#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১৩(একঝাঁক শূন্যতা)
১৫.
নম্রমিতার মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে কয়েকমাস আগে। বেশিরভাগ সময় রাফিদ নিজেই তোহা আর নম্রমিতাকে একসাথে কলেজে পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিসে যায়। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ বেশ সকালেই বেরিয়ে যায় রাফিদ আবার ফিরতেও রাত হয়। যথারীতি নিয়মের লঙ্ঘনে সন্দেহের বাসা বাঁধে নম্রমিতার মনে। ভাবতে না চাইলেও মস্তিষ্কে হানা দেয় অযাচিত কিছু ভাবনা। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। রাতের আকাশে নিমগ্ন নম্রমিতা তাকিয়ে আছে অস্পষ্ট কিছু তারাদের দিকে। আকাশের বুকে চমকালো তারারা সহজে ধরা দিলোনা তার দৃষ্টিতে। অথচ কি নিখুঁদভাবে অস্পষ্ট জিনিসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে সে। ঠিক যেমন জীবনের ঝাপসা, ঘোলাটে এক কাহিনীতে সে বুঁদ। রাফিদকে আজকাল বোঝা যায়না ঠিকঠাক। আগের রফিদকে সে চিনতো। জানতো তার মনের খবর। মুখ দেখেই পড়ে নিতে পারতো অন্তরের লুকানো কথা। অথচ এই রাফিদকে সে বুঝে উঠতে পারেনা। মনে হয় মুখে এক আর মনে আর এক। সন্দেহের বীজ বপনের কাজটা করেছে কয়েকদিন আগের একটা ছোটো মেসেজ। রাফিদের কাছাকাছি দাড়ানো একটা মেয়ে। মুখটা স্পষ্ট না হলেও রাফিদের মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট খুশির আভাস। বেশ অন্তরঙ্গ দুজনে। মুহুর্তেই তছনছ হয়ে যায় নম্রমিতার গোছানো অনুভূতির পসরা। শুন্য শুন্য লাগে নিজেকে। শূন্যতায় ছেয়ে যায় চতুর্দিক। নিজেকে সামলানোর জন্য বেশ অনেকটা সময় শাওয়ারের নীচে দাড়িয়ে থাকে। নীরবে বিসর্জন দিতে থাকে অশ্রুকনা।
ব্যালকনিতে রাখা ছোট্টো এক সোফায় পিঠ এলিয়ে বসে আছে নম্রমিতা। এখান থেকে বাড়ির গেটটা স্পষ্ট দেখা যায়। অপেক্ষায়মান সে রাফিদের জন্য। এক বাজে অভ্যাস হয়েছে যে নম্রমিতার। রাফিদ না খেলে নিজেরও গলা নিয়ে ভাত নামেনা। সকাল থেকে শরীরটা বেশ খারাপ নম্রমিতার। আনোয়ারা খাতুন বেশ কয়েকবার তাকে খেয়ে নেওয়ার জন্য বললেও নম্রমিতা অপেক্ষা করছে রাফিদের। গেট দিয়ে সাদা রঙের গাড়িটা ঢুকতেই হালকা আলো এসে পড়ে নম্রমিতার মুখেও। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। সন্তর্পনে পানিটুকু মুছে ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ায় নম্রমিতা। রাফিদ রুমে ঢোকার আগেই কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে সে।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢোকে রাফিদ। শরীরটা ভীষণ ম্যাচম্যাচ করছে তার। এখন লম্বা একটা শাওয়ার নেওয়া দরকার। যথারীতি আলমারি থেকে কাপড় বের করে রাফিদ চলে যায় ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের দরজায় আওয়াজ শুনে মুখ থেকে কাঁথা সরায় নম্রমিতা। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকায় ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে। কান্নাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আছে যেনো। নিশ্চুপে কান্নাগুলো গিলে ফেলে নম্রমিতা। অতঃপর হালকা হাসে। যে হাসির মাঝে নেই কোনো সুখ বরং রয়েছে বিষাদের প্রতিচ্ছবি।
ডাইনিং টেবিলে সাজানো সব খাবার। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষন আগেই গরম করা হয়েছে। অথচ এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও নম্রমিতাকে দেখতে পায়না সে। অতঃপর কিছু একটা ভেবে প্লেটে করে খাবার সাজিয়ে রুমে নিয়ে আসে। বেডের একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে নম্রমিতা। রাফিদ সাইড টেবিলে প্লেট রেখে উঠে আসে নম্রমিতার পাশে। একহাতে কপাল ছুঁয়ে উষ্ণতা মাপে। উষ্ণতা স্বাভাবিক দেখে সস্তির শ্বাস ফেলে চুমু এঁকে দেয় কপালে। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ওঠে,
“নম্র, ঠিক আছো তুমি?”
