#মন_বিনিময়
#পর্বঃ১৩
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
ঘুমের মাঝে বাহুতে টান পড়ায় বেশ বিরক্ত হয় রাহিতা। তবুও চোখ খুলেনা সে। বন্ধ হয়ে থাকা চোখমুখ কুচকে দু-একবার “উহু” বলে পুনরায় ঘুমের সাগরে তলিয়ে যায়। ওর এমন ভাবলেশহীনভাবে ঘুমোনো দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় স্বপ্নিল। বেশিক্ষণ তো হয়নি ওর ঘুমোনোর, ঘণ্টাখানেক হবে হয়তো। তাতেই এই অবস্থা! কিন্তু রাহিতার হাতের দিক তাকিয়েই তার ধৈর্যের বাধ শেষ, না একে আর ঘুমোতে দেওয়া যাবেনা। না উঠলে টেনেই তুলতে হবে! যা ভাবা সে কাজ, আর কোনোকিছু না ভেবেই রাহিতাকে একপ্রকার জোর করেই শোয়া থেকে উঠে বসালো স্বপ্নিল। তাড়স্বরে ডেকে উঠলো,
—রাহি, এই রাহি। উঠো বলছি।
—হুম
—এই মেয়ে উঠো!
—উফ! কি সমস্যা? এখনো তো সকাল হয়নি। তাহলে ডাকছেন কেন এভাবে?
চোখ ডলতে ডলতে বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো রাহিতা। এদিকে ওর সদ্য ঘুম ভাঙা নিষ্পাপ মুখের দিকে এক পলক তাকায় স্বপ্নিল। অতঃপর অন্যদিক চেয়ে গলা ঝেড়ে গম্ভীর মুখে বলে,
—তোমার হাতে কি হয়েছে?
—আমার হাতে? কই?
আনমনে কথাটা বলে নিজের হাতের দিক তাকাতেই চুপসে যায় সে। এতক্ষণ ঘুমের রেশে তো ভুলেই বসেছিলো সে এলার্জির কথা! এখন কি হবে? সে তো ধরা পড়ে গেছে স্বপ্নিলের কাছে! হুট করে এভাবে ধরা পড়ায় কি উত্তর দিবে তৎক্ষণাত ভেবে পায়না রাহিতা। ওর মুখ দেখেই যা ধারণা করার ধরে নেয় স্বপ্নিল। মুখখানা আরেকটু গম্ভীর করে সুধায়,
—আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি, রাহিতা৷
—ক,,কই? কিছু না তো। এমনিই হয়েছে এম..
—আমায় রাগিয়ো না, রাহি। দু’হাতে লালচে দাগ স্পষ্ট আর তুমি বলছো কিছু হয়নি! আমায় কি বোকা মনে হয় তোমার কাছে? কিভাবে এটা হলো চুপচাপ বলো।
—আসলে আমার চিংড়িতে এলার্জি। তাই একটু র্যাশ উঠেছে।
মিনমিনিয়ে বলে রাহিতা। স্বপ্নিল রেগে আছে, এখন অন্তত ওর থেকে লুকোনো ঠিক হবেনা। ওর উত্তরে বেজায় চমকে উঠে স্বপ্নিল। কোনোমতে প্রশ্ন করে,
—তোমার যখন চিংড়িতে এলার্জি তবে তখন কেন বললেনা? আমায় বললেই তো হতো!
খানিকটা থেমে আবার রাগী গলায় বললো,
—দু হাতে র্যাশ উঠেছে আর এটা তোমার কাছে একটু মনে হচ্ছে? অস্বস্তি হচ্ছেনা এগুলোর জন্য?
—সরি। আসলে খাবার আসার পর আমি খেয়াল করি যে সেখানে চিংড়ি ছিলো।
—এজন্যই আমি খাবার অর্ডার দেওয়ার আগে তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি কি খাবে। কিন্তু তুমিই তো কিছু বললেনা তাই আমি আমার পছন্দে অর্ডার দিয়েছি। তবুও যদি তোমার এলার্জি থাকে তুমি বললেই পারতে, আমি কি তোমায় বকা দিতাম?
—না মানে, আপনি এত শখ করে বলছিলেন..
—শখ করে বলেছি তো কি হয়েছে? এজন্য তুমি এমন কিছু খাবে যেটা খেলে তোমার শরীর খারাপ হয়? এটা কি ধরনের ছেলেমানুষী, রাহিতা? আশ্চর্য!
