#আমি_তারে_দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#৬ষ্ঠ_পর্ব
সবই ফিকে হয়ে গেলো যখন শোনা গেলো,
“শান্ত আসে নি”
নবনীতা মলিন দৃষ্টিতে চাইলো, তখন সামিয়া বলল,
“ওর একটা কাজ পড়ে গেছে, বোঝ ই তো পুলিশ মানুষ”
নবনীতা ম্লান হাসলো। কিন্তু বুকে ভয় সৃষ্টি হলো। সেই ভয় তীব্র হলো যখন আধ ঘন্টা পার হবার পর ও শান্ত আসলো না। হেনা বেগম ফোন দিতেই অপাশ থেকে শুনলেন,
“কাঙ্খিত নম্বরটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না”
শান্তর মোবাইল বন্ধ, চিন্তার মেঘ জমলো হেনা বেগমের মস্তিষ্কে। কপালে পড়লো ভাঁজ। এদিকে কাজী সাহেবের অনেক তাড়া, তিন আজ মোট চারটে বিয়ে পড়াবেন। শুক্রবার দিন হলেই কাজী সাহেবের সংকট দেখা যায়। হেনা বেগমের সাথে আগে যার কথা হয়েছিলেন তিনি কথা কাটাকাটি করেছেন। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন তিনি এই মহিলার সাথে কোনো কাজে যাবেন না। এমন কি নাম্বারটিও ব্লক লিষ্টে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে সকাল বেলা শান্তর বড়ভাই মারুফ এই কাজীকে ধরে দিয়ে এসেছে। ভাই এর বিয়ে বলে কথা, এই কাজী সমস্যা অবশ্য অনেক আগেই মিটে যেত কিন্তু জসীম সাহেব সেটা মিটান নি। যারা বিয়ে করতে লাফাচ্ছে তারা কাজী আনুক তার তো মাজায় ব্যাথা। সে এসব কোনো কাজ ই করতে পারবে না। কাজী সাহেব একটু পর মোবাইলের এলার্মের মত বলছেন,
“বর কি আসবে?” “বর কখন আসবে?” “দেখুন জুম্মার নামায ধরবো, ফোন দেন”
অবশেষে তিনি মুখে পান গুজে বললো,
“আমি এখন প্রস্থান করবো, আপনাদের ছেলে আসবে না। এমন আমার বহুত দেখা, বিয়ে করবো বলে বর বা কন্যা পালানো। এখনকার কি জানে বলে, হ্যা ট্রেন্ড এটা। আমার টাকাটা বুঝিয়ে দিন আমি চলে যাই”
“চলে যাই মানে? বিয়ে কে দিবে তাহলে?”
“আমি তো জানি না, আমি চলে যাবো এইটা হলো আসল কথা। আমার সময় সংক্ষেপ। আপনাদের ছেলে তো পালাইছে। প্রেমিকার সাথে, নিশ্চয়ই এখন অন্য কোথাও হয়তো বিবাহ করছেন। আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আরোও চারখানা বিবাহ পড়াবো”
রেবা ছুটে আসলো ভেতরের ঘরে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“আম্মা, কাজী সাহেব কয় চইলে যাবেন। উনার কতা, আমগোর ভাইজানে অন্যখানে এখন বিয়া করতাছে”
রেবার কথায় ভেতরের ঘরের গুমোট পরিবেশে চাঞ্চল্যের সঞ্চার হলো। নবনীতা হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইলো রেবার দিকে। সামিয়া ধমক দিলেও তার বিলাপ থামলো না। ফলে মুহূর্তেই চটে গেলেন হেনা বেগম। একেই শান্ত ফোন ধরছেন না, চিন্তায় মাথা বন্ধ হয়ে যাবার যোগাঢ়, এদিকে বিয়ের দিন এমন কুকথার প্রচার তার মেজাজ বিগড়ে দিলো। সাথে সাথে হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন। মারুফ তখন ও কাজী সাহেবকে আটকে রাখার চেষ্টা করলো। এদিকে জসীম সাহেব নির্বিকার। হাতে চিপস এর প্যাকেট। তিনি হেলান দিয়ে বসে চিপস খাচ্ছেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার কোনোই মাথা ব্যাথা নেই। স্ত্রী শারমিন বেগম ছুটে এলো তার কাছে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“কাজী সাহেব তো থাকতে চাচ্ছেন না, নীতুর আব্বু শান্ত তো এখনো আসে নি”
“এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে আমাকে টেনো না তো”
“এগুলো ক্ষুদ্র বিষয়?”
“অবশ্যই, শোনো শারমিন বড় বড় বিষয় নিয়ে চিন্তা করবে। চিন্তা করতেই হলে রাশিয়া ইউক্রেন নিয়ে চিন্তা করো, দেশের ইকোনমি নিয়ে চিন্তা করো। আচ্ছা বলতো, এবার ডোনান্ড ট্রাম্পকে কি ইলেকশন দাঁড় করানো হবে?”
