আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -৩৬+৩৭+৩৮

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৬]

হঠাৎ রিমি কাধে মাথায় রাখায় হকচকিয়ে গেলো অভ্র। চটজলদি রিমির মাথা কাধ থেকে সরিয়ে দিয়ে চমক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। না! কেউ দেখে নি। অভ্র কণ্ঠস্বর নিচু করে ফিশফিশ করে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি রিমি? কাধে মাথা রাখলে কেন?’

চরম লেভেলের বিরক্ত হলো রিমি। শব্দ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে হতাশ হয়ে বললো, ‘তো কি হয়েছে? তুমি তো আমার বয়ফ্রেন্ড-ই।’

এমন একটা মুহূর্তে রিমির কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিলো না অভ্র। সময়টা একান্তে হলে সমস্যা ছিলো না। যেহেতু এখানে সকলে উপস্থিত সেহেতু এভাবে কাধে মাথা রাখা কিংবা এমন কথাবার্তা দৃষ্টিকটু। তার মতে পারসোনাল কথাবার্তা, কাজকর্ম পারসোনালি-ই করা ভালো। ব্যাপার টা রিমির বুঝা উচিত ছিলো। তাই রিমির অতিরিক্ত ইমম্যাচিউরিটি অভ্র নিতে পারলো না। কণ্ঠস্বর নিচু করে ফিশফিশ করে বললেও রাগান্বিত চোখমুখ কাটকাট গলায় বললো, ‘ছেলেমানুষির একটা লিমিট থাকে। দিন দিন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছো তুমি। কেউ যদি দেখতে পায় তাহলে কেমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট হতো? বোকা তুমি? এইসব কি হাতে কলমে শিখিয়ে দিতে হবে তোমাকে?’

রিমি প্রথমের মতো ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো, ‘কেউ তো দেখেনি।’

অভ্র কোনো রকম রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে উঠলো, ‘জাস্ট শাট আপ রিমি। তুমি কোনো বাচ্চা না যে হাতে ধরে বুঝিয়ে দিতে হবে। এখানে সবাই উপস্থিত থাকার পরেও কিভাবে কাধে মাথা রাখো তুমি? কমনসেন্স বলতে কিছু মাথায় নেই? তুমি আমি এখানে একা না যে যা ইচ্ছে করবে। আর বয়ফ্রেন্ড হোক কিংবা জামাই ; ফ্যামেলি মেম্বারদের সামনে কাধে মাথা রাখতে হবে কেন?’

একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো রিমি। অভ্রের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। ভীষণ ভাবে লজ্জিত হলো অভ্রের কথায়। অপমানে শরিরে রিরি করে উঠলো। আরেকটু ভালো ভাবে বুঝাতে পারতো না অভ্র? সে তো অভ্রকে রাগাতেই কাধে মাথা রেখেছে। ভেবেছিলো অভ্র বোধহয় ভ্যাবাচ্যাকা খাবে। আর সে ঝগড়া করবে। কিন্তু হলো তো উলটো। রাগ হলো অভ্রের উপর। সরাসরি এভাবে না বলে ভালো ভাবেই বলতে পারতো। অপমানে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো রিমির। চলন্ত গাড়িতেই পিছনের সিট ছেড়ে সামনের সিটে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। হতবাক হয়ে গেলো অভ্র। রিমি একটা সিট ধরে সামনে পা বাড়াতেই গাড়ি রাস্তার বাম পাশে ঘুরলো। পরে যেতে নিলেই আরেকটা সিট ধরে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে। ভয়ার্ত হলো অভ্র। পিছু ডেকে বাধা দিতে চাইলো, ‘রিমি বসে পরো। ব্যাথা পাবে।’

অভ্রের কথার বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলো দিলো না রিমি। নিজের জেদ বজায় রেখে সামনের ফাঁকা সিটে গিয়ে বসে পরলো। মন খারাপ করে জানালার বাহিরে তাকালো। মন খারাপের শহরে কালো মেঘ হানা দিলো। অভ্রের উপর অভিমান হলো। এই অভিমান সহজে ভাঙ্গার নয়।

নিরবে দাঁতে দাঁত পিষলো অভ্র। সাংঘাতিক রাগ হলো রিমির উপর। চলন্ত গাড়িতে এভাবে সিট পরিবর্তন করার কোনো মানে আছে? ভালো কিছু বুঝানো যায় না এই মেয়েকে। এখানে রাগ করার মতো কিছু বলেছিল সে? মেয়েটা দিন দিন বড় হওয়ার বদলে ছোট হচ্ছে। রিমির এই অহেতুক রাগের উপর গুরুত্ব দিলো না। নিরবে তপ্ত শ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিলো।
.
মনোযোগ রাস্তার দিকে থাকলেও নজর বারংবার লুকিং গ্লাসের দিকে আবরারের। হাস্যউজ্জ্বল দীবার মায়াবী মুখশ্রী যতোবার দেখে আবরার ; ঠিক ততবারই মুগ্ধ হয় সে। চোখে কালো সানগ্লাস পরে থাকায় গাড়ি চালানোর পাশাপাশি দীবাকে প্রখর করতে সুবিধে হলো। গোলগাল চেহারা, মিষ্টি হাসি, মসৃণ চুল, লাল লিপস্টিক সব মিলিয়ে আবরার আবারো নতুন করে দীবার প্রেমে পরতে বাধ্য হলো। ভাগ্যিস চট্টগ্রামে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে। নাহলে মায়াবিনীর সঙ্গে দেখা মিলতো আরো দেরিতে। আনমনে মুচকি হাসলো আবরার।

রাজিবের দেওয়া লোকেশন অনুযায়ী আগ্রাবাদ হালিশহর থানার সামনে গাড়ি থামালো আবরার। সাবিত আরিয়ান গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। নামলো না অভ্র। চুপচাপ নিজের জায়গায় বুকে দুই হাত গুঁজে বসে রইলো। এক মনে তাকিয়ে রইলো সামনের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা রিমির নিষ্পাপ মুখখানির দিকে। জানালা খোলা থাকায় শ্রাবণের হাওয়া রিমির উন্মুক্ত চুল উড়িয়ে দিচ্ছে। চোখেমুখে আনাগোনা চলছে ছোট ছোট চুল গুলোর। নিষ্পাপ মায়াবী মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো অভ্রের মন। ইচ্ছে আপাতত মনেই দমিয়ে রাখলো। তবে মন ভরে রিমি দেখার ইচ্ছে দমালো না অভ্র। এক মনে, এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো তার পাগলী টাকে।
.

