একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব -৫৩+৫৪

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৩
#Saji_Afroz

স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে দামী একটা হোটেলে উঠে ইনতিসার। আজরার দেওয়া টাকাতে হোটেল সহ যাবতীয় খরচ হয়ে যাবে তার। বাকি রইলো বাড়ি নেওয়া। নিজে যা জমিয়েছিল তা দিয়ে একটা বাড়ি নেওয়া যাবে।

নাবীহা ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, একটা কথা বুঝতে পারলাম না।
-কী?
-আজরা টাকা কেন দিতে চাইলো? আমাদের টাকা কেন লাগবে! কী বোঝালো সে?

আমতাআমতা করে ইনতিসার বলল, এত রাতে ব্যাংক খোলা থাকে না। তাই নিশ্চয়!

নাবীহা কথা বাড়ালো না। ইনতিসারকে সোফায় শুতে বসে সে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
.
.
.
আজরার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিচ্ছেন ইলারা জামান। যদিও আজরা না করেছে। তবুও তিনি নিজের পছন্দ মতন আজরাকে সাজালেন আজ৷
এই দৃশ্য দেখে সাদ বলল, সেরা শাশুড়ী বউমা জুটির পুরষ্কার দিতে হবে তোমাদের।

ইলারা জামান হেসে বললেন, নাস্তা খেয়েছিস তো?
-হু।
-চল তবে এবার তবে অফিসে।

তারা অফিসে আসে। এদিকে আজ ইনতিসার একাই অফিসে এসেছে। নাবীহার মাথাটা ধরেছে বলে সে আজ আসেনি।

আজরাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনতিসার। সে বলল, তোমরা? কিছু বলবে?

ইলারা জামান বললেন, আমি তোকে এখানে আশা করিনি।

নরমস্বরে ইনতিসার বলল, কেন? আমি অফিসে আসব না!
-নাহ।

ইনতিসার অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, মানে?
-আজ থেকে এসব সামলাবে আজরা। কারণ আমি সব আজরার নামে লিখে দিয়েছি।

একথা শুনে পা এর নিচ থেকে যেন মাটি সরে যায় ইনতিসারের। কী বলছেন ইলারা জামান!
ইনতিসার দ্রুত তার কাছে এসে বলল, এসব কী বলছ মা? এসবের প্রাপ্য আমি। এতবছর আমি শ্রম দিয়েছি।

তাকে থামিয়ে ইলারা জামান বললেন, সবই আমার। আমার যা খুশি করতে পারি।
-তবে আমার শ্রমের কোনো মূল্য নেই? বিশ্বাস করে কী ঠকলাম?
-ঠকতে কেমন লাগে দেখ না এখন!

নিশ্চুপ হয়ে যায় ইনতিসার। ভাগ্যিস নাবীহা আজ আসেনি।
ইলারা জামান বললেন, আমার সবকিছুর দরজা তোর জন্যে বন্ধ। গাড়িটাও আর নিবি না। আসতে পারিস এখন। এখন এই চেয়ারে বসবে আজরা।

ইনতিসার একবার চারপাশে চোখ বুলালো। ঝাপসা হয়ে আসছে তার দুচোখ। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে সে। আজরা তাকে থামিয়ে বলল, নাবীহা নিশ্চয় সবটা জানেনা। তাইনা?

না সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো ইনতিসার। আজরা বলল, জানার পর কী হতে পারে এটা দেখার অপেক্ষায় আমি।

ভাঙা গলায় ইনতিসার বলল-
আমি ওকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসায় আঁটকে রইবে সে।
-শুধু ভালোবাসা দিয়ে আটকানো গেলে আপনি দূরে যেতেন না আমার থেকে।

একথা শুনে আজরার চোখের দিকে তাকালো ইনতিসার। আজরা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ইনতিসার বেরিয়ে যায়।

সেই চেয়ারে আজরাকে বসানো হয়। ইলারা জামান নিজে তার ছবি তুলেন। এরপর আজরা উঠে সেখানে সাদকে বসতে বললে সে গিয়ে বসলো।
ইলারা জামান বললেন, আমার কথা রাখার জন্য তোকে ধন্যবাদ৷ তোদের বিজনেস তোর ভাই সামলাবে। আর আমারটা তুই। আজরা প্রেগন্যান্ট। তাই আমি আর আজরা বাড়তি কোনো প্রেসার নিতে চাইনা। দুজনে সুন্দর সময় কাটিয়ে অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় থাকব।

