কাঞ্জি পর্ব -০৬

#কাঞ্জি
#পর্ব-৬
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

“সৃষ্টিকর্তা কেন এতিম সন্তানদের পৃথিবীতে একা রাখে?বাবা মারা যাওয়ার পর তো আমি এতিম ই হয়ে গেছি তাই না?সবার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে তার অভিভাবকের সাথে মৃত্যু দিয়ে দিলে খুব একটা বেশি ক্ষতি হতো না। তাই না?”

আবৃতির কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহানারা।রত্না বেগম অসুস্থ মেয়েটাকে মেরেছে।পিঠে কয়েকটা বাড়ি দিয়েছে বিছানার ঝাড়ু দিয়ে। এত মানুষের মাঝে রত্না বেগম মেয়েকে মারলো।অথচ আবৃতি মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করেনি। শাহানারা পানির জগ রাখতে এসে দেখতে পায়।রত্না বেগমকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবৃতিকে জড়িয়ে ধরে রত্না বেগমকে জিজ্ঞেস করে,

“এভাবে ওকে কেন মারছো মামনি?কি করেছে ও?”

“ও কি করেছে একবার ওকেই জিজ্ঞেস কর।”

রত্না বেগম বেরিয়ে যেতেই শাহানারা জিজ্ঞেস করলো,

“কি করেছিস?”

“কোনো কারণ নেই আপু।বাদ দাও।”

“ভাইয়া তোকে ধরেছিল বলে মামনী তোকে মারলো তাই না?”

আবৃতি হাসে, বিছানায় শুতে গেলে কামিজের সাথে গায়ের ঘসা লাগতেই ককিয়ে উঠলো।শাহানারা তাকে বসিয়ে কামিজ উঠাতেই দেখতে পেল ঝাড়ুর বাড়িতে কয়েক জায়গায় ফুলে গেছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা বরফ এনে সুতি কাপড়ে প্যাঁচিয়ে পিঠে লাগাতে লাগাতে শাহানারা বলল,

“এটা নতুন নয় তাই না রে?মামনি তোকে মাঝেমধ্যেই মারে।”

“আরে নাহ। কে বলল এসব।”

“এই দুই দিনেই বুঝতে পেরেছি।তোকে মারে আর তুই চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিস।শব্দ অবধি করিস না।”

“কী লাভ আপু।বাদ দাও এসব কথা।তার চেয়ে তুমি বরঙ বাহিরে যাও।তোমার বিয়ে নিয়ে কতো আলোচনা চলছে।বিয়ের শপিং করতে যাবে না?”

“এসব বড়দের জানা দরকার।”

“আপু বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়েছি।অন্তত এটুক কেড়ে নিও না আমার থেকে।আমি মেনে নিয়েছি তাই এখানে দ্বিতীয় কোনো কথা থাকতে পারে না।”

কেটে গেল চারটে দিন। বাড়িতে রূপকথারা গল্প করছে।একটা বিয়ে হাজার খানেক কাজ।এই কাজের মাঝেও শাহরিয়ার দূর থেকে খেয়াল রাখছে তার পাখিটার।এই যে সকালবেলা আগে টেবিলের কোণা লেগে পায়ে ব্যথা পেল মেয়েটা। সে সকল চারকোণা টেবিলের চারপাশে মোল্ড লাগিয়ে দিলো।আবৃতি খালি পায়ে হাঁটে বলে বার বার লোকেদের দিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার রাখাচ্ছে।কেবল তাই নয় এই যে মেয়েটা একটু পর পর পানি খাচ্ছে, তার পানি খাওয়া দেখে তীব্র পিপাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।পানি খাওয়ার গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল,

“অন্যের তৃষ্ণা মিটিয়ে আমার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিচ্ছিস। এক কাজ কর না তুই ফালি হয়ে আমার বুকের ভিতরেই ঢুকে যা। এটাই তো বাদ আছে। তারপর এক গ্লাস র ক্ত আমার নিয়ে খেতে দে ওকে।যদি এতে তার তৃষ্ণা মিটে।”