রাজকে এমনিতেই সহ্য করতে পারে না আবরার। তাই তো আন্তরিকতা দেখাতে গাড়ি থেকে নামলো না। “আধিখ্যেতা” নামক শব্দটা তার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। তাই এবারো পাত্তা দিলো না। সাবিত নেমে যাবার পরে পিছু ফিরে তাকালো আবরার। দেখলো রাইমা চুপচাপ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। দীবা আর নুরা বসে কথা বলছে। রিমিকে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করলো দুজনকে, ‘রিমি কোথায়?’

নুরা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘ঘুমাচ্ছে।’

কপালে আপনাআপনি সূক্ষ্ম ভাজ পরলো আবরারের। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো একবার। মাত্র বিশ মিনিট সময় লেগেছে এখানে আসতে। এরই মাঝে ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা? কিছুটা উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলো, ‘এখন ঘুমাচ্ছে মানে? শরির ঠিক আছে রিমির? দেখতো একবার।’

নুরা সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘রিমি একদম ঠিক আছে। টেনশন নিও না। এমনিতেই ঘুমাচ্ছে।’

আবরার কিছু না বলে সামনে ফিরে তাকালো। অপেক্ষা করতে লাগলো সাবিত আসার। দীবার সাথে কথার ফাঁকেই নুরা গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই রাজের দিকে নজর গেলো। মুহূর্তই কয়েকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো তার। বুকের বাম পাশের হৃদযন্ত্রটা ঢিপঢিপ শব্দ তুলে দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো। নতুন করে ক্রাশ খেলো রাজের স্টাইলের উপর। পরনে কালো রঙের শার্ট। সিল্কি চুল গুলোতে এক হাত বুলাতে বুলাতে আরিয়ানের সাথে কথা বলে এগিয়ে আসছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙের সঙ্গে আজকের ডেস’আপ টা দারুণ মানিয়েছে। নতুন করে প্রেমে পরলো নুরা। মুগ্ধকর চোখে তাকিয়ে রইলো রাজের দিকে। ওরা কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো নুরা। লম্বা দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। রাজিব গাড়ির কাছে আসতেই নুরা হেসে বলে উঠলো, ‘আসসালামু আলাইকুম জিজু মশাই। কেমন আছেন?’

হাসলো রাজিব। সুন্দর করে সালামের উত্তর দিয়ে বললো, ‘এইতো ভালো। তোমরা কেমন আছো?’

দীবা আর নুরা মিষ্টি হেসে শুধাল, ‘আমরাও ভালো।’

রাইমা কথা বললো না। লজ্জায় নত হয়ে নিশ্চুপ বসে রইলো। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া রাইমার মুখ দেখে মৃদু হাসলো রাজিব। ফোনকলে তো সারাক্ষণ ননস্টপ কথা বলে মেয়েটা। আর সামনাসামনি দেখো? লজ্জায় একদম মাকালফল। ডাকলো না রাজিব। এড়িয়ে গেলো রাইমাকে। আপাতত রাস্তায় কথা বলার চেয়ে নিদিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবার পর বলা যাবে। আবরার আর অভ্রের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ শেষে গাড়িতে উঠে বসলো দুজন। রিমি এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাই তাকে কেউ জ্বালাতন করেনি।

আবরার এতোক্ষণ চুপচাপ তীক্ষ্ণ চোখে সামনে থাকা লুকিং গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মনে মনে দীবাকে দেওয়ার জন্য ভয়ংকর একটা শাস্তির কথা ভেবে রেখেছিলো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দীবা তার কথা-ই রেখেছে। রাজের সাথে কথা বলা তো দূর চোখ তুলেও তাকায় নি। তাই এই যাত্রায় মহা বিপদ থেকে নিজের অজান্তেই বেঁচে গেলো দীবা। খুশি হলো আবরার। ফুরফুরে মনে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ঘন কালো পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে জিপ গাড়িটি সু-সু শব্দ তুলে চলতে লাগলো।
_______________________

ফটিকছড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত একটি শহর। আয়াতনের দিক দিয়ে বিশাল হওয়ায় ফটিকছড়ি উপজেলা অল্পসময়ে ঘুরে শেষ করা একজন পর্যটকের জন্য কখনোই সম্ভব হবে না। দুই পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত ফটিকছড়ি ভূ-প্রাকৃতিক দিক দিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ। সিলেটের পাশাপাশি এই উপজেলার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যের কারণ হলো চা বাগান। দেশের মোট চায়ের ১০ শতাংশ চা উৎপাতন হয় ফটিকছড়ি চা বাগানে। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ফটিকছড়ির রাস্তাঘাট, গাছগাছালি ও পাহাড় অন্যতম।

পিচ ঢালা রাস্তা। গত কাল রাতের ভারি বর্ষণের কারণে রাস্তাঘাট বৃষ্টির পানিতে ভেজার পর এখনো চকচকে। চারপাশে সবুজের সমারোহ, নীল আকাশের নিচে সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি সঙ্গে উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। এই সবুজ গালিচাই হলো চা বাগান। এই অপরূপ সৌন্দর্য সচক্ষে উপভোগ্য। মন ছুঁয়ে যাবার মতো পরিবেশ। মুগ্ধ চোখে বাহিরে তাকিয়ে চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করছে সবাই। গাড়ির স্টেরিংয়ের পাশেই আইপড টা রাখা আছে। আইপডের লোকেশন অনুযায়ী সামনে আগাচ্ছে আবরার। ড্রাইভিং করার ফাঁকে ফাঁকে দীবাকে প্রখর করতে ভুলে নি সে। আজ কেন যেন দীবাকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে তার কাছে। তাই বারংবার দীবার দিকেই দৃষ্টি যাচ্ছে তার। ভাবতেই মৃদু হাসি ঠোঁটে ফুটে এলো ঠোঁটে।

