#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ১৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৪৬
যমুনা ফিউচার পার্কে বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে এসেছে মাহাদ, স্নেহা, দিগন্ত, রাইমা, শার্লিন, ইফরাদ। বড়োদের মাঝে এসেছেন সাহিরা বেগম ও শাহনাজ বেগম। বিয়ের শপিং বলে কথা, বড়োদেরও একটা মতামতের বিষয় আছে। মাহাদ রাইমাকে নিতে গিয়ে শার্লিনকে দেখে তাকপও ছাড়েনি, রাইমাও শার্লিনকে নিজের বোরখা আর হিজাব পরিয়ে রেডি করে সাথে এনেছে। দুজনের উচ্চতা প্রায় একই৷ শার্লিন বাসায় যাবে, রেডি হবে! এই ধৈর্য বা সময় কোনো টাই হাতে ছিলো না তাদের৷। এজন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছে রাইমা। রাইমা আর শার্লিনকে নিয়ে বের হওয়ার সময় খালামনিকেও রেডি হতে বলেছিলো মাহাদ। শাহনাজ বেগম আসতে চাননি, তবুও ভাগ্নের জোড়াজুড়িতে এসেছেন তিনি। সবাই বের হওয়ার ইফরাদকেও ঠিকানা টেক্সট করে দিয়েছিলো শার্লিন। যার ফলে ইফরাদও আসতে পেরেছে। মায়েরা আর মেয়েরা মিলে দোকানে দোকানে ঘুরে শাড়ি না লেহেঙ্গা কোনটা বউকে পড়াবে খুজে খুজে হয়রান। বেশি জিনিস দেখলে কোন টা রেখে কোনটা পছন্দ করবে! এটা বুঝে উঠতে পারছেনা কেউ। ইফরাদ, দিগন্ত, মাহাদ এদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে একস্থানে। বাকিরা এক দোকানে বসে লেহেঙ্গা আর শাড়ি হাতরাচ্ছে। একজন বলে তো এটা সুন্দর তো অন্যজন অন্যটা নিয়ে বলে সেটা সুন্দর। ব্যস হয়ে উঠেনা কেনা৷ কোন টা নিবে কোনটা বাদ দিবে চোখ ধাঁধিয়ে উঠে। যমুনা ফিউচার পার্কটা ওদের বাসার থেকে আসতে কাছে হয় বলে ওরা এখানেই এসেছে৷ কিন্তু এসে যে এতো ঘোরাবে বুঝতে পারেনি মাহাদ। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে তবু এদের পছন্দ হওয়ার খবর নেই। বিয়ের যে আরও আয়োজন বাকি! এদের মাথাতেই নেই। দিগন্ত এবার বিরক্তি নিয়ে স্নেহার উদ্দেশ্যে বললো,
“আপা! আজ কি এখানেই রাত কাটিয়ে দিবি? এতো বড় শপিং মল! তোদের কিছু পছন্দ হয়না? চোখ কি খুলে বাসায় রেখে এসেছিস?”