সাদ বলল, খালামনি কোনো চিন্তা করো না তুমি। আমি সামলে নেব সবটা।
-তোর উপর আস্থা আছে আমার।

ইনতিসার দু’দিনের মধ্যেই একটি বাড়ি পছন্দ করে নেয়। নাবীহা নিজের বাড়িতে উঠতে চায়। তাই ইনতিসার বাড়ির সন্ধানে পুরা দুইটা দিন ব্যয় করে। পরিচিত একজনের মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়। যদিও অনেক নিয়মাবলি রয়েছে। কিন্তু তার এখুনি বাড়িটা প্রয়োজন। নতুবা এভাবে হোটেলে থেকে অনেকটা খরচা হয়ে যাবে। তাই পরিচিত জনের মাধ্যমে বাড়িতে উঠে যাওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। এইখানে থেকেই বাকি নিয়মাবলি চলবে।

এদিকে নাবীহা নতুন বাড়ি দেখতে অনেক বেশি আগ্রহী। কখন সেই বড়ো বাড়িতে নিজে রাজ করবে এই অপেক্ষায় আছে সে।
লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাবীহা। ইনতিসারকে অন্য একটি গাড়ি থেকে নামতে দেখে সে জিজ্ঞাসা করলো, আপনার গাড়ি কোথায়?

নিজের গাড়িটিও যে মা এর নামে ছিল এবং তা নিয়ে ফেলা হয়েছে সেটা আর বলল না ইনতিসার। সে বলল, কিছু সমস্যা হয়েছে। ঠিক করতে দিলাম।
-এটা কার?
-ভাড়া করেছি।
-কেন? অন্য একটি গাড়ি আনতেন।
-ও বাড়ির কিছু আনব না। পরে কিনে নেব। চলো এখন।

নাবীহা গাড়িতে উঠে বসে। খানিকবাদে পৌঁছে যায় তারা। গাড়ি থামলে তারা নামে। ইনতিসার ভাড়া পরিশোধ করতে ব্যস্ত আর নাবীহা আশেপাশে দেখতে। কী ব্যাপার! বড়োসড় কোনো বাড়ি তো চোখে পড়ছে না তার।
ইনতিসার তাকে বলল, এসো।

এই বলে সামনে থাকা গেইটের তালা খুলতে লাগলো সে। নাবীহা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। গেইট খুলতেই সাদা রঙের ছোটোখাটো একটা বাড়ি দেখে নাবীহা বলল, আমরা এখানে কেন?
-ভেতরে তো আসো।

ভেতরে এসে ইনতিসার বলল, এই হলো আমাদের বাড়ি৷ যেটা আমি তোমার নামে নিয়েছি নাবীহা। আমি ঠিক করেছি আমাদের প্রথম সন্তান যেটাই হোক না কেন তার নাম দেব নব্য। আর এই বাড়ির নাম হবে নব্য ভবন।

নাবীহা বাড়িটা ঘুরে দেখে। একটি ড্রয়িংরুমে, একটি ডাইনিং রুম, দুটো শোয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর, দুটো ওয়াশরুম ও দুটো বারান্দা রয়েছে এখানে। আর এসব আকারে বড়োও না। সে এসব দেখে অবাক হয়ে বলল, সিরিয়াসলি! এটা আমার ভবন! মানে আপনি কী বলেছেন আর কী করেছেন?
-কী?
-এটা ও বাড়ির চেয়ে বড়ো বাড়ি? বরং ও বাড়ির তিনটে রুমের সমানও নয়!

ইনতিসার পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল, এটা আপাতত! মুহুর্তেই বড়ো বাড়ি নেওয়া তো সম্ভব না। তাইনা?