অতঃপর, দীর্ঘ আড়াই ঘন্টার পথ অতিক্রম করে নিদিষ্ট গন্তব্যে এসে পৌঁছালো সবাই। বাড়ির কাছে গাড়ি থামাতেই বিশাল বড় লোহার গেইট খুলে দিলো দারোয়ান। ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে গাড়ি ঢুকালো আবরার। কয়েকজন অর্ধবয়স্ক লোক এসে স্বাগতম জানালো তাদের। ফটিকছড়ি উপজেলার রাস্তাঘাট ও পরিবেশ দেখে যতোটা না মুগ্ধ হয়েছে সবাই ; তার থেকেও দ্বিগুণ মুগ্ধ ও অবাক হয়েছে গাড়ি থেকে নেমে। পুরনো আমলের জমিদার বাড়ি। বাহির থেকে দেখতে তিনতলা। বাড়ির চারপাশের রঙ গুলো অযত্নের কারণে কিছুটা কালচে বর্ণ ধারন করেছে। বাড়ির সামনে রয়েছে হাজার রকমের ফুল গাছ। এতো সুন্দর পরিবেশ দেখে বিমুখিত সবাই। আবরার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘শুধুমাত্র বাড়ির রঙটা বদলেছে। বাকি সব ঠিক আছে।’

আরিয়ান পকেটে দুই হাত রেখে আশেপাশে দেখতে দেখতে বললো, ‘ লেঙ্গটা কালে এই বাড়িতে আসছিলাম ভাই। কিচ্ছু মনে নাই।’

উচ্চস্বরে হেসে উঠলো নুরা ও দীবা। দুজনের হাসির শব্দে বাকিরাও হেসে উঠলো। নুরা হাসতে হাসতে শুধাল, ‘নিজের প্রেস্টিজ নিজেই মা’র’ছো ভাই।’

রিমি নিশ্চুপ থেকে চারপাশ দেখছে। কারোর কথায় ধ্যান নেই তার। আপাতত পুরো বাড়িটা দেখতে ব্যস্ত। রাইমা বাড়ির সামনের বাগানে লাগানো ফুল গুলো দেখছে। জেসমিন ফুলে হাত বুলিয়ে একটা অপরাজিতা ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজতে গুঁজতে বললো, ‘আমি এসেছি কিনা জানি না।’

বাড়ির দুইজন অর্ধবয়স্ক লোক গাড়ি থেকে সবার ব্যাগ নামাচ্ছে। সাবিত তাদের সাহায্য করতে করতে রাইমার কথার প্রত্যুত্তর করলো, ‘তুই তখন একদম ছোট ছিলি।’

আবরার শৈশবের কথা মনে করলো। তখন সাবিত আরিয়ানের পাশাপাশি একটা বোনের শখ ছিলো তার। রাইমা যখন আয়েশার গর্ভে ছিলো তখনই আবরার পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেলতো তার ছোট একটা আদুরে বোন হবে বলে। হলোও তাই। শান্তি নিবাসে সর্বপ্রথম কন্যাসন্তান হিসেবে রাইমা আসে। আদরে আহ্লাদে বড় করে সবাই। রাইমা যখন গুটিগুটি পায়ের কদম ফেলে হাঁটার প্রচেষ্টা করে তখন শেষবারের জন্য এই বাড়িতে এসেছিলো সবাই। কারণ সাবিতের খালামনিরা সবাই ইউকে তে চলে যাবে একেবারের জন্য। পিচ্চি রাইমা এই বাড়িতে আসার পরেই সর্বপ্রথম আবরার ও সাবিতকে “ভাইয়া” বলে ডেকেছিলো। সেই স্মৃতি আজও আবরারের চোখে ভেসে উঠলো। রাইমার শৈশবের কথা মনে করে মৃদু হেসে বললো, ‘এই বাড়িতে এসে ফাস্ট ভাইয়া বলে ডেকেছিলি তুই। কি যে ভালো লেগেছিলো।’

সাবিত ব্যাগ গুলো মানিয়ে দিয়ে শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে রাইমার কাছে এসে বললো, ‘এতোটাই খুশি হয়েছিলাম যে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি চুরি করে এই এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের বিলিয়েছিলাম। যদিও তখন তারা আমাদের সমবয়সী ছিলো।’

প্রাণবন্ত হাসি দিলো আবরার। উল্লাসকর কন্ঠে সাবিতের কথার বাকি অংশ বলে উঠলো, ‘শুধু কি তাই? চুরি করার অপরাধে শাস্তিও পেয়েছিলাম দুজন।’

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো নুরা। দীবা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, ‘কি শাস্তি পেয়েছিলেন দুইজন? নিশ্চয় উঠবস করিয়েছিলো?’

আবরার কিছুটা গড়িমসি করে এক হাতে মাথা চুলকে বললো, ‘ওইতো অল্প করেছিলাম।’

শব্দ করে হেসে উঠলো দীবা। গোলগাল চেহারায় এই হাসির স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হলো আবরার। নিজেও স্মিতি হেসে উঠলো। সঙ্গে হাসলো অন্যরাও। সবার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এক মনে দীবার প্রাণোচ্ছল হাসি দেখছে রাজ। এই হাসির মায়াতেই পরেছিলো সে। এক হাসিই তাকে ভালোবাসার জালে ফাঁসিয়েছিলো। আজও মুক্তি মিললো না তার। মুক্তি চায় তার।
____________________

