আমার ভাঙা ক্যানভাসে পর্ব -১৯+২০

#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (১৯)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

রুহি বাড়ির সামনে এসে থমকে যায়, দরজা হাট করে খোলা আছে, ভেতরে কিছু মানুষের গুজন শোনা যাচ্ছে। রুহির বুকটা কেঁপে উঠল, বাড়ির ভেতর এত ঠট্টগোল কেন? আবার কিছু হলো‌ না তো!!

রুহি তড়িঘড়ি বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখল দিয়া কাঁদছে আর প্রিয়া ওকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রুহি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

– ‘কি হয়েছে? এইভাবে দিয়া কাঁদছে কেন?’

দিয়া প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে রুহিকে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। রুহি কিছু না বুঝে দিয়াকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এখনো জানে না ঠিক কি কারনে দিয়া কান্নাকাটি করছে।

– ‘এই দিয়া এইভাবে কাঁদিস কেন? কি হয়েছে বল।’
– ‘রুহি দি মা।’ (বলে আবারো কেঁদে উঠল)
– ‘কি হয়েছে মামনির?’
– ‘জানি না। আমি মায়ের রুমে গিয়ে দেখি মা শুয়ে আছি কোনো সাড়া শব্দ নেই, অনেকবার ডাকলাম তারপরেও মা উঠল না।’
– ‘মামনি এখন কোথায়?’
– ‘হাসপাতালে।’
– ‘শান্ত হ কিছু হবে না মামনির।’

রুহি বুঝে উঠতে পারছে না এইটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল। নাসরিনের সাথে দেখা করতে যাবার আগেও জয়ের মায়ের সাথে কথা বলেছে, তখন তো পুরোই সু্স্থ ছিল এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি এমন হলো?

রুহি এইখানে বসে থাকতে পারছে না, দিয়াকে প্রিয়ার সঙ্গে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্যে হাসপাতাল।

**

জয় চিন্তিত হয়ে বসে আছে, চোখে মুখে চিন্তা, ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কেউ।

– ‘জয়।’

অনেকগুলো দিন,বছর পরে চেনা কন্ঠস্বরে নিজের নাম শুনে সামনে তাকাল জয়। রুহি ধীর পায়ে এগিয়ে আসতেই জয় রুহির কোমড় জড়িয়ে ধরল নিরবে কেঁদে উঠল। রুহি বুঝল জয় কাঁদছে।

– ‘এই কাঁদছো কেন? মামনির কিছু হবে না, নিজেকে সামলাও।’

অন্যসময় হলে রুহির তুমি বলাটা নিয়ে জয় কৌতুহল প্রকাশ করত কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। আদৌও জয় রুহির কথা শুনেছে নাকি সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে।

জয়, রোহান, রুহির কাকু সকলেই জয়ের মায়ের সাথে এসেছেন। সোহানও খবর পাওয়া মাত্র রওনা দিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর, ডাক্তার বের‌ হয়ে আসলেন।

– ‘কি হয়েছে ডক্টর? আমার মা কেমন আছে?’
– ‘ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। একটা বড়ো‌ ধরনের স্ট্রো’ক করেছেন, আপনারা উপরওয়ালার কাছে দোয়া করুন।’

সবার‌ সকল‌ আশা নিভে গেল। এতক্ষন ভেবেছিল হয়তো উনি সু্স্থ হয়ে উঠবেন কিন্তু ডাক্তার কি বলে গেল?

জয় ভেঙে পড়ছে, ছোট থেকে বাবাকে কাছে পাইনি কর্মসূত্রে বেশিরভাগ সময়েই বাইরে থাকেন। জয় আর দিয়ার মাকে ঘিরেই সবকিছু আর আজকে সেই মা মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করছে অথচ জয় কিছুই করতে পারছে না।

– ‘এই রুহি ডাক্তার কি সব বলে গেল? আমার মায়ের কি হয়েছে। এই রুহি আমার মা কি আর সুস্থ হয়ে উঠবে না!’

