অরুণিকা পর্ব -৪১+৪২

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪১||

৭১.
হাতে কাচের চুড়ি পরে এদিক-ওদিক হাঁটছে অরুণিকা। চুড়ির টুংটাং শব্দ পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। আহনাফ ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে আর আগামীকাল তাকে একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। এখন সে ল্যাপটপে বসে সেই প্রেজেন্টেশনের জন্য স্লাইড তৈরী করছে। কিন্তু অরুণিকার চুড়ির শব্দে তার মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সে ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কারো বিয়ে নেমেছে?”

অরুণিকা আহনাফের আজগুবি প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আহনাফ তার হাতের দিকে ইশারা করে বলল,
“এসব কি শুরু করেছো? এতো রাতে সঙ সেজে বসে আছো কেন?”

অরুণিকা তার হাত ঝাঁকিয়ে তার চুড়িগুলোতে গুঞ্জন তুলে বলল,
“সঙ আবার কি?”

“জোকার!”

অরুণিকা কপালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“হায় আল্লাহ! এই ছেলে বলে কি? জোকররা কি চুড়ি পরে নাকি? চুড়ি তো মেয়েরা পরে। তুমি জোকারও চেনো না? জোকার হচ্ছে যার নাকে….”

আহনাফ অরুণিকাকে থামিয়ে বলল,
“হয়েছে হয়েছে। আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না। এখন চুড়িগুলো খুলে রাখো।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার চুড়ির শব্দ হলো। অরুণিকা চুড়ি পরেই টেবিলের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোমাকে চুড়িগুলো খুলতে বলেছিলাম না?”

অরুণিকা এবার কোমরে হাত রেখে বলল,
“আমার হাত। আমার চুড়ি। তুমি খুলতে বলার কে?”

“তোমার হাত তোমার চুড়ি, কিন্তু এটা আমার রুম।”

“তো!”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“রুম থেকে বের হও, যাও।”

“কোথায় যাবো? ড্রয়িংরুমে ইভান পড়ছে। রকস্টারের রুমে তাহমিদ আর আরাফ। আমার রুমে ইমন আর রকস্টার। আর এই রুমে তুমি একা।”

“আমি একা তাই তুমি আমাকে বিরক্ত করতে এসেছো?”

“আরেহ না না। সব রুমে দুইজন করে আছে। এই রুমে একজন হলে তো আর সমান হয় না। স্কুলে মাস্টারমশাই পড়িয়েছেন, সমান সমান সুযোগ সবাইকে দেওয়া উচিত। তাই আমি এই রুমে বসে সুযোগ দিচ্ছি।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কাকে সুযোগ দিচ্ছো, শুনি?”

“এই রুমকে। এখন এই রুমে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতা হবে।”

“তুমি ইভানের পাশে বসে এই সমতা করে নাও।”

অরুণিকা চাপা কন্ঠে বলল,
“ওর ভয়ে আমি তো শ্বাস ত্যাগ করতেই ভুলে যাই। তখন তো সমতা হবে না। বুঝো নি তুমি?”

“আল্লাহর ওয়াস্তে চুড়িগুলো খুলে চুপচাপ যা করার করো। তোমার এসব উদ্ভট লেকচার শুনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

অরুণিকা এবার আহনাফের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করেই চুড়িগুলো ঝাঁকাতে লাগলো। আহনাফ বসা থেকে উঠতেই সে পালাতে যাবে আহনাফ তাকে খপ করে ধরে ফেললো। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা, আর শব্দ হবে না।”

আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই জোর করে চুড়িগুলো খুলে তার আলমারিতে তুলে রাখলো। অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে বলল,
“আমার চুড়িগুলো দাও না, প্লিজ। আমি আর শব্দ করবো না।”

“একদম কালই এই চুড়িগুলো পাবে।”

অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সে রুমে এসে দেখলো তূর্য আর ইমন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছে। সে আস্তে করে তার ড্রয়ার খুলে চুড়ির আরেকটা বক্স বের করে সেগুলো পরে নিলো। আর আহনাফের রুমে চলে এলো। রুমে এসে এবারও সে ইচ্ছে করেই চুড়িগুলো ঝাঁকাতে লাগলো। আহনাফ হাত মুঠো করে রাগী দৃষ্টিতে ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা ভাব নিয়ে বলল,
“আমার চুড়িগুলো দাও, তারপর আমি এগুলো খুলে ফেলবো”

“তুমি কিন্তু মারাত্মক বেয়াদবি করছো।”

অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমার চুড়ি দাও আগে।”

আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে অরুণিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“চুড়ি তো এতোক্ষণ আলমারিতে ছিল। এখন দেখো, তোমার এই চুড়িগুলোর স্থান কোথায় হয়!”

আহনাফ এবারও অরুণিকাকে শক্ত করে চেপে ধরে তার হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে নিলো। আর অরুণিকার রুমে গিয়ে তার ড্রয়ার আর আলমারিতে থাকা সব চুড়ি বের করে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। অরুণিকা তার চুড়িগুলো নেওয়ার জন্য আহনাফের পিছে পিছে ঘুরছে। আহনাফ হুট করে রুমের জানালা খুলে চুড়িগুলো সব জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অরুণিকা হতভম্ব হয়ে গেছে। আহনাফ এমন কিছু করবে সে কল্পনাও করে নি। অরুণিকা জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। সে এবার রাগী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালো। তারপর আরাফের কাছে গেলো।

আরাফ অরুণিকাকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, অরু? এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন?”

অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আহনাফ আমার সব চুড়ি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে।”

অরুণিকার কথা শুনে তাহমিদ আর আরাফ তার দিকে তাকালো। আরাফ অরুণিকার অভিযোগ শুনে আহনাফের কাছে আসতেই আহনাফ নিজের যুক্তি দেখিয়ে বলল,
“ওর শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। এখন আর ভুলেও কখনো আমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।”

আরাফ এরপর অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, আমি তোমার জন্য আরো চুড়ি এনে দেবো।”

অরুণিকা পা ধাপিয়ে কাঁদতে লাগলো, আর বলল,
“না, আমার ওই চুড়িগুলোই লাগবে।”

আরাফ আর তাহমিদ কোনোভাবে তাকে বুঝিয়ে অন্য দিকে মনোযোগ ফেরালো। তবে অরুণিকাও চুপ করে বসে থাকার মতো নয়৷ সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে আহনাফকেও শাস্তি দেবে৷

সকালে আহনাফ কলেজে যাওয়ার জন্য তার ড্রয়ার খুলে দেখলো, সেখানে তার হাত ঘড়িটা নেই৷ আশেপাশে খুঁজে যখন পেলো না, তখন সে আলমারি খুললো। আহনাফকে অনেকক্ষণ ধরে আলমারিতে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে তাহমিদ বলল,
“কলেজে যাবি না? আলমারিতে কি খুঁজছিস?”

“অদ্ভুত তো! আমার একটা ঘড়িও খুঁজে পাচ্ছি না।”

হঠাৎ তার টনক নড়লো। সে জোরে পা চালিয়ে অরুণিকার কাছে গেলো। গিয়ে দেখলো অরুণিকা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে দুই পা উপরে তুলে গালে হাত দিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফকে দেখে সে তাড়াতাড়ি উঠে পা দুইটা দুই পাশে মেলে বসলো, আর বলল,
“আসো, আসো তোমার অপেক্ষায় অরুণিকা চৌধুরী তার দুয়ার খুলে বসে আছে।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি দিন দিন খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো। এখন বলো, আমার ঘড়িগুলো কোথায়?”

“আছে একটা জায়গায়। কিন্তু উত্তর পাবে এক ঘন্টা পর। যদি এখন উত্তরের অপেক্ষায় বসে থাকো, তাহলে তোমার পরীক্ষার বারোটা বেজে যাবে।”

আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গেলো। এরপর বিকেলে আহনাফ বাসায় আসার পর অরুণিকা বলল,
“তোমার ঘড়ি কোথায় জানতে চাও?

