কালো রাত্রির খামে পর্ব -০৯+১০

#কালো_রাত্রির_খামে (০৯)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________

মিশাত এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। পাশে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটি তার পরিচিত। এর আগে দুইবার দেখেছে। ভীষণ অমানবিক। মিশাত জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কাঁদছো কেন?”

শ্রাবণী তাকালো মিশাতের দিকে। মিশাতের চোখেও অশ্রু। শ্রাবণী প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো প্রশ্ন করলো,
“আপনি কাঁদছেন কেন?”

শ্রাবণীর এই প্রশ্নে মিশাতের কান্নার বেগ বাড়লো। অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো সে। শ্রাবণীর খুব আগ্রহবোধ জাগলো মিশাতের কান্নায়। মিশাতের কান্না দেখে সে নিজে কাঁদতে ভুলে গেল। জানতে চাইলো,
“আপনার কি কেউ মারা গেছে?”

“না।”

“তবে?”

মিশাত আবার ঘুরে তাকালো শ্রাবণীর দিকে। ভীষণ করুণ গলায় বললো,
“আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।”

শ্রাবণী চমকে ওঠে,
“কীভাবে?”

“পকেটমার আমার সবকিছু নিয়ে গেছে।”

এই কথায় শ্রাবণীর একটু খটকা লাগলো। একজন পকেটমারের কারণে কেউ কীভাবে নিঃস্ব হতে পারে? সে যতদূর জানে পকেটমারেরা অন্যের পকেট থেকে টাকাপয়সা বা মূল্যবান কোনো জিনিস চুরি করে থাকে। একজন পকেটমারের দ্বারা কি সম্ভব কারো পকেট কেটে কাউকে নিঃস্ব করা? শ্রাবণী বললো,
“পকেটমার কি আপনার বন্ধু ছিল? আপনাকে ঠকিয়ে আপনার সব সম্পত্তি নিয়ে গেছে?”

“পকেটমার আমার বন্ধু হতে যাবে কেন? আমার কোনো বন্ধু নেই।”

“তাহলে আপনি কীভাবে নিঃস্ব হলেন?”

“আমার শেষ সম্বল ছিল একশ দশ টাকা। ওটা পকেটমার নিয়ে গেছে। তাই আমি নিঃস্ব।”

একশত দশ টাকা ছিল শেষ সম্বল? শ্রাবণীর দুঃখ লাগলো। আহারে! একটা মানুষ তার শেষ সম্বল এভাবে হারালো? লোকটা অত্যন্ত গরীব! এই বিল্ডিংয়ে তার মতো এত অসহায় কেউ নেই।
মিশাত জানতে চাইলো,
“তোমার কী হয়েছে? তুমি কাঁদছিলে কেন?”

এ প্রশ্নে এবার শ্রাবণীর থেমে যাওয়া কান্না বাড়লো। সে আজকের ঘটনাটা সম্পর্কে বললো মিশাতকে। মিশাত দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে বললো,
“পৃথিবীটা নির্দয় মানুষে ভরে গেছে।”

শ্রাবণী নাক টানলো। সে কেঁদে চলেছে। দুজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজেদের দুঃখগুলো নিজেদের মতো করে অনুধাবন করে গেল। কেউ কোনো কথা বললো না। শুধু তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ।

