দখিনের জানলা পর্ব -০৫

#দখিনের_জানলা (পর্ব-৫)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৯.
চমচম সারা রাত অনেক ভেবে চিন্তে দেখল এই রকম একটা কথা কাউকে বলা যাবে না। তবে আব্রাহামকে সে একটা সাজা দিবেই। মনকে নানাভাবে বুঝিয়ে সে পরে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল বেলা কলেজ যাওয়ার সময় আয়মানের সাথে দেখা হলো। চমচমকে দেখে এগিয়ে এসে সে বলল,

-‘কীরে! কি খবর তোর?’

-‘আমার খবর ভালোই।’

-‘ওহ।’

-‘তোমার ভাই কোথায়?’

-‘সে তো হলে চলে গেছে।’

-‘মশকরা করছ?’

-‘তোর সাথে মশকরা করি আমি?’

-‘করো না বুঝি!’

-‘এখন করছি না। সত্যি। বিশ্বাস না হলে বাসায় গিয়ে দেখে আয়।’

-‘পালিয়েছে!’

-‘পালাবে মানে?’

-‘ওর পিঠের ছাল তুলতাম আমি। সেই ভ’য়ে ব্যাটা পালিয়েছে।’

-‘কি বলছিস? কি করেছে সে?’

চমচম একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বলল,
-‘সে যে কাজটা করেছে তা অতি জ’ঘ’ন্য। আমি ভালো মানুষ। তাই লোকের কাছে বলে বেড়াই না।’

-‘তাই নাকি!’

-‘হ্যাঁ।’

চমচম চলে গেল। আয়মানের বহু কষ্টে আটকে রাখা হাসিটা এবার বের হয়ে আসে। পেট চেপে ধরে সে হাসতে লাগল।

দিনগুলো ধীরে ধীরে বেশ কঠিন হয়ে গেল। চমচমের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। বহু ক’ষ্টে একমাস নিয়ম করে পড়ল চমচম। টেস্টটা ভালো ভাবেই দিল। টেস্ট পরীক্ষা শেষে তার কলেজ কয়দিন বন্ধ ছিল। সে বাসাতেই থাকত।

একদিন সকালে চমচম ঘুম থেকে উঠছিল না। এগারোটা বেজে গেছে। তার মা বকতে বকতে এসে রুমের সবকয়টা জানালা বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল। চোখে আলো পড়ায় আর শুয়ে থাকা গেল না। সে ঘুমে ঢুলু ঢুলু অবস্থাতে বাথরুমে ঢুকল। হাই কমোডের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার গায়ে টুপ করে পানির মতো কি একটা পড়ল। তার ঘুম ছুটে গেল চোখ থেকে। উপরে পানি আসবে কোথা থেকে! সে মাথা তুলে তাকাতেই দেখল উপরের দেওয়াল বেয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। সে বুঝে গেল এটা কীসের পানি। ‘আম্মুউউউউউউ!’ বলে এক চিৎকার দিয়ে সে বাথরুম থেকে বের হয়ে পড়ল। তার মা রান্নাঘর থেকে আত’ঙ্কিত হয়ে দৌঁড়ে আসলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলেই চমচম বলে দিল উপর তলার সায়েমদের বাসার টয়লেটের পানি তার গায়ে পড়েছে। শুনে তো চমচমের মায়ের মুখটা হা হয়ে গেল। তিনি দৌঁড়ে বাথরুমে ঢুকে দেখে আসলেই পানি পড়ছে। এর আগেও একবার এমন হয়েছিল। তাই তারও বুঝতে বাকি রইল না এসব কীসের পানি। হায় হায় করে সে বাথরুম থেকে বের হলো। এদিকে চমচম আর চমচমের মায়ের সব কথোপকথন আব্রাহাম শুনে ফেলল। সে গতরাতেই এসেছিল। চমচম সেটা জানেনা। জানলে এত জোরে কখনোই এসব বলত না। আব্রাহামের সাথে চয়নও ছিল। চমচমের গায়ে নোংরা পানি পড়েছে কথাটা শুনে হাসতে লাগল হো হো করে। আব্রাহাম তাকে হাসতে বারণ করল। আব্রাহামের সামনে হাসা যাবে না বুঝতে পেরে চয়ন রুম থেকে বের হয়ে গেল। আর নিচে গিয়ে বাম্পা সহ সবার কানে খবর ছড়িয়ে দিল।

———–
চমচম বাথরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে বের হয়েছে। একেবারে গোসল নিতে হয়েছে তাকে। এক ফোঁটা পানি তার হাতের কনুই এর উপরে পড়েছিল। কিন্তু সেই এক ফোঁটা তো অতি নোংরা পানি। তাই তার মা তাকে গোসল করতে বলে দিয়েছে।

খাবার টেবিলে গিয়ে সে তার মাকে বলল,

-‘বলেছ ওদের? ওরা দেখেনি যে টয়লেটে সমস্যা?’