রাহিতার মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে ওকে কথাগুলো বলে স্বপ্নিল। বিয়ের পর থেকে এতদিন রাহিতাকে ওর বয়স অনুযায়ী যথেষ্ট ম্যাচিউর এক মেয়ে হিসেবে জেনে এসেছে ও, সেই রাহিতার দ্বারা আজ এমন ইম্যাচিউর কাজ ঘটতে দেখে অবাক না হয়ে পারেনি সে! এদিকে স্বপ্নিলের থেকে এতগুলো বকা খেয়ে মুখ ভার করে আছে রাহিতা। মনে মনে আফসোস করলো সে কেন স্বপ্নিল তাকে ভালোবাসেনা! যদি ভালোবাসতো তবে সে-ও বুঝতো কেন রাহিতা তার দেওয়া প্রথম কিছু প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি! কিন্তু মনের আফসোসকে সে মনেই রাখলো, মুখ ফুটে বেরোতে দিলোনা। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে বললো,
—এরকম এলার্জি আমার আগেও হয়েছে, চিন্তা করবেন না। ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়!
—খেয়েছো ওষুধ?
স্বপ্নিলের শান্ত গলার প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় সে। চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে না-বোধক মাথা নাড়ে সে। বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে স্বপ্নিল। রাহিতার করা কাজকর্মে আজ খুব রাগ লাগছে তার। একেতো চিংড়ি খেয়ে এলার্জি বাধিয়েছে অন্যদিকে বাসায় এসে ওষুধটাও খায়নি। এই কেয়ারলেস মেয়েকে নিয়ে সে কি করবে? আশ্চর্য!
—ওষুধ খাওনি কেন?
ধমকে উঠে স্বপ্নিল, যে ধমকে ইষৎ কেপে উঠলো রাহিতা। আড়চোখে স্বপ্নিলের থমথমে মুখের দিক তাকিয়ে নীচু গলায় বিড়বিড়িয়ে বলে,
—ওষুধ খুজেছিলাম, পাইনি কোথাও।
চোয়াল শক্ত হয়ে আসে স্বপ্নিলের। দাতে দাত চেপে বলে,
—তো আমাকে সেটা ফোন করে বলা যেতোনা? আমি কি বাহিরে ছিলাম না এতক্ষণ?
—অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে ছিলেন। আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি!
—শাট আপ, রাহি। কি সমস্যা তোমার? আমায় বলো তো! তখন থেকে যেটাই বলছি তোমার একটাই উত্তর- আমার জন্য তুমি করোনি। তোমার কথা শুনে আমার এখন মনে হচ্ছে সব দোষ আমার! আমার জন্যই তোমার এ অবস্থা। আমাকে নিজের নজরে অপরাধী বানাচ্ছো তুমি!
কথাগুলো বলতে বলতেই বিছানা থেকে উঠে গেলো স্বপ্নিল। একটু পর ওয়াশরুম থেকে গেঞ্জি বদলে গায়ে শার্ট চেপে বের হলো সে। ওকে এভাবে বের হতে দেখে কপালে ভাজ পড়ে রাহিতার। সেভাবেই বোকার মতো জিজ্ঞেস করে,
—এ সময় কোথায় যাচ্ছেন আপনি? অনেক রাত হয়েছে তো।
—নিজের দায়িত্ব পূরণ করতে যাচ্ছি।
—মানে?
—কিছু না। তুমি আমায় ফোন দিলে যেটা বাহিরে থেকে আনতে পারতাম এখন সেটাই আনতে যাচ্ছি।
—আল্লাহ! আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আমি কাল ভার্সিটি যাওয়ার সময় কিনে নেবো। অতটাও অসুবিধা হচ্ছেনা আমার। এত রাতে কস্ট করে যেতে হবেনা আপনার, প্লিজ।
ওর কথাকে পাত্তা না দিয়ে টেবিল থেকে ওয়ালেট হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয় স্বপ্নিল। যেতে যেতে শীতল কণ্ঠে বলে যায়,
—এমনিতেই আমি কম গিল্টি ফিল করিনা তোমায় এতদিন কস্ট দিয়ে। তার মধ্যে তুমি এসব শুরু করেছো। এক মাস তোমায় যথেষ্ট অবহেলা করেছি, কিন্তু বাকি জীবনে আর নয়। তাই আমায় চুপচাপ নিজের কাজ করতে দেও, আমি না আসা পর্যন্ত ঘুমোবেনা। মনে থাকে যেন।
ওর যাওয়ার পানে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে রাহিতা। স্বপ্নিলের আচরণ ও বলা কথাগুলোর মাঝে আজ অন্যরকম এক ভালো লাগা খুজে পায় সে। মনের এ খুশির সামনে যে তার হাত পায়ের সামান্য এলার্জি যেন কিছুই না! তার প্রতি এমন যত্নশীল স্বপ্নিলকে আগে কখনো দেখেনি সে। ও যদি রোজ রোজ এমন কেয়ার দেখায় তবে তার জন্য প্রতিদিন এলার্জির কস্ট সইতে পারবে রাহিতা! আনমনে ভেবে বোকার মতো নিজেই হাসে মেয়েটা!