এইবার নাবীহা শান্ত হয়ে বলল, তাই বলুন! ওই বাড়িও কী আমার নামে হবে?
-নিশ্চয়।

বাইরে ট্রাকের শব্দ শুনতে পায় তারা। নাবীহা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে ইনতিসার বলল-
খাটসহ প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্র আনালাম। ওরাই সব গুছিয়ে দেবে।
-ঠিক আছে।

আজকের দিনটা কোনোমতে কেটে যায়। বাইরে থেকে খাবার আনানো হয়। পরেরদিন নাবীহা অফিসে যেতে চাইলে ইনতিসার বাহানা দিয়ে বলল, কিছুদিন অফিসে যেতে হবে না।
-কেন?
-ডেকোরেশনের কাজ করতে দিয়েছি। তুমি ছুটিতে থাকো। আর আমি এখানে বসেই সব সামলে নেব।

বোকা নাবীহা কিছু বুঝলো না।
.
.
যত দিন যায় আজরার অদ্ভুত ইচ্ছে যেন বেড়ে যেতে থাকে। এখন তার খুব করে চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে। আর সেটা সে ফেইসবুকের মাই ডে তে দেয় এক বাটির চটপটির ছবি দিয়ে। সবসময় ইলারা জামানকে এসব বলে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয় না তার। আবার অনলাইনেও অর্ডার দিতে ভয় পায়। ইলারা জামান এতে রাগ করেন যে কেন তাকে না বলে এমনটা করলো আজরা। তিনিই তো সব নিজ হাতে করতে চান।

খানিক বাদে বুয়া তার সামনে চটপটি নিয়ে হাজির হয়। আজরা একগাল হেসে বলল, চটপটি!
-জি ম্যাডাম।
-কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে যে আমার চটপটি খেতে মন চায়ছে? এর আগেও একবার এমন হয়েছিল। বিরিয়ানি ইচ্ছে হয়েছিল আর তুমি নিয়ে হাজির। সবসময় তো কাকতালীয় হয় না। কাহিনী কী?

বুয়া আমতাআমতা করতে থাকলে আজরা বলল, আরে বলো না!
-সাদ সাহেব পার্সেল করেছেন।

এই বলে সে চলে যায়। আজরা অবাক হয়। আগে সে চটপটি খাওয়া শেষ করে। এরপর ফোন করে সাদকে।
সাদ রিসিভ করেই বলল, পেটে কথা রাখতে পারেনি বুয়া নিশ্চয়?
-আপনি কিভাবে জানলেন সেটা বলুন?
-ফেইসবুকে এড হয়েছিলাম। ভুলে গেলেন?
-শিট!
-আপনি ভালো না।
-কী করলাম?
-বলেছিলাম সেসব ইচ্ছে আমাকে বলতে।
-তবে বলব?
-হু।
-রাতে চলুন, বাইরে কোথাও বসে কাচ্চি খাই?
-নিশ্চয়।

ফোন রেখে হাসলো আজরা। এই সময়ে তার এমন একজন বন্ধুর খুব করে প্রয়োজন ছিল।
.
.
ইনতিসার বাজার করে নিয়ে আসে। নাবীহা তাকে দেখে বলল, বাজার? তাও আপনি করেছেন?

সে সোফায় বসতে বসতে বলল, এক গ্লাস পানি দাও।

নাবীহা পানি আনে। সে পানি পান করে বলল-
বাইরের খাবার আর কত খাব। তাই বাজার করে আনলাম।
-ওহ।
-সরষে ইলিশ করো। আমার পছন্দ বেশ।

নাবীহা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে।

সে যে বিরক্ত হয়েছে ইনতিসার বুঝেছে। কিন্তু কিছু বলল না।
এদিকে ইনতিসার কত চাপে আছে তা যদি নাবীহা জানতো!
তার জমানো টাকার বেশিরভাগই বাড়ির পেছনে চলে গেছে। বাকি যা আছে তা দিয়ে তো চলতে হবে তাদের।
কিন্তু এসব তো নাবীহাকে বলা প্রয়োজন। সাহস সঞ্চয় করে আজ সন্ধ্যায় ঠিক বলবে সে। তারা দুজনেই চাকরি করে আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু সন্ধ্যে বেলায় যে তার মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা নাবীহা করবে কে জানতো!
ঘরে কাজের বুয়া নিয়ে আসে নাবীহা। যার মাসিক বেতন অনেকখানি। এটা শুনেই ইনতিসারের মেজাজ খারাপ হয়। সে নাবীহাকে বলল, দু’জনের কাজও কী তোমাকে দিয়ে হবে না?