“হ্যাঁ, কোথায়!”

অরুণিকা ডাস্টবিনের দিকে ইশারা করতেই আহনাফ দৌঁড়ে সেদিকে গেলো। গিয়ে দেখলো ডাস্টবিন খালি। আহনাফ বলল,
“কোথায়?”

অরুণিকা খালি ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওপস! রকস্টার তো কিছুক্ষণ আগেই ময়লাগুলো ফেলে এসেছিল। ইশ, তাহলে তোমার ঘড়িগুলো সব সামনের বড় ময়লার ঝুড়িতে চলে গেছে।”

আহনাফ নিচে নেমে একটা কাঠি দিয়ে ময়লাগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো ঘড়িগুলো সেখানেই আছে। আহনাফের দামি ঘড়ির পরার শখ৷ সব’কটাই তার শখের ঘড়ি, আর ঘড়িগুলোর দামও অনেক বেশি। তাই সে বাধ্য হয়েই একটা ছেলেকে ডেকে এনে ঘড়িগুলো সব ডাস্টবিন থেকে তুলে আনলো। বাসায় আসার পর অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“অরুণিকার সাথে পাঙ্গা নিলে গঙ্গায় পড়বে। বুঝেছ?”

(আজকের পর্ব ছোট হয়েছে। আগামী পর্ব বড় করে দেবো। আজকে আর কাউকে কাঁদালাম না।)

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২||

৭২.
“আমার তাহমিদের জন্য খুব চিন্তা হয়। সাধ্যের মধ্যে থাকলে আমি ওকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। ও শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল।”

রহমতুল্লাহ চুপচাপ বসে মুরশিদ জুবাইয়েরের কথা শুনছেন। তিনি আবার বললেন,
“কেউ তাদের মারতে চায়। আর আমি নিরুপায়। ওরা বাংলাদেশে না ফিরলেই ওদের জন্য ভালো হবে।”

রহমতুল্লাহ মনে মনে বললেন,
“এটা সম্ভব না মুরশিদ সাহেব। ওদের আসতেই হবে। আর ওরা আসবেই।”

মুরশিদ জুবাইয়ের আবার বললেন,
“রহমত সাহেব, ওরা জানে না এতো বছর আমিই ওদের খরচ দিয়েছিলাম। বাকিরা আমার জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু তাহমিদ আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর ওর জন্যই ওর বন্ধুদের দায়িত্ব নিয়েছিলাম৷ খুব ইচ্ছে করে ছেলেটার সাথে গিয়ে দেখা করি। আমার মামাটাকে জড়িয়ে ধরি। ও তো আমার মরিয়মের শেষ চিহ্ন। আমি তো আমার মরিয়মকে বাঁচাতে পারি নি। আমার বোনটার অভিমান ভাঙাতে পারি নি।”

মুরশিদ জুবাইয়ের আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তার চোখের জল ভারী হয়ে আসছে। রহমতুল্লাহ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“আপনি জানেন ওদের জীবন সংকটে আছে। এর মধ্যে দেখা করলে, সবাই জেনে যাবে ওরা বেঁচে আছে। ওদের বাকি জীবন লুকিয়ে কাটাতে হবে। আর পুরোনো পরিচয় ভুলে যাওয়ায় ভালো।”

“হ্যাঁ। ওরা বিয়ে করুক, সংসারী হোক। ওরা তো ওদের জন্যই যথেষ্ট।”

রহমতুল্লাহ বললেন,
“মুরশিদ সাহেব, আপনি শুধু ওদের সাথে যোগাযোগ না করলেই চলবে। বাকি সব আমি দেখছি।”

“আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, রহমত সাহেব।”

“আরেকটা কথা, আপনি তো জানেন মির্জা গ্রুপ কতোটা ক্ষতিকর আমাদের জন্য। ওদের সাথে আঁতাত না রাখায় ভালো।”