স্নেহা করুণ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। বিয়ে নিয়ে তেমন স্বপ্ন না থাকলেও বিয়ের দিন তাকে সবথেকে সুন্দর লাগবে এই স্বপ্ন তার আছে! প্রতিটা মেয়েরই প্রায় এমন স্বপ্ন থাকে বিয়েকে ঘিরে। স্নেহাও তার উর্ধ্বে নয়৷ রাইমা দিগন্তের কথার জবাবে ঠোট বাকিয়ে বলে,
“আপনাদের বিরক্ত লাগলে শপিং মলের গেইট খোলা আছে, যেতে পারেন৷ যাওয়ার আগে শুধু আমাদের শপিং করার টাকাটুকু দিয়ে চলে যান।”
“সব টাকা তোমার খালামনির কাছে রাই। আমরা বরং বাড়িতেই যাই।”
মাহাদ বললো রাইমার কথার জবাবে। শার্লিন তখন বলে,
“তবে আপনারা কি করতে দাড়িয়ে আছেন? বডিগার্ড হিসেবেও তো আপনাদের রাখিনি! যেতে পারেন আপনারা।”
“শালীর বেডি মানুষ, ফোন দিয়ে ডেকে এনে অপমান করে। ঘসেটি বেগমের বংশধর পুরোই।”
ইফরাদ কপাল চুলকিয়ে ফিসফিস করে কথাটা বলে শার্লিনের কথা শুনে। শার্লিন ভাগ্যিস আবার কাপড় দেখায় ব্যস্ত হয়েছিলো, নতুবা ইফরাদকে ফিসফিস করতে দেখে জিদ ধরতো কি বলেছে ইফরাদ! না শোনা অব্দি তার কানের পোকা মে”রে ফেলবে, তবুও না জানা অব্দি ছাড়বেনা। দিগন্ত পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। ইফরাদের কথা শুনে সে ফিক করে হেসে দেয়। রাইমা আচমকা মাহাদকে একটা প্রশ্ন করার জন্য তখনই তাকায় তাদের দিকে। দিগন্তের মুখে হাসি দেখে মুগ্ধতা ফুটে উঠে তার চেহারায়। আনমনে ভাবে,
” বাহ লোকটার হাসি তো চমৎকার, কিন্তু হাসি টাকে চেপে সবসময় রাগ দেখিয়ে বেড়ায়! এটা তো ঠিক না। বিয়ের পর উঠতে বসতে না হাসলে এ বেডার খবর আছে। রোজ দুবেলা নিয়ম করে আমার সামনে বসিয়ে জোড় করে হলেও হাসাবো। হাসিটা সুন্দর।”
রাইমা চুপচাপ এক পলকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকায় দিগন্ত বিষয়টা খেয়াল করতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। রাইমা চোখ সরিয়ে নেয়। কিছু বলতে গিয়েও বলেনা। মিটমিট করে হেসে অনেক বাছাই করে স্নেহার জন্য একটা শাড়ি আর একটা লেহেঙ্গা নেয়। সাথে আরও কয়েকটা শাড়ি নেয়। তার কাপড় নেওয়া শেষে রাইমার চোখ আটকে যায় একটা হালকা মিষ্টি রঙের লেহেঙ্গায়।
৪৭,
পছন্দ হলেও রাইমা কিছু বললো না। লেহেঙ্গা টা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে রেখে দেয়। শাহনাজ বেগম তা দেখে জিগাসা করেন,
“তোমার পছন্দ হয়েছে রাইমা? কিনে দিবো?”
“না মা, এমনি ভাবছিলাম ভাবীকে এই রঙে সুন্দর লাগবে। কিন্তু ভাবী নতুন বউ এতো ফিকে রঙ বিয়েতে পড়া যাবেনা৷ আমার বিয়ের সময় ভাবীকে এমন রঙের লেহেঙ্গা পড়তে বলবো ভাবীকে।”
রাইমা অতি সর্পণে কথাটা এড়িয়ে যায়। সাহিরা বেগম বললেন,
“তোমার ভাবী কি পরবে না পরবে পরের বিষয়। লেহেঙ্গা টা সুন্দর। তুমি আর শার্লিন দুজনে দুটো নাও। দোকানদারকে জিগাসা করে দেখি দুটো আছে কিনা!”
“আরে আন্টি না না আমার লাগবেনা। আমি এমনিতেও উস্টা খাই এসব পরে। আমার লাগবেনা। আপনি রাইকে কিনে দেন।”
শার্লিন কথাটা বলে উঠে তার কথা উঠায়। তার কথায় দোকানদার সহ বাকিরা একটু হাসলেও ইফরাদ মাথার পিছনে হাত দিয়ে মাথা চুলকে বলে,
“শুকনা পাঠকাঠিরে ভালোবাসছি, উস্টা খায় উঠতে বসতে। জানিনা বিয়ের দিন শাড়ি লেহেঙ্গা বাদ দিয়ে না জানি জিন্স টপ পরে বসে যায় বিয়ে করতে!”