পরক্ষণেই শাহরিয়ারের বেশ বিরক্তি উঠে এলো নিজের প্রতি।সে নিশ্চয়ই চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সী ছেলে নয়।যে প্রেমিকার জন্য ছটফট করবে, তাকে অন্য কারোর সাথে দেখে হিংসে করবে। সে একজন পূর্ণ পুরুষ তবে কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে তার? নিজেই নিজের জবাব পেয়ে গেল।তার মনের গহীনে ছোট্ট কুঠুরিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকা আবৃতি ফিসফিস করে তার কানে কানে বলতে লাগলো,

“শাহ্ আপনি কি জানেন? যখন আপনি কাউকে ভালোবাসবেন প্রেমে পড়বেন না, ভালোবাসবেন তখন আপনার অনুভূতির উপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।এটার নামই ভালোবাসা যা আপনাকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য ক্ষমতাহীন বানিয়ে দিবে।আপনার সকল চেষ্টা এই আবৃতির জন্য ব্যর্থ। কারণ প্রেমিকের অনুভূতি বেহায়া না হলে যে প্রেম জমে না।”

(****)
স্মিতার মৃত্যুর জন্য রত্না বেগম কিংবা অদিতি নিজেদেরকে খানিকটা দায়ী মনে করে। স্মিতা আজমীরের স্ত্রী ছিলেন। পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে আজমীর কেবল তার সব দায়িত্বই নিয়েছিল না, সাথে নিয়েছিল স্বপ্নের দায়িত্ব।বিয়ের ছয় মাসের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল স্মিতা।ওয়াশরুমে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিল।সাত মাস চলা কালীন সময়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল ওয়াশরুমে। কোমডে মাথা লেগে মাথায় আঘাত পায়।প্রচুর র ক্ত ক্ষর ণ হয় এবং অবচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল সে।আজমীর বাসায় ফিরে তাকে দেখতে না পেয়ে ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কা দেয়। বিশেষ কারণে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ রাখতো না স্মিতা।এটাচড ওয়াশরুম হওয়ার কারণে কোনো সমস্যা হতো না।সেদিন বার বার আজমীর রত্না বেগমকে কল দিয়ে স্মিতাকে দেখে রাখতে বলেছিলেন।রত্না বেগমও বার বার খবর নিয়েছিলেন কিন্তু যখন স্মিতা পড়ে যায় তখন সে ঘুমে।হুট করে প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল তার।তাই অদিতিকে বলেছিল স্মিতার সাথে থাকতে কিন্তু অদিতি ফোনে ব্যস্ত ছিল বলে ওই ঘরে যায়নি।এতকিছু হয়ে যাবে কে জানতো?যদি জানতো তবে আজমীর সেদিন বের হতো না কিংবা রত্না বেগম ঘুমাতেন না।নিছক দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয় স্মিতার। স্মিতার বাসার মানুষজন পুলিশ কেসও করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারিবারিক ভাবে ঘটনাটা শেষ করা হয়।রত্না বেগমের অসুস্থতা এবং ভিন্ন কিছু কারণে আজমীর বাসার ড্রয়িং, ডায়নিং এবং রান্নাঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিল।সেখানে দেখা যায় স্মিতার রুমে কেউ প্রবেশ করেনি এবং আজমীর যখন এসেছে স্মিতা তখন অবচেতন। সবাই সবটা মেনে নিলেও রত্না বেগমের আত্মগ্লানি যায়নি।তার প্রতিনিয়ত মনে হয় সে যদি ওই মেয়েটার ঘরে ঘুমাতো তবে আজ মেয়েটা জীবিত থাকতো।

(***)