“জানি, কিন্তু এই মুহূর্তে শত্রুদের হাতে রাখায় ভালো। সেই রাতের খুনের সাথে যে মির্জা গ্রুপ জড়িত ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আদালত প্রমাণ চাইবে। আর আমি প্রমাণটাই নিতে চাই।”

“জ্বি, মুরশিদ সাহেব। তাই তো চুপচাপ সেই মির্জা গ্রুপের সব ছলচাতুরী সহ্য করে যাচ্ছি। শাহেদ মির্জা মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তো তার লোকেদের খবরদারি কমছে না। তাদের এখন দ্বিগুণ শক্তি।”

রহমতুল্লাহ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,
“আজ তাহলে আসি।”

মুরশিদ জুবাইয়েরের গার্ড তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে গেলো। রহমতুল্লাহ গাড়িতে উঠেই একটা অপরিচিত নম্বরে কল দিয়ে বললেন,
“জনাব, ফোন দিয়েছিলেন!”

ওপাশ থেকে মোটাস্বর ভেসে এলো।

“কাজ কতোদূর?”

“জনাব প্রাথমিক ধাপ শেষ। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি। এবার আপনার কাজ শুরু করুন। ওরা খুব শীঘ্রই দেশে ফিরবে। মুরশিদ সাহেবের নাকের নিচ দিয়ে ওরা আসবে, আর তান্ডব করবে। আর তিনি কিছুই টের পাবেন না।”

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। এরপর হাসি থামিয়ে অপরিচিত কন্ঠস্বর বলল,
“আমেরিকার হাওয়া আজ খুব মিষ্টি। ভালো খবর শুনিয়ে মন ঠান্ডা করে দিয়েছেন। তারা একবার আসুক। এরপর মৈত্রী গ্রুপের ইমন মাহবুব হবে চিফ অব ইন্ডাস্ট্রি৷ আর আমাদের ছোট্ট সোনামণি অরুণিকার জীবনে আসবে চমৎকার সেই দিন।”

“কিন্তু জনাব, ওর আঠারো হতে অনেক দেরী!”

“সমস্যা নেই। সার্টিফিকেটে বয়স বাড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু না৷ ওর জন্য পাত্র প্রস্তুত৷ শুধু ওর বডিগার্ডগুলো থেকে ওকে দূরে সরাতে পারলেই আমাদের দ্বিতীয় ধাপ শেষ হবে।”

“জনাব, এটা খুবই কঠিন কাজ।”

“হুহ, আমার ডিকশনারিতে কঠিন শব্দটি নেই। আমার যেকোনো মূল্যে সেই অরুণিকাকে চাই-ই চাই। ইমন আর অরুণিকায় আমাদের মূল চাবি, বাকিরা শুধু এই চাবি দু’টোকে ঘুরাবে।”

এদিকে সাহিল মির্জা নিজের অফিসের রকিং চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে। তার মুখোমুখি বসে আছে রাহি। তার পাশেই এক কোণে দাঁত কিড়মিড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সানায়া। সাহিল বসা থেকে উঠে রাহির সামনে এসে বসলো। তারপর রাহির হাত দু’টি নিজের হাতে আবদ্ধ করে সেই হাতে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। রাহি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“সাহিল, এখন তোমার কাছে আমার চেয়ে বেশি এই চেয়ার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।”

সাহিল শান্ত কন্ঠে বললো,
“না, রাহি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি৷ কিন্তু এই চেয়ার, এই পদ আমার কাছে অনেক প্রিয়৷ তুমি কি নিজের ভালোবাসার মানুষকে তার প্রিয় জিনিস থেকে দূরে সরাতে চাও?”