দিগন্তের সাথে ইফরাদের তেমন পরিচয় নেই। বয়সের দিক থেকে দুজনই একই বয়সী। আজকেই শার্লিনের মাধ্যমে তার সাথে পরিচয়। এরমাঝেই তার পরপর দুটো কথা শুনেই তার হাসি পেলো। সে ইফরাদের কাধে হাত রেখে আস্তেধীরেই বলে,
“আমাদের দুইজনের কপালে দুঃখ আছে ভাই। দুনিয়ার মাঝে সেরা দুই সুস্থ পা”গলি আমাদের বউ হবে। এরপর দুজনের কি অবস্থা হবে! বিষয়টা কল্পনা করতে ভয় লাগছে ভাই।”
ইফরাদ দিগন্তের কথায় বোকার মতো হাসার চেষ্টা করে বলে,
“আসলেই, উপরওয়ালা জানেন কপালে কি আছে!”
মাহাদ ওদের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলো। দিগন্ত আর ইফরাদের কথা শেষ হতেই সে বলে,
“মেয়ে দুটো একটু বেশিই সহজ-সরল। মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করে। মনটা ভালো ওদের, এটা বিয়ের পরই বুঝবে। যতোটা প্যারা দেবে ওরা, তার থেকে শতগুণ ভালোবাসায় আগলে রাখবে। চোখের সামনে বড়ো হলো তো! চিনেছি ওদের। উপর থেকে শক্ত, হাসিখুশি, আধ পাগলি দুটো মেয়েকে যে দেখো তোমরা, এরা ভেতর থেকে ততোটাই নরম।”
মাহাদ কথা শেষে মুচকি হাসে। ওর সাথে তাল মিলিয়ে দিগন্ত আর ইপরাদও মুচকি হাসে। এদিকে রাইমা আর শার্লিন দেজানপ বসেই ডিসাইড করে ফেলেছে আগামীকাল ছোটো পরিসরে হলেও হলুদ ছুইয়ে মাহাদকপ ভুত বানাবে। সেজন্য হলুদের জন্য শাড়ি পছন্দ করে ফেলেছে। বিয়েতে পরার জন্য দুজনে একরকম একই রঙের দুটো গাউনও কিনে ফেলেছে। শাড়ি পরে উস্টা খাওয়া বা ভারী লেহেঙ্গা সামলানোর ঝুকি ওরা নিলো না। সব পছন্দ করা শেষে দাম ঠিক করে প্যাকেট করে নিয়ে উঠে পরে ওরা। সাহিরা বেগম বিল ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয়। বাকি ব্যাগগুলো দিগন্ত আর ইফরাদ নিয়ে নেয়। মাহাদ বিল দিয়ে এসে ওদের থেকে কিছু ব্যাগ নিয়ে হাটা ধরে। হাঁটতে হাঁটতে দিগন্ত মাহাদকে প্রশ্ন করে,
“ভাই বিয়ে তো আমার বোন একা করছেনা! আপনিও করছেন। আপনার শেরোওয়ানি পাঞ্জাবি কিছু তো কিনলেন না।”
“এদের সাথে কিনতে ধরলে নানান কথা উঠবে শালাবাবু। আগামীকাল রেডি থাকিও তোমরা দুজন। বাইকে তুলে আনবো, চট করে কিনে নিয়ে যাবো।”
ইফরাদ বললো,
“বুদ্ধি ভালো।”
এরপর তিনজনেই হেসেই রাইমাদের অনুসরণ করে হাটতে শুরু করলো। গহনার দোকানে গিয়েছে তারা।
৪৮,
গহনার প্রতি একটুও আগ্রহ নেই রাইমার। সেজন্য সে বাইরেই দাড়িয়ে আছে। কিছু মেয়ে থাকে যাদের শাড়ি, চুড়ি, গহনা, সাজগোজের উপর কোনো আগ্রহ থাকেনা। তাদের জন্য হাতে ঘড়ি কানে সিম্পল কানের দুল হলেই এনাফ। রাইমা সেই কিছু মেয়েদের মাঝে একজন। সাজগোজ, গহনাগাঁটি মেয়েলি জিনিসপত্রে তার আগ্রহ নেই। সব আকর্ষণ শুধু ঘড়ির দিকে। বাকিরা সব ভেতরে গহনা পছন্দ করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। দিগন্ত রাইমাকে একা দাড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে দাড়ায়। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,
“সবাই ভেতরে গহনা পছন্দ করে, আপনি এখানে একা দাড়িয়ে আছেন যে!”