___________________

অয়ন খুব রাগ করেছে। শ্রাবণীর সাহস কী করে হয় একা একা বাসায় ফেরার? শ্রাবণী ছাদ থেকে নামলেই প্রথমে অয়নের মুখোমুখি হতে হলো। কিন্তু শ্রাবণীর এখন একদমই মন নেই অয়নের সঙ্গে তর্ক করার। সে অয়নের প্রশ্ন এড়িয়ে রুমে চলে এলো। অয়নও ওর পিছন পিছন এসেছিল, কিন্তু রাত্রি ওকে চোখের ইশারায় কিছু বলতে নিষেধ করলো। থেমে গেল অয়ন। বিরক্ত হয়ে চলেও গেল।
শ্রাবণী বিছানায় শুয়ে পড়েছে। রাত্রি ঠিক তার পাশে বসে আছে। তার কেটে ফেলা জামা জোড়া লাগাচ্ছে সুঁই-সুতার সাহায্যে। রাত্রি জানে জোড়া লাগালে কিছুই হবে না। খুব বাজে ভাবে জামাটাকে কে’টেছে শ্রাবণী। তবুও অহেতুক এই কাজটা করা থেকে সে নিজেকে বিরত রাখতে পরলো না। কিছুক্ষণ সে শ্রাবণীর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বললো,
“কী হয়েছিল?”

“কিছু না।” বালিশে মুখ চেপে বললো শ্রাবণী।

“আমি বলতে বলেছি।”

শ্রাবণী ভণিতা না করে বললো কী হয়েছিল। রাত্রি আগেই ধারণা করেছিল এরকম কিছু। সে মনে মনে বিষয়টা নিয়ে ব্যথিত হলেও বেশি কিছু বললো না, শুধু বললো,
“ঘুমাও। পরের কথায় কান দেওয়ার দরকার নেই। আল্লাহ আমাদের যা দিয়েছেন তা নিয়ে আমরা সুখী আছি।”

শ্রাবণী কিছু বললো না। তার নৈঃশব্দে নামা চোখের জলে বালিশ ভিজতে লাগলো। সে মনে মনে ভাবছে, একদিন সেও ধনী হবে। একটা ধনী ছেলেকে বিয়ে করবে। তখন কেউ আর তাকে এরকম করে কথা শোনাতে পারবে না। সবাই সম্মান করবে।

___________________

“এই, এখনও ঘুমাচ্ছ কেন? ওঠো।”

রাত্রি সামান্য ঠ্যালা দিলো শ্রাবণীর হাতে। শ্রাবণীর আরও আগেই ঘুম থেকে ওঠার কথা, কিন্তু সে এখনও ঘুমাচ্ছে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
“কেন?”

“কেন মানে? স্কুলে যাবে না?”

“ওই স্কুলে আমি আর যাব না। ওখানে কেউ আমায় পছন্দ করে না।”

“যাবে না মানে? কে তোমায় পছন্দ করে, আর কে করে না সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে, তোমাকে লেখাপড়া করতে হবে।”

শ্রাবণী উঠে বসে বললো,
“আচ্ছা, এমন কোনো স্কুল নেই, যেখানে শুধু নিম্নবিত্তরা পড়ে? যে স্কুলের সবাই দিনকে দিন শুধু নিরামিষ খেয়ে থাকে, কারোরই একটা-দুটোর বেশি ভালো জামা নেই, এমন কোনো স্কুল কি নেই আপু? আমাকে এমন একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও। প্লিজ!”

রাত্রি খুব কষ্টে চোখের অশ্রু আটকে রাখলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
“উঠে পড়ো। আর খেয়ে তৈরি হও। আমি তোমাকে স্কুলে দিয়ে আসবো।”

শ্রাবণী স্কুলে যাবে না বলে বেশ শক্তপোক্ত গোঁ-ই ধরেছিল। কিন্তু শেষমেশ তাকে রাত্রির জোরাজুরিতে স্কুলে যেতেই হলো।

__________________

আদিল সচরাচর বাইরে বের হয় না। তবে আজ সে বের হবে এবং হয়েছেও। সে এখন বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তার চুল পরিপাটি, পরনের পোশাক সুন্দর, চোখে সানগ্লাস। সে দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায়। তার ঠিক সামনে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। সে-ই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ঘড়িতে সময় দেখলো। বিকেল চারটা বেজে তিন মিনিট। অথচ মেয়েটা এখনও আসেনি। আদিলের হাতে একটি লাল জবা। বাড়ির অভ্যন্তরে লাগানো জবা গাছ থেকে সে বের হওয়ার সময় জবাটি ছিঁড়ে নিয়েছে।

