#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩
®মেহরুমা নূর
★ছুটির দিন আজ। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে আদিত্য। সকাল সকাল বৃষ্টি নামায় ঘুমটা ভালো হয়েছে তার৷ বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠল আদিত্য। খালি গায়ে, পড়নে শুধু টাউজার। কেবিনেটের উপর সার্ভেন্ট কফি রেখে গেছে। ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে ব্যালকনির থাইগ্লাস খুলে সামনে পা বাড়াল আদিত্য। বৃষ্টি হচ্ছে এখনো মুষলধারে।সটান হয়ে দাঁড়িয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে রইলো সম্মুখের বৃষ্টি পানে। যদিও এই আদিত্যর মাঝে কোনো আলাদা অনুভূতি জাগায় না৷ জাগাবে কি করে! সেতো অনুভূতির দুয়ারই বন্ধ করে রেখেছে। কোনো মোহ মায়াতে তার মন ভোলে না। তবে সে নিজের অবস্থান খুব বেশি সময় টিকিয়ে রাখতে পারলোনা। হঠাৎ তার নজর পড়ল নিচে। আর সেই নজর পড়াটাই যেন তার সর্বনাশের সূচনা করল। নিচে লনে বৃষ্টিতে আপন মনে ভিজছে নূর। বৃষ্টির পানিতে লাফিয়ে নেচে নেচে ভিজতে মগ্ন সে।মুখটা আকাশের দিকে করে, দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে মনের আনন্দে সিক্ত হচ্ছে। মন আনন্দের হাসি তার বৃষ্টি ভেজা চোখে মুখে। লাফিয়ে লাফিয়ে ভেজায় পায়ের নিচটাতে কাদাও লেগে গেছে অনেক টা। তাতেও যেন আনন্দের শেষ নেই তার। আদিত্যর দৃষ্টিতে হঠাৎ আশেপাশের বাকিসব ধোঁয়াশা হয়ে গেল সহসাই। দৃষ্টিসীমার মাঝে কেবলই আবদ্ধ হলো শুধু নূর। ওই বৃষ্টি ভেজা মেয়েটা যেন প্রকৃতিরই আরেক রুপ। যেন এই বৃষ্টিময় প্রকৃতিরই পরম সখি সে। আদিত্যর হৃদ দুয়ারে অনুভূতির এক দমকা হাওয়া প্রবল বেগে ধাক্কা দিলো যেন। যার তোড়ে আদিত্যর নিজেকে টিকিয়ে রাখা বড্ড দুর্বোধ্য হয়ে গেল । বেসামাল হয়ে পড়ল তার হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ। মুগ্ধতার অতলে ডুবে থাকা আদিত্য টেরও পেলনা কখন তার হাত থেকে কফির মগটা হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল। নিচে পড়ে গরম কফি খানিকটা আদিত্যর পায়েও ছিটে পড়ল। সেটাও বিন্দুমাত্র অনুভব হলোনা এমুহূর্তে তার। তার সকল ইন্দ্রিয় যেন এমুহূর্তে শুধু ওই একজন ব্যাক্তিকে ঘিরেই কাজ করছে। অন্য কোনো কিছু তাকে ছুঁতে পারছেনা এমুহূর্তে। ওই হাস্যজ্বল, মায়াবী,নিস্পাপ, প্রকৃতি কন্যার আবহ আদিত্যর মনে জমা শতবর্ষের কালো মেঘ সরিয়ে দিয়ে সেখানে সোনালী আলোয় আলোকিত করে দিচ্ছে যেন। এই অতি সাধারণ বৃষ্টি আজ তার কাছে অসাধারণ প্রশান্তি সৃষ্টি করছে। এমনটাতো তার আগে কখনো হয়নি! তবে আজ এ কোন বৃষ্টি নামল তার মরুময় ভুবনে!