“যদি বলি ঠিক নেই!”
“এতো উদাসীন কেনো? মন খারাপ?”
হাসে নম্র। নিঃশব্দ সে হাসি যেনো ব্যঙ্গাত্মক শব্দ ছুড়ে দেয় রাফিদের দিকে।
“কে রাখে কার খোঁজ! সব তো শরীর পেলেই নিখোঁজ।”
“নম্র!”
“ভুল কিছু বললাম!”
“তুমি কি আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে চাইছো? মনে কিছু থাকলে বলে ফেলো। ভেতরে যতো বেশি কথা জমাবে বুক ততো তিক্ত হবে। সেই তিক্ত বুকে ভালোবাসার বদলে প্রতিহিংসার আগুনের সূচনা হবে। জ্বলবে তুমি, জ্বলবে আমাদের সংসার।”
তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নম্রমিতা। সত্যিই তার ভেতরটা পুড়ছে। ভীষণভাবে জ্বলছে।
১৬.
ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে মনমরা হয়ে বসে আছে তোহা। রুহেলের সাথে তার সম্পর্ক আদৌ আছে কিনা সে জানেনা। কখনও ঘটা করে ব্রেকআপ করা হয়নি। দুইমাস হলো রনক কলেজ ছেড়েছে। কোনোরূপ যোগাযোগের মাধ্যমও রাখেনি তোহার জন্য। বিদায় বেলায় দূর থেকে দেখেছিল তোহা। হাস্যোজ্বল মানুষটাকে বিদায় জানাতে অনেকেই নানান ধরনের গিফট দিয়েছিলো তাকে। শুধু হাত খালি ছিলো তোহার। লজ্জায় তাই আর সামনে যাওয়া হয়নি। বারংবার বুকের মাঝে অঘোষিত এক আন্দোলনের দোলাচল অনুভব করেছিলো সে। তবুও বোঝেনি গোপনে সে ভালোবাসার কথা। রূহেলের ফাইনাল এক্সাম কিছুদিন পর থেকে। রুহেল যে সে ছাড়াও আরো অনেক মেয়ের সাথে এমন ফ্লার্ট করতো, জেনেছিল তোহা রনক চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই। তবুও কেনো যেনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি সে। এমনকি রুহেল সারাদিন তার সাথে কোনো কথা না বললেও তার কোনোরূপ যায় আসেনা। কেমন যেনো সব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। হয়তো দুজনে ব্রেকআপ ঘোষণা করেনি, তবে কেউ কাউকে আর চায়না এ ব্যাপারে দুজনেই নিশ্চিত। মেয়েদের সুন্দর সুন্দর কথা বলে কিছুদিন মজা নেওয়া, এসব রুহেলের নিত্যদিনের কাজ। রনকের অনুপস্থিতি তোহাকে প্রতি মুহূর্তে আরো বেশি করে রনকের করে তুলেছে। তোহা আজও আশায় আছে, রনক ফিরবে। কোনো একদিন সে ঠিকই ফিরবে। অপেক্ষা করবে তোহা। অপেক্ষার ফল নাকি মিষ্টি হয়! তবে সে একজনম অপেক্ষা করবে রনকের জন্য। এতোটা তীব্রভাবে কখন ভালোবেসে ফেললো সে রনককে জানেনা। তবে ভালোলাগা আর ভালোবাসার মাঝের বিস্তর ফারাক সে বুঝতে পেরেছে। অল্প কিছুদিনের মোহের টানাপোড়নে সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছে তোহা। অবশ্য রনকও তাকে একইভাবে ভালোবাসতো কিনা জানে না। তবুও সে ভালোবাসে রনককে।
