স্বামীর মৃত্যুর ঠিক এক ঘন্টা পর রত্না আজ জানতে পারলো তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা। সে বুঝতে পারছে না কোন শোকটাকে বেশি প্রাধান্য দিবে।স্বামীর মৃত্যু না কি তার বেঈমানী? কাঁদতে ভুলে গেল সে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তার স্বামী খায়রুল আলম। সম্পর্কে তার খালাতো ভাইও ছিল। হাসপাতালে শেষ সময় সাথেই ছিল রত্না। মৃত্যুর আগে খায়রুল তার থেকে ওয়াদা নিয়েছে যেন তার প্রিয় সব কিছুর খেয়াল এবং দায়িত্ব পালন করে রত্না।স্বামীর কথার মানে এই মুহুর্তে তার কাছে স্পষ্ট হলো।সে তবে দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানের কথা বলছিল।দীর্ঘ দশ বছরের বিবাহিত জীবনে ছয়টা বছর খায়রুল তাকে ঠকিয়েছে এটা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এলো।তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না কেউ।অথচ তার কোলে ঘুমিয়ে আছে বছর বছর চার কি পাঁচের একটা মেয়ে। কাফন পরানোর পর যখন অনুমতি চাইলো লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য তখন রত্নার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী কণা বলল,
“আমি উনার বিবাহিত স্ত্রী।আমাকে উনার লাশটা শেষ বার দেখতে দিন।”
কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। খায়রুল আলমের মা সুফিয়া খাতুন সেই মেয়ের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলে সে সুফিয়া বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল,
“শেষ বারের মতো দেখতে দিন আম্মা।আমার স্বামী আমার জীবনের রঙ ছিল।তাকে সাদা কাফনে শেষ বার আম্মা দেখতে দেন।”
কণাকে অনুমতি দেওয়া হলো। সে স্বামীর লাশের খাটিয়া ধরে খুব কাঁদলো।যেমনটা স্বামীর বিচ্ছেদে স্ত্রী কাঁদে। তবে যখন রত্নাকে সাদা শাড়ি পরিয়ে আনা হলো সে মুখ ফিরিয়ে নিলো লাশের থেকে।সবাই বার বার বলল খালেস নিয়তে মাফ দিতে কিন্তু রত্না ফিরে চাইলো না।লাশ নিয়ে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল,
“আপনার অতীব আদরের জিনিসটা আমি আমার কাছে রাখবো। কথা যখন দিয়েছি খুব যত্ন করেই রাখবো তাকে কিন্তু সতীনের সন্তানকে কী নিজের বলে সত্যি মানা যায়?”
যায়, রত্না মেনে নিয়েছে। বিগত পনেরো বছর যাবত সে নিজের দুই সন্তানের সাথে সতীনের সেই মেয়েটিকেও পালন করছে ।মৌলিক চাহিদা সাথে বিলাসিতা দুটোই দিচ্ছে। দূর থেকে দেখে সবাই ভাবে কতোটা সুখী পরিবার তাদের। কিন্তু আদৌও কি সুখ রয়েছে সবার ভাগ্যে?
সকালের মিঠে রোদ হুটোপুটি করছে রুমের ভিতর। ফ্লোরে ঘুমিয়ে থাকা আবৃতির ঘুম ভাঙলো বাইরে থেকে ভেসে আসা মায়ের ডাকে। ঘড়িতে সাতটা বেজে দুই মিনিট।ওড়না গায়ে ব্রাশ বেরিয়ে এলো আবৃতি ।চুলোয় চায়ের পানি বসাতেই রত্না বেগম বলল,
“কতবার বলেছি একটু আগে উঠতে তোকে?আর ব্রাশ নিয়ে রান্নাঘরে কেন আসিস?বলিনি হাত মুখ পরিষ্কার করে আসবি।দিলি তো পুরো বাড়িটা পেস্টের গন্ধে ভরিয়ে দিতে।এখন চায়ের থেকেও পেস্টের গন্ধ আসবে।”
থুক করে বেসিনে পেস্টের ফেনা ফেলে আবৃতি। কুলকুচি করে ফিরে আসে রান্নাঘরে।পানিতে চা পাতি দিতে দিতে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“মা! অন্তত একটা দিন আমার সাথে ভালো করে কথা বলবে?আজকের দিনটা?”
“আজকের দিনে কি এমন বিশেষ যে তোর সাথে আমাকে জি হুজুরি করতে হবে?”
“কিছু না।”
“বল আজ কি?রাগ উঠাবি না কিন্তু।”
রত্না বেগমের সামনে চায়ের কাপ রেখে স্মিত হেসে সে বলল,
“কিছুই না মা।আমার ইচ্ছে হলো তাই বললাম।”
রত্না বেগমের এমন নিরুত্তাপ সহ্য হলো না।দুই গালে দুটো বসিয়ে দিয়ে বলল,
“বলতে বলেছি বলবি। এত কথা কিসের? বেয়াদব মেয়ে।”
মায়ের হাত থেকে নিজের বিনুনিটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে নিচু গলায় আবৃতি জবাব দিলো,
“মা আজ আমার জন্মদিন।”
(দুই)
ক্যাম্পাসে এসে আবৃতি বুঝতে পারলো তার পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে কিছুই খেয়ে আসতে পারেনি।ব্যাগ হাতড়ে দেড়শো টাকা পেলো।এই দেড়শো টাকা দিয়ে মাসের বাকী সাত দিন চলতে হবে। বাবা মারা যাওয়ার আগে জীবনটা কত সুন্দর ছিল।না চাইতেই সব কিছু পেয়ে যেত। এমন নয় যে এখন তাদের টাকা পয়সার সমস্যা চলছে। সমস্যাটা হলো এখন আর বাবা নেই। তাই মায়ের ইচ্ছেতেই সব। মাসের শুরুতে হাজার খানেক টাকা দেয় রত্না বেগম।সেই টাকা দিয়েই পুরো মাস চলতে হয়। কোনো কিছুর অভাব নেই জীবনে তবে যেটার অভাব রয়েছে সেটা হলো একটু শান্তির। আবৃতির জীবনে আরো একটি অশান্তির নাম হলো শাহরিয়ার। এই যে আর মাত্র পাঁচটা মিনিট অবশিষ্ট আছে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে। এই পাঁচ মিনিটের মাঝে সে ক্লাসে কোনোভাবেই পৌঁছাতে পারবে না। আর পৌঁছাতে না পারলে আজকেও শাহরিয়ারের ক্লাসটা মিস হয়ে যাবে। তৃতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে কোনো ক্লাস মিস হয়ে যাওয়া মানে অনেক কিছুই অজানা থাকা।তার মাঝে যদি হয় শাহরিয়ারের ক্লাস তবে আলহামদুলিল্লাহ। ক্লাস উপস্তিতির উপর যে নাম্বারটা সেটা পুরোটাই কাঁটা যাবে। ডিপার্টমেন্ট নয় ক্যাম্পাসের অধিকাংশ মেয়েদের ভীষণ প্রিয় এবং স্মার্ট স্যার কেবল আবৃতির জন্য জেদী, একরোখা,ডাটিয়াল এবং অহংকারী স্যার।ক্যান্টিন থেকে পাঁচ টাকার একটা সমচা কিনে দৌড়ে উঠে এলো ডিপার্টমেন্টে। অথচ দরজাটা বন্ধ।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়া আসবো?”
কথাটা বলেই চকিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল আবৃতি।নিচের ঠোঁটটা কামড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে আছে শাহরিয়ায়।সাদা শার্টে কেমন উথাল-পাতাল সুন্দর লাগছে তাকে।আবৃতি দুটো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,
” মে আই কাম ইন স্যার?”
“নো. ইউ আর লেট.”
“আচ্ছা।”
চলে যাওয়ার সময় শাহরিয়ার তাকে ডাকলো। পায়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে আবৃতি জানালো দ্রুত উঠতে গিয়ে নখে ব্যথা লেগেছে।ভেবেছিল এতে কাজ হবে কিন্তু হলো না।তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে ক্লাস শুরু করলো শাহরিয়ার।ক্লান্ত দেহে কমন রুমে চলে গেল আবৃতি।ব্যাগ থেকে সমচা আর পানি বের করে খেলো।ওয়াশরুম থেকে পায়ে পানি দিলো। আজকে বাড়ি গেলে তার কপালে শনি আছে। শাহরিয়ার আহমেদ সম্পর্কে আবৃতি আহমেদের বড় চাচার ছেলে। বরাবর লেখাপড়ায় এই অমনোযোগী ছেলেটা সাতাশ বছর বয়সে কেবল বিসিএস কমপ্লিট করেনি দুই বছর বিদেশ থেকেও নিজ সাবজেক্টে মাষ্টার্স করেছে।তাকে কি না বেছে বেছে এখানেই জব নিতে হয়েছিল।আবৃতি মাঝেমধ্যে বাসায় তাকে স্যার বলে ডেকে উঠে।হাসির রোল পড়ে যায় পুরো বাড়িতে। আর এখানে ভাইয়া বলে ডাকলে চোখ রাঙানি তো আছেই। মাঝেমধ্যেই তার ইচ্ছে হয় ভাইয়া এবং স্যারের কম্বিনেশনে তাকে স্যাইয়া বলে ডাকতে কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে বলে,
“ছিঃ তুই কি অশ্লীল আবৃতি।নিজের স্যারকে স্যাইয়া বলে ডাকতে চাইছিস।”
ক্লাস করতে ইচ্ছে হলো না আর।আজ তার জন্মদিন অথচ দিনটা কতোটা বাজে যাচ্ছে।প্রথমে মায়ের মার পরে ক্লাসে লেট এখন পায়ে ব্যথা।ফিরতি পথে একটা দোকানের সামনে থেমে গেল আবৃতি।কেকের দোকান।কি ভেবে ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো সেই মুহুর্তে শাহরিয়ার তার বিনুনি ধরে টেনে নিয়ে গেল দোকানটার ভিতরে। সাইডে একটা টেবিলে বসে পড়লো শাহরিয়ার। তার দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।আবৃতি দুটো শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“স্যাইয়া কি হচ্ছে এসব?আমাকে এভাবে টেনে আনার মানে কি?”
কথাটা শেষ করার পূর্বেই ভীষণ ভাবে চমকে গেল আবৃতি।সে ভাইয়া বা স্যার না বলে স্যাইয়া ডাকবে এটা ভুলেও বুঝতে পারেনি।দুই হাতে মুখ চেপে ধরে উল্টো পথে দৌড় দিলো।নাহ্ এই মুখ আর দেখানোর উপায় রইল না তার।মনটা এতো বেহায়া কেন?ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়।
চলবে ( এডিট ছাড়া।আর যারা গল্প পড়বেন তারা নিশ্চয়ই রেসপন্স করবেন।কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।)
#কাঞ্জি
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-১
#ছবিয়ালঃঢাকা_আর্ট