সানায়া চেঁচিয়ে বলল,
“তোমাদের রোমান্টিক কথা শুনার জন্য আমি এখানে আসি নি৷ ভাই, আমি শুধু একটা কথায় বলবো। তুমি রাহিকে মুক্তি দাও৷ তোমার জন্য ও শান্তিতে কোথাও যেতে পারছে না।”

সাহিল রাহির গালে দুই হাত রেখে বলল,
“আমার দিকে তাকাও রাহি, আমি কি তোমাকে শান্তি দিচ্ছি না? তুমি কেন বুঝো না, এসব আমি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য করছি। আজ আমি পরিশ্রম করবো, কাল তুমি দেশের টপ রিচ উইমেন হিসেবে পরিচিতি পাবে।”

রাহি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি ধনী হতে চাই না। আমার সাধারণ জীবন লাগবে। একজন সুস্থ স্বামী লাগবে।”

“আমি কি অসুস্থ?”

“হ্যাঁ, সাহিল। আজও তোমার উপর হামলা হয়েছে। কালও হতে পারে। একদিন আমাদের বাচ্চাদের উপর হামলা হবে। মৈত্রী গ্রুপকে তো সবাই চেনে। আট-নয় বছর আগে তারা পুরো পরিবার এক রাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, এমন আমাদের সাথেও তো হতে পারে।”

সাহিল তার টাই ঢিলা করে, বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো৷ তা দেখে সানায়া বলল,
“ভাইয়া, আমি যদি কখনো প্রমাণ পাই, বাবা এই খুনের সাথে জড়িত ছিল, এই প্রমিজ আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো।”

সাহিল পানি খেয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“কোথায় যাবি?”

“যেখানে ইচ্ছে যাবো।”

“একবার মির্জা গ্রুপের নজরে কেউ পড়লে, তাদের মুক্তি হয় না। তা হোক শত্রু, বা আপন কেউ৷ রাহি, সুইটহার্ট, তুমি চাইলেও আমাকে এই চেয়ার থেকে উঠাতে পারবে না, আর আমার হাত থেকেও মুক্তি পাবে না। আমি আমার প্রিয় জিনিস কাউকে দেই না। হাতছাড়াও করি না। তাই তুমি আমার এই পরিচয়টাই মেনে নাও।”

ইদানিং তূর্য আর উপমার কথাবার্তা যেন বহুদূর পৌঁছে গেছে। রাত-দিন মেসেজে তারা বাক্য বিনিময় করে যাচ্ছে। উপমা যেন রিকির মাঝেই ডুবে গেছে। রিকির সাথে কি কি কথা হয়েছে সে তার বান্ধবীদের সবটাই জানায়। তারা রীতিমতো উপমাকে মিথ্যুক গল্পবাজ হিসেবেই জানে। অথচ উপমার ভালোবাসার গল্পটা ভার্চুয়াল জগতের সবচেয়ে সত্য আর মিষ্টি গল্প। প্রতিদিন সে ফোন হাতে নিয়ে রিকির মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। আর রিকি ইচ্ছে করলে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে, আর ইচ্ছে না করলে, অনলাইনেই আসে না। রিকির সময় দেওয়া, তাকে গান শুনানো, তার জন্য রাত ২টাই গিটার বাজানো, ছাদে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত অডিও কলে কথা বলা, উপমার ছবিতে কাব্যিক মন্তব্য করা এসব একজন মেয়ের কাছে ভালোবাসার একটা সম্পূর্ণ উদাহরণ। এখানে শুধু বাকি আছে ‘ভালোবাসি’ বলাটাই। তাই উপমা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে রিকি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে, যেমনটা সে তার রিকিকে ভালোবাসে। তবে এবার উপমার আবদার একটু ভিন্ন হলো, সে এখন রিকিকে দেখতে চায়। এই আবদার পূর্ণ হলেই আরো প্রমাণ হবে উপমা বাকি সব ভক্তদের থেকে আলাদা। তবে এই আবদার রিকি মেনেও নিয়েছে। সে উপমাকে বলল,
“আমি দুই মাস পর বাংলাদেশ আসবো। তখনই তোমার-আমার দেখা হবে।”