নূরের বৃষ্টিবিলাসের মুগ্ধতায় মুগ্ধ হচ্ছিল আদিত্য। তবে হঠাৎই তার নজর তীক্ষ্ণ হয়। তার চোখে পড়ে গেটের কাছে থাকা গার্ডগুলোর উপর। সেখান থেকে নূরকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজায় নূরের শরীরের জামাটা লেপ্টে আছে। যদিও গার্ডগুলো নূরের দিকে তাকাচ্ছে কিনা তা বৃষ্টির মাঝে বোঝা যাচ্ছে না। তবে তাদের চোখের সামনে নূর এভাবে ভিজছে এটাই যেন আদিত্যর চোয়াল আর হাতের মুঠো তীব্র শক্ত করে দিলো। মুখমন্ডল হলো ক্রোধে কঠিন। চোয়াল ফুলিয়ে দ্রুত পায়ে রুমের বাইরে বেড়িয়ে গেল সে।প্রচন্ড বেগে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে সোজা বাইরে বৃষ্টির মাঝে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে একবার নূরের তাকালো, তারপর গার্ড গুলোর দিকে তাকালো। ওদের মাঝে একটা গার্ড নূরের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। এই শীতল বৃষ্টির মাঝেও যেন আদিত্যর র,ক্তনালী টগবগিয়ে ফেটে পড়ল। চোখে ঢেলে পড়ল র,ক্তিম দাবানল। দাঁতে দাঁত পিষে আদিত্য ছুটে গেল নূরের দিকে। নূর তখনও নিজ মনের আনন্দে বৃষ্টি স্নান করছে।তখনই আদিত্য গিয়ে ঝট করে নূরের এক হাত ধরে টান দিলো তার দিকে। চমকে উঠল নূর। আৎকে উঠল সম্মুখে আদিত্যকে দেখে। এভাবে হাত ধরায়তো আরও ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে গেল নূর। তার ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়ে আদিত্য তার হাত টেনে ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। ভয়েতো নূর কেঁদে দেবার জোগাড়। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কাঁদো কাঁদো গলায় ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“ছা…ছাড়ুন…
আদিত্য যেন কিছু শোনার পরিস্থিতিতে নেই তখন। সে সোজা নূরকে বাসার ভেতরে নিয়ে এসে জোরে জোরে জমিলাকে ডাকল। তা শুনে জমিলা ছুটে এলো তার সামনে। নূর তখনও ভয়ে ভয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে নিজরে হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় নিয়োজিত। আদিত্য নূরকে জমিলার কাছে এক প্রকার ছুঁড়ে মারল।আতঙ্কিত নূর অতি দ্রুতই জমিলার পেছনে লুকিয়ে ফেলল নিজেকে। জমিলার আঁচল খামচে ধরে ভয়ে কাঁপতে লাগল। আদিত্য ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
“আপনাকে ওর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলাম আমি। তাহলে ও এই বৃষ্টির মাঝে বাইরে একা একা কি করছে!”
জমিলা অপরাধী মুখে বলল,
“আমি বুঝতে পারি নাই বউমনি কখন বেড়িয়ে গেছে। জানলে কখনো যেতে দিতাম না। ভুল হয়ে গেছে আমার।”
“ঠিক আছে যান এখন নিয়ে যান ওকে।”
জমিলা মাথা নেড়ে নূরকে ধরে উপরে নিয়ে যেতে লাগল। ভীতু নূর জমিলার কাঁধের মাঝে মুখ লুকিয়েই হালকা করে চোখ কুঁচকে তাকালো আদিত্যর দিকে।যেন তার কাজে খুব নারাজ সে। খুব আস্তে বিড়বিড় করে বলল,
“পঁচা লোক।”
আদিত্য আবার বেড়িয়ে এলো বাইরে। ক্ষিপ্র গতিতে তেড়ে গেল গার্ড রুমের দিকে। গার্ড রুমের ভেতরে ঢুকেই তখন তাকিয়ে থাকা গার্ডটার সোজা গলা চেপে ধরল। আচমকা আক্রমণে ঘাবড়ে গেল বাকিরাও। হিংস্র বাঘের মতো গার্ডের গলা চেপে ধরে তাকে পেছনের দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। লোকটার চোখ বড় বড় হয়ে গেল ভয় আর শ্বাসকষ্টে। তবে আদিত্যর হিংস্রতা কমছে না। সে গার্ডের প্যান্টে লাগিয়ে রাখা পি,স্তলটা খুলে নিয়ে সোজা গার্ডটার চোখের উপর চেপে ধরে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
“এই চোখ রেখে কি হবে যদি তা বুঝতেই না পারে কোনটা দেখা উচিত আর কোনটা না।”
বলেই ট্রিগার চাপতে নিলো আদিত্য। তখনই ছুটে এলো সেখানে বিহান। আটকালো আদিত্যকে। আদিত্যর হাত থেকে গান নিয়ে তাকে সরিয়ে এনে বলল,
“কি ওইচে তোর! এমতে পাগলের লাহান করতাছচ ক্যালা! ছেড়ায় করছেডা কি?”
আদিত্যর যেন একটু হুঁশ এলো। সে বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“এইটারে জীবন্ত চাইলে আজই বিদায় কর।”
তারপর বাকি গার্ডদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আই হোপ এরপর থেকে সবার নজর জেনে রাখবে কোনটা দেখা উচিত আর কোনটা না।”
বলেই হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল আদিত্য। বিহান হতভম্বের মতো বলল,
“মোর জালা! মাগার হইচেটা কি ছেইটাইতো জানলাম না।”
__
রাতে আদিত্যর বাসায় একটা বিজনেস পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।দেশ-বিদেশী বড় বড় ক্লাইন্টসদের গেট টুগেদারের উদ্দেশ্যে এই পার্টি থ্রো করেছে আদিত্য। আসলে ক্লাইন্টসরাই ডিমান্ড করেছিলো পার্টির৷ তাদের আবদার রাখতেই আসলে আদিত্য পার্টির এরেঞ্জমেন্ট করেছে। বাসার বিশাল লিভিং এরিয়াতেই সব করা হয়েছে। মেহমানে সমাগম হয়ে উঠেছে পার্টি।ব্যাকরাউন্ডে সফট মিউজিকের ধুন বাজছে। হাতে সবার ড্রিংক এর গ্লাস। সার্ভেন্টরা সবাই ওয়েটারের মতো কালো প্যান্ট, কোটে সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে। আদিত্য ব্লাক কোট,প্যান্টে ড্যাশিং লুক দিয়েছে নিজেকে। সে’ও ড্রিংকস এর গ্লাস হাতে মেহমানদের সাথে আলাপচারিতা করছে। এর মাঝে কিছু ফিমেল ক্লাইন্টও আছে। যাদের প্রায় সবারই আকর্ষণের বস্তু হলো ওই সুদর্শন পুরুষ সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য। যাকে পেতে তাদের ছলাকলার শেষ নেই। কিন্তু ওই কঠোর মানব যেন কিছুতেই তাদের হাতে আসে না৷ তবুও প্রয়াস ছাড়ে না কেউ। যেমন এই মুহুর্তে পিআর কোম্পানির মালকিন প্রভা রহমান এগিয়ে এলো আদিত্যর সম্মুখে। পড়নে পাতলা জর্জেটের শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজ। শরীরের অর্ধভাগ দৃশ্যমান তার। মুখে আবেদনময়ী হাসি ঝুলিয়ে আদিত্যর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“আই মাস্ট টেল মিঃ আদিত্য। আপনাকে যতবার দেখি ততবারই মনে হয় আগেরবারের চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন৷কিভাবে করেন এটা! আজকেও কি মারাত্মক হট লাগছে! ঘায়েল হয়ে যাচ্ছি আমি।”
আদিত্য চরম বিরক্ত এসব নেকামিতে। এমন অশালীন ধরনের নারী তার কাছে সর্বদাই অবমাননীয়। কিন্তু বিজনেস পার্টনার আর মেহমান দেখে আদিত্য জোরপূর্বক হেঁসে তাকে সহ্য করে গেল। প্রভা আহ্লাদী হেঁসে বলল,
“বাইদা ওয়ে আমাকে কেমন লাগছে বললেন নাতো!”
আদিত্য মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“এই প্রশ্নটা না করাই ভালো আপনার জন্য মিস প্রভা।কারণ উত্তরটা আমার দিতে যতটা না রুচিতে বাঁধবে, আপনার শুনতেই বেশি বাঁধবে। সো বেটার বি উই স্কিপ ইট।”
আগ্রহী প্রভার মুখটাই ভোঁতা হয়ে গেল আদিত্যের জবাবে। তবুও যেন হাল ছাড়ল না। সে আবারও হাসিমুখ করে বলল,
“মিঃ আদিত্য, আমার শাড়িটা একটু ঠিক করা দরকার। একটু আপনার ওয়াশরুমে নিয়ে যাবেন?”
আদিত্য প্রভার পরিকল্পনায় একেবারে পঁচা পানি ঢেলে দিয়ে ওর বাসার এক সার্ভেন্টকে ডাক দিয়ে বলে দিলো প্রভাকে যেন ওয়াশরুম টা দেখিয়ে দেয়। প্রভা আদিত্যর কাছে এভাবে উপেক্ষিত হয়ে ভীষণ পরিমাণ রাগ হলো। রাগী মনোভাব নিয়েই সে সরে গেল ওখান থেকে।
নূর রুমেই বসে খেলছিল তার পুতুল দিয়ে। পুতুল টা তার অনেক দিনের। তার খুব প্রিয়। সেটা নিয়েই খেলছিল সে। জমিলা বলে গেছে আজ বাইরে যেন না বের হয়। বাইরে অনেক মানুষজন এসেছে। আদিত্য রেগে যেতে পারে এই ভেবেই জমিলা নূরকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। নূরও তাই আর যায়নি। এমনিতেও এবাড়িতে সে একা ঘুরাফিরা করতে ভয় পায় কেমন। এটাতো আর ওর গ্রাম না। যেখানে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াত সে। তাইতো সেই সাহস পায়না সে। আর সবচেয়ে ভয় পায় ওই টিভির নায়কদের মতো দেখতে লোকটাকে। দেখতে নায়কের মতো হলেও নূরের কাছে কেমন ভয়ংকর ভিলেন মনে হয় তাকে।দাদীর রুপকথার গল্পের সেই রাক্ষসের মতো মনে হয়। যেন নূরকে মেরেই ফেলবে। নূরের খেলার মাঝেই হঠাৎ তার ভীষণ ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন মনে হয়। কিন্তু এখানকার এত অত্যাধুনিক ওয়াশরুমে একা যেতে ভীষণ ভয় হয় নূরের। কারণ সে অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। তাইতো প্রতিবার জমিলা ওকে হেল্প করে। কিন্তু এখনতো জমিলা নেই। আর নূরের খুব জরুরিও মনে হচ্ছে এখন। নূর জমিলাকে খুঁজতে বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে যায়।আস্তে করে দরজাটা হালকা করে খোলে। মাথাটা একটু বের করে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো বাইরে কোথাও জমিলা আছে কিনা। কিন্তু পেলনা কোথাও। নূর এবার দরজা খুলে বাইরে এলো ধীর পায়ে৷ ভীতু কদম ধীরে ধীরে এগুতে লাগল। করিডর থেকে সিড়িতে আসতেই নূরের চোখ যেন ধাঁধা লেগে গেল এত চাকচমক আর লোকজন দেখে। কৌতুহলী হলো অবুঝ মন তার। ধীরে ধীরে সবকিছু দেখতে ভীরু পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো সে। রঙবেরঙের বাহারি লোকজন দেখে তার চমক লাগছে কেমন৷ সাথে ভয়ও হচ্ছে একটু৷এসব দেখার মাঝেই হঠাৎ জমিলাকে চোখে পড়ে তার। ডাইনিং টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে সে। তাকে দেখে নূর ঝট করে ছুটে তার কাছে যেতে চাইল। তার এমন ছুটে যাওয়ার মাঝেই হটাৎ বেখেয়ালিতে প্রভার সাথে ধাক্কা লেগে যায় তার। প্রভা এমনিতেই অহংকারী আর বদমেজাজি স্বভাবের। তারউপর আদিত্যর অপমানে তার মেজাজ আগে থেকেই চটে ছিলো। আর এমুহূর্তে নূরের ধাক্কায় তার হাতের ড্রিংকস উল্টে শাড়ির উপর পড়ে যায়। ব্যাস,তাতেই প্রভার আগুনে যেন ঘি’য়ের কাজ করে। রেগে যায় সে। যার দরুন সে ঠাস করে নূরের গালে চড় বসিয়ে দেয়৷ বেচারি নূর চড়ের ধাক্কায় টিকতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। পড়ে যেতে নিয়ে হাতের ধাক্কায় সামনে সাজিয়ে রাখা কাচের ফুলদানিটাও ঠাস নিচে পড়ে যায়। মুহূর্তেই বিকট শব্দে তা ছড়িয়ে পড়ে ফ্লোরের মাঝে। সেই শব্দেই উপস্থিত সকলের কৌতুহলী নজর পড়ে তাদের উপর। নজর পড়ে খোদ আদিত্যেরও। নূরকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে তার৷ ঘটনার সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করে সে। নূর ভয়ে শঙ্কিত। গালে হাত চেপে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় সে। প্রভা তখন কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
“ইউ ব্লাডি চিপ গার্ল। আমার এত দামি শাড়িটা নষ্ট করে দিলে! এসব চিপ, গাইয়া,বস্তির মেয়ে এখানে কি করছে! খাবার চুরি করার জন্য এসেছ তাইনা!”
আদিত্যর মনে হলো এই মুহুর্তে মস্তিষ্কে বোধহয় টগবগে, উত্তপ্ত লাভা ভোলকে উঠল তার৷ কপালের রগ নীল হয়ে ফেটে যাবে যেন৷ মুঠো দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ। হাতের সবগুলো রগ গোনা যাবে যেন। সে চেয়ে দেখলো ভীতিগ্রস্ত আর অশ্রুসিক্ত নূরের লাল চোখ দুটো। বুকে অদৃশ্য ক্ষত হলো তার সহসাই। হলো চিনচিন পিড়ার অনুভব। গালে হাত রাখায় এতক্ষণে বুঝে গেল প্রভা তার গায়ে হাত তুলেছে। আর এটা বোধগম্য হতেই আদিত্যর ক্রোধ পৌঁছাল সর্বসীমায়।চোখে জমল র,ক্তিম লাল আভা। হাতের ড্রিংকসের গ্লাস সজোরে আছাড় মারল সে। ক্রুদ্ধ, বিক্ষিপ্ত কন্ঠে হুংকার দিয়ে বলে উঠল,
“মিস প্রভা….!
তার হুংকারপূর্ণ ডাকে প্রভাসহ পুরো মজলিস যেন কেঁপে উঠল। আদিত্য তেড়ে এলো বেগে প্রভার সম্মুখে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,
“শুকুর করেন বিধাতা আপনাকে নারী রুপে জন্ম দিয়েছে।কারণ আজ কেবল এই একটা জিনিসই আপনাকে রক্ষা করল। নাহলে আপনার কাজের প্রতিদানস্বরুপ এতো ভয়াবহ জবাব পেতেন যা আপনি পরবর্তী সাত জনমেও ভুলতে পারতেন না।”
প্রভা তেতে উঠে বলল,
“হোয়াট ডু ইউ মিন৷ মিঃ আদিত্য, আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন আমি কে! আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন!”
“আদিত্য হুমকি দেয়না।সোজা করে দেখায়। আর আপনার মতো থার্ড ক্লাস মেয়েদের জন্যতো একদমই না। আদিত্যর হুমকি এতো সস্তা হয়নি এখনো। নাউ গেট দ্যা হেল আউট অফ হিয়ার।”
“মিঃ আদিত্য, আপনি কিন্তু অনেক বেশি বলে ফেলছেন! তাও এই সস্তা, বস্তির মেয়েটার জন্য! কেন? কি হয় আপনার ও?”
আদিত্য তখন গর্জিত গলায় বলল,
“ওয়াইফ। সি ইজ মাই ওয়াইফ। ইউ গেট দ্যাট!”
আদিত্যের এমন কথায় প্রভাসহ সবার মাঝে যেন বিস্ফোরণ ঘটলো। আদিত্য এবার নিচে ভীতু অবস্থায় বসে থাকা নূরের হাত ধরে টেনে তুলে সোজা করে দাঁড় করাল। নূর যেন আরও ভয় পেয়ে গেল। আদিত্য নূরকে টেনে নিয়ে এসে সবার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“এভরিওয়ান লিসেন টু মি ভেরি ক্লিয়ারলি। সি ইজ মাই নিউলি ম্যারিড ওয়াইফ, মিসেস নূর।”
সবাই অবাক হয়ে গেল আদিত্যের কথা শুনে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আদিত্যের মতো ছেলের এমন বউ দেখে সবাই অবাক। তবে আদিত্যের সামনে কেউ কিছু বলার আর সাহস পেলনা৷ আদিত্য আরও বলল,
“দ্য পার্টি ইজ ওভার নাউ৷ এভরিওয়ান প্লিজ লিভ। ”
নূর আদিত্যর কথার কিছুই বুঝলনা৷ সে এমনিতেই ভয়ে কুঁকড়ে আছে৷ কোনো কিছু বোঝার পরিস্থিতিতে নেই সে এখন৷ আর এসব ইংলিশ ভাষায় বলা কথাতো সে একদমই বোঝে না। সে আরও ভয় পাচ্ছে হয়তো তার এখানে আসা আর ওই ফুলদানিটা ভেঙে ফেলার দায়ে নাজানি কি ভয়ংকর শাস্তি দেয় তাকে। সেই ভয়েই আরও জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছে সে। হাত ছাড়িয়ে আদিত্যের কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তা হলোনা। বরং উল্টো আরও আদিত্য ওর হাত ধরে উপরে নিয়ে গেল। উপরে নিজের রুমে নিয়ে এলো তাকে। নূরের ভয়ে জান বেড়িয়ে যাবার জোগাড়। আদিত্য নূরকে রুমে এনে দরজা আঁটকে দিলো। তারপর নূরের হাত ছেড়ে দিয়ে কাবার্ডের দিকে এগুলো। কাবার্ড খুলে ভেতর থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে ঘুরে নূরকে আর পেলনা আদিত্য। এদিক ওদিক চোখ বোলাতেই হঠাৎ কাবার্ডের কোনা ঘেঁষে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখল নূরকে। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আরে ওখানে কি ক…..
আদিত্যের কাছে আসা দেখেই নূর আরও ভয় দলামলা হয়ে মুখের উপর দুই হাত রেখে কান্না জড়িত করুন সুরে বলল,
” মারবেন না, মারবেন না, দয়া করে মেরেন না আমাকে। আমি ওয়াদা করছি আর হবে না এমন। আর ভাঙবো না কোনো কিছু। তাও মেরেন আমাকে দয়া করে।”
আদিত্য থেমে গেল। এগুতে পারলোনা যেন সে আর৷ কোথাও যেন কোনো কিছু মুচড়ে উঠল তার। নূরের এই করুনতা যেন তার চোখের মাঝে কাটা বিদ্ধ করে দিচ্ছে। কষ্ট নামক বস্তুর আবির্ভাব ঘটছে যেন তার মাঝে। আদিত্য দলা পাকানো বস্তুটা ঢোক গিলল। উল্টো ঘুরে চোখ বুজে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিলো। তারপর ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে দরজার বাইরে এসে জমিলাকে ডাকল। জমিলা দ্রুত ছুটে গেল সেই ডাকে। তখন নূরকে ওভাবে দেখে খুব মায়া হচ্ছিল জমিলার৷ কিন্তু ভয়ে নূরের কাছে যেতে পারেনি তখন৷ জমিলা আসতেই আদিত্য ফাস্ট এইড বক্সটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ওর ঠোঁট কেটে গেছে একটু৷ ফাস্ট এইড করে দিন৷ আর এই ক্রিমটা ওর গালে লাগিয়ে দিয়েন।”
জমিলা দ্রুতই মাথা নেড়ে বক্সটা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আর আদিত্য তার জিমিং রুমের দিকে পা বাড়াল। বক্সিং ব্যাগেই এখন তার ভেতরের ফ্রাস্ট্রেশন বের করবে।
মেহমান সব চলে গেছে। বিহান মনে মনে খুশিই হচ্ছে বন্ধুর জন্য। ওর বন্ধুটা হয়তো ধীরে ধীরেই নূরের প্রতি দূর্বল হচ্ছে। খুশিমনে পেছনে ঘুরতেই থতমত খেয়ে গেল সে। দরজার মাঝখানে শক খেয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানবকে দেখে আচম্বিত হেঁসে বলল,
“কিরে ছালা তুই কহন আইলি!”
চলবে…..