ফিলোফোবিয়া পর্ব -২৮

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

২৮.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

আজ গায়ে হলুদ। ভোর পাঁচটায় বাড়ি ফিরেছে প্রিয়। আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে বাড়ি। চারিদিকে চাপা গুঞ্জন। বিয়েতে মেয়ের মত আছে কি? আমেনা বেগম সকাল থেকে মেয়ের সাফাই গাইতে ব্যস্ত।
গ্রাম থেকে জাফর সাহেবের ভাইবোনদের পুরো পরিবার এসেছে। আশেপাশের বন্ধুবান্ধব পাড়াপ্রতিবেশি সবাই আমন্ত্রীত। মেয়েদের বিয়েতে ঘটা করে আয়োজন করছেন। বরের বাড়িতে তেমন কোন আয়োজন নেই এখন। ছেলের বাবা মা সহ দশ পনের জন আত্মীয় এসে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাবেন। পরে আস্তেধীরে অনুষ্ঠান করবে।
বেলা দশটায় ঘুম ভাঙ্গল প্রিয়’র। চেয়ারে এক পা তুলে বেশ আয়েশ করে রুটি ছিঁড়ে খাচ্ছিলো। হ্ঠাৎ-ই সামনে এসে দাঁড়াল প্রভা। কোমরের দুপাশে হাত রেখে বলল,
‘ এখন খাচ্ছিস? ওইদিকে মেক-আপ আর্টিস্ট এসে অপেক্ষা করছে। দশটায় এপয়েন্টমেন্ট ছিল আমাদের।’
প্রিয়’র বেশ স্বাভাবিক খাপছাড়া আওয়াজ,
‘ ওহ আচ্ছা। জানতাম না তো আমি!’
বিরক্ত হলো প্রভা। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ নাম্বার বন্ধ থাকলে কি করে জানাবো? দেখ আপা, এমনিতেই বাড়িতে তোর ট্যুরে যাওয়া নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলছে। মা সকাল থেকে সেইসব সামলাচ্ছে। এখন নতুন কোন সিনক্রিয়েট করিস না প্লিজ!’
প্রভা খানিকক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করল। প্রিয়’র কোনোরূপ হেলদোল না দেখে ক্ষি*প্ত পায়ে চলে গেল।

রাত তিনটা পর্যন্ত বাড়ির ছাদে হলুদের অনুষ্ঠান হলো। পুরোটা সময় প্রিয় মূর্তির মত বসেছিল। আশেপাশে যা ঘটছে কোনকিছুতে কোন প্রকার হেলদোল নেই তার। সবকিছু অসহ্য লাগলেও বাবা মায়ের মুখের দিক তাকিয়ে চুপচাপ মেনে নিচ্ছে। মেক-আপ উঠিয়ে ফ্রেশ হয়ে যেই বিছানায় ঘুমাতে যাবে অমনি কলিং বেল বাজলো। সবাই মাত্রই যার যার ঘরে বিশ্রাম নিতে গেছে। এমন সময় কে এলো? বিরক্ত হলো প্রিয়। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলতেই হতভম্ব। দারোয়ান চাচা এসেছে। বড়সড় একটা লাল গোলাপের বুকে হাতে। বিহ্বল প্রিয়। বুকের মাঝে ছোট একটা চিরকুট। ভাঁজ ভাঙ্গতেই দেখল,
‘ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার জন্য একগুচ্ছ গোলাপ’

প্রচন্ড রাগ হলো প্রিয়’র।বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কে পাঠিয়েছে চাচা?’
‘ একটা ছেলে। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিচে।’
‘ এখনো আছে?’
‘ হ আম্মা।’
দ্রুত পা চালিয়ে কয়েক সিড়ি নিচে নামল প্রিয়। আচমকা কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। দারোয়ান চাচা জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হইলো থাইমা গেলা কেন! যাইবা না ?’
‘ না চাচা। তাকে দেখার ইচ্ছা নাই আমার।’
গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল প্রিয়। পিছন ঘুরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠল। ভিতরে ঢুকার আগে ফুলের বুকেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। ঘরে এসে জানালার পাশে দাঁড়াল। দূর রাস্তা একটা গাড়ি দাঁড়ানো। অন্ধকারে একজন পুরুষালি আভা। এদিকটাই তাকিয়ে আছে যেন লোকটা।