নাবীহা অবাক হয়ে বলল, আমি আর কাজ! কেন করব বলুন তো? আপনার এত টাকা পয়সা দিয়ে কী করবেন?
-এত বুয়া থাকার পরেও আজরা নিজের কাজ গুলো করতো না?

একথা বলে নিজেই চুপ হয়ে গেল ইনতিসার। মুখ ফসকে এ কী বলে বসলো সে!
নাবীহা রাগান্বিত হয়ে বলল-
আমি আজরা নই। আমাকে আপনি রাণীর মতো রাখবেন বলে এনেছেন। সেভাবেই রাখুন। নতুবা বিয়েটা এখনো হয়নি। সেটা মনে রাখবেন।

এই বলে নিজের রুমে চলে যায় নাবীহা। ইনতিসার তার রুমে আসে। হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে সে। এই কয়েকটা দিন প্রতিটা মুহুর্ত আজরাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। তার জন্য নিয়মিত খাবার, চা, কফি নিয়ে হাজির হওয়া! তার জামা কাপড় ধুয়ে আয়রণ করা। মোট কথা তার সব কাজই আজরা অতি যত্নের সঙ্গে করতো। অথচ এখানে এসে সেসব ইনতিসারের নিজের করতে হয়।
নাবীহাকে ঘর সামলাতে বলেছিল। আর সে চব্বিশ ঘন্টার কাজের বুয়া নিয়ে হাজির হয়ে গেল। এই বুয়ার বেতনটাও যে ইনতিসারের জন্য চাপের সৃষ্টি করবে!

এদিকে বালিশে চোখের পানি ফেলে তা ভিজিয়ে ফেললো নাবীহা। পুরুষ মানুষ এমনি! কত কী বলে তাকে পটালো আর এখন কেমন আচরণ করলো। হঠাৎ ইনতিসার এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন! এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে নাবীহা।

যে যার রুমে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ইনতিসার ও নাবীহা। হঠাৎ পোড়া গন্ধ ভেসে আসে ইনতিসারের নাকে। সে ঘুমঘুম চোখে উঠে৷ ধোঁয়াও ভাসতে দেখতে অবাক হয়। কাশি শুরু হয় তার। রুম থেকে বেরুতেই রান্নাঘরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখলো। ইনতিসার ছুটে নাবীহার রুমে যায়। তাকে জাগিয়ে তুলে। এরপর দুজনে ডাইনিং রুমে এসে বুয়াকে ডেকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। আগুনের মাত্রা বাড়তে থাকে। তারা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নাবীহার হুশ আসলে চ্যাঁচাতে শুরু করলো সে। আশেপাশের মানুষ বেরিয়ে আসে। বালতি দিয়ে পানি মারতে শুরু করে। কিন্তু লাভ হয় না। মুহুর্তেই সারাবাড়িতে আগুন ছড়িয়ে যায়। ইনতিসার ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দেয়। তারা আসার আগেই অসহায় চোখে নিজের সম্বল টুকুও শেষ হতে দেখতে থাকলো ইনতিসার!
.#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৪
#Saji_Afroz

আগুনে অনেকবড়ো ক্ষতি হয়ে গেল ইনতিসারের।
বাধ্য হয়ে তাকে নাবীহার বাড়িতে আসতে হয়। এত রাতে মেয়েকে দেখে অবাক হলেন নায়লা খাতুন। তিনি বললেন, এত রাতে তোরা?
-সব বলছি। ভেতরে আসি?
-আয়!