“গহনা আমার পছন্দ না।”
“তো কি পছন্দ? ছেলেদের জিনিসপত্র?”
“ধরতে গেলে তাই!”
দিগন্ত অবাক হয় রাইমার কথায়। ভ্রু কুটি করে বলে,
“মানে?”
“মানে কিছু না। আপনার টাকা বেঁচে যাবে। আমার এতো টান নেই এসব শাড়ি, গহনার প্রতি। ঐ টাকা দিয়ে আমায় একগাদা চকলেট আইসক্রিম কিনে দিবেন।”
“মানুষ বাঁচাল হয়, আপনার মতো না৷”
“কথা আগ বাড়িয়ে আপনিই বলতে আসছেন।”
“আচ্ছা ক্ষমা চাই। এতো বাঁচালতা আমার পছন্দ না।”
“আমিও সবার জন্য বাঁচাল হই না। আমার জীবনে প্রিয় মানুষগুলো ব্যতিত আমায় টু শব্দ করতে কেউ দেখেনি। ১০টা কথার পর একটা উত্তর পায়। মানুষ হয়তো বলবে আমি আর শার্লিন ন্যাকামি করি, একটু বেশিই পাগলামি করি! সবাইকে কতো বিরক্ত করি৷ কিন্তু হয় কি বলুন তো! কাঁদানোর জন্য হাজারও মানুষ থাকে, দিনশেষে হাসানোর কেউ থাকেনা। কেউ ভরসা দিয়ে মন খারাপ থাকলে ম্যাজিক করে মন ভালো করেনা। বলেনা মন খারাপ কেনো তোমার? আমি তো আছি। মন খারাপির গল্পটাও কেউ শুনতে চেয়ে বলে না, আমায় বলো, বলে হালকা অনুভব করো। দিনশেষে নিজের আমি ব্যতিত কেউ থাকেনা। সেজন্য সারাদিন দুষ্টমি করি, বাঁচাল হই। যেনো দিনশেষে যেই মন খারাপের গল্পেরা ভীর জমায়! তাদের এই দিনের সুন্দর স্মৃতি গুলো দিয়ে হটাতে পারি। আইডিয়াটা দারুণ না?”
রাইমা কথাটা বলেই দিগন্ত কে ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি ভেতরে অবস্থিত মায়েদের উপর যায়। তারা স্নেহার উপর বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা বসিয়ে দেখছে কেমন হয়। রাইমার মুখে প্রিয় শব্দটা শুনে দিগন্ত একটু বিস্মিত হয়। তবে কি সেও রাইমার প্রিয় কেউ! দিগন্তের মুখের গম্ভীরতা ছাপিয়ে ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠে। মেয়েটাকে যতোটা ষ্টুপিড ভেবেছিলো, ঠিক ততোটা নয় সে। বিয়ে করাই যায়। রাইমা দিগন্তের হাসি আবার লক্ষ্য করে। আনমনে এবার বলে,
“আপনি হাসবেন না। আপনার হাসিটা ভয়ংক”র সুন্দর। অন্য মেয়েরা দেখলে ক্রাশ খাবে। আমি চাইনা, আমার উডবির উপর কেউ ক্রাশ খাক। আমার ব্যাক্তিগত জিনিসের উপর অন্য কারোর নজর আমি নিতে পারিনা।”
রাইমা কথাটা বলেই জিভে কামড় দেয়। গতকাল দুদিন আগে অব্দি যাকে সহ্য হতো না, তার প্রতি ভালো লাগা কাজ করছে। তবে কি এটার বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে, সেই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধিত হওয়ার পূর্বের অনুভূতি! যেই অনুভূতিই হোক না কেনো! অনুভূতি টা সুন্দর। রাইমা মাথা নিচু করে লাজরাঙা হয়ে হাসে। দিগন্ত অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেছে। যে মেয়েটার সাথে তার ঝগড়া ছাড়া কিছু হয়নি দেখা হলে! সেই মেয়েটা বলছে তাকে, সে তার ব্যক্তিগত মানুষ! দিগন্ত মাথা চুলকে ভেতরে সবার মাঝে চলে যায়। কেমন একটা মনের মাঝে উথালপাথাল ঢেউয়ের সূচনা হয়ে গেছে মনে। রাইমার সামনে থাকলে নির্ঘাত রাইমা সেই শব্দ শুনতে পেতো! তার আগেই সে চলে যায়। রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিগন্তের যাওয়ার পানে তাকিয়ে। নিজমনে বলে,