বাড়ির বাহিরের দেয়ালের রঙ বিবর্ণ ধারণ করলেও ভিতরের পরিবেশ টা সম্পূর্ণ আলাদা। পুরো বাড়িটা সৌখিনতায় ভরপুর। পুরনো আমলের জমিদার বাড়ি। তাই সাজসজ্জায় রয়েছে রাজকীয় আমেজ। বাহিরের আঙ্গিনা দেখে যতোটা অবাক হয়েছে, তার থেকেও দ্বিগুণ অবাক হয়েছে ভিতরটা দেখে। আগ্রাবাদ থেকে রওনা দিয়েছিলো বিকেলে তাই ফটিকছড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাবার পর কোমল পানীয় দিয়ে প্রথমে আপ্যায়ন করলো সবাইকে। তারপর তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে নিয়ে গেলো। যেহেতু বাড়িটা বিশাল বড় সেহেতু থাকার জন্য রুম রয়েছে পর্যাপ্ত। প্রত্যেকটা রুমই থাকার উপযোগী। বাড়ির মালিকরা না থাকলেও কর্মচারীর মাধ্যমে সুন্দর পরিপাটি করে রেখেছে সব। বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মাঝে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো কে কার সঙ্গে রুম শেয়ার করবে কিংবা একা রুমে থাকবে। আবরার কখনো রুম শেয়ারে কমফোর্টেবল ফিল করে না। তাই সে একা থাকবে। আরিয়ানের সঙ্গে অভ্রের বন্ধুত্ব জমেছে বেশ। তাই তারা দুজন এক সঙ্গে মাস্তি করবে ভাবলো। সাবিত কিছুই বললো না। তাই রাজিব নিজে থেকে সাবিতের সঙ্গে থাকবে জানালো। রইলো একা রাজ! সে একাই রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। বাকি রইলো মেয়েরা। রিমি, নুরা ও দীবা তো কখনোই আলাদা থাকবে না। তিন জন একইসঙ্গে থেকে জমিয়ে আড্ডা দিবে প্রথম থেকেই ভেবে রেখেছে। রাইমা একা থাকার কথা প্রথমেই জানিয়েছিলো। আলোচনা শেষে সবাই নিজেদের পছন্দ মোতাবেক রুম সিলেক্ট করলো। জার্নি করায় সবাই টায়ার্ড। তাই সন্ধ্যার পর খাবার খেয়ে যে যার রুমে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পরলো।

চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৭]

রাতের ঘড়ির কাটা সাড়ে নয় টার ঘরে। এই অল্প সময়েও চারপাশ একদম নিরব নিস্তর। রাত্রীর ঘন কালো ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারপাশ আচ্ছন্ন। বাড়ির পাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের অমৃসণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে। বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বসে আছে রিমি, নুরা ও দীবা। সামনে ল্যাপটপে “Choose or die” সাসপেন্স থ্রিলার মুভি চলছে। তিনজনই পাশাপাশি বসে অধিক আগ্রহ নিয়ে দেখছে। একের পর এক টুইস্ট দেখে নুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাইমা এক্সাইটেড নেক্সট কি হবে ভেবে। আর এতো এতো টুইস্ট দীবার মাথায় তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। তবুও আগ্রহ প্রবল তার। তখুনি দরজায় ধাক্কা পরার শব্দ কানে আসলো তিনজনের। রিমি দীবাকে চোখের ইশারা দিলো দরজা খোলার জন্য। দীবা কিছু দেখেনি কিছু শুনেনি একটা ভাব নিয়ে বিছানার পাশে থাকা ছোট কেবিনেটের উপর থেকে বোতল হাতে নিলো পানি খাওয়ার জন্য। তার ভাবলেশহীন ভাব দেখে বিরক্ত হলো রিমি। নুরার দিকে তাকাতেই দেখলো নুরা মোবাইল নিয়ে মহা ব্যস্ত। অবশেষে দুইজনের উপর চরম বিরক্ত হয়ে কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে বিছানায় রাখলো। গটগট পায়ের কদম ফেলে দরজার কাছে যেতে যেতে প্রশ্ন করলো, ‘কে রে ভাই? এতো রাতে এখানে কি?’

বাহির থেকে আবরারের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘আমি।’

চিনতে পারার পরেও দীবা না চেনার ভান করে গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে উঠলো, ‘আমি টা কে? নাম টাম নাই নাকি?’

দীবার কন্ঠ শুনে আলতোভাবে হাসলো আবরার। বাঁকা হেসে প্রত্যুত্তর করলো, ‘দীবার জামাই আবরার জুহায়ের।’

মাত্রই বোতল থেকে পানি খাওয়ার জন্য মুখে ঢেলেছিল দীবা। আবরারের প্রত্যুত্তর শুনে বিষম খেলো দীবা। খুকখুক করে কেশে উঠলো। রিমি ও নুরা ঠোঁট চেপে হাসলো। রিমি দরজা খুলে দেবার পর আবরার ভিতরে এসে দেখলো দীবার চোখমুখ লাল করে হয়ে আছে। হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে অস্থির হলো আবরার। দ্রুত দীবার কাছে এগিয়ে এসে ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কি হয়েছে তোমার? চোখমুখ এমন লাল হলো কিভাবে?’

বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করলো দীবা। তবুও অতিরিক্ত কাশির জন্য হাঁপিয়ে উঠেছে সে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে অপ্রসন্ন চোখে আবরারের দিকে তাকালো দীবা। কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘অসভ্য লোক।’

আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো, ‘অসভ্যের মতো আবার কি করলাম?’

দৃষ্টি সরিয়ে অন্যত্র তাকালো দীবা। পানির বোতলটা কেবিনেটের উপরে রেখে দিলো। বাহিরের আকাশে কালো মেঘের ছায়া স্পষ্ট। রাত্রী হওয়ায় পরিবেশ শীতল। হালকা শীত শীত আমেজ চারপাশে। শুয়ে পরার জন্য বিছানায় হেলান দিতেই তার হাত টেনে ধরলো আবরার। বাধা দিয়ে বলে উঠলো, ‘এখানে না উঠো!’

বিস্মিত হলো দীবা, ‘এখানে না মানে? ঘুমাবো কোথায় আমি? আশ্চর্য!’

আবরার দীবার হাত ধরে রুমের বাহিরে যেতে যেতে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আমার রুমে ঘুমাবে।’

হতবাক হয়ে গেলো দীবা। বলে কি এই অ’সভ্য লোক? ঘুরতে এসেও এক সাথে? আবরারের রুমে যাবার ইচ্ছে নেই তার। তাই নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত মুচড়াতে লাগলো দীবা। আবরার আরো শক্ত করে ধরলো তার হাত। পুরো রাতের পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো আবরার। রিমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে। দীবাকে নিয়ে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো নুরা, ‘আরব ভাই দীবা থাক না এখানে। ওকে নিতে হবে কেন?’