-‘আরে আর বলিস না! সায়েম এর বোনের ছেলেটা আবারও এই কাজ করেছে। গতবারও ওই বিচ্ছু ছেলে কমোডে বল ফেলেছে। এবার কি করল! মাজুনি আর লোফা কমোডে ফেলেছে। এই জন্যই ময়লা, পানি জমে গিয়ে পানি চুইয়ে পড়ল।’

-‘ছেলেটাকে হাতের কাছে পেলে ঠাসঠাস করে দুইটা লাগিয়ে দিতাম। বে’য়া’দ’ব ছেলে একটা! গতবার তাও গায়ে পানি পড়েনি এবার পড়েছে। ইয়াক! আমার এখনও ঘিনঘিন লাগছে।’

-‘থাক। বাচ্চা ছেলে। বুঝলে তো আর করত না।’

-‘এখন তো দেখছি পানি আর পড়ছেনা। ঠিক করিয়েছে?’

-‘হ্যাঁ। আমি গিয়েই দেখি ম্যাথর এনেছে। পরিষ্কার করছিল।’

-‘আমার বাবা আর তার বন্ধুদের উপর ভীষণ রা’গ হচ্ছে। তারা এটা কি ধরনের বাড়ি করল? প্ল্যানিং নাই কোনো! একটা ফলস্ ছাদ দিয়ে দিতে পারল না! সরাসরি একদম কমোডের নিচে ধুর!’

-‘তোর রুমের বাথরুমেই তো নেই। এগুলো সেই কবে করেছিল। তোকে তো আগেই বলেছি চিনির রুমটা নিতে। আমি আর তোর বাবা এই রুমে থাকব। তুই তো মানলি না। ওই এক জানলা দেখলি। সেটা নিয়েই এত করেছিস! তোর দখিনের জানলা!’

-‘আমার দখিনের জানলা নিয়ে কিছু বলবে না আম্মু। নো কমেন্টস্!’

১০.
খাবার খাওয়ার পর চমচম বাসা থেকে বের হলো। তার বান্ধবী মুনতাহার বাসায় যাবে সে। রাস্তায় নামতেই পরিচিত বেশ কয়েকজন তাকে দেখে হাসতে লাগল। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হঠাৎ সবার তাকে দেখে এত হাসি পাচ্ছে কেন? সে দুই তিনজনকে জিজ্ঞেস করল তারা কিছুই বলল না।

আরেকটু সামনে হেঁটে যেতেই দেখল মেহেদী আসছে। চমচমকে দেখে বলল,

-‘এই চমচম! শুনলাম তোমার গায়ে নাকি কমোডের পানি পড়েছে? তা ভালো করে সাবান দিয়ে গা ডলে গোসল করেছ তো!’

চমচম তব্দা খেয়ে গেল। মেহেদী এই কথা জানল কী করে? বদমাইশটা আবার আড়ি পেতেছে তাদের বাসায়? কিন্তু সে আড়ি পাতলেও তো শুনবেনা। কারণ তার রুমের দিকের কিছু মেহেদীর শোনার কথা নয়। ডাইনিং এ সে তার মায়ের সাথে বেশ আস্তেই কথা বলেছে। তাছাড়া কথা তো স্পষ্ট শোনা যায় না। চেঁচামেচি করলে বোঝা যায় কিন্তু কি নিয়ে চেঁচামেচি করছি সেটা বোঝার উপায় নেই। তার মা কি কথাটা সায়েমদের বাসায় বলে দিয়েছে? তার মা নিশ্চয়ই এই কথা বলবে না। তাছাড়া সায়েমদের বাসায় বললেও খবর ছড়াবে কে? সায়েম তো নেই। চমচমের জানামতে সায়েম তার দাদুর বাড়িতে। তাহলে আর কে বলবে? মেহেদী চমচমকে চুপ থাকতে দেখে বলল,

-‘কি হলো? আচ্ছা শোনো! তুমি কয়দিন চিনির আশেপাশে যাবে না। চিনিটাও না আবার নোংরা হয়ে যায়।’

চমচম চোখ বড়বড় করে তাকালো মেহেদীর দিকে। বে’য়া’ব’টা বলছে কি! সে তাকে তার বোনের কাছে যাওয়ার নি’ষে’ধা’জ্ঞা দিচ্ছে। ব্যাপারটা এমন মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। আর বলছে নোংরা হয়ে যাবে! চমচম নোংরা! নিজের এতদিনকার জে’দ আর নিজের ভেতরে পুষে রাখতে পারল না চমচম। তার সব ক্রো’ধ বের হয়ে পড়ল মুখ দিয়ে,