বিয়ের খবর বাতাসের আগে গন্ধ ছড়ায়।শাহানারার বিয়ের গন্ধটাও ঠিক পৌঁছাছে আত্মীয়দের কাছে। আজ তার দুই ফুপু এবং তাদের পরিবার আসছে।মেয়েরা এসে মায়ের সাথেই থাকে।বড় মেয়ে সায়মা বেগমের দুই ছেলে।বড় ছেলে সিজাদ রহমান এবং ছোটো ছেলে সিয়াম রহমান। স্বামী গত হয়েছে বছর চার হলো।দুই ছেলেই ডিফেন্সে জব করে।ছোটো মেয়ে নাসরিনের দুই মেয়ে।রাফা এবং রিমঝিম।বড় মেয়ে এবার ভর্তি পরীক্ষা দিবে ছোটো মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে। নাসরিনের স্বামী বিদেশে আছেন।তারা আসতেই পুরো বাড়ি হেসে উঠেছে উচ্চস্বরে।

আচ্ছা এবার একটু থামুন। এবার লেখকের কথাটা শুনুন।আরে, আরে একটু ধৈর্য্য রাখুন।এই যে এতো এতো চরিত্র গল্পে, বুঝতে নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে। তাই না?মনেও থাকবে না।তাই আপনাদের চাপ কমিয়ে দিচ্ছি।আপনারা কেবল মাথায় রাখুন সিজাদ এবং রিমঝিমকে।রিমঝিম?তার ক্রাশ খাওয়ার একটা বদ অভ্যেস আছে।সে যাকে তাকে দেখে ক্রাশ খেতে পারে।আর সিজাদ?সুফিয়া খাতুন এবং ফয়সাল সাহেবের পরিবারে সবচেয়ে বড় নাতী হচ্ছে সিজাদ।বর্তমানে সেনাবাহিনীতে কর্মরত।শাহরিয়ার এবং তার বয়সের তফাৎ মাত্র ছয় ঘন্টা।শাহরিয়ারকে পরিবারের প্রতিটি বাচ্চা যেমন ভালোবাসে, আবদার করে তেমনি সিজাদের গম্ভীর চেহারা দেখে তার থেকে দূরে দূরে থাকে।অথচ শাহরিয়ার এবং সিজাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব দেখার মতোন।বাকী সবার সামনে গম্ভীর সিজাদ তার এই ভাইয়ের কাছে ডায়েরির খোলাপাতা।

দুই বছর পর মিশন থেকে সিজাদ ফিরেছে।এবার তার টানা ছুটি চলছে। শাহরিয়ার ফিরে এসে ড্রয়িং রুমে তাকে বসে থাকতে দেখে আর উপরে গেল না।আবৃতি দুজনের জন্য চা করে নিয়ে এসেছে।তাকে দেখে ভ্রু-কুঁচকে শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কেন? আর লোক নেই?”
“আছে।ভাইয়া আপনাদের কিছু লাগবে?”
“না তুমি বিশ্রাম নাও।যাও।”

সিজাদ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে।শাহরিয়ারকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলল,
“ওকে রোগীর মতোন ট্রিট করছিস কেন?”
“কারণ ও রোগী।টায়ফয়েড হয়েছে।আইভিতে তিন বেলা ইন্দ্র ইনজেকশন চলছে।”
“আচ্ছা।আবৃতি তুমি বোসো।”
আবৃতি বসলো।শাহরিয়ার কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলো।বিরক্তি কাটাতে সে সিজাদকে প্রশ্ন করলো,
“তো এই ছুটিতে বিয়ে করছিস তো?”
“এজন্যই তো এলাম।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে শাহানারার পর পর নিজেও বিয়েটা করে নিয়েই যাবো।ভাবছি বাপ বেটার শ্বশুর বাড়ি এক হলে মন্দ হয় না।কি আবৃতি তুমি রাজি তো?”

আবৃতি কথাটা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো না।সে বোকার মতো হেসে বলল,
“রাজি না থাকার কি আছে?”

চলবে (এডিট ছাড়া। যারা গল্প পড়েন তারা রেসপন্স করবেন।কারণ আপনারা রেসপন্স করলে বাকীদের টাইমলাইনে পৌঁছাবে।)

#ছবিয়ালঃঅদিতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here