“ধ্যাত, যত্তসব”
বলেই বিরক্ত শারমিন বেগম প্রস্থান করলেন। এদিকে বসার ঘরে তুলকালাম কাণ্ড। ক্ষিপ্র হেনা বেগমের সাথে কাজী সাহেবের সাথে বাকবিতণ্ডায় জরিয়েছেন। মেহমানেরা দর্শক, তারা বসে বসে উপস্থিত ঘটিত রঙ্গ দেখছেন। একসময় কাজী সাহেব ক্ষেপে বললেন,
“আপনার মতো মা থাকলে পোলা পালাইবে, এটাই হল আসল রহস্য। আপনি একটা আস্তো পা/গ/ল”
“মারুফ, ব্যাটাকে ধরো”
“মা, ছেড়ে দিন। সিন ক্রিয়েট কেন করছেন”
সামিয়ার কথায় উলটো রেগে গেলেন হেনা বেগম। ধমকের সুরে বললেন,
“চুপ কর বউমা, মারুফ এই ব্যাটা থা/প্পড় দাও। গুনে গুনে দুটো দিবে”
মারুফ বিপাকে পড়লো, মায়ের রাগ সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে। তিনি শান্তর বেখেয়ালির রাগ কাজী সাহেবের উপর দেখাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আজমল সাহেব এবং ইরশাদ এলো। ইরশাদ এলো পুলিশি ইউনিফর্মে। ফলে কাজী সাহেবকে ভয় দেখানো সহজ হলো। মারুফ ফিসফিসিয়ে বলল,
“দেখুন আপনার কাছে দুটো উপায়, হয় আপনি বিয়ে করাবেন নয় হাজতে যাবেন”
“হাজতে যাব কেন?”
“কারণ লাগে না, আজকাল পৃথিবী কোনো কিছু ঘটতেই কারণ লাগে না। সুতরাং হাজতে যেতে না চাইলে চুপচাপ বসে পড়ুন”
কাজী সাহেব চুপসে গেলেন। এদিকে আজমল সাহেব জেরা করলেন হেনা বেগম। ইরশাদ হতবাক হল, শান্তর অনুপস্থিতিতে। আজমল সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,
“ভাবি, আমি সত্যি জানি না আপনি কি বলছেন। শান্তকে ডিপার্টমেন্ট থেকে কল করার প্রশ্ন ই উঠে না। সে তো ছুটিতে”
ইরশাদ ও সম্মতি দিলো। মিয়ে যাওয়া স্বরে বলল,
“স্যারের পেন্ডিং কেস এই কদিন আমি হ্যান্ডেল করছি ম্যাম। কিন্তু আমি তাকে সকাল থেকে ফোন দেই নি”
ইরশাদের কথায় উদ্বিগ্নতা বাড়লো। হেনা বেগম ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়। ছেলের ফোন এখনো বন্ধ। এদিকে একরাশ অপেক্ষা নিয়ে নবনীতা বসে আছে। অপেক্ষা মদনকুমার তর্কালংকারের। এতদিন সে কখনো তার অপেক্ষা এত আগ্রহ নিয়ে করে নি। প্রয়োজনীয়তা পড়ে নি। কিন্তু আজ করছে, কেন যেন অন্তস্থলে একটা সুপ্ত কামনার কুড়ি পরিস্ফুটিত হচ্ছে। কামনা তার আগমণের। কাঙ্গাল হৃদয়টা মরুভূমির তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে আছে। এটা কি কেবল ই ক্ষণিকের আবেগ? হয়তো না। নবনীতা আনমনেই হাসলো, তার হৃদয় কাঁপছে, ভয় পাচ্ছে কেবল ই সেই অসহ্যকর মানুষটির জন্য। অথচ সে ভেবেছিলো সে একজন জড়বস্তু। যার অনুভূতিগুলো পাথর, হৃদয় ভালোবাসা নামক বৃষ্টির অভাবে চিরে চৌচির হয়ে গেছে। টুপ করে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।
পরিস্থিতি গম্ভীর হতে শুরু করলো, দুঘন্টা পেরিয়ে গেছে শান্ত এখনো আসে নি। ইরশাদ থানায় খোঁজ নিয়েছে শান্ত সেখানে যায় নি। তার মোবাইলটি এখনো বন্ধ। হাতে হাত দিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে তার মোবাইল ফোনের লোকেশন ট্রাক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শত্রুর তো অভাব নেই, কোথা থেকে কে আক্রমণ করে সেটার ও ঠিক নেই। ইরশাদ বের হতেই যাবে তখন কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই এলোমেলো অবস্থায় হন্তদন্ত হয়ে শান্ত প্রবেশ করলো। শান্তকে দেখেই হেনা বেগমের প্রাণে পানি এলো। তবুও বাজখাঁই কণ্ঠে শুধালেন,
“কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে গেছো তুমি? এতো সময় কোথায় ছিলে?”
শান্ত খানিকটা থতমত খেলো। এভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি হবে বুঝতে পারে নি। আমতা আমতা করে বলল,
“একটা কাজে গিয়েছিলাম?”
“কি এমন কাজ তোমার বিয়ে থেকে বেশি জরুরি?”