আবরার ভাবলেশহীন ভাবে শুধালো, ‘কারণ বউ ছাড়া আমার ঘুম আসে না।’

দুইজনের উষ্ঠধয়ে কিঞ্চিৎ দূরত্ব তৈরি হলো আপনাআপনি। ফ্যালফ্যাল চোখে আবরারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর দুইজনে একইসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠলো।
_____________________

আবরারের রুমের সামনে যাবার পর দীবা তার হাত ঝামটা মে:রে ছাড়িয়ে নিলো। আবরারের দিকে রাগী রাগী লুক দিয়ে কটমট করে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি আপনার?’
স্মিতি হাসলো আবরার। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে জবাব দিলো, ‘তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না। এটাই তো একমাত্র সমস্যা। সমাধান দিবে?’

শেষের কথাটা দীবার দিকে ঝুকে এসে বললো আবরার। দীবা চোখ তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে আবরারের বুকে মৃদু ধা:ক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর গটগট পায়ের কদম ফেলে আবরারের রুমে চলে গেলো। দীবার রাগী চেহারা দেখে হেসে উঠলো আবরার। এক হাতে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। রুমের পাশে থাকা বড় জানালার কাছে থাকা বেতের মোড়ার উপর বসলো দীবা। রাগের কারণে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। চুপচাপ নাক ফুলিয়ে ফুঁশছে সে। আবরার তার এই অবস্থা দেখে ঠোঁট গোল করে শিশ বাজাতে বাজাতে বিছানায় বসলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আপন মনে ফেসবুক স্ক্রোল করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আবরারের সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য হয়ে উঠলো দীবা। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে মোবাইল টিপছেন আপনি? আমি কি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো?’

মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে দীবার দিকে তাকালো আবরার। মোবাইলটা বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের শার্টটের কলার ঠিক করতে করতে বললো, ‘তাহলে আসো টাইম ওয়েস্ট না করে বাসর টা সেরে ফেলি।’

চোখ দুটো ছানাবড়া করে তাকালো দীবা। হকচকিয়ে যাওয়া কন্ঠে শুধাল, ‘আপনার মুখে এই শব্দটা ছাড়া আর কিছুই নেই।’

অল্প শব্দে হাসলো আবরার। দীবা চোখমুখ কালো করে অন্যদিকে তাকালো। আবরার এগিয়ে এসে দীবাকে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ লুকালো। মৃদু কন্ঠে বললো, ‘আগে কেন আমার জীবনে আসো নি তুমি?’

আলতোভাবে লাজুক হাসলো দীবা।আবেশে চোখ বন্ধ করে বললো, ‘আগে আসলে কি হতো?’

দীবাকে নিজের দিকে ঘুরালো আবরার। মুখের সামনে পরে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আদুরে গলায় বললো, ‘আরো বেশি ভালোবাসতে পারতাম।’
_____________________

রাত যতো গভীর হলো চারপাশে পিনপতন নিরবতা বাড়তে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গা ছমছম করার মতো ভয়ংকর অনুভূতি হয়। জানালা দিয়ে সু-সু শব্দ তুলে শীতল বাতাস ভেসে আসছে। শরিরের পশম কাটা দিয়ে উঠলো নুরার। কাঁপুনি দিয়ে উঠলো শরির। পরনে শুধুমাত্র সাদা টপ শার্ট। তাই শীতল বাতাসের ঠান্ডা অনুভব হতেই শীত লাগলো তার। তবুও টেবিল চেয়ার থেকে উঠলো না নুরা। চিরকুট টা লিখা শেষ হয়নি। তাই এক বসাতেই লিখে শেষ করে কলমটা পাশে রাখলো। হলুদ রঙের চিরকুট টা হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ লিখাটা নতুন করে পড়লো। নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই হলুদ রঙের চিরকুট টা দেখে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। তখুনি আকাশে বৃহৎ শব্দ তুলে মেঘগর্জন দিয়ে উঠলো। ইষৎ কেঁপে উঠলো নুরা। তুফানের মতো বাতাস তুমুল বেগে ছুটছে। জানালা খোলা থাকায় শীতল বাতাস রুমে প্রবেশ করছে। নুরা জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে বিছানায় তাকালো। দেখলো রিমি গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। চিরকুট টা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো নুরা। জানালা কাছে এসে পর্দা টেনে ধরলো। ভুলবশত হাত থেকে ছোট চিরকুট টা বাতাসে উড়ে বাড়ির নিচে পরে গেছে । হতবাক হয়ে গেলো নুরা। জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখলো চিরকুট টা ঘাসের উপর পরে আছে। বাতাসের বেগ অতিরিক্ত। যেকোনো মুহূর্তে কাগজ টা উড়িয়ে নিতে পারে। কিন্তু নুরা এটা হারাতে চায় না। তাই বিলম্ব না করে দ্রুত পা চালিয়ে দৌড়ে বাড়ির নিচে আসলো। চারপাশ নিঝুম অন্ধকার। বাড়ির ভিতরের আলোতে বাড়ির সামনের আঙ্গিনা আলোকিত। আঙ্গিনায় মাটির ছোঁয়া নেই। কারণ পুরো খালি জায়গা জুড়ে রয়েছে কেবল ঘাস। আবছায়া অন্ধকারে চিরকুট টা খুঁজবে কিভাবে? আসার আগে লাইট টাও আনতে ভুলে গেছে। বাতাসে উড়ে কোথায় পরেছে কে জানে। চিন্তিত হলো নুরা। ঠোঁট কামড়ে খুঁজতে লাগলো আশেপাশে।

বাতাসের শব্দ, অন্ধকার পরিবেশ। ভয়ে নুরার বুক ধড়ফড় করছে। তবুও চিরকুট ফেলে রেখে মন চাইছে না তার। ভয়ার্ত চোখেমুখে চিরকুট খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হঠাৎ-ই থমকে গেলো নুরা। নিজের পিছনে কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে অসাড় হয়ে এলো তার শরির। নিশ্বাস ভারি হয়ে গেলো তার। ধীরে ধীরে পিছু ফিরে তাকাতেই ভড়কে গেলো। রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকে এক হাত রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো নুরা।

রাজ তীক্ষ্ণ চোখে নুরার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখখানি কাটকাট কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘এতো রাতে এখানে কি করছো?’