তারা ভেতরে এসে সব জানালেন নায়লা খাতুনকে। ইনতিসার তার উপকার করেছে আর নাবীহা তার মেয়ে। তাই চাইলেও বেশিক্ষম রেগে তিনি থাকতে পারেন না। যদিও নাবীহার কাজ ক্ষমার যোগ্য নয়। তবে অসময়ে তাদের দূরে ঠেলেও দিতে পারেন না।
তাদের জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এলেন নায়লা খাতুন। এরপর ইনতিসারকে নিয়ে নাবীহার রুমে যেতে বলেন। তারা তাই করলো।
নাবীহার রুমে কোনো সোফা নেই। সে পাটি নিতে নিতে বলল, আজ এখানে আমি শুচ্ছি। আপনি বিছানায় থাকুন। কাল একটা ডিভাইন বা সোফা নিয়ে আসবেন। যখন যখন এখানে আসব আমরা কাজে দেবে। আচ্ছা, বড়ো বাড়িটা কবে নেবেন? না মানে কতদিন সময় লাগবে?

একটু আগেই ইনতিসারের সব শেষ হয়ে গেল। অথচ নাবীহার তার লোকসান নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই!

-কী হলো?
-যেটা নিয়েছিলাম সেটা মুহুর্তের মাঝে শেষ হয়ে গেল। এ নিয়ে আফসোস নেই তোমার?
-আপনার কী কম আছে সম্পদ!

এই বলে শুয়ে পড়ে নাবীহা। ইনতিসার পড়ে যায় গভীর ভাবনায়। কেন যেন নাবীহাকে সত্যিটা বলার সাহস সে পাচ্ছে না। নাবীহা সব জেনে যদি তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়!
.
.
মানতাশাকে দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো আজরা। মানতাশা আজকাল ঘুরাঘুরি নিয়েই ব্যস্ত। তাই এদিকের খবর খুব একটা রাখতে পারেনি। আজরা এখানে আছে শুনে দেখা করতে এলো সে। সবটা শুনে আজরার জন্য খুবই খুশি মানতাশা।
এদিকে আজরা কথায় কথায় সাদের বেশ প্রশংসা করলো। জানালো সে ইনতিসারের ভাই হলেও দু’জনের স্বভাব একদমই আলাদা।
তা শুনে মানতাশা হেসে বলল, প্রেমে পোড়ার দু:খিত পড়ার গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে!

আজরা তার নাকে চিমটি মেরে বলল, তোর নাকে সমস্যা।
-নাক আমার ঠিকই আছে। তোর মুখে সাদের কথা শুনে তাকে দেখার ইচ্ছে প্রবল হলো।
-দেরীতে আসে রে অনেক।
-তাই! নাকি নাবীহার মতো ছিনিয়ে নেব বলে ভয় পাচ্ছিস?

শান্তস্বরে আজরা বলল, যা আমার নয় তা নিয়ে ভয় পাব কেন? আবোলতাবোল কথা ছাড়। তোর কথা বল?

আড়াল থেকে এসব শুনে ইলারা জামানের মুখে হাসি ফোটে। তিনি আপনমনে বললেন, আরেহ! এটা আমার মাথায় আসেনি কেন! সাদ আর আজরা, ভালোই তো মানাবে তাদের। কিন্তু তারা একে অপরকে নিয়ে কী ভাবে, এটা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
.
.
দরজা কড়া নাড়ার শব্দ হলে দরজা খুলে দেন নায়লা খাতুন। বাইরে এত মানুষ দেখে অবাক হোন তিনি। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। তাদের মধ্যে একজন মহিলা বললেন, তা কই তোমার নষ্টা মেয়ে?

নায়লা খাতুন চমকে উঠেন। তিনি আমতাআমতা করে বললেন, কে?

আরেকজন বলল, কে আবার! নাবীহা। ডাকো ওকে।
-কেন?
-আমরা ওর মুখে কালি মাখতে এসেছি। কিভাবে পারলো অন্যের সংসার নষ্ট করতে?