রুহি জানে প্রিয় মানুষদের হারানোর কষ্ট। আর জয়ের মাও তো ওর কম প্রিয় ছিল না। তারা এই করুন পরিনতি দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না কিন্তু রুহি ভেঙে পড়লে তো চলবে না। রুহিকে জয় আর দিয়াকে সামলাতে হবে‌। রুহির খেয়াল পড়ল জয়ের বাবার কথা, ওনার তো জানা উচিত তার স্ত্রী মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করছে। যেই ভাবা সেই কাজ, রুহি জয়ের ফোন থেকে নম্বরটা নিয়ে ডায়াল করল।

একবার কেটে যাবার পর, দ্বিতীয় বারের ফোনটা রিসিভ হলো। একজন মহিলা বলে উঠল,

– ‘হ্যালো কে বলছেন?’

মহিলা কন্ঠস্বর শুনে রুহি চমকে উঠল, মহিলা ধরার তো কথা নয়। আপাতত এইসব ভাবলে চলবে না, রুহি শান্ত কন্ঠে বলল,
– ‘এইটা কি জহির আঙ্কেলের নম্বর?’
– ‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?’
– ‘আমি রুহি, ওনাকে একটু দেওয়া যাবে!’

মহিলাটি কি বুঝল কে জানে, ওপাশ থেকে কিছু শোনা গেল না। রুহি দেখল কলটা এখনো কাটেনি তাই কলটা ধরে থাকল।

ওপাশ থেকে শুনতে পেল,
– ‘তোমার ফোন এসেছে।’
– ‘কে করেছে?’
– ‘রুহি বলে কেউ তোমাকে চাইছে।’
– ‘রুহি! ফোনটা তাড়াতাড়ি আমাকে দাও।’

– ‘হ্যালো রুহি মামনি, কেমন আছিস?’
– ‘আছি ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
– ‘ভালো। তা আমাকে ফোন করলি সব ঠিক আছে তো।’
– ‘কিছু ঠিক নেই। মামনি হসপিটালে ভর্তি আপনি প্লিজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসুন।’
– ‘কিন্তু হঠাৎ করে!’

রুহির মাথাতে অজানা রাগ চেপে বসল।‌ প্রথমে মহিলা কন্ঠস্বর তারপর ওনার‌ এইরকম কথা শুনে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে বলল,

– ‘নিজের স্ত্রীকে যদি জী’বিত দেখার ইচ্ছা থাকে তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবেন। রাখছি‌।’

ফোনটা খট করে কেটে দিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিল। নিজের হঠাৎ করে রেগে ওঠার কারনটা রুহি নিজেই ধরতে পারল না, তবে খারাপ কিছুর আশংকা হচ্ছে।

১দিন পর,

জয়ের মায়ের এখনো শারিরীক অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। দুই একবার সেন্স ফিরলেও আবারো সেন্সলেস হয়ে পড়ছেন। ইতিমধ্যেই জয়ের বাবা উপস্থিত হয়েছে তাকে দেখে সকলে খুব অবাক।

জয় বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– ‘বাবা তুমি!’
– ‘হ্যাঁ, তোমার মা এখন কেমন আছে?’
– ‘সেইরকমই কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?’ (একরাশ বিস্ময় নিয়ে জয় কথাগুলো বলল)
– ‘আমি বলছি।’ (রুহি)

জয় অবাক হলো বটে কিন্তু রুহির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অসময়ে বাবাকে খবর দেবার কথাটা মাথা থেকে পুরোই বেড়িয়ে গিয়েছিল, রুহি যে বুদ্ধি করে খবর দিয়েছে এটাই অনেক।

ডক্টর উপস্থিতিতে সবাই নড়েচড়ে দাঁড়াল। জয় বাবাকে ছেড়ে ডক্টরের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

– ‘ডক্টর মায়ের সেন্স ফিরেছে?’
– ‘হ্যাঁ। উনি আপনাদের দেখতে চাইছে, আপনারা কোনো সাউন্ড না করে ওনার সাথে দেখা করে আসুন প্লিজ।’

জয়,রুহি আর জয়ের বাবা কেবিনের ভেতর ঢুকল। জয় এগিয়ে এসে মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরল। জয়ের মা রুহি আর জয়ের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,

– ‘জীবনের যেকোন পরিস্থিতিতে দুজন দুজনের হাত ছাড়বি না কথা দে, কথা দে সমস্ত মুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিবি।’

