ করে পাঠিয়েছে ভাবতেই ভয়ে কাঁপতে লাগে। ধনী পরিবার থেকে সমন্ধ আসতেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে একবার ভাল করে খোঁজ ও নেয়নি। যার ছোট ভাই এমন তার বড়ো ভাই না জানি কত খারাপ। জায়ান দের পরিবারের প্রতি তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হলো তাদের মনে।
দুই মেয়ের চিন্তায় তারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। বকুলের জন্য কাউকে কিছু বলতেও পারছে না সইতে ও পারছে না।
আয়ানের সামনে এসে উপস্থিত হয় জায়ানের ড্রাইভার মজিদ এর।
মজিদ এসে বলল,,,” আয়ান স্যার এইবার আমার ছেলেটাকে ছেড়ে দেন। আমি তো আপনার কথা মতো জায়ান স্যার কে মিথ্যা বলেছি। বলেছি আমি তৃষ্ণা ম্যাডামের বোন কে আনিনি। সে আমার কথা বিশ্বাস ও করেছে।”
” ভেরি গুড। তোমার ছেলে বাসায় পৌঁছে গেছে। তুমি কথা রেখেছ আমিও কথা রেখেছি।”
মজিদ খুশি হয়ে ধন্যবাদ বলে বেরিয়ে আসতে পা বাড়ায়।
” তোমার ছেলেকে ছেড়ে দিলেও তোমাকে ছাড়তে পারব না মজিদ।”
মজিদ থমকে দাঁড়িয়ে পরে। আয়ান বন্দুক বের করে গুলি করে মজিদ কে। মজিদ দৌড়ে পালাতে চেয়েও পারে না। ঠাস করে ফ্লোরে পরে যায়।
মজিদ পরে গিয়ে বলল,,” আমি মরে গেলে আমার পরিবার কিভাবে চলবে স্যার।আমায় ছেড়ে দেন আমি আপনার সব কথা শুনব।”
” তুই আমার কথা শুনবি আমি জানি কিন্তু জায়ান তোর পেট থেকে কথা বের করার ক্ষমতা রাখে আমি তো রিস্ক নিতে পারব না।”
বকুলকে একটা শাড়ি এনে দেয় আয়ান তারপর ওকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
তারপর সবটা আয়ানের পরিকল্পনা মতোই চলে। বকুল আয়ানের হাতের পুতুল হয়ে যায়। বাবা মায়ের জন্য, আয়ান যা বলে তাই করে।
আয়ানের চোখের আড়ালে কাউকে এসব ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারে না বকুল।
#চলবে…..