আজকাল কলেজে ক্লাস করতেও ভালো লাগেনা তোহার। কেমন যেনো উদাসীন হয়ে গেছে সবকিছুতে। কলেজ থেকে একটু জলদিই ফিরেছে সে আজ। ক্যাম্পাসে গেলেই যেনো কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে তার। শূন্যতা ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে। যেনো গিলতে আসে তাকে।
তোহার পাশে দাড়িয়ে তাকে খাবার বেড়ে দেন আনোয়ারা খাতুন। মেয়েটাকে আজকাল আর আগের মতো হাসিখুশি দেখেন না তিনি। কিছু একটা নিয়ে যে গভীর চিন্তায় তা বেশ টের পান। তবুও মুখ ফিরে কিছু বলতে পারেন না। মেয়ে যে বড়ো হয়েছে। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে তাদের নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি হয়। জ্বী জগতে তারা বাবা মায়ের হস্তক্ষেপ পছন্দ করেনা। একান্ত ব্যাক্তিগত রাখতে চায় কিছু জিনিস। তিনিও তাই জোর করে সেখানে প্রবেশ করতে চান না। তবে মনে মনে মেয়ের জন্য তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
বিকালের নাস্তা বানানোর জন্য কিচেনে কাজ করছে নম্রমিতা। মূলত ছুটির দিন হওয়ায় আজ সবাই বাড়িতে। রাফিদ আর আরিয়ান চৌধুরী সোফায় বসে বসে ম্যাচ দেখছে। তোহা একবার করে টিভির দিকে তাকায় আবার একবার করে ফোন দেখে। একেবারে শান্ত পরিবেশের মাঝে হুট করেই মাঝে মাঝে উল্লাসে চিল্লিয়ে উঠছে বাপ ছেলে। যা দেখে হাসেন আনোয়ারা খাতুন। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে এগিয়ে যান কিচেনের দিকে। নম্রমিতা তখন পকোড়া ভাজছিলো। শাশুড়িকে দেখে হাসে সে। অতঃপর বলে,
“কিছু লাগবে আম্মা?”
“মাঝে মাঝে আমি ভীষণভাবে আশ্চর্য হই জানো তো নম্র! অনুতাপও হয়। এইযে আমি প্রথমে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি তোমাকে! ভাবলেই খারাপ লাগে। অথচ তুমি অল্প কিছুদিনেই কি সুন্দরভাবে সামলে নিয়েছ আমাদের সংসারটাকে। অন্য কেউ এলে কি আদৌ পারতো এভাবে! শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ নিয়ে সংসার করে, এমন মেয়ে এখন খুঁজে পাওয়া দায়। বিয়ে হতে না হতেই শুরু হয় তাদের আলাদা থাকার প্ল্যানিং। ননদের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝামেলা, আরো কত কি হয়। অথচ দেখো তোহা আর তোমার সম্পর্ক কি মধুর। দুজনকে দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় আমার। আমার ছেলেটা যে যোগ্য পাত্রী এনেছে তার সংসারে, এ ব্যাপারে আর কোনো সংকোচ নেই। শান্তিতে ম’রতে পারবো এখন আমি। কারণ ভাবি নয় বরং বড়ো বোনের মতো আগলে রাখার মতো মানুষ আছে এই বাড়ীতে। এখন আমি নিশ্চিন্ত।”
#চলবে!
Follow গল্পের লিংক story link