#কাঞ্জি
#পর্ব-৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
আবৃতি লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লড়াইটা তো নিয়তির বিরুদ্ধে, তবে ক্লান্ত হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?স্বাভাবিক কারণ নিয়তি যেমনি হোক না কেন আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে।নিয়তি পরিবর্তন করা যায় না, কেবল এটার সাথে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইটা করা যায়।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার পরেও আবার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো আবৃতির।ঘন্টাখানেকের মাঝেই সে আবার জ্বরে বেহুশের মতো পড়ে রইল।সকাল বেলা কিছু টেস্টের জন্য ব্লাড পাঠানোর পর আজমীর শাহরিয়ার কে বলল,
“তুই বাড়ি যা ভাই।তোর আবার ক্লাস আছে। ও যেহেতু ঘুমাচ্ছে আমিও একটু বের হবো।”
“কোথায় যাবি?”
“এইতো কিছু ক্লায়েন্টের আসার কথা।তাদের সাথে মিটিং ফিক্সড ছিল।বাতিল করার সুযোগ নেই।”
“আচ্ছা তবে তুই যা। আমি এখানে আছি।আসতে হবে না।বিকেল নাগাদ যদি ওর অবস্থা ভালো হয় আমি নিয়ে বাসায় যাবো।না হলেও রাতে আছি।তুই এসে পড়িস।”
“ক্লাস আছে না তোর?”
“ছুটি নিয়েছি।”
“তাহলে আবৃতির টাও নিয়ে নে।”
শাহরিয়ার হাসে।তপ্ত গ্রীষ্ম দুপুরের শীতল সমীরণের ন্যায় সে হাসি।আজমীরের কাধে হাত রেখে বলে,
“স্টুডেন্টরা এমনি ওমনি ক্লাস বাদ দিতে পারে।তাদের ছুটির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু টিচারিদের ছুটি নিতে হলে এটলিস্ট একটা মেইল পাঠিয়ে অথোরিটিকে জানাতে হয়।ব্যস এটুকুই।”
বিলাসবহুল হাসপাতালের কেবিনে ঘুমিয়ে আছে আবৃতি।সমাজে উচ্চবিত্তদের কাতারেই তাদের স্থান তবুও আবৃতিকে বেঁচে থাকার লড়াই চালাতে হয়।কেন হয় সেটা আবৃতি জানে।কারণ রত্না বেগম।তিনি আবৃতির জীবন থেকে সকল বিলাসিতা কেড়ে নিয়েছেন।সামান্য জ্বর হলে বাড়ির অন্যদের ডাক্তার দেখানো হলেও আবৃতি নির্ভর করে দশ টাকা পাতা প্যারাসিটামলে।এইতো বছর কয়েক আগে পায়ে লোহা ঢুকেছিল। সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেটার চিকিৎসা করিয়েছে আবৃতি। এসবের টু শব্দের খবর ঘরের চার দেয়ালের বাইরে যাওয়া নিষেধ বলে একই বাড়িতে থেকেও বাকীদের অজানা গল্প।এই যে আজ শহরের নামী-দামী হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার।হয়তো শাহরিয়ার না থাকলে আজমীরের সাহস হতো না এখানে নিয়ে আসার।রত্না বেগমের এমন আচরণের কারণ হিসেবে তারা তিন ভাই বোন কেবল এটাই জানে যে
“বাবা মারা যাওয়ার চার দিন পর মায়ের ব্রেইন স্ট্রোক হয়।লনে ঘাসের মধ্যে পড়ে ছিল।এরপর সে নিজ ইচ্ছায় সতীন এবং সৎ মেয়েকে গ্রহণ করে।কিন্তু পনেরো দিন পর কণা বেগম চলে যায়।কেন চলে যায় এটাও তারা জানে না।এরপর দুই বার সুইসাইডের চেষ্টা করেছিলেন রত্না বেগম।তাকে কিছু বললে সে পুনরায় সেই পথেই হাঁটবে।তাই মায়ের সব কথা মেনে নিতেই হবে।”
সকালের মিষ্টি বাতাস এসে কড়া নাড়ছে বারান্দায়।ভারী পর্দার কারণে প্রবেশ করতে পারছে না।শাহরিয়ার পর্দা সরিয়ে দিতেই তারা হুড়োহুড়ি করে ছুঁয়ে দিলো আবৃতিকে।শাহরিয়ারের হিংসে হলো।হাওয়াদের এমন প্রতিদান সে মেনে নিতে পারলো না।এই ভাবে তার পাখিকে তারা কেন ছুঁয়ে গেল? কই সে তো এখনো পারেনি।আকাশস্পর্শী হিংসে নিয়ে পুনরায় পর্দা টেনে দিলো সে। ইদানীং তার একটা রোগ হয়েছে। রোগটার নাম মহামারী হিংসে রোগ।আবৃতির আশেপাশের সবকিছু দেখে তার বড্ড হিংসে হয়।আবৃতির পেন্সিল যেটা পড়ায় খুব মনোযোগী হলে গুঁজে রাখে কানের পিঠে কিংবা পানির বোতল, হাত ঘড়িটা অথবা তার চুলের কাটা।এসব জন্মের শত্রুর মতোন লাগে শাহরিয়ারের। তারা কত কাছে থেকে ছুঁতে পারে আবৃতিকে অথচ সে পারে না।এই মুহুর্তে তার হিংসে হচ্ছে আবৃতির পাশে থাকা বালিশটাকে।কেমন বুকে আগলে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে সে।বালিশের জায়গায় সে নিজেও তো হতে পারতো।শাহরিয়ারের এখন মনে হচ্ছে যদি তার কাছে কোনো যাদু থাকতো তবে সে সেই জাদুবলে এই মুহুর্তে বালিশ হয়ে যেত।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পাশের বেডে বসে ফোনে মনোযোগ দিলো।
শাহানারা যখন এসেছে তখন আবৃতি কেবল ঘুম থেকে উঠেছে। উঠেই সে জেদ করছে গোসল করবে।অগ্যতা তাকে গোসল করতে দিতে হলো।ডাক্তার রিপোর্ট দেখে জানালো টাইফয়েড হয়েছে। অবাক হলো শাহানারা। এই রোগ একদিনে অবশ্যই হয়নি।শাহরিয়ার জানালো প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট বাসাতেই চলবে।বিকেল নাগাদ রিলিজ দিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।সুফিয়া খাতুন অসুস্থতার কথা শুনে রত্না বেগমকে বললেন,
“বউ তোমার হাই প্রেশার, আজমীর বাড়িতে এই আছে এই নেই আর অদিতির পরীক্ষা।আবৃতি আমার কাছে থাকুক।যতদিন সুস্থ না হয়।আপত্তি আছে?”