কোনার ঘরটায় বউ সাজচ্ছে। সেদিকে যাওয়া নিষেধ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পা নাচাচ্ছে প্রভা। চোখমুখ জুড়ে চাপা উত্তেজনা। এই দিনটারই তো অপেক্ষা ছিল তার। অবশেষে তার স্বপ্ন পূর্নতা পাচ্ছে। অনেক যুদ্ধের পর ভালোবাসার মানুষটার হতে যাচ্ছে। একদম টিপটপ পার্ফেক্ট দেখতে লাগে যেন তাকে। মেক-আপ আর্টিস্টদের এটা কম, ওইটা বেশি হয়েছে বলে বেশ বিরক্ত করছে। আচমকা প্রিয়’র দিক চোখ যেতেই চেঁচিয়ে উঠল প্রভা। বাজখাঁই আওয়াজে বলল,
‘ বিয়েতে এমন লাইট মেক-আপ কে করে আপা? তুই কি গেস্ট? তুই হচ্ছে বউ। সবার আকর্ষণ থাকবে তোকে ঘিরে। তুই করবি গ্ল্যামারাস হ্যাভি মেক-আপ।’
মেক-আপ আর্টিস্ট মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল প্রভা,
‘ ভেস মেক-আপটা আরেকটু হ্যাভি করেন তো আপু।’
প্রিয় বাঁধা দিলো। গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘ কেন লাইট মেক-আপ করলে কি তোর ভাসুর আমাকে বিয়ে করবে না? তোর সার্কাস সাজার ইচ্ছা, তুই সাজ। আমাকে প্যাচাবি না একদম।’
প্রভা চুপসে গেল। মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

ভারী লেহেঙ্গা পড়ে মুখ ভার করে স্টেজে বসে আছে প্রিয়। চোখমুখে গম্ভীর অন্ধকার। দুইরাত ধরে ঘুম হচ্ছেনা। মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে এখনো। অন্যদিকে প্রভা বেশ হাসিখুশি প্রাণবন্ত। বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে ব্যস্ত। দাওয়াতের লোকজন কমেছে। বরযাত্রা চলে আসবে। একটু আগে জাফর সাহেব ফোন করেছে। বলেছে, রাস্তায় আছে।দশ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। জানুয়ারির শুরু। শীতের দাপট এখনো প্রচন্ড। এই শীতেও ঘামছে জাফর সাহেব। কাজের ফাঁকে বারবার প্রিয়’র দিক চাইছে। খানিক বাদে যা ঘটতে পারে তা আশংকা করেই ভয়ে কেঁপে উঠছে। ইতোমধ্যে অনেকই তা লক্ষ করেছে। বেশ কয়েকজন জিজ্ঞেসা ও করেছে। বিয়ে বাড়ির ঝামেলার সামান্য ছুতো দিয়ে এড়িয়ে গেছেন তিনি।
বাহির থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ বলে বাচ্চারা হুরাহুরি করছে। বরের বাড়ির লোকেদের স্বাগতম করতে এগিয়ে গেলেন জাফর সাহেব।

বর এসেছে। বাহিরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন চলছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে প্রিয় প্রভাকে স্টেজে নেওয়ার হবে। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে প্রভা। উশখুশ করছে মন। আরমানকে দেখতে কেমন লাগছে? রাজপুত্রের মত কি! স্টেজের দিক উঁকিঝুঁকি করছে বারবার। প্রভার এমন কান্ড দেখে বিরক্ত হলো প্রিয়। খানিক চেঁচিয়ে বলল,
‘ লাজলজ্জা আছে? নাকি বেচে দিয়েছিস সব! কেউ দেখলে কি বলবে প্রভা।’
প্রভার খাপছাড়া আওয়াজ,
‘ যা বলার বলবে। তাতে কি! অনেক যুদ্ধ করে তাকে পেতে যাচ্ছি। রূপকথা মনে হচ্ছে সব। আচ্ছা আপা, রূপকথার ভালোবাসাও কি এমন সুন্দর হয়?’
উদাস হাসলো প্রিয়। মলিন কন্ঠে বলল,
‘ উহু, বড্ড বা*জে জ*ঘন্য হয়। ভালোবাসা অনুভূতিটাই জ*ঘন্য ইলোজিকাল ব্যাপার স্যাপার।’
প্রভার হাসিহাসি মুখটা চুপসে গেল। প্রিয়’র কাছে এমন প্রশ্ন করা, একদম উচিত হয়নি তার। প্রবল উত্তেজনার তাড়নায় কিভাবে জানো করে ফেলল হ্ঠাৎ!