“আই উইশ সম্পর্ক টা যেনো মন থেকে মানতে পারি আল্লাহ। তার প্রতি যদি আমার অনুভূতিগুলো সত্যি হয়, তবে আলহামদুলিল্লাহ। নিজেই নিজেকে বুঝতে পারিনা, সেখানে অন্যের প্রতি অনুভূতি আর কি বুঝবো! জানিনা কথাগুলো কিভাবে বললাম! কিন্তু যা বলেছি তা যেনো মন থেকে মেনে নিয়ে সম্পর্ক টা সহজ হয় আল্লাহ। তুমি দেইখো।”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, রিচেইক করিনি। আসসালামু আলাইকুম।#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ১৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৪৯,
পরদিন সকালবেলায়, সাহিরা বেগমের বাসায় এসে পরেছে আজাদ সাহেব স্বপরিবারে। এসেই মাহাদের বাবা হাসান সাহেবের সাথে হাতে-হাতে বিয়ের আয়েজন শুরু করেছেন। একমাত্র পুত্রের বিয়ে উপলক্ষে বড় করে আয়োজন করার ইচ্ছে ছিলো উনার। কিন্তু মাহাদের কথায় মানুষজন তেমন দাওয়াত করেননি উনি। শুধু নিজের ভাইবোন, তাদের সন্তান-সন্ততিদেরই আনাগোনা দেখা যাচ্ছে বাসায়। রাইমা মানুষের মাঝে থাকতে পারেনা, তার প্রচুর অসস্তি হয়। বাসায় এতো অল্প মানুষ থাকা সত্বেও তার বাসার কোথাও মন টিকছেনা। ইচ্ছে করছে এক ছুটে বাসায় চলে যেতে। শার্লিনকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, তবুও তার মন টিকছেনা এখানে। অথচ নিজেদের সস্তিকর জায়গায় দু বান্ধবী থাকলে আর কাউকে লাগে না। মাহাদের বাবার পক্ষের আত্মীয় স্বজনদের দেখেই তার অসস্তি বোধ জাগ্রত হয়েছে। এখানে আসার পর নিজের খালামনির রুম দখল করে নিয়েছে রাইমা। শার্লিন আগেভাগে ওয়াশরুমে ঢুকেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই রাইমা উঠে দাড়ায়। শার্লিন তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বলে,
“বইনে, বাসায় যাবি কবে? আমার একদণ্ড মন টিকছেনা।”
“তোরে অকারণে আমার আত্মা বলি না বইনে, আমারও মন টিকতেছে না। অথচ মাহাদ ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে আমার কতো স্বপ্ন ছিলো। বইনে চল পালাই এখান থেকে।”
রাইমা বললো। শার্লিন হেসে দেয় রাইমার কথায়। রাইমা ভ্রুকুটি করে বলে,
“হাসছিস কেন?”
“পালানোর কথা শুনে? কার সাথে পালাবো? আমরা দুজন মেয়ে মানুষ পালিয়ে কি হবে? কেউ তো কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। চল।ইফরাদ আর দিগন্ত ভাইকে খবর দিই। ওদের সাথে পালিয়ে মাহাদ ভাইয়ের আগে বিয়ে করে নিই!”
“একটা থাপ্প’ড় খাবি তারছিড়া মহিলা।”
“বিয়ে করলাম না, বাচ্চা হলো না, দাদী হলাম না, নাতী-নাতনীর ঘরের পুতি দেখা হলো না। তুই আমায় মহিলা বানিয়ে দিলি?”