খুব বাজে একটা পরিস্থিতিতে পড়ে যায় নায়লা খাতুন। সবাইকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

চোখ কচলাতে কচলাতে নাবীহা আসলো। এই বিকেলেও ঘুমে মগ্ন ছিল সে। এসবের কিছুই সে জানেনা। কেউ একজন তার দিকে একটি জুতা ছুড়ে মারতেই চ্যাঁচিয়ে উঠলো সে। বলল, এসবের মানে কী?
-অন্যের সংসার নষ্ট করার শাস্তি এটা।

নাবীহা বলল, তোমরা কে আমায় শাস্তি দেওয়ার?
-আমরা এই সমাজের জনগণ । আর আমরা চাইনা এমন নষ্টা মেয়ের বসবাস এখানে হোক। তাহলে আমাদের বাচ্চারাও বিপথে যাবে।

নাবীহা বলল, এখন পুলিশ এনে সব কটার পেছনে লাঠি মারলে উচিত শিক্ষা হবে।
আরও একজন জুতা ছুড়ে মারে নাবীহার দিকে। এরপর কয়েকজন মহিলা এসে তাকে ধরে টানতে টানতে উঠোনে নিয়ে আসে। সবাই ঘিরে ধরে তাকে।
ইনতিসার বাসায় নেই। তাকে যে ফোন করে ডাকবে সেই সুযোগও নাবীহা পাচ্ছে না। এদিকে জহির ও নায়লা খাতুনকেও আঁটকে রেখেছে বাকিরা।
নাবীহার মুখে কালি মাখানো হয়। সে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অনেকে আবার তার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। সবাই তামাশা দেখতে ব্যস্ত।
হঠাৎ কোনো মানতাশার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় নাবীহা। সবাইকে ঠেলে নাবীহার পাশে আসলো সে। তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে নাবীহা। মানতাশা সকলকে যেতে বললে তাকে গালমন্দ করা হয় এই বলে যে, সে খারাপের সঙ্গ দিচ্ছে। মানতাশা দাঁড়িয়ে পুলিশকে ফোন দিতে চায়। সবাই ঘাবড়ে গিয়ে চলে যায়। নাবীহাকে নিয়ে ভেতরে আসলো সে। নাবীহাকে পানি পান করানো হয়। এরপর তাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। নাবীহা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো। নায়লা খাতুন বললেন, মান সম্মান সব শেষ হয়ে গেল! কী দরকার ছিল ইনতিসারকে নিয়ে এখানে থাকতে আসার?

মানতাশা বলল-
এটা না বলে বলুন যে কী দরকার ছিল বান্ধবীর সংসার নষ্ট করার? খারাপ কাজের ফল তো এভাবেই ভোগ করবে তাইনা?

নাবীহা বলল, ইনতিসার ছিল না বলে এমন করতে পেরেছে ওরা৷ থাকলে কখনোই পারতো না।
-কী করতো সে?
-আমাকে অসম্মান থেকে বাঁচাতো।
-নাকি সেও অসম্মানিত হত?
-এমন করার সাহস কারো নেই।
-তার বউ এর সাথে তো হয়ে গেল খারাপ কিছু। তাই না?
-সব কটাকে দেখে নেব আমি। মানহানির মামলা করব।

এই বলে ফোন হাতে নেয় নাবীহা। মানতাশা বলল, কাকে ফোন দিচ্ছিস?
-ইনতিসারকে। কী জানি কোথায় চলে!
-আমি জানি। তোদের বাড়ি সম্পর্কেও শুনলাম। তাই তো দেখতে এলাম তোকে।
-কীভাবে জানিস?
-আরশানের সঙ্গে দেখা করতে গেল ইনতিসার ভাই।
-ওহ।
-আরশানের কোম্পানিতে চাকরির খোঁজ করছেন তিনি।

এইবার চমকালো নাবীহা। সে বলল, কার জন্যে?
-কার আবার! তার নিজের জন্যে।

নাবীহা অবাক হয়ে বলল, ইনতিসারের চাকরির কী প্রয়োজন?
-তুই মজা করছিস?
-মানে?
-উনার এখন কী আছে? কিছুই না! তারপরেও বলছিস চাকরির প্রয়োজন নেই!

নাবীহা হেসে বলল, কিছু নেই থাকবে না এসবের মানে কী মানতাশা?

মানতাশাও হেসে বলল, তার মানে তোকে কিছুই জানায়নি।
-কী জানাবে?
-এই যে সব সম্পত্তি আজরার নামে হয়ে গেছে।

নাবীহার হাত থেকে তার দামী ফোনটা পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা কাচের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে সে নিজেই গুড়িগুড়ি হয়ে গেছে। অস্পষ্ট গলায় বলল সে, কী?