স্বপ্নিল ফিরে কিছুক্ষণ পরেই। ওদের বাসা থেকে মিনিট দশেক দূরে এক ফার্মাসি থাকায় বেশিদূর যেতে হয়নি তার। ভাগ্যক্রমে দোকানটা বন্ধ করার ঠিক আগ মুহুর্তে সে পৌছায় অন্যথা ওষুধ পাওয়া হতোনা তার আজ! ওকে ফিরতে দেখেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় রাহিতা। বিস্মিত সুরে প্রশ্ন করে,
—এত তাড়াতাড়ি এলেন যে? কোনো দোকান খোলা পাননি তাইনা? আমি আগেই মানা করেছিলাম এ সময় যেতে!
ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শার্ট বদলাতে শুরু করে স্বপ্নিল। রাহিতা ভাবলো ও এখনো রেগে আছে তাই চুপচাপ এক কাত হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। একটু পর চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে চমকে সামনে তাকায় সে। ওর সম্মুখে গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্নিলকে দেখে আপনাআপনিই উঠে বসে বিছানায়। অবাক হয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলে হা করতেই ওর মুখে ওষুধ ঢুকিয়ে দেয় স্বপ্নিল। একিসাথে দ্রুতবেগে গ্লাসটাও ধরিয়ে দেয় ওর হাতে। বিস্ময়ে হতবিহ্বল রাহিতা কোনো শব্দ উচ্চারণ করারও সুযোগ পায়না আর। নিজের কাজ শেষ করে শব্দহীনভাবে অপরপাশে নিজেও বিছানায় শুয়ে পড়ে স্বপ্নিল। এতক্ষণে বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে খুশিমনে মাত্র চোখ বন্ধ করেছিলো রাহিতা। মনে মনে ভাবলো স্বপ্নিল তবে ধীরে ধীরে ওকে মন থেকে নিজের বউ হিসেবে মেনে নেওয়া শুরু করেছে! অন্তত ওর আচরণ তো তাই বলছে! মন বিনিময়ের অপেক্ষার অবসান ঘটলো বটে! ঠিক সে সময় তার আশার প্রদীপকে দপ করে নিভিয়ে স্বপ্নিলের কাঠকাঠ গলা ওর কানে ভাসে,
—একটু আগে যা করলাম তাতে ভেবোনা আমি তোমায় নিজের স্ত্রী হিসেবে মন থেকে মেনে নিয়েছি। আমি তোমায় মিথ্যে আশ্বাস দিতে চাইনা, রাহি। তাই তুমি কিছু ভাবার আগে নিজ থেকেই বলেছি আজ আমি স্রেফ নিজের দায়িত্ববোধের খাতিরে তোমার সাথে এমন আচরণ করেছি এবং এটা ভবিষ্যতেও করবো। কারণ আমি না মানতে চাইলেও তুমি আমার বউ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, আর তার চেয়েও বড় কথা হলো তুমি আমার দায়িত্ব। তোমার প্রতি কোনোরুপ অবহেলা হলে সেটার দায়ভার আমাকেই নিতে হবে। তাই তোমার ভালোমন্দের বিষয়ে আমি কোনো প্রকার হেরফের হতে দিবোনা। আর একটা কথা, আপাতত তোমায় বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। আমার সময় দরকার। আশা করছি তুমি আমাকে বুঝবে।
ব্যস, এতক্ষণের খুশিটা যেন মুহুর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেলো রাহিতার। নিশব্দে চোখ বেয়ে গড়ে পড়লো দু’ফোটা নোনা অশ্রুজল, যা অন্ধকার কক্ষের নির্জনতায় টের পেলোনা স্বপ্নিল। বেশ কিছুক্ষণ ওকে নীরব দেখে সে ভেবে নিলো ওর কথা শুনে জবাব দেওয়ার আগেই ঘুমকাতুরে রাহি হয়তো এতক্ষণে আবারো ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেছে। তাও নিজের মনের কথা রাহিতাকে বলতে পেরে হালকা অনুভব করে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়লো স্বপ্নিল। কিন্তু ঘুমন্ত সে ঘুণাক্ষরেও টের পেলোনা যে তার কথার প্রভাব তারই পাশে শয়নরত মানুষটার বাকি রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে!
#চলবে
জানি পর্ব ছোট হয়েছে আজ। রোজা রেখে কাজের চাপে এটুকুই লিখার সময় পেয়েছি। কেমন লেগেছে জানাবেন।