~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০১
অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরলো ইভান। ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে কলিংবেল বাজালো।মিনিট পাঁচেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপরও যখন দরজা খুললো না,তখন এক্সট্রা চাবি ব্যাবহার করে দরজা খুললো ইভান।ভেতরে প্রবেশ করতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার এসে ইভানের চোখে ঝাপটা মারলো। কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ তুলে লাইট জ্বালালো সে।হঠাৎ রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ইভানের।
আজ সোমবার। রুটিন অনুযায়ী আজকের রান্নার পালা ছিলো মিষ্টির। অথচ সে লাপাত্তা। ঠাস করে দরজা লাগিয়ে রুমে চলে গেলো ইভান।দড়াম দুড়ুম শব্দ তুলে নিজের পরিধানের পোশাক নিয়ে বাথরুমে ঢোকে পড়লো। যথাযথ সময়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সময় রাত আটটা।
এবার ইভান দাঁতে দাঁত চেপে ফোন করে নিজের জন্য খাবার অর্ডার করে দিলো।
মিষ্টি ফিরলো আরো আধঘন্টা পর।ভয়ে সিঁটিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সে। ইভান তখন ফোনে চোখ গুঁজে আছে। মিষ্টি নিজের হয়ে কৈফিয়ত
দিতে বলল,
— স্যরিরে! আজকে একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছিলো। তুই একটু অপেক্ষা কর আমি ঝটপট রান্নাটা
করে ফেলি।
ইভান গম্ভীর আর বিরক্তমুখে বলল,
— তোরটা করে নে।আমারটা অর্ডার দিয়ে দিয়েছি।
ইভানের কথায় মিষ্টির মনঃক্ষুণ্ণ হলো ভীষণ। রাগটা মাথা চড়া দিয়ে উঠে তার।তারপরও চুপচাপ নিজেকে সামলে নিলো। আগের ইভান আর আজকের ইভানের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তাই পূর্বের মতো তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে পরিবেশ খারাপ করতে চায়না সে। শাড়ি পাল্টে ঢিলেঢালা থ্রী-পিছ পরিধান করলো মিষ্টি। রুম থেকে বের হতে হতে একবার আঁড়চোখে ইভানের দিকে তাকালো, মিটিমিটি হাসছে সে।হয়তো অফিসের কোন মেয়ে কলিগের সাথে রমরমা আড্ডা জমিয়েছে। মিষ্টি টলতে টলতে কিচেনে এসে দাঁড়ালো। সবসময় রুটিন অনুযায়ে রান্নাবান্না হতো।শনি,রবি,সোম তিনদিন রান্নার দায়িত্ব মিষ্টির।মঙ্গল,বোধ,বৃহস্পতিবার তিনদিন ইভানের দায়িত্ব। বাকি রইলো শুক্রবার সেদিন তারা দু’জনে আলাদাভাবে বাইরে থেকে অর্ডার করে খায়।অথবা,বাইরে গিয়ে খেয়ে নেয়।কোনমতে চুলায় একটা বেগুন পুড়াতে দিলো মিষ্টি।রাতের খাবারটা বেগুনের ভর্তা দিয়ে চালাবে।
যথা সময়ে ইভানের অর্ডারকৃত খাবার চলে আসলো। ডায়নিং টেবিলে নিজের খাবার নিজে পরিবেশন করে রাখলো। হাত ধুয়ে চেয়ারে বসে পড়লো সে। খাবারের মাঝখানে মিষ্টি নিজের প্লেটে ভাত আর বেগুন ভর্তা নিয়ে ডায়নিং টেবিলে রাখলো। এরপর সেও হাত ধুয়ে বসে পড়লো চুপচাপ। দু’জনে নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছে। ইভানের জন্যে আজকের খাবারটা একদম স্বাদহীন।বেগুন ভর্তার ঘ্রাণ একদম নাকের ভেতরে ঢোকে পড়েছে।এতো লোভনীয় খাবার মিষ্টি তাকে না দিয়ে খাচ্ছে।
ইভানের লক্ষ খাওয়া-দাওয়ার হলেও পূর্ণ দৃষ্টি ফোনে নিবদ্ধ। যেনো দুনিয়ার সব মনোযোগ ফোনের মধ্যে ঢেলে দিবে। সামনে যে তার স্ত্রী নামক মেয়েটি বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছে তাতে সে ভ্রুক্ষেহীন।ইভানের মেসেজিং টাইমের এর মাঝে মিষ্টির খাওয়া শেষ হয়। সে খাবারের প্লেট ধুয়ে রেখে দিলো।এরপর চুপচাপ রুমে চলে গেলো। আজ মশারি টাঙানোর দায়িত্ব ইভানের।যেহেতু,আজকের রান্নাটা মিষ্টি করতে পারেনি।তাই মশারিটা টাঙানোর দায়িত্ব মিষ্টির। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে আচমকা ইভান এসে ঝড়ের গতিতে মিষ্টির হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালো। কঠিন স্বরে বলল,
— বাহ! শরীর ফুটো করে রক্তদান করে এসেছিস। আমাকে বললিনা কেন?”
—তুই জানতে চেয়েছিস?”
— আমি কেন জানতে চাইবো? তোর মুখ নেই।মিথ্যে না বলে সত্যিটা বললে কি হতো?”
মিষ্টি চুপচাপ ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। একবছরের বন্ধুত্ব,দুই বছরের প্রেম, আর এক বছরের বৈবাহিক সম্পর্কে ইভানের জন্য সে কতোটা অসহ্যকর হয়ে উঠেছে সেটা ইভানের শ্যামবর্ণ মুখে ল্যাপ্টানো বিরক্তি দেখে আঁচ করতে পারলো মিষ্টি।ইভান বলল,
— কথা বলছিস না কেন?’
— আমি রক্তদান করেছি তোকে কে বলেছে?”
— বলার জন্য মানুষের অভাব নেই আমার। ফর্দার আমার থেকে কোন কথা লুকিয়েছিস তো ঘর থেকে বের করে দিবো।”
— ঘর তোর একার না,আমারও। ফ্ল্যাট দু’জনের নাম আর টাকা দিয়ে কিনেছি।ভুলে যাবিনা।”
ইভান মিষ্টির চুল খামছে ধরে বলল,
— এই ঘর থেকে বের করে দিবো বলেছি।” এরপর মিষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ইভান চলে গেলো কিচেনে।মিনিট পাঁচ-ছয় কিচেনে ব্যয় করে আবার ফিরে এলো। মিষ্টি তখনো বিছানায় বসেছিলো। ইভান প্লেটভর্তি ফ্রুটস মিষ্টির সামনে রাখলো। মিষ্টি নাকচ করার ভঙ্গিতে কিছু বলতে যাচ্ছিলো,ইভান থামিয়ে দিয়ে বলল,
— তোর টাকায় কেনা।পরশু এনেছিলি।”
ইভানের কথায় মিষ্টি প্রসন্নবোধক শ্বাস ছাঁড়লো। ফ্রুটস গুলোর দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ রেখে বলল,
— এটার বদলে তোকে কিছু করে দিতে হলে বলিস।”
— সবকিছুতে ভাগাভাগি করিসনা মিষ্টি।”
ইভান চুপচাপ মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লো। মিষ্টি আপেল,আর আঙুর গুলোও চুপচাপ খেয়ে ফেললো। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘাঁড় ঘুরিয়ে একবার ইভানের দিকে তাকালো। ইভানের পিঠ বৈ কিছু দৃষ্টিগোচর হলোনা।কিছুসময় নির্মিমেষ চেয়ে থেকে ঘাঁড় সোজা করলো। মিনিট দুয়েক অতিক্রম করার পর ইভান ফোনটা রেখে মিষ্টির দিকে ফিরলো। মিষ্টির পিঠের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কালো চুলের দিকে তাকিয়ে রইলো।
পূর্বাহ্নে আজ সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি অনুপস্থিত। কুহেলিকার ধুম্রজালে বন্দি ব্যস্তনগরী। বন্দিদশায় কর্মজীবিদের আঁটকে রাখতে ব্যর্থ প্রকৃতি।
আজ মঙ্গলবার, রুটিন অনুযায়ে আজ থেকে তিনদিন রান্নার দায়িত্ব ইভানের। ইভান সকাল সকাল উঠে নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।নামায পড়ে শুয়েছিলো মিষ্টি।এলার্মের তীক্ষ্ম শব্দে সাথে সাথে ঘুম থেকে জেগে উঠলো মিষ্টি। বিছানাপত্র ঘুছিয়ে,হাতমুখ ধুয়ে,অফিসে যাওয়ার জন্য একদম পরিপাটিরূপ নিয়ে রুম প্রস্থান করলো মিষ্টি। ডায়নিং রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলো।শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর।অবশেষে ইভান তৈরিকৃত নাস্তা এনে টেবিলে রাখলো। একটা প্লেট মিষ্টির দিকে বাড়িয়ে দিলো,একটা প্লেট নিজের সামনে রেখে বসে পড়লো। মিষ্টি একবার মানচিত্রের মতো দেখতে পরোটার দিকে তাকালো,আরেকবার তাকালো ইভানের মুখের দিকে। ময়দা মাখিয়ে যা-তা অবস্থা করেছে মুখের। মিষ্টির হাসতে মন চাইলো,সম্পর্কটা যদি আগের মতো ছন্দময় হতো,তাহলে হাসিঠাট্টায় ভরপুর হতো আজকের সকাল। তপ্তশ্বাস ফেলে মিষ্টি মানচিত্র আঁকারের পরোটা ছিঁড়ে খেতে লাগলো। খাওয়ার ফাঁকে ইভান শুধু একবার তাকিয়েছিলো মিষ্টির দিকে।কিয়ৎক্ষণ পর অক্লিষ্ট মুহূর্ত কে বিতাড়িত করে ইভান বলল,
–” আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।”
মিষ্টি নিষ্পলক দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
–” বল আমি শুনছি।”
–” এভাবে আর কতোদিন মিষ্টি। গত তিন মাস ধরে
আমরা স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে অনেক দূরে আছি।
তোর মনে হয় না এখন আর কিছু ঠিক হবে না।
লেট’স গেট এ ডিভোর্স!’
খাওয়া গলা দিয়ে নামলো না আর মিষ্টির।
ম্লানমুখে হেসে বলল,
–” তোর যা ভালো মনে হয় কর।আমার আপত্তি নেই।
মিষ্টি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পার্সে ফোন রাখতে রাখতে নিঃশব্দে দরজা মেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ইভান অস্থির হয়ে টেবিল পরিষ্কার করতে লাগলো। বারকয়েক দৃষ্টি তুলে দরজা দিকে তাকালো। মিষ্টির মুখে কাঙ্খিত জবাব শোনার পর কেমন যে অস্বস্তি লাগছে। কান বেয়ে রক্তের স্রোত দ্রুতগতিতে উঠানামা করছে। বুকের মধ্যখানি অংশে ফাঁকা অনুভূতি হচ্ছে তার।
____________
ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট আ্যন্ড আ্যকউন্টিবিলিটি,অর্থাৎ প্রোগ্রাম অফিসার পদে চাকরি করে ইভান। মাসে একটা সাইটপ্রজেক্টের মাধ্যমে চাকরি প্রতিষ্ঠানে বেশ নাম অর্জন করেছে সে। ভালো প্রমোশনের ফলে আজ তার বেতন পঞ্চাশের উপরে। বেশ আরামেই আছে সে।
সবেমাত্র কক্সবাজারের প্রজেক্টটা নিয়ে মিটিং শেষ করেছিলো ইভান।তন্মধ্যে তার কেবিনে প্রবেশ করলো জুঁই। এগিয়ে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
— দোস্ত,লাঞ্চ টাইম শুরু হয়েছে।লাঞ্চ করবিনা?
লাঞ্চের কথা শুনতেই ইভানের মস্তিষ্কে সর্বপ্রথম মিষ্টির কথা মাথায় এলো। চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ইভান।লাঞ্চ আওয়ার পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এখান থেকে দশমিনিট হেঁটে গেলেই কলেজ। একটা সরকারি কলেজের শিক্ষিকা মিষ্টি। তারসাথে পাল্লা দিয়ে পাশাপাশি কলেজে চাকরি নিয়েছিলো,যাতে ইভানকে চোখে চোখে রাখতে পারে। আসলে সন্দেহ জিনিসটা খুবই খারাপ।একবার মনের মধ্যে প্রবেশ করলে আর বের হতে চায় না। ইভানকে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে যেতে দেখে জুঁই হঠাৎ বলে উঠলো,
—- মিষ্টিকে দেখেছি দোস্ত। দাওয়াত রেস্তোরাঁয়।
সাথে কে যেনো ছিলো। বন্ধু মনে হয়।
কথাটা বলে ফিচেল হাসলো জুঁই।
_______________
©তারিন_জান্নাত
(চলবে)
অনেক দিন আগে লিখে রাখছিলাম।তাই পোস্ট করলাম। সাড়া পেলে চালমান রাখবো নয়তো ডিলেট করে দিবো। আপনাদের মন্তব্য জানানোর অনুরোধ রইলো।