ইলারা জামানের সম্পত্তি সম্পর্কে নাবীহাকে সব জানালো মানতাশা। সে সবটা শুনে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ে। মানতাশা বলল, আজরার ঘর ভেঙে লাভ কী হলো? সেই তো তুই ওর নিচেই রইলি রে!
.
.
ইনতিসার আজ আরেকটা মিথ্যে বলতে চলেছে। আরশানের মাধ্যমে একটি বড়ো বাড়ি কিছুদিনের জন্য ঠিক করেছে সে। আর সেইটা নাবীহাকে দেখিয়ে তাকে বিয়েটা সেরে নিতে হবে। এরপর নাবীহা সব জানলেও ইনতিসারকে ছেড়ে সহজে যাবে না। ইনতিসার নিজেই তাকে যেতে দেবে না! ভালোবাসার জন্য এতটুকু করাই যায়!

বাসায় এসে নাবীহার কাছে এসে হাসিমুখে ইনতিসার বলল, বড়ো বাড়ি নিয়ে ফেলেছি তোমার নামে। তৈরী হয়ে নাও৷ আজই যাব।

নাবীহা তার কাছে এসে বলল, তাই?
-হুম। আচ্ছা বাড়িতে উঠার আগেই বিয়েটা সারলে কেমন হয়?
-খুবই ভালো। তা বাড়ির কাগজপত্র কই? আমার নামে নিয়েছেন তা দেখি!
-উহু নাবীহা! এত সহজেই সব হয় নাকি! তবে হয়ে যাবে। এর ভেবো না। বিয়েতে কী পরবে এটা ভাবো।
-একটা ডিজাইনার লেহেঙ্গা পরার অনেক ইচ্ছে। সাথে ডায়ামন্ড এর জুয়েলারি। মাথায় একটা ভারী মুকুট। জোশ লাগবে না?
-অবশ্যই।
-এসবে প্রায় পঞ্চাশ লাখেরও বেশি যাবে। আসলে আমি ওভাবেই সিলেক্ট করেছি। আপনার জন্য তো বেশি না এটা। তাইনা?

আমতাআমতা করে ইনতিসার বলল, নাহ। তবে এসব রিসিপশনে পরলে ভালো হয় না?
-তো এখন?
-আপাতত একটা জামদানী পরেই বিয়েটা সেরে ফেলো। তোমাকে যে এভাবেই দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।

ইনতিসারের গালে কষে একটা চড় বসায় নাবীহা। ইনতিসার নির্বাক হয়ে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। নাবীহা বলল, কিছুই তোর নেই! আর কত বড়ো বড়ো মিথ্যা বলে গেলি এতদিন! ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করতে চাইছিস আমাকে?
ইনতিসার গালে হাত দিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নাবীহা বলল-
তোর যে থলি খালি হয়ে গেছে আগে জানাসনি কেন! ওহহো! এইজন্যই ও বাড়ি থেকে বের হয়ে আসা, অফিসে না যাওয়া। যাবি কীভাবে! সবই তো আজরার হয়ে গেছে।

ইনতিসার অবাক হয়ে বলল, তুমি কীভাবে জানলে?
-সেটা বিষয় না। বিষয় হলো তুই আমাকে ঠকিয়েছিস সেইটা। অবশ্য আমি আশা কীভাবে করি এমনটা তুই করবি না! আজরার মতো মেয়েকে যে ঠকাতে পারে সে সব পারে।

ইনতিসার নাবীহার হাত ধরে বলল, আমি যা করেছি সবটা তোমার জন্য করেছি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও!

নাবীহা একটু থেমে বলল, যেটার জন্য রাজি হয়েছিলাম সেটাই যখন নেই তোর কাছে আর তোকে কী প্রয়োজন! বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।

এই বলে ইনতিসারের হাত ধরে টেনে তাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেয় নাবীহা। ইনতিসারের মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। ইনতিসার অনবরত দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে বলল, দরজা খোলো নাবীহা! তোমাকে সুখে রাখব আমি। আবার সবটা গড়ে নেব। একবার সুযোগ দাও আমাকে প্লিজ!
.
চলবে
চলবে
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here