“ফালতু কথা কম বল। বোসে থাক রুমে, কোথাও যাবিনা। আমি ফ্রেশ হই৷”
৫০,
রাইমা চলে গেলো ফ্রেশ হতে। শার্লিন লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ব্যাগ হাতড়ে কাপড় বের করলো। দুপুরের পরপর মাহাদকে হলুদ ছোয়ানো শুরু হবে। কথা ছিলো মেয়েপক্ষ থেকে কেউ আসবেনা। ছেলেপক্ষ থেকেও মেয়েপক্ষের বাড়ি যাওয়া হবে না। শুধু কাজিন ক’জন মিলে একটু আনন্দ করতে এই আয়োজন। কিন্তু দিগন্ত পরে যে কয়েকজন হয়, গিয়ে স্নেহাকে হলুদ ছুইয়ে আসতে বলেছে। সেজন্য এতো তাড়াতাড়ি সব আয়োজন শুরু করা। নয়তো বিকাল বেলায় সবাই আনন্দে মেতে উঠতো। শার্লিন হলুদের জন্য কেনা শাড়ি, অর্নামেন্টস বের করে গুছিয়ে রাখে বিছানায়। নিজের টার সাথে রাইমার গুলোও বের করে। রাইমা একেবারে গোসল দিয়েই বের হলো। গরমের আভাস পরে গেছে চারপাশে। বাসায় যে মানুষ, পরে গোসল করার জন্য সিরিয়াল পায় কি পায় ভরসা নেই। শার্লিন ইফরাদের সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলো। মাহাদ ইফরাদকেও স্পেশালি আলাদা করে দাওয়াত দিয়েছে পরিবার সহ। শার্লিনের পরিবারকেও বলা হয়েছে। কিন্তু আজ শুধু মেসবাহ আসবে হলুদের সময়। আগামীকাল বিয়েতে পুরো পরিবার সহ আসবে সব। রাইমা বের হতেই শার্লিন ফোন রেখে দেয়। রাইমা তা দেখে বললো,
“বের হয়ে কথা বলায় ডিস্টার্ব করলাম নাকি?”
“না, কথা বলা শেষ বলে রেখে দিলাম। কখন আসবে শুনতে ফোন দিয়েছিলাম।”
“তো কখন আসবে ইফরাদ ভাই?”
“হলুদ ছোয়ানো শুরু হওয়ার আগেই।”
“আচ্ছা। কিন্তু বিছানার উপর সব ছড়িয়ে রেখেছিস কেনো?”
“আমি তো শাড়ি পরতে জানিনা। কতো টা সময় লাগবে কে জানে! সেজন্য আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছি। হাতের কাছে যেনো সব পাওয়া যায় এজন্য।”
“আমি শাড়ি পরাতে জানি। চল তোকে রেডি করি আগে। এরপর আমি রেডি হবো।”
“ঠিক আছে বইনে।”
রাইমা হাসে শার্লিনের কথা বলার ধরণ দেখে। এই মেয়েটা আছে বলেই তার মন খারাপ হয়না। রাইমা ব্যস্ত হয়ে পরে শার্লিনকে সাজাতে৷ শাড়ি পরিয়ে চুল বেঁধে হালকা একটু মেকআপ করিয়ে দেয়। মেকআপ জিনিসটা তার পছন্দ না হলেও কোনো অনুষ্ঠান বাধলে বা ঠ্যাকা কাজ পারি দিতে একটু আকটু শিখেছিলো সে। যার দরুণ আজ সহজেই সাজাতে পারলো শার্লিনকে। শার্লিনকে সাজানো শেষে রাইমা মুগ্ধ হয়ে বলে,
“মাশাআল্লাহ আমার আত্মার সাথী। আপনাকে কি সুন্দর লাগছে।”
শার্লিন মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নেয়। মুখটা মুহুর্তে লাজরাঙা হয়ে উঠে। রাইমা শার্লিনকে লজ্জা পেতে দেখে হাসে। হেসে বলে,
“বাহ আমার আত্মা আবার লজ্জা পেতেও জানে।”
“তোর মতো বান্ধবী থাকা ভাগ্যের বিষয় জানিস! তোর আমার বন্ডিং টা আজীবন এমন অটুট থাকুক। তোর চোখে আমার জন্য মুগ্ধতা দেখতে পাই। কিছু বান্ধবী থাকে, যারা মুখে ভালোবাসা দেখায়, অন্তরে হিংসা প্রতিপালন করে। আমি হয়তো কিছু একটা ভালো কাজ করেছিলাম, যার দরুণ আমার রব আমায় তোকে পাইয়ে দিয়েছেন।”
“সেইম টু ইউ বান্ধবী। এবার আমায় শাড়ি পরতে একটু সাহায্য কর। বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু শাড়ির কুচি ধরবি।”
“ঠিক আছে বান্ধবী।”
রাইমা নিজেও চট করে শাড়িটা পরে নেয়। এরপর কিছু একটা মনে হতেই শার্লিনকে বলে,
“মাহাদ ভাইয়ের থেকে তার ফোন টা এনে দিতে পারবি?”