রাজের গম্ভীর চেহারা ও কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ার্ত হলো নুরা। কোনো মতে ঠোঁট নাড়িয়ে মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো, ‘এমনি এসেছি।’

উত্তর টা নিজের পছন্দ মোতাবেক না হওয়ায় সন্তুষ্ট হলো না রাজ। তাই আরো গম্ভীর হলো মুখ। রাগটাও বাড়লো বেশ। তবুও নিজেকে শান্ত রাখলো। রাগ যথেষ্ট সংযত রেখে বললো, ‘রুমে যাও।’

নুরা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা একপাশ কাত করে সম্মতি দিলো। পিছু ফিরে আবারো চারপাশে একবার চোখ বুলালো। চিরকুট টা না পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো। ক্ষুন্ন মনে চুপচাপ বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। নুরা চলে যাবার পর রাজ নিজেও চলে যেতে পা বাড়াতেই দাঁড়িয়ে পরলো। দেয়ালের একদম চিপায় একটা হলুদ রঙের কাগজ দেখে সেটা হাতে নিলো। চিরকুট টা পড়ে ভ্রুঁ জোড়া কুচকালো তাৎক্ষনাৎ। হাতের লিখাটা দেখে অনায়াসে বুঝে গেলো এটা নুরার হাতের লিখা। এটাই নুরা খুঁজছিলো এতোক্ষণ? কিন্তু লিখাটা? আবারো পড়লো চিরকুট টা। বিস্মিত হলো বেশ। নুরা কাউকে ভালোবাসে? অপ্রকাশিত ভালোবাসা? তারই মতো। স্মিতি হাসলো কেবল।

Dear Astrology,

You are as beautiful as the night sky. Sight is as perfect as the stars. I will always watch you from afar. You will never know how much I love you. If the time comes, I will reveal my hidden love. But I’m afraid. Will you really accept my love? Or neglect? I don’t know if I’ll get you. But I want you. I really want you from my heart.

The end
Someone.

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৮]

স্নিগ্ধ ভোরের আলো মিটমিট করে ফুটছে। কাঠের বিশালাকৃতি জানালা দিয়ে দূরের ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সবুজের অরণ্যে মেঘের হাতছানি। চারিদিকে সারি সারি পাহাড় আর মাঝে মাঝে সাদা তুলোর মত মেঘমালা উড়ে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে শীতল বাতাস। চোখ দুটো বন্ধ করে এক টানে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো দীবা। আবারো চোখ খোলে সামনে তাকিয়ে দূর দূরান্তের ছোট-বড় পাহাড় ও টিলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। চারদিকে সবুজ চা বাগানের রূপ সূর্যোদয়ের পাশাপাশি ফুটে উঠছে। সব কিছুই মুগ্ধকর চোখেমুখে অবলোকন করছে দীবা। পরনে শুধু আবরারের সাদা একটা শার্ট যা দীবার হাঁটু পর্যন্ত। শার্টের গলা বড় হওয়ায় কাধের এক পাশে পরে উন্মুক্ত হয়ে আছে উজ্জ্বল ফরশা গলা। তাই শীতল বাতাসের কারণে গায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে তার। নিজের দুই হাত বুকে গুঁজে শীত কমানোর প্রয়াস করছে সে। বেশ কিছুক্ষণ পর পিছন থেকে আবরার নিজের গায়ের চাদড় দিয়ে দীবাকে জড়িয়ে ধরলো। কোমড় জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রেখে বাহিরে তাকালো আবরার। দীবার ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখে বললো, ‘এখানের ভিউ টা সুন্দর না?’

আবরার দীবার গালে নিজের নাক ঘেঁষে কোমলায়ন কন্ঠে শুধাল, ‘হুম। কিন্তু তার থেকেও তুমি বেশি সুন্দর।’

মৃদু শব্দ তুলে হেসে উঠলো দীবা। আবরার দীবাকে তার দিকে ঘুরালো। দীবার কপালে আলতোভাবে চুমু খেয়ে নরম গলায় বললো, ‘রাতটা আমার জন্য অনেক স্পেশাল ছিল।’

লজ্জাভূতি হলো দীবা। গাল লাল হয়ে এলো তার।ঠোঁটে ঠোঁটে চেঁপে মাথা নত করে ফেললো। আবরার এগিয়ে এসে আরেকটু নিবিড় হলো দীবার সাথে। এক হাত কোমড়ে জড়িয়ে অপর হাত দীবার গালের পাশে গলায় রেখে আবারো বললো, ‘তুমি, তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার জন্য স্পেশাল। আমি আমার প্রতিটা সকাল তোমার সঙ্গে শুরু করতে চাই। দিনের শুরু থেকে শেষ অব্দি তোমাকে পাশে পেতে চাই। তুমি আমার রক্তের সাথে মিশে গেছো দীবা। তোমাকে ছাড়া থাকা কখনোই সম্ভব না। তুমি চলে গেলে আমি ম’রে….”

কথাটা সম্পূর্ণ হতে দিলো না দীবা। তার আগেই এক হাতে আবরারের মুখ ধরে থামিয়ে ফেললো। শেষার্ধ কথাটা উপলব্ধি করতে পেরেই হৃদপিন্ড কেঁপে উঠেছে তার। নিশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে তাৎক্ষনাৎ। পরিচয় অল্প সময়ের হলেও সারাজীবনের পথচলা একইসঙ্গে। এই অল্পসময়েই আবরারকে নিজের মনে জায়গা করে দিয়েছে দীবা। এখন আবরারকে ছাড়া তার নিজের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব না। তাই ভয় এসে হানা দিল মনে। কাঁপা কাঁপা দুই হাতে আবরারের দুই গাল স্পর্শ করলো দীবা। মাথাটা একটু এগিয়ে আবরারের উষ্ঠধয়ে নিজের উষ্ঠধয় ছোঁয়াল। গভীর ভাবে একটা চুমু খেয়ে মৃদু গলায় আশ্বাস দিয়ে শুধাল, ‘আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না।’

আবরার মৃদু গলায় পূর্ণরায় জানতে চাইলো, ‘সত্যি?’

দীবা মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বুঝালো। তার উত্তর শুনে খুশি হলো আবরার। নিস্প্রভ চেহারায় শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয়ে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে এলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে দীবাকে কোলে তুলে নিলো। হকচকিয়ে গেলো দীবা। পরে যাবার ভয়ে আবরারের গলা দুই হাতে শক্ত করে ধরলো। মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো, ‘কোলে নিয়েছেন কেন? পরে যাবো প্লিজ নামান।’

নামালো না আবরার। দীবাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দীবার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো, ‘ফিল সামথিং স্পেশাল!’
_____________________

স্নিগ্ধ ভোরের আলো চোখে পরতেই পিটপিট করে তাকালো রিমি। ঘুমটা বেশ ভালো হয়েছে। গতকাল রাতে মাথাটা একটু ঝিমঝিম করেছিলো। পুরো রাতে আড়ামে ঘুমানোর কারণে মাথাটা এখন হালকা লাগছে। আড়মোড় ভেঙ্গে জানালার দিকে তাকালো। বিছানায় শুয়ে থেকেই কাঠের জানালা দিয়ে বাহিরের অপরূপ পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। স্মিতি হাসলো রিমি। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল বের করলো। হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন দেখে চেক করে দেখলো অভ্র বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছে। গতকাল রাতে অভ্র আর আরিয়ান মিলে বারান্দায় বসে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে। সঙ্গে ছিলো গিটার। ওই মুহূর্তে কয়েকটা ছবি তুলেছিলো যা রিমির হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে। সব গুলো ছবিই দেখলো রিমি। ছবি গুলোর মাঝে অভ্রের একটা সিঙ্গেল ছবি যেখানে অভ্র গিটার হাতে নিয়ে প্রাণোচ্ছল হাসি দিয়ে তুলেছে। ছবিটা সেভ করে নিলো রিমি। সর্বশেষে একটা ছবি দেখলো। সেটা অর্ধগোলকাকৃতি চাঁদের ছবি। ছবিটা দিয়েই অভ্র ম্যাসেজে লিখেছে,

“আজকের চাঁদের থেকেও অধিক সুন্দর আমার প্রেমিকা। তাকে এখন বড্ড মিস করছি।’

ম্যাসেজটা দেখে মুচকি হাসলো রিমি। মোবাইলটা পাশে রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকালো এক দৃষ্টিতে। ভাবলো অভ্রকে নিয়ে। অভ্র তাকে প্রেমিকা বলে সম্মোধন করলো? ভাবতেই ভালোলাগা কাজ করলো মনে। উফফ! লোকটা এতো কিউট কেন? একবার দেখলে চোখ ফিরাতে ইচ্ছে করে না। আচ্ছা অন্য মেয়েরাও তার মতো অভ্রের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে? ক্রাশ খায়? প্রশ্ন দুটো তার মাথায় আসতেই ধড়ফড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো রিমি। সে এভাবে উঠায় নুরার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। তাই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে সাদা কাথাটার ভিতরে গিয়ে বললো নুরা, ‘উফফ রিমোটের বাচ্চা নড়াচড়া করবি না।’

হতভম্ব রিমি। অভ্রের দিকে অন্য মেয়েরা তাকায়? ভাবতেই কেমন হিংসে হলো তার। রাগ হলো প্রচুর। অস্থির মনে নুরাকে ঠেলে উঠাতে চাইলো, ‘এই নুরা? নুরা? উঠ না।’

নুরা প্রথমে উঠতে চাইলো না। কাথা দিয়ে মুখ ঢাকতে চাইলে রিমি আবারো টেনে ধরে ডাকলো। অবশেষে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত বিরক্তিকর চোখেমুখে শুয়া থেকে উঠে বসলো নুরা। বসেই রিমির হাতটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বললো, ‘কি হইছে? ভ্যা ভ্যা করতেছোস কেন?’

রিমি অধীক আগ্রহ নিয়ে অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘সাপোজ তোর বফের দিকে কেউ তাকায়। তাকায় মানে ক্রাশ টাশ সব খায়। তাহলে কি করবি তুই?’

অসন্তুষ্টির চোখে রিমির দিকে তাকালো নুরা। মারাত্মক লেভেলের রাগের কারণে দাঁতে দাঁত পিষে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, ‘এই বা/লের প্রশ্নের লাইজ্ঞা আমারে ডাইকা তুলছোস? তোর বুদ্ধি কি বাথটাবের ডুইবা ম:র:ছে? আজাইরা কথাবার্তা কই খুঁইজা পাস তুই?’

নুরার রাগের প্রতি গুরুত্ব দিলো না রিমি। নিজের প্রশ্নের উত্তরের আশায় তাড়া দিয়ে বললো, ‘বল না তখন কি করতি?’

নুরা বালিশ ঠিক করতে করতে রাগি গলায় উত্তর দিলো, ‘কি আর করতাম? হয় মাইয়া গুলার চুল ছিঁ:ড়:তাম। নাহয় সুন্দর হওয়ার অপরাধে বফরে ঝা:ড়তাম।’

কথাটা বলেই লম্বা হাই তুলে ধপাস করে শুয়ে পরলো নুরা। রিমি কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নুরার কথাটা ভাবলো। তারপর কি থেকে কি মনে পরতেই চটজলদি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। গলায় ফ্লাস্ক পেঁচিয়ে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। রিমি রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার আভাস পেতেই তাৎক্ষনাৎ চোখ খুলে তাকালো নুরা। সজাগ হলো তার ঘুমন্ত মস্তিষ্ক। বিস্মিত হয়ে উঠে বসলো তাৎক্ষনাৎ। মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো। হঠাৎ-ই ঘুম থেকে উঠে তাকে এমন প্রশ্ন করলো কেন রিমি? বফের দিকে অন্য কেউ তাকালে তার কি? ভাবতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো নুরার। রিমির বফ আছে? বসে থাকলো না তার মন। রিমি কোথায় গেলো জানার জন্য দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পরলো। তাড়াহুড়ো করার কারণে গলায় ফ্লাস্ক পরতে ভুলে গেছে। পরনে সাদা টপ শার্টটা পরেই দ্রুততার সঙ্গে পা বাড়ালো রুমের বাহিরে।

অভ্র আর আরিয়ানের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো রিমি। দৌড়ে আসায় হাঁপিয়ে উঠেছে সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজায় টোকা দিলো একটা। সাড়া না পেয়ে আরো কয়েকবার টোকা দিলো। ভিতর থেকে কোনো প্রকাশ শব্দ না পেয়ে দরজা ধা:ক্কা দিতেই খোলে গেলো। দরজা খুলতেই দেরি করলো না রিমি। গটগট পায়ে ভিতরে ঢুকে পুরো রুম, ওয়াশরুমে তাল্লাসি লাগালো অভ্রের। অভ্রের বোধহয় আজ ভাগ্যটা ভালো ছিলো। তাই ভোর হতে না হতেই আরিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। যদি না বাহিরের যাবার প্ল্যান করতো, তাহলে রিমির রা:গ ঝা:ড়া চুপচাপ সহ্য করতো।

রিমির পিছনে পিছনে দৌড়ে আসায় নুরা নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছে। কোমড়ে দুই হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো, ‘এখানে আসছোস কেন?’