“আপনার কাছে থাকলে আমার আপত্তি কিসের? থাকুক আমি ওর জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিবো।”
আজমীর ঔষধপত্র রাখতে রাখতে বলল,
“ওর তিন বেলা ইনজেকশন আছে আইভিতে। ”
“ও তো দিতেই পারে।”
“মা ও দিতে পারে কিন্তু নিজের হাতে নিজে কীভাবে দিবে?লোক আসবে দিয়ে দিতে। তখন তোমরা একটু খেয়াল রেখো।”
সেদিন সন্ধ্যেবেলা আবৃতির চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন সুফিয়া খাতুন।মাথার ভিতর তার হাজার খানেক চিন্তাভাবনা ঘুরছে। এজন্যই আবৃতি ইদানীং মুখটা ছোটো করে রাখতো।সচরাচর খাবার খেতে চাইতো না।শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।সে না হয় বুঝেনি কিন্তু রত্না? একই বাসায় থেকে মেয়েটা এতো অসুস্থ তবুও সে বুঝেনি? ধীরে ধীরে নানান প্রকার সন্দেহ হতে লাগলো তার।তবে কি আবৃতির প্রতি রত্না যত্নশীল নয়?
সন্ধ্যে হতেই হৈচৈ করে প্রবেশ করলো বর্ণ, অদিতি, শাহানারা এবং আজমীর।তাদের দুই হাত ভর্তি নানান ধরনের খাবার।সুফিয়া বেগমের খালি ঘর মুহুর্তেই কোলাহলে ভরে গেল।তারা এসেই বায়না করলো চা খাবে।আজমীর বাইরে থেকে ভাজাপোড়া নিয়ে এসেছে। মুড়ি মাখা সাথে দুধ চা। নিচে ফ্লোরিং করে সবাই বসে পড়েছে।সুফিয়া খাতুন চা করে নিয়ে এসেছেন।আবৃতিকে ঘিরে আড্ডার আসর বসেছে।আড্ডার মধ্যমণি সুফিয়া বেগম।তিনি নানান গল্প বলে চলেছেন নাতী নাতনীদের। শাহরিয়ার যখন ফিরলো তখন বর্ণ এসে তার হাত ধরিয়ে বসিয়ে দিলো আবৃতির মুখোমুখি।মেয়েটাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।বিনুনি করার কারণে বুঝা যাচ্ছে অনেকটা শুকিয়েছে সে।ফয়সাল সাহেব এসে আরো একটি খুশির খবর দিলেন।পাত্রপক্ষ পছন্দ করেছে শাহানারাকে।তারা আগামী শুক্রবার আংটি বদল করতে আসবেন।যেহেতু মেয়ের মত আছে তাই একেবারে ডেট ফিক্সড করে ফেলেছেন ভদ্রলোক।আরো এক দফা খুশির বাতাস বয়ে গেল।বাড়ির তিন বউ এসে যোগ দিলো আড্ডায়।দুই ছেলে এসেও বসেছে।সুফিয়া খাতুন বললেন রাতের খাবার তার ওখানেই খেতে। ব্যস সবাই জমিয়ে ফেলল আড্ডার আসর।
সবাই হাসি হাসি থাকলেও তার মুখটা গম্ভীর। পানি খাওয়ার ছুতোয় সে উঠে এসে আবৃতির পাশে বসে বলল,
“খারাপ লাগছে?ঘুমাবে কি তুমি?”
দু পাশে মাথা দুলিয়ে না করলো সে।শাহরিয়ার বুঝতে পেরে নিজের কোলে থাকা কুশনটা আবৃতির পিছনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“হেলান দিয়ে বোসো।আরাম লাগবে।”
আবৃতি হেলান দিয়ে তো বসলোই না উল্টো দৌড়ে ওয়াশরুমে ছুটলো।তার পিছন পিছন শাহরিয়ার এসেছে।বমির কারণে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না মেয়েটা।শাহরিয়ার শক্ত হাতে ধরে রইল তাকে।পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।অথচ সে যদি জানতো যে সামান্য এই কারণে অসুস্থ আবৃতিকে এতটা কষ্ট দিবে তার মা তবে কিছুতেই আবৃতিকে স্পর্শ করতো না সে।
চলবে (এডিট ছাড়া।যারা পড়ছেন রেসপন্স করবেন এবং অন্তত এক লাইন মন্তব্য করবেন।)
#ছবিয়ালঃ ছবিওয়ালাবিডি