“মাহাদ ভাই কোথায় কি কাজে ব্যস্ত আমি তো জানিনা রাই।”
“বাসাতেই দেখ, পেলে আনিস। না পেলে থাক, চলে আসবি।”
“ওকে।”
শার্লিন বেরিয়ে পরে মাহাদকে খুজতে। সফলও হয়। মাহাদ ড্রইং রুমে সব আত্মীয় স্বজনকে সকালের খাবার খাওয়াতে হাতে হাতে সাহায্য করছিলো। শার্লিন গিয়ে একটু সাইডে ডাকে। মাহাদ আসতেই বলে,
“রাই আপনার ফোন টা চেয়েছে মাহাদ ভাই।”
৫১,
মাহাদ নিশব্দে হাসিমুখে পকেট থেকে ফোন বের করে দেয়। শার্লিন ফোন টা এনে রাইমার হাতে দেয়। রাইমা ফোন টা নিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট হাতড়াতে থাকে। শার্লিন বিছানার এক কোণায় বসে রাইমার কান্ড দেখছে। রাইমা কন্টাক্ট লিস্ট ঘেটে দিগন্তের নাম্বারে ফোন দেয়। দিগন্তের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে, অথচ দিগন্তের নাম্বার তার কাছে নেই! বিষয়টা হাস্যকর লাগছে রাইমার কাছে। কিন্তু কি করার! লোকটার সাথে ঝগড়া ছাড়া তো ভালো মন্দ দুটো কথাও সেভাবে হয়নি কখনও! নাম্বারটা নিবে কি করে? দিগন্তের নাম্বার খুজে পেতেই সে কল দেয় দিগন্তকে। দুটো রিং হতেই দিগন্ত কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে দিগন্তই আগে সালাম দেয়, দিয়ে বলে,
” হ্যাঁ মাহাদ ভাই বলুন!”
“আমি মাহাদ ভাই নই।”
দিগন্ত থমকে যায় ফোনের ওপরপাশে নারী কণ্ঠ শুনে। মেয়েটার গলার স্বর রাইমার মতো। সে কোনোমতে জিগাসা করে,
“রাইমা খন্দকার?”
“হ্যাঁ।”
“হঠাৎ আমার কাছে কল দিলেন! সেটাও মাহাদ ভাইয়ের নাম্বার দিয়ে!”
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।”
“বলুন, আমি শুনছি।”
“আচ্ছা, পরে লজ্জা দেবেন না ঠিক আছে!”
“ওকে, আপনি আমার সামনে নেই যে লজ্জা দিবো।”
রাইমা মৃদু হাসে। শার্লিন বুঝতে পারলো দিগন্তের সাথে কথা বলছে রাইমা। নতুবা মাহাদের ফোন দিয়ে আর কাছেই বা ফোন দিয়ে এসব বলবে? শার্লিন রাইমাকে স্পেস দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রাইমা শার্লিনকে বেরিয়ে যেতে দেখেও কিছু বললো না। রাইমা চুপ দেখে দিগন্ত বলে,
“কি হলো! চুপ যে?”
“আচ্ছা আপনি আমায় কি রকম সাজে পছন্দ করবেন?”