জয় রুহির দিকে তাকাল। রুহি জয়ের হাতের উপর হাতটা রেখে বলল,

– ‘মামনি তোমার সব কথা রাখব, আগে তুমি সুস্থ হয়ে যাও।’
– ‘হুমম।’
– ‘মা দ্যাখো কে এসেছে।’
– ‘কে?’
– ‘বাবা।’

কথাটা শোনার পর জয়ের মায়ের মুখে কোনোরকমের খুশির আভাস পাওয়া গেল না, বরং ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যের হাসি। বিষয়টি জয় খেয়াল না করলেও রুহি স্পস্টভাবে খেয়াল করল, এই তাচ্ছিল্যের হাসির কারন কি??

রুহি জয়ের বাবার দিকে তাকাল, উনি কিছু একটা বলতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। রুহি ওনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

– ‘জয় আঙ্কেল মামনির কাছে থাকুক, আমরা বরং বাইরে যায়।’

জয় বুঝল বাবা আর মাকে প্লেস দিতে চাইছে তাই অমত না করে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।‌ জয়ের বাবা জহির সাহেব নিজের স্ত্রীর পাশে বসলেন, উনি অন‌্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে।

– ‘আমাকে কি মাফ করা যায় না?’

জয়ের মা ওনার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– ‘মাফ না পাবার মতো কোনো কাজ কি তুমি করেছ?’

জহির সাহেব কোনো কথা বলতে পারলেন না, মাথা নীচু করে বসে রইল।
#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (২০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

জয়ের মা যে আবারো সুস্থ হয়ে উঠবে এটা সবার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সকলের দোয়াতে তিনি মৃ’ত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আজকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেবে। সবার মাঝেই একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে, ঘরের মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরবে এর থেকে আনন্দের আর কি আছে।

– ‘মামনি ডাক্তার কিন্তু বলে দিয়েছে কোন স্ট্রেস না নিতে।’

রুহি কাপড় গোছাতে গোছাতে বলল, এই কয়েকদিন জয় আর ও হসপিটালেই থেকেছে। জয়ের মায়ের খেয়াল রেখেছে। বউমার এইরকম কথা শুনে জয়ের মা মৃদু হেসে বলল,

– ‘তোরা থাকতে আমার কি আর স্ট্রেস!’
– ‘সেটা তো তুমি জানো।‌ এইবার চুপচাপ উঠে পড় আমি তোমাকে রেডি করিয়ে দিই।’

শাশুড়ি মাকে রেডি করিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। জয়ের বাবা জহির সাহেব বাড়িতেই আছেন, এই কয়েকদিন বেশ কয়েকবার স্ত্রীকে দেখে গেছেন। একবার থাকতেও চেয়েছিলেন কিন্তু জয় রাখতে চাইনি, এতটা পথ এসেছে তারপর হাসপাতালে থাকবেন শরীরের দিকটাও তো দেখতে হবে নাকি।

জয়ের মা বাড়ির গেটে পা রেখে লম্বা করে একটা শ্বাস নিলেন। এই বাড়িতে ঘিরে কত কত স্মৃতি লুকিয়ে আছে, গোটা বাড়িটা নিজের পছন্দমতো করে সাজিয়ে তুলেছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, ভেবে ছিলেন আর হয়তো কখনো এই বাড়িতে ফিরবেন না। কিন্তু না আবারো ফিরেছেন, এটাই ওনার কাছে অনেক কিছু।

রুহি আর জয় ওনাকে নিজের ঘরে রেখে ফ্রেশ হবার জন্য নিজেদের রুমে গেল। দিয়া মায়ের কাছেই ছিল কিন্তু বাবা বললেন আমি আছি তাই সেও চলে গেল।

জহির সাহেব স্ত্রীর পাশে বসে বললেন,
– ‘এখন কেমন আছো আতিকা?’
– ‘যেমনটা দেখছেন তেমনটাই।’ (অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে)
– ‘এইভাবে বলছ কেন!’
– ‘এইভাবে ছাড়া আর বলার উপায় রেখেছেন আপনি!! আর কেনই বা এসেছেন! দেখতে এসেছেন যদি মরে যায় আপনার সব পথের কাঁটা সরে যায়।’
– ‘আতিকা!!’
– ‘দয়া করে আপনি আমার কাছে আসবেন না, আপনাকে দেখলে আমার ঘৃনা হয়। যদি নিজের ছেলেমেয়েদের সামনে নিজের সম্মান হারাতে না চান তাহলে এখান থেকে দ্রুত চলে যান।’

জহির সাহেব গম্ভীর মুখে রুম থেকে বেরিয়ে যান। দরজায় দাঁড়িয়ে রুহি সবটাই শুনল, জয় ফ্রেশ হচ্ছিল বলে এই রুমে এসেছিল ফ্রেশ হবার জন্য কি এইসব কি শুনল??

নিরস মুখে আবারো নিজের রুমে ফিরে গিয়ে ভাবনায় বসল।‌ কি হয়েছিল যার জন্য মামনি আঙ্কেলকে ঘৃনা করে!!

– ‘এই রুহি কি ভাবছ এত??’

জয়ের ডাকে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসল। জয় আর রুহির সম্পর্কটা আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক, দুজন একসাথে খারাপ পরিস্থিতির সাথে লড়াই করেছে আর সফলও হয়েছে।

– ‘কই না তো।’
– ‘যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।’
– ‘হুম।’

রুহি ওয়াশরুমে চলে গেল। জয় ল্যাপটপটা নিয়ে বসল, কয়েকদিন অফিসে না যাবার ফলে অনেকগুলো কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে সেইগুলো করতে হবে। এখন অনেক কাজ।

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে জয় ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। পিংক কালারের শাড়িতে রুহিকে খুব সুন্দর লাগছে, মোজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বের হয়ে আসছে। জয়ের মুখটা হাঁ হয়ে গেল। রুহিকে শাড়ি পড়া অবস্থায় হাতে গোনা কয়েকবার দেখেছে। জয় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুহির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ততক্ষনে রুহি আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। জয় ধীর পায়ে রুহির পিঠ ঘেষে দাঁড়াল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুহির ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগল। রুহি কেঁপে উঠল, আয়নায় তাকিয়ে দেখল জয় ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ের স্পর্শগুলো আরো গভীর হয়ে উঠছে, রুহি শাড়ি আঁকড়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।

জয়ের কিছু একটা মনে‌ পড়তেই রুহিকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। তারপর মিনমিনিয়ে বলল,
– ‘সরি রুহি।’

জয় রুহিকে কিছু বলতে না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, জয়ের এইরকমের করার কারনটাও ওর অজানা নয়। এইবার সবকিছু ঠিক করে নিতেই হবে।

**

রুহি নিজের শাশুড়ি মায়ের খেয়াল রাখছে, রাতে ছহির সাহেবের ওনার রুমে থাকার কথা থাকলেও উনি অনুরোধ করেছে রুহিকে থাকার জন্য। অসুস্থ মানুষকে একা রাখা ঠিক হবে না, তাই কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি। রাতে রুহি ওনার কাছেই থাকব ঠিক হয়।

– ‘মামনি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

জয়ের মা মৃদু হেসে বলল,
– ‘আমি জানি তুই কি প্রশ্ন করবি। আর এটাও জানি আমার দেওয়া ডাইরিটার একটা পাতাও তুই পড়িস নি।’

রুহি থতমত খেয়ে গেল। জয়ের মায়ের কথাটি সত্যি, এতকিছু ঝামেলার মাঝে রুহি ডাইরির কথাটা ভুরেই গিয়েছিল।

– ‘তুই হয়তো ভাবছিস আমি কিভাবে বুঝলাম, তুই যদি সত্যি ডাইরিটা পড়তিস তাহলে তোর মনে প্রশ্ন জাগত না। সবটাই বুঝতে পারতিস। জানিস রুহি যে বয়সে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকার কথা ছিল সেই সময়ে ধৈর্য্য আর লড়াই করতে শিখেছিলাম। নিজের একাকিত্ব নিজেকেই কাটিয়ে উঠতে হত কেউ কখনোই পাশে দাঁড়িয়ে বলেনি আমি আছি। জয় আমাকে একবার বলেছিল বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে কিন্তু আমি রাজি হয়নি কেন জানিস!’