-‘এই কি বললি তুই! তোর সাহস তো কম না তুই আমাকে এসে আদেশ দিচ্ছিস! ওই? তুই কে? তুই কে বলার আমি আমার বোনের কাছে যাব নাকি না যাব! তুই কে? তোর জিহ্ব টেনে ছিড়ে দিব বে’য়া’দ’ব। আড়ি পাতিস! লোকের ঘরের হাঁড়ির খবর রাখিস? দাঁড়া! তোর খবর রাখা ছুটাচ্ছি আমি। চিনি চিনি করিস না! এবার চিনিকে দিয়েই তোর হিসেব নিব।’

মেহেদীর মুখটা এতবড় হা হয়ে গেল। চমচম ধ’ম’কে উঠে বলল,

-‘সর আমার রাস্তা থেকে। আর কোনোদিন যদি দেখে আমার সামনে আসছস তুই! তোর একদিন কি আমার একদিন! শা’লার বেক্কল!’

মেহেদী সরে দাঁড়ায়। রাগে গিজগিজ করতে করতে চমচম আবারও হাঁটা ধরল। একটু সামনে যেতেই দেখল তন্ময় সাইকেল নিয়ে আসছে। চমচমকে দেখেই বলল,

-‘চমচম আপু! শুনলাম তোমার গায়ে না গু’র পানি পড়েছে!’

চমচম বিস্মিত হয়ে গেল। এরা এসব কি বলছে? জানল কী করে? সে ক’র্ক’ষ গলায় বলল,

-‘একটা থা’প্প’ড় দিব অ’স’ভ্য। কি বলছিস এসব?’

-‘বা রে! আব্রাহাম ভাইয়া তো বলল।’

চমচম চমকে গেল। বলল,

-‘কে বলল?’

-‘আব্রাহাম ভাই বলেছে। চয়ন ভাইয়ার কাছে। চয়ন ভাইয়াই তো জানালো সবাইকে।’

-‘কি! হাম ভাইয়া বলেছে?’

-‘হ্যাঁ। চমচম আপু সত্যিই তোমার গায়ে ওই পানি পড়েছে।’

চমচম মাথা নেড়ে বলল,

-‘তুই কি যা তা বলছিস! চিনিস না ওই হাম রো’গীকে। ও একটা ব’দমাইশ। মি’থ্যা ছড়াচ্ছে। ছিঃ ছিঃ আমার গায়ে ময়লা পানি পড়তে যাবে কেন?’

-‘কথাটা শুনে আমার খুবই খা’রা’প লাগছিল। ভেবেছিলাম আর কোনোদিন তোমার সাথে খেলতে পারব না। নোংরা পানিতে তো তুমি ইয়াকি হয়ে যাবে। এখন শুনে খুব ভালো লাগছে। যাক! আমরা আগের মতো একসাথে খেলতে পারব।’

তন্ময় চলে যেতেই চমচম মাথায় হাত দিল। গোটা এলাকায় এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে? কিন্তু আব্রাহাম কবে এসেছে? আর সে জানল কীভাবে! চমচমের মনে পড়ল সকালে তার দখিনের জানলাটা খুলে দিয়েছিল তার মা এসে। আর তার গায়ে যখন ময়লা পানি পড়েছিল সে বেশ চিৎকার দিয়েই কথা বলছিল। উফফফ! আব্রাহাম তখন শুনে ফেলেছে? চমচমের এত রা’গ হচ্ছে। সে মুনতাহার বাসায় গেল না আর। আব্রাহামদের বাসার উদ্দেশ্য উল্টো পথে হাঁটতে লাগল। আজ আব্রাহামের একদিন নয়তো তার একদিন!

চমচম যখন আব্রাহামদের বাসায় ঢুকল তখন তারা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিল। চমচমকে দেখে নিগার খানম উঠে এলেন। বললেন,

-‘কীরে! তোর গায়ে শুনলাম সায়েমদের বাথরুমের ময়লা পানি পড়েছে? কতটুকু পড়েছে রে! সারা গায়ে! হায় হায়! কি হয়ে গেল বল তো! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। তোর মা কনফার্ম করল। গায়ে সাবান দিয়েছিস ভালো করে? গন্ধ টন্ধ কেমন ছিল রে?’

চমচম অসহায় চোখে একবার নিগার খানমের দিকে তাকালো আরেকবার সোফায় বসে থাকা আব্রাহামের দিকে। তার এইমুহূর্তে রা’গে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। একদম গলা ফা’টিয়ে! ইচ্ছে করছে আব্রাহামের চুল টেনে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের সেফটি ট্যাঙ্কির মধ্যে ফেলে দিতে।

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here