রাত্রি আজ যারপরনাই অবাক হলো আদিলকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে শুনেছে এক্সিডেন্টের পর আদিল একা একা কখনও বাড়ির বাইরে বের হয়নি। আদিলকে আজ বেশ সুন্দরও লাগছে। এতদিন সে অগোছালো আদিলকে দেখেছে। যার চুলগুলো সব সময় অগোছালো থাকতো। সে আদিলকে টি-শার্ট, ট্রাউজার আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা ছাড়া কোনো ফরমাল ড্রেসে দেখেনি এর আগে। আজ আদিল একদম পরিপাটি। এমনকি সে চোখে সানগ্লাসও দিয়েছে। আদিল কি তবে সুস্থ হয়ে গেছে? কথাটা ভেবে ভালো লাগলো রাত্রির।

রাত্রি সামনে আসতেই আদিল বললো,
“ক’টা বেজেছে?”

রাত্রির হাতে ঘড়ি নেই, তাই চট করেই সে উত্তর দিতে পারলো না। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে বললো,
“চারটা ছয়।”

“ছয় মিনিট দেরি। কেন? আপনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখুন, ঘাম পড়ছে কপাল বেয়ে।”
আদিল ঘাম মুছলো রুমাল দিয়ে।

রুমাল নিয়েও বের হয়েছে? সত্যিই আদিল ভালো হয়ে গেল না কি? ভাবলো রাত্রি। জানতে চাইলো,
“আমার জন্য কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”

“দাঁড়িয়ে থাকতেই পারি। রিকশায় উঠুন।”

রাত্রি রিকশার দিকে তাকালো, এরপর আবার আদিলের দিকে। বললো,
“রিকশায় কেন উঠবো?”

“আমি বলেছি তাই।”

“রিকশায় ওঠা সম্ভব নয় ভাইয়া। এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি, মালিহাকে পড়াতে হবে না? আমি যাচ্ছি।”

রাত্রি এক পা সম্মুখে এগোলেই আদিল এক হাত প্রসারিত করে ওকে আটকালো। বললো,
“ওকে পড়াতে হবে না। আজ আপনি শুধু আমাকে পড়াবেন। রিকশায় যেতে যেতে অ আ, ক খ শেখাবেন। ইংরেজি আমি জানি। ছাব্বিশটা অক্ষরই পারি।”

রাত্রির ভুল ভাবনারা নিজেদের শুধরে নিলো। না, আদিল তো ভালো হয়নি। রাত্রি বিপদ অনুভব করছে। আদিলকে টপকে সে ভিতরে যাবে কী করে? রাত্রি ভাবনায় পড়ে গেল। আদিলের আদেশ শোনা গেল তৎক্ষণাৎ,
“উঠুন।”

রাত্রি বললো,
“আপনার সঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়, আপনি একাই যান। ঘুরুন। বিকালটাকে উপভোগ করুন।”

আদিল রাগ করলো। গম্ভীর গলায় বললো,
“আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না?”

“মাফ করবেন।”

আদিল পাশ থেকে একটা গাছের ডাল তুলে নিলো অকস্মাৎ। তার পাশে ডালের স্তুপ ছিল। কারা কী জন্য এই স্তুপ তৈরি করেছে জানা নেই। ডালটা রাত্রির দিকে তরবারির ন্যায় ধরে বললো,
“উঠুন।”