রিমি আশেপাশে দেখে নুরার দিকে তাকিয়ে রাগে কপাল কুঁচকে বললো, ‘রুম ফাঁকা কেন? অভ্র আরু ভাই কোথায়?’

‘আশ্চর্য! তুইও ঘুমিয়ে ছিলি আমিও ছিলাম। তুই জানিস না তো আমি কিভাবে জানবো? আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? দুইজন তো এমনিতেই সারাদিন ঘুরেবেড়ায়। তো কি হয়েছে?’

‘তুই বুঝবি না।’ বলে নুরার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো রিমি। আহাম্মক হয়ে গেলো নুরা। ভ্যাবলার মতো রিমির চলে যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রিমির এমন অদ্ভুত আচরণের কারণে কি? বিশ্লেষণ করতে হবে। আগে দীবা আসুক তারপর। তাই ব্যাপার টা নিয়ে ঘাঁটালো না সে। কিন্তু রিমির উপর থেকে নজর সড়াবে না। কখনোই না।
_____________________

সকালের নাস্তার সময় অদ্ভুত এক কান্ড ঘটলো বাড়িতে। সবাই যা আশা করেছিলো তার থেকেও বেশি বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটালো বাড়ির কর্মচারী সকলে। রাজকীয় আমেজের বিশালাকৃতির বাড়ির ভিতরে ঢুকার পর কম বেশি সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে। তাই বাড়ির ভিতরে থাকা মার্ভেল পাথরের বিশাল বড় ডাইনিং টেবিলটা কারোর নজরে এড়ালো না। টেবিলটা এতোই বড় যে এখানে কমপক্ষে বিশ থেকে পঁচিশজন লোক এক সঙ্গে খেতে পারবে। কিন্তু এতো বড় টেবিল থাকতে সকালের নাস্তা কিনা সবার রুমে রুমে দিয়ে গেলো তারা? বিস্মিত হলেও কেউ প্রকাশ করলো না। সবার রুমে নাস্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব কর্মচারী আনিসুরের কাধে পরলো। দায়িত্ব মোতাবেক সকলের রুমে নাস্তা পৌঁছে দেবার পর সর্বশেষে আবরারের রুমে সামনে আসলো। ভদ্র ভাবে রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়ালো। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর আবরার রুমের দরজা খুললো। খয়ের দিয়ে পান খাওয়ার ফলে লাল হয়ে যাওয়া বিদঘুটে দাঁত বের করে হাসলো আনিসুর মিয়া। বয়স বোধহয় পঞ্চাশের উর্ধ্বে। তার এই বিদঘুটে হাসি আবরার পছন্দ না করলেও ভদ্রতার খাতিরে নিজেও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। আনিসুর মিয়া হাতে থাকা নাস্তার ট্রে টা দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাজান। এই নেন আপনের নাস্তা।’

আবরার লোকটার থেকে চোখ সরিয়ে নাস্তার ট্রে-টার দিকে দৃষ্টি রাখলো। মনে মনে খুশি হলো এই ভেবে যে দীবার সঙ্গে একসাথে নাস্তা করতে পারবে। পারসোনাল ভাবে আরো সময় কাটাতে পারবে। তাই মৌনতার সঙ্গে ঠোঁটে নম্র হাসি রেখে ট্রে টা ধরলো। লোকটা সালাম দিয়ে চলে যেতে নিলেই রুমের ভিতরে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার এমন চাহনী দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো আবরার। চোখের চাহনী ফলো করে নিজেও পিছু ফিরে তাকালো।

মাত্রই ওয়াশরুম থেকে গোসল করে চুল মুছতে মুছতে বেড়িয়েছে দীবা। লোকটাকে তার দিকে এভাবে তাকাতে দেখে ভড়কে গেলো। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল। আনিসুর মিয়ার এমন রিয়েকশনের কারণ বুঝতে বাকি আবরারের। তাই স্বাভাবিক রইলো। আনিসুর মিয়া প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘এই মাইয়া আফনের ঘরে কি করতাছে? হায় আল্লাহ। এই গুলা কি নাউজুবিল্লা কাম কারবার। ছিঃ বিয়ার আগে!’

বলেই নাক কুঁচকালো আনিসুর মিয়া। তার থেকে এমন কুৎসিত কথাবার্তা শুনে রাগান্বিত হলো আবরার। চোয়াল শক্ত করে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আমার বউ লাগে চাচা। সাবধানে কথা বলবেন।’

এবার যেন অবাকের চড়ম পর্যায়ে চলে গেছে আনিসুর। আবরারের কথা শুনে তার মাথায় ডাব পরেছে এমন একটা রিয়েকশন দিলো। ফ্যালফ্যাল করে আবরারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আফনে কবে বিয়া করছেন? আমি আপনের মেলা গান হুনছি। কিন্তু বিয়ার খবর পাইলাম না ক্যান?’

আবরার নিরবে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘নাস্তা দিয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনি এখন আসতে পারেন।’

বলেই দরজা টা লাগিয়ে দিলো। দীবা এখনো আহাম্মকের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আবরার অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নাস্তার প্লেট বিছানায় রেখে দীবাকে প্রশ্ন করলো, ‘গোসল শেষ?’

দীবা মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বুঝালো। আবরার নাস্তার দিকে ইশারা করে বললো, ‘খেয়ে নাও।’ বলে ওয়াশরুমে গেলো গোসল করতে। দীবা একবার নাস্তার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালো। লোকটাকে ছাড়া সে একা একা খাবে? আবরার আসলেই নাহয় এক সাথে নাস্তা করবে। তাই আগে নিজেকে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলো। ভিজা চুল গুলো আবরারের টাওয়াল দিয়ে মুছতে লাগলো।

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here