শান্ত একবার আজমল সাহেবের দিকে চাইলেন। তার মুখখানা শুকনো। বোঝা যাচ্ছে একটা ঝড় বয়ে গেছে। সামিয়া তখন বললো,
“মা আগে বিয়েটা সেরে নেই। সবাই অপেক্ষা করছে”
মাদার বাংলাদেশ এবার একটু দমলেন। জসীম সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“জসীম, বিয়ের আয়োজন শুরু কর”
এতোক্ষণে জসীম সাহেব একটু নড়ে চড়ে বসলেন। যেন তিনি জানতেন শান্ত কোথাও যাবে। শেষ অবধি কাজী সাহেব বন্দিশালা থেকে মুক্ত হলেন। নবনীতা এবং শান্তর বিয়ে হলো। নবনীতার হাত কাঁপছিলো সাইন করার সময়। সে উপলদ্ধি করছিলো সে সত্যি খুব খুশি। অনেকটা আমাবস্যায় চাঁদ পাওয়ার মতো। বিদায় কালীন মাকে জড়িয়ে বেশ কাঁদলো সে। ভাই কে উপদেশ দিলো,
“বাবা ছা/গ/ল বললে কিছু মনে করবি না”
নিশাদ মাথা নাড়ালো। জসীম সাহেব সেখানে শক্ত রইলেন। একটু কাঁদলেন না, শুধু বললেন,
“তোমার নতুন পরিবার হয়েছে বলে মনে করবে না এই পরিবারটি হারিয়ে গেছে। আমরা সবসময় আছি”
**************
আকাশে তখন মেঘের চাঁদর। চাঁদটা কোথাও ঢাকা পড়ে আছে। সিমসাম সাদামাটা ঘরটির বড় জানালার গ্রিল ধরে সেই বিষন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নবনীতা। ঘরটি খুবই আঁটসাঁট। খাটের উপরে বড় ফ্রেমের মেডেল গ্রহণকারী বরের ছবি ঝুলছে সাদা দেওয়ালে। আইনের মোটা মোটা বই এর থাক। বিছানার পেছনে সাদা বোর্ড। মার্কার গুলো টেবিলে সাজানো। টেবিলের সামনে ম্যাপ, মানুষের ছবি, পেপারের কাটিং ইত্যাদি। ঘরটাকে দেখে প্রথম দর্শনেই নাক শিটকালো নবনীতা। এটা কি মানুষের থাকার যোগ্য। পরমুহূর্তেই তপ্তশ্বাস ফেললো, ভুলে গিয়েছে কার সাথে বিয়ে হয়েছে। ওয়াকি টকি চলছে। অস্পষ্ট কিছু কথা কানে আসছে, এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ ঘটলো শান্ত। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। শেরওয়ানির গলার কাছের বোতামটা খুলতে খুলতে বলল,
“খেয়েছো কিছু?”
“নাহ”
“খাও নি কেনো? রাগ করেছো?”
নবনীতা এবার পেছনে তাকালো। লাল বেনারসী শাড়িতে তার রুদ্ররুপটিকে মুগ্ধ নয়নে দেখলো শান্ত। মেয়েটির নাক লাল হয়ে আছে, চোখগুলো ছলছল করছে। ঠোঁট ঈষৎ কাঁপছে। খুব অভিমান জমেছে যেন মনের আকাশে। শান্ত হাসলো, নির্মল হাসি। উঠে বসে হাতটা টেনে নবনীতাকে কাছে টানলো। আজ নবনীতা বাঁধা দিলো না। বরং বাধ্য মেয়ের মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো। শান্ত কোমল স্বরে বলল,
“খুব বাজে একটা কাজ পড়েছিল”
“আমি কিন্তু অপেক্ষায় ছিলাম”
“জানি। এজন্য অপেক্ষার দাম রুপে একটা উপহার এনেছি”
নবনীতাকে অবাক করে দিয়ে তার অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলো একটি আংটি। তার আস্তে বললো,
“মিসেস আরেফিন শান্ত, এবারের মত এই অধমকে ক্ষমা করে দিন”
কথাটায় কিছু একটা ছিলো। নবনীতার কান্নার বেগ বাড়লো। ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। শান্ত বলিষ্ট বুকে তাকে আঁকড়ে নিলো। রাতটা আজ সত্যি সুন্দর। জ্যোৎস্না নেই, তবুও যেন প্রণয়ের জ্যোৎস্নায় স্নান করছে পৃথিবী______
*****
শান্তের ঘুম ভাঙ্গলো মধ্য রাতে। পাশে হাত দিতেই বিছানায় শীতলতা ছুঁয়ে দিলো হাতের তালু। চোখ মেলে তাকালো। পাশের স্থানটি ফাঁকা। নবনীতা নেই, অথচ মেয়েটি তার পাশেই ঘুমিয়েছিলো…………
চলবে
[বুকশেলফ.কম পেজে চলছে অতিরিক্ত মূল্য ছাড়। আমার প্রথম উপন্যাস “তন্দ্রাবিলাসী” পেয়ে যাবেন মাত্র ২২০টাকায়]
মুশফিকা রহমান মৈথি