রুহি কিছু না বলে ওনার দিকে তাকিয়ে রইল, উনি আবারো বলতে শুরু করলে,
– ‘আমি চাইনি আমার মতো তুইও কষ্ট পাক, তোকেও একাকিত্ব ঘিরে ধরুক। জানিস জয়ের দাদু বলে গিয়েছিলেন তোকে নাতবউমা করার জন্য, আর সেই কথা রাখতেই জয়ের বাবা তোদের বিয়ে ঠিক করে রাখেন। কারোর কোনো আপত্তি ছিল বেশ ভালোই দিন কাটছিল। হঠাৎ করেই জয়ের বাবার বিদেশে যাবার মন চাইল আমার শত বারন সত্ত্বেও তিনি বিদেশে পাড়ি দিলেন, সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ল। একটা সময়ে সম্পর্কটা কিরকম একটা ফিকে হয়ে পড়ল, প্রয়োজন ছাড়া ফোন করতেন না, কথা বলতেন না। একদিন জিজ্ঞাসা করাতে জানান উনি আবারো বিয়ে করেছেন, সেইদিন নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করেছিল কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে পারিনি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছি।’

রুহির চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে, একটা মেয়ে আর যাই পারুক নিজের স্বামী, ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যকারোর‌ সাথে শেয়ার করতে পারে না। এতগুলো বছর উনি কিভাবে সবটা সহ্য করে গেছেন, কাউকে বুঝতে দেয়নি ওনার মনের মধ্যে ঠিক কি চলছে। সেইকারনেই হয়তো বলে, নারী মন বোঝা বড়োই দায়।

**

জহির সাহেবের প্রতি যে সম্মান, শ্রদ্ধা ছিল তার কোনটাই আর নেই। ওনাকে দেখলেই মন‌ বলছে এই মানুষটা একজন ঠকবাজ, প্রতারক। কিন্তু যেহেতু মামনি তার সন্তানদের সামনে‌ মানুষটির আসল‌ রূপ প্রকাশ করেনি তাই রুহিও চুপ করে আছে। ইচ্ছা করছে, ওনার কুকীর্তি সকলের সমানে প্রকাশ করে দিতে কিন্তু নিরুপায়। জয়ের মা চাই না, তার সন্তানরা জানুক তাদের বাবা একজন ঠক, প্রতারক তাই রুহিকেও বলতে নিষেধ করে দিয়েছে।

রুহি জয়ের মায়ের কাছেই ঘুমায়, ওনার সাথে বসে গল্প করে আড্ডা দেয়।

– ‘রুহু।’
– ‘হ্যাঁ মামনি বলো।’
– ‘তোকে খুব কষ্ট দিচ্ছি না রে।’
– ‘না তো কেন?’
– ‘না কোথায় ছেলেটার সাথে সময় কাটাবি কিন্তু আমি আটকে রাখছি।’
– ‘মামনি চিন্তা করো না, তুমি আগে সুস্থ হয়ে নাও তারপর জমিয়ে তোমার ছেলের সাথে সময় কাটাব।’
– ‘বড্ড পাকা হয়ে গেছ।’
– ‘হি হি।’
– ‘জয়ের বাবাকে বলেছি কয়কেদিধের মধ্যে যেকোন বাহানায় চলে যেতে, নাহলে সব সত্যি সবাইকে বলে দেব।’
– ‘হুম।’

জয় একা ঘরে বোর হচ্ছে, দিয়া থাকলে আড্ডা দেওয়া যেত কিন্তু দিয়াও হোস্টেলে ফিরে গেছে। জয় বিরক্ত হয়ে গল্পের বই খুঁজতে লাগল, বই পড়তে পড়তে সময় কাটানো যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ। খুঁজতে খুঁজতে খোঁজ পড়ল একটা ডাইরির উপর, ডাইরিটা ওর নয় তবে ডাইরিটা আগে কোথায় দেখেছে বলে মনে‌হচ্ছে। কৌতুহল বশত হাতে নিয়ে উল্টে দেখল মায়ের নাম লেখা। কৌতুহল আরো তীব্রতর হলো, পাতা উল্টে পড়তে লাগল…

জয় কি তাহলে জেনে যাবে তার বাবার আসল‌ রূপ!!

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here