কাজি এসেছে। বউদের স্টেজে ডাকছে। বিয়ে পড়ানো হবে এখন। তিন চারজন মেয়ে এসে নিয়ে গেল তাদের। লজ্জায় গদগদ করছে প্রভা। অন্যদিকে প্রিয়’র চোখমুখ অন্ধকার এখনো। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। জোড়ালো ভয় চেপেছে মনে। ধুকপুক করছে বুক।
প্রথমে স্টেজে বসানো হলো প্রভাকে। দুইজন জন মেয়ে এসে নিয়ে গেল প্রিয়কে। কারো পাশে বসানো হলো তাকে। তখনো প্রিয়’র চোখজোড়া ঝুঁকে আছে অস্বস্তিতে। হাত জোড়া উশখুশ করছে।
‘ কি হয়েছে? খারাপ লাগছে!’
আচমকা কানের কাছে অতিপরিচিত ফিসফিস আওয়াজ বাজলো। ভড়কে উঠল প্রিয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টি তুলে পাশের মানুষটার দিক তাকালো। মুহূর্তেই হাতপা কাঁপতে শুরু করল। এতবছর পর এই লোকটা আবার! কেন!
ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথা। কিছু ভাবতে পারছে না। বুঝতে পারছেনা। কি করবে? কি হচ্ছে! ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে মাথা। বুজে আসছে চোখ। আচমকাই নেতিয়ে পড়ল প্রিয়। পাশের মানুষটার উপর ঢুলে পড়ল।

ঘর জুড়ে চাপা গুঞ্জন। কানাঘুষা করছে আশেপাশের লোকজন।সোফায় শুয়িয়ে রেখেছে প্রিয়কে। পাশে বসেই বাতাস করছে আমেনা বেগম। চোখেমুখে চিন্তা ভয়ের ছাপ। মেয়েটার কিছু হলো না তো আবার?
প্রিয়’র পায়ের কাছে বসে পায়ের পাতা মালিশ করে দিচ্ছে প্রভা। দূরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। চিন্তায় মুখে হাত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। শেষ অবধি তাদের বিয়েটা হবে তো?
বিয়ের পাগড়িটা নিচে পড়ে।অস্থির ক্ষি*প্ত পায়ে ঘর জুড়ে পায়চারি করছে শতাব্দ। ভীষণ এলোমেলো লাগছে। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ডরকম নার্ভাসনেস কাজ করছে। চিন্তা, ভয়ে প্রিয়’র পাশে এসে দাঁড়াতে পারছেনা সে। না তাকে ছোঁয়ার সাহস করতে পারছে। আনন প্রিয়’র চেকআপ করে উঠে দাঁড়াতেই। ছুটে এলো এলো শতাব্দ। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে? সবঠিক?’
শতাব্দের কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করল আনন।?
‘ শান্ত হ, তুই একজন ডাক্তার। অল্পতেই এভাবে অস্থির হলে চলবে না’
আননের সান্ত্বনা সূচক কথাবার্তা শোনার মত মানসিকতা নেই এখন। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল আবার,
‘ ঠিক আছে প্রিয়?’
‘ তেমন কিছু না। প্রেসার লো। ঘুম খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে হয়তো। একটু পরই জ্ঞান ফিরবে।’
জাফর সাহেব শক্ত পাথর বনে দাঁড়িয়ে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো এতক্ষণ। জ্ঞান ফিরলে রিয়েকশন কি হবে প্রিয়’র! মাথা কাজ করছেনা তার।

ঘন্টা খানেক বাদে প্রিয়’র জ্ঞান ফিরল। লোকজন চলে গেছে ততক্ষণে। পিটপিট চোখজোড়া মেলে আশেপাশে তাকালো প্রিয়। তাকে ঘিরে চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজন। প্রথমে কিছু না বুঝতে পারলেও। আস্তে আস্তে সব স্পষ্ট হলো। চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। চারদিকে চোখ বুলালো। আ*তঙ্কিত চোখমুখ। সমুদ্রের সাথে প্রভার বিয়ে? কি করে সম্ভব এসব।
দরজার কাছে শতাব্দকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘৃ*ণায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। ঘৃ*না রাগে শরীর কাঁপছে থরথর। ভারী-ভারী নিশ্বাস ফেলছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। মাথার ওড়নাটা টেনে খুলে নিচে ছুঁড়ে ফেলল। বাবার দিক মাথা তুলে তাকালো। র*ক্তিম চোখ। সারা মুখ অশ্রুতে ভিজে। ভীষণ অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। ঘৃ*ণা মিশ্রিত কাঁপাকাঁপি কন্ঠে বলল,
‘ এই বিয়ে আমি করবোনা। এই লোকটাকে এখান থেকে চলে যেতে বলো আব্বা।’

চলবে……….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন )

সবার প্রশ্ন গল্প কিভাবে আগাবে? গল্পের মেইন থিম শুরু হবে দ্বিতীয় খন্ড থেকে। প্রথম খন্ডে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি। অনেক রহস্য উন্মোচন বাকি। আমি আবারো বলছি প্রথম খন্ডের প্রিয় আর দ্বিতীয় খন্ডের প্রিয় আকাশ পাতাল তফাত।

টাইপোগ্রাফি: Maksuda Ratna আপু🌺❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here