উপমা এই মেসেজ দেখেই পুরো বাড়ি মাথায় তুললো। আদিল বোনের পাগলামো দেখে মনে মনে খুশি হলো। বোন যে তার রিকি নামের ছেলেটার সাথে প্রেম করছে, তা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। সে ভাবলো, রিকি দেশে আসলে সে নিজেই উপমার সাথে যাবে। রিকির খোঁজখবরও নিয়ে আসবে। এরপর পরিবার ভালো মনে হলে বাবা-মাকে বুঝিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

এদিকে ইমন, তাহমিদ, আহনাফ আর তূর্যের পরীক্ষা শেষ৷ তারা দুই মাস পর দেশে ফিরবে। এরই মধ্যে আরাফ অরুণিকাকে নতুন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। নিজেরাও জিনিসপত্র বিক্রি করে দেওয়া শুরু করেছে। আরাফ আর ইভান অরুণিকাকে নিয়ে আগামী মাসে এক রুমের একটা বাসায় উঠবে। তাদের দু’জনের পঞ্চম বর্ষ শেষ হলেই তারা দেশে ফিরতে পারবে।

এদিকে আজ মাস্টারমশাই তাদের বাড়িতে এলেন৷ মাস্টারমশাইকে দেখে তাহমিদ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। তার এক হাতে একটা দইয়ের হাড়ি, অন্য হাতে একটা ব্যাগ। তিনি হাড়িটা অরুণিকার হাতে দিয়ে বললেন,
“একটা ভারী খুশির খবর নিয়ে এসেছি।”

ইভান চেয়ার এগিয়ে দিতেই তিনি বসলেন। অরুণিকা রান্নাঘরে হাড়ি রেখে দৌঁড়ে এসে বলল,
“আমি শুনবো। কি খবর?”

“তোমার দিদিমণির বিয়ের খবর দিতে এসেছি। পরশু সন্ধ্যায় হলুদ-সঙ্গীত, আর এর পরের দিন বিয়ে। তোমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। আসবে কিন্তু। এই নাও বিয়ের কার্ড।”

মাস্টার মশাই ব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করে অরুণিকার হাতে দিলেন। অরুণিকা সেটা নিয়ে খুলে দেখলো কার্ডে লেখা শতাব্দী সেন আর বিরাজ কুমারের শুভ বিবাহের নিমন্ত্রণ।

মাস্টার মশাই চলে যাওয়ার পর অরুণিকা কার্ডটা তাহমিদের হাতে দিয়ে বলল,
“ভেবেছি, তুমি আমার দাদা হবে। আর শতু আপু আমার ভাবী। এখন তো কচু হয়েছো। তোমার সাথে কোনো কথা নেই। তুমি শতু আপুকে বিয়ে করছো না কেন?”

আরাফ উঁচু গলায় বলল, “অরু, তুমি রুমে যাও।”

আরাফের কথার অমান্য সে কখনোই করে নি। তাই বাধ্য হয়েই অরুণিকা রুমে চলে গেলো৷ তাহমিদকে কেউ কিছু বলতে যাবে তখনই সে বলল,
“আমাদের বিয়ের জন্য কেনাকাটা করা উচিত। সে আমাদের খুব কাছের বন্ধু। ওর বিয়েতে ভালো একটা উপহার দিতে হবে।”

কথাটা বলেই তাহমিদ রুমে চলে গেল। ইমন তার পিছু যেতেই ইভান বলল,
“ওকে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিস না, ইমন। যা হচ্ছে হতে দে। এমনিতেই এই সম্পর্ক মেনে নেওয়ার মতো না। শতাব্দী অন্য ধর্মের। ও মুসলিম হলে কোনো সমস্যায় ছিল না। ইনফেক্ট শতাব্দীই আমাদের অরুণিকার সবচেয়ে কাছের মেয়ে বান্ধবী। এমনকি ও মাওশিয়াতের চেয়ে বেশি দায়িত্ববান। কিন্তু শুধু এসব দেখেই একটা সম্পর্ক হয় না৷ আর ডাল-পালা ঠিক না থাকলে, একদিন এর শেষ হবেই।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here