“আসলে আমি আপনাকে কোনো সাজেই পছন্দ করবো না।”
দিগন্ত নিজের হাসি চেপে উত্তর দেয়। মেয়েটার আসলেই মাথায় সমস্যা। নয়তো ফোন দিয়ে কেউ এই প্রশ্ন করে! রাইমার দিগন্তের উত্তরে মেজাজ খারাপ হয়। লোকটা আস্তো তিতা নিমপাতা৷ মুখে একটু ভালো কথা নেই। রাইমা নিজের মেজাজ শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,
“আপনার হবু বউ আমি, আর আমায় কোনো সাজেই পছন্দ করবেন না?”
“না করবোনা।”
“কথাটা না সায়ন্তিকার কথার মতো হয়ে গেলো।”
“সায়ন্তিকা কে?”
“এই আপনি কোন গ্রহে থাকেন? সায়ন্তিকাকে চিনেন না?”
“আমার জানামতে এই নামে আমার পরিচিত কেউ নেই যে চিনবো!”
“অবশ্য আপনার মতো মানুষ যে নিজেকে চিনেনা, সে মানুষকে কি করে চিনবে? সায়ন্তিকা ভারত বাংলা ছবির নায়িকা। ওর একটা ছবি আছে, পাওয়ার। সেই ছবিতে সায়ন্তিকাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসে পাত্র জিগাসা করেছিলো, যে পাত্রকে সায়ন্তিকা কোন সাজে পছন্দ করবে! সায়ন্তিকা উত্তর দিয়েছিলো, পাত্রকে সে পছন্দই করবেনা৷ আপনারও কি একই অবস্থা নাকি? আমায় পছন্দ না আপনার? আপার কথায় বিয়ে করছেন? এমন হলে আগেই বলে দেন। আমি আমায় পছন্দ না এমন লোককে বিয়েই করবোনা।”
রাইমা একদমে কথাগুলো বলে। দিগন্ত ফোনের এপাশে একদম থতমত খেয়ে যায়। তার মুখটা জাস্ট দেখার মতো হয়েছে। সে কি বললো, আর এই মেয়ে তার কথার কি মানে বের করে কতো ইতিহাস শুনিয়ে দিচ্ছে। রাইমা দিগন্তের উত্তর না পেয়ে ক্ষেপে বলে,
“কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?”
“ক্ষমা করেন ম্যাম। আমার ঘাট হয়েছে ওভাবে বলা। আপনাকে আমার এমনিতেই নরমাল যে রকম থাকেন, ওভাবেই পছন্দ। আমি কোনো মেয়েকে কখনও বলতে যাইনি, তারে এই সাজে, বা এরকম সাজলে সুন্দর লাগবো! এজন্য বলেছি কোনো সাজে পছন্দ করবো না। কিন্তু এটা বলিনি আপনাকে আমার পছন্দ হয়না। তবুও বলছি, শাড়ি কিনেছেন, সেটা পরুন, চুল ছেড়ে একপাশে ৩-৪টা তাজা গোলাপ গুজে দিন। একদম মেক আপ করবেন না। শুধু হালকা রঙের লিপ গ্লোজ লাগাবেন। লিপস্টিক আমার পছন্দ না। গলায় আর কানে ছোট্ট সিম্পল অর্নামেন্টস আর একহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, অন্য হাতে ঘড়ি। ব্যস, আমার অস’ভ্য হবু বউকে আমি এভাবেই দেখতে চাই। কোনো নারীকে বলিনি, এভাবে সাজতে, ওভাবে সাজতে। আপনাকে প্রথম বললাম। তাই এই সাজে পেত্নীর মতো লাগলেও আমার কিছু যায় আসেনা। আপনাকে এই সাজেই আমার কাছে মিষ্টিপরি লাগবে।”
দিগন্তও এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কল কেটে দেয়। রাইমার মনের মাঝে ভালো লাগার একটা শীতল বাতাস বয়ে যায়। আমার অস’ভ্য হবু বউ, শব্দটা কানে ঝনঝনিয়ে বাজছে যেনো। এই লোকটা এমন কেনো! এমনিতে কথা বলে না, কিন্তু যা বলে মনের মধ্যে গেঁথে যায়। ইশশশ, কি সব ভাবছি, লজ্জা লাগছে কেনো! রাইমা নিজের চিন্তাভাবনা দেখে নিজেই হেসে ফেলে।
চলবে?
।