রাত্রি আদিলের কাণ্ডে ভয় পেল। সে যদি রিকশায় না ওঠে তবে কি আদিল তাকে এই গাছের ডাল দিয়ে মা’রবে? হ্যাঁ, চাইলেই মা’রতে পারে। আদিলের দ্বারা তো সবই সম্ভব। রাত্রি আশেপাশে তাকালো। মানুষজন দেখছে তাদের। কেউ বিস্ময়ে, কেউ আবার হাসছে। বয়স্ক রিকশাওয়ালাও হাসছে মিটিমিটি। এদের সামনে যদি আদিল সত্যিই তাকে আ’ঘাত করে এর চেয়ে অপমানের আর কী হবে?
আদিল আবারও তাকে রিকশায় ওঠার জন্য বললো। রাত্রি ভাবতেই পারছে না তাকে এখন আদিলের সঙ্গে রিকশায় ঘুরতে হবে। রাত্রি বললো,
“আমি চলে গেলে মালিহাকে পড়াবে কে? খারাপ রেজাল্ট করলে তো সেই আমাকেই দোষারোপ করবেন।”

আদিল ডাল দিয়ে আ’ঘাত করার ভঙ্গিমা করলেই রাত্রি দ্রুত রিকশায় উঠে বসলো। এতগুলো মানুষের সামনে অপমান হওয়ার চেয়ে রিকশায় ঘোরা অন্তত ভালো।
আদিল হাতের ডালটা ফেললো রিকশায় ওঠার পর। রিকশা চলতে শুরু করেছে। রাত্রির মুখ গম্ভীর। দৃষ্টি পাথর। আদিল বললো,
“আপনি রাগ করেছেন রাত্রি?” তার কণ্ঠ ভীষণ মোলায়েম।

“হুঁ।”

“আপনিও তো আমাকে রাগান। আমাদের মাঝে এত রাগারাগি কেন বলুন তো?”

রাত্রি জবাব দিলো না। আদিল বললো,
“আমাকে আর ভাইয়া ডাকবেন না।”

রাত্রি কিছু বলছে না দেখে আদিল আবারও রাগ করলো। রুক্ষ গলায় বললো,
“কিছু বলবেন না?”

রাত্রি এবারও চুপ রইল। তার কিছু ভালো লাগছে না। আদিলের এবার আর রাত্রির নীরবতায় রাগ হলো না। তার ঠোঁটে এক চিলতে স্নিগ্ধ হাসি ফুটলো। হাতের লাল জবাটি রাত্রির কানে গুঁজে দিলো সে।
রাত্রি সঙ্গে সঙ্গে আদিলের দিকে তাকালো। কতকটা বিস্ময়ে। আদিলের ঠোঁটে এখনও সেই স্নিগ্ধ হাসি। বললো,
“এবারও কিছু বলবেন না?”

রাত্রি কীয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে আদিলকে বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে দুর্বোধ্য আদিলকে বিন্দু পরিমাণ বুঝতে পারলো না। বললো,
“এরকম কেন করছেন?”

“কী রকম করছি?”

রাত্রি উত্তর না দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আদিল হঠাৎ বললো,
“আমি জানি রাত্রি, আমি অসুস্থ। কিন্তু যদি আমি ভালো হয়ে যাই, তবে আমি আরও একবার অসুস্থ হতে চাই আপনার জন্য।”

রাত্রি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো।
আদিল হেসে বললো,
“আমার অসুস্থতার কারণ হবেন?”

রাত্রি কানে গুঁজে দেওয়া জবাটি আদিলের হাতে দিয়ে বললো,
“কখনোই না।”

বলে সে রিকশা থামাতে বললো। আশ্চর্যভাবে আদিল কোনো বাধ সাধলো না। রাত্রি নেমে গেল। আদিল রিকশা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে রাত্রিকে দেখে। দেখতে দেখতে অস্ফুট স্বরে বললো,
“আপনি ইচ্ছুক হন বা না হন, তবুও আপনি আদিলের অসুস্থতার কারণ।”
#কালো_রাত্রির_খামে (১০)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________

আদিল বাড়ি ফিরেছে। এখন ঘড়িতে সময় পাঁচটা বেজে ছাব্বিশ। এই এতক্ষণ সময়টাতে সে একাই ঘুরেছে রিকশায়। কোথাও রিকশা থামায়নি। শহরটাকে দেখছিল এক ঝলক। ভালো লাগছিল। সে চেয়েছিল বৃষ্টি নামুক। সেই বৃষ্টি ভিজিয়ে দিক তাকে। সে ভিজতে ভিজতে রিকশা ভ্রমণ করবে। কিন্তু বৃষ্টি নামেনি, আকাশ মেঘলাও করেনি। আদিল নিজের রুমের দিকে এগোতে নিলেই পারভীন ডাকলেন,
“দাঁড়াও আদিল।”

সে আদিলের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আদিল তাকে খেয়াল করেনি আগে। ডাক শুনে ফিরে বললো,
“ওহ, তুমি ফিরেছো?”

আদিল এসে মায়ের পাশে বসলো। পারভীন ছেলেকে দেখে অবাক হচ্ছেন। তিনি ভাবেননি আদিল কখনও একা একা বাইরে বের হবে। আদিলের বাইরে বের হওয়াতে তিনি আনন্দ বোধ করছেন। কারণ এটা আদিলের সেরে ওঠার একটা লক্ষণ প্রকাশ করছে। কিন্তু তিনি সেই সাথে খুব চিন্তিতও। বললেন,
“তুমি রাত্রির সাথে এরকম কেন করছো?”

“কী রকম করছি?” আদিলের নির্বিকার প্রশ্ন।

“রহমান ভাই বলেছেন আমাকে, তুমি না কি ওকে ভয় দেখিয়ে রিকশায় উঠতে বাধ্য করেছো?”

“হুঁ, করেছি।” উত্তর দিতে আদিল এক মুহূর্ত সময় নিলো না।

“কেন? তুমি কি ওর কানে ফুলও গুঁজে দিয়েছো?”

“কে বলেছে?”

“সামিনা। ও দেখেছে।”

“সামিনা কে? তিন তলায় ভাড়া থাকে?”

“না, পাঁচ তলায় থাকে। তুমি সত্যিই করেছো এটা?”

আদিল হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো,
“করেছি আমি।”

“কিন্তু কেন?”

আদিল একটু নড়েচড়ে বসে বললো,
“আমার লুকোচুরি ভালো লাগে না। তোমাকে বলছি তাহলে।”
আদিল আরেকটু মায়ের নিকটে এগিয়ে গলার স্বর নিচু করে বললো,
“আই ওয়ান্ট টু ম্যারি হার!”

পারভীন স্তব্ধ হয়ে গেলেন ছেলের কথায়। আদিল কি বিয়ের কথা বলছে?
আদিল বললো,
“শোনো, তুমি আবার তার পরিবারের নিকট যৌতুক দাবি করো না। আমি তাকে কথা দিয়েছি, আমি তার বাবার থেকে একটা টাকাও যৌতুক নেবো না। আমি এখন রুমে যাব মা?”

পারভীন রুদ্ধ চোখে চেয়ে থেকে সম্মতি দিলেন,
“যাও।”

আদিল চলে গেল।
পারভীন গভীর চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি কখনও ভাবেননি এরকম কিছু ঘটবে। কিন্তু এটা বোধহয় তার ভাবা উচিত ছিল। তার উচিত হয়নি রাত্রির বয়সি একটা মেয়েকে টিচার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। খুব বড়ো ভুল করে ফেললেন কি তিনি?

__________________

সকাল সকাল পারভীন ডেকে পাঠিয়েছেন রাত্রিকে। রাত্রি বুঝতে পারছে না তাকে এখন এত জরুরি তলব করার মানে কী? পারভীন ফোনে কারণ বলেননি, শুধু বলেছেন জরুরি। রাত্রি তার কথা অমান্য না করে এলো। ডোর বেল বাজাতেই সোহাগি দরজা খুললেন। পারভীন বসে আছেন সোফায়, চা খাচ্ছেন। সোহাগীকে বললেন রাত্রিকেও এক কাপ চা দেওয়ার জন্য। সোহাগি মুহূর্তেই আরেক কাপ চা নিয়ে হাজির হলেন। রাত্রি অবশ্য তা খেলো না। জানতে চাইলো,
“কেন ডেকেছেন আন্টি?”

বাড়িটা খুব নিস্তব্ধ। মালিহা এবং আদিল সম্ভবত এখনও ঘুমাচ্ছে। পারভীন কাপের চা শেষ করেছেন। রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আদিলের ব্যাপারে কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।”

রাত্রির আজব লাগলো পারভীনের কথা। আদিলের ব্যাপারে তার সঙ্গে কী কথা বলবে?
পারভীন বললেন,
“প্রায় কয়েক বছর আগে আমার ভাইয়ের মেয়ের সাথে ওর বিয়ের কথা পাকা করেছিলাম। কথা ছিল ও যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবে তখন ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু যখন ও ফিরলো তখন তো সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। তুমি তো জানো তা।”

“জি।”

“আদিল এখন ঠিক নেই। ও অসুস্থ। ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি সহজে মেয়ে পাবো না। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে আমার ভাই ওর এ অবস্থা জানা সত্ত্বেও ওর সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি।”
পারভীন কিছুক্ষণের জন্য থেমে বললেন,
“তুমি কি জানো এসব আমি তোমাকে কেন বলছি?”

রাত্রি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। হয়তো পারভীন আদিলের আচরণ সম্পর্কে কিছু জেনে গিয়েছেন।

পারভীন বললেন,
“আমি জানি তুমি ভালো মেয়ে। কিন্তু তুমি নিজেই হয়তো আদিলকে বিয়ে করতে চাইবে না। যতটুকু আমি বুঝতে পারি। আর যদি তুমি রাজিও থাকতে তাহলেও আসলে তোমাদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না, কারণ আমি ইতোমধ্যে কারো সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

রাত্রি বললো,
“আমাকে এখন কী করতে হবে?”

“দেখো, তুমি যদি আদিলের সামনে থাকো, ও তোমার প্রতি ধীরে ধীরে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। আমি চাইছি না এমন কিছু হোক। তাই আমি বলবো, তুমি মালিহাকে আর পড়াতে এসো না।”

রাত্রি ধারণা করেছিল পারভীন এরকম কিছুই বলবে এবং সে তাই বললো। কিন্তু তবুও রাত্রি কথাটা শুনে যেন ধাক্কা খেলো, কষ্ট পেল। সত্যিই টিউশনিটা হারালো সে! তার আয়ের একটা উৎস কমলো। এতদিন ধরে এই টাকা দিয়ে তার পরিবারের যে উপকার হতো, সে সেই উপকারটুকু কীভাবে পূরণ করবে? আদৌ কি সে নতুন টিউশনি পাবে? চিন্তায় যেন চোখে অন্ধকার নেমে আসে রাত্রির। কিন্তু তবু সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো,
“ঠিক আছে, যদি এতে সব ঠিক হয়ে যায়।”

পারভীন রাত্রির দিকে ওর এ মাসের বেতন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“পুরো মাসের বেতনই আছে।”

রাত্রি টাকাটা নিয়ে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ধন্যবাদ।”
এরপর সে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“তাহলে আমি যাচ্ছি। আর হয়তো দেখা হবে না। ভালো থাকবেন। মালিহা লেখাপড়ায় উন্নতি করুক সেই দোয়া রইল।”

পারভীন রাত্রিকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে রাত্রির দু চোখের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। যখন সে বাইরে নেমেছে তখন কেউ একজন যেন তাকে ডাকলো। গলাটা পরিচিত। এটা কি আদিল? সম্ভবত ঘরের বারান্দা থেকে ডেকেছে সে। রাত্রি ফিরে দেখলো না। আদিলই তো দায়ী তার টিউশনি চলে যাওয়ার পিছনে।

আজ আবারও রাত্রি সেই গাছের নিচের বেঞ্চিটায় বসলো। কেন এত কষ্ট হচ্ছে তার? কত টাকাই বা পেতো সে? দেড় হাজার। এটা কী এমন বড়ো? রাত্রি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েও সক্ষম হলো না। তাদের জন্য দেড় হাজার টাকা নিছকই কম নয়। এই দেড় হাজার টাকার অপূর্ণতা কীভাবে ঘুচাবে সে? রাত্রির চোখ বেয়ে পানি নামে।

___________________

এনামুল শিকদারের ঘরে এক সময় এমন দীনতা ছিল না। তারা সচ্ছলই ছিল বলা যায়। সংসারের খরচ মিটিয়ে সামান্য সঞ্চয়ও ছিল। কিন্তু তার স্ত্রীর দুরারোগ্য রোগ ধরা পড়ার পর তার চিকিৎসায় সব শেষ হয়ে যায়। ধার দেনা করেও স্ত্রীর চিকিৎসা চালাতে হয় তাকে, কিন্তু শেষমেশ তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে। সেই থেকে যে দীনভাব তাদের পিছু নিয়েছে আর গেল না। এখনও তাড়িয়ে চলেছে তাদের। পাওনাদাররা চাপ দিচ্ছে দেনা পরিশোধের জন্য। কিছু দেনা তিনি শোধ করেছেন। কিন্তু এখনও ঢের দেনা মেটানো বাকি! এনামুল শিকদার জানেন না তিনি কীভাবে কী করবেন। এদের টাকা না দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। তার জমিজমা নেই যা বিক্রি করে দেনা শোধ করবেন। যেটুকু ছিল তা আগেই বিক্রি করা শেষ। সঞ্চয়ও নেই কোনো। পাওনাদারদের কাছ থেকে কেবল সময় নিয়ে যাচ্ছেন। এনামুল শিকদার ভাবেন মরে গেলে হয়তো তিনি এসবের থেকে পরিত্রাণ পাবেন। কিন্তু তিনি মরে গেলে এ দেনার চাপ তো তার ছেলেমেয়েদের উপর এসে পড়বে। এনামুল শিকদার চিন্তায় নুয়ে পড়া মুখ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন।
রাত্রির নিজেরও মন ভালো নেই, এর উপর বাবার এমন বিধ্বস্ত মুখ দেখে সে আরও চিন্তিত বোধ করলো।

“কিছু হয়েছে বাবা?”

“না, কী হবে?”
বলে এনামুল শিকদার রুমে চলে যান।

রাত্রি বাবার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। শ্রাবণী এই ফাঁকে ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছিল, রাত্রি দেখে ফেলে ধমকে উঠলো,
“এই, কোথায় যাচ্ছ?”

শ্রাবণী বললো,
“যাই না একটু, কী হবে?”

“এই রাতে কোথায় যাবে? পড়ালেখা নেই?”

রাত্রি সদর দরজা বন্ধ করে ওকে টেনে আনলো রুমে। শ্রাবণীর একজনের জন্য চিন্তা হচ্ছে। সেই যে চিলেকোঠায় ভাড়া থাকা লোকটা। কী যেন নাম? শ্রাবণীর মনে পড়ছে না। লোকটা কি আদৌ তার নাম বলেছিল? না বলেনি। সেও তো জানতে চায়নি। লোকটা কি খেয়েছে? তার কাছে তো এক পয়সাও ছিল না। শ্রাবণী বললো,
“চিলেকোঠার লোকটাকে তুমি দেখেছো আপু?”

“কেন?”

“উনি খুব গরিব। ওনার কিছু নেই। জানো, ওনার শেষ সম্বল ছিল একশ দশ টাকা। কিন্তু পকেটমার ওনার সেই টাকা নিয়ে গেছে। উনি এখন একেবারে নিঃস্ব। ওনার কাছে এক পয়সাও নেই।”

রাত্রি বললো,
“তুমি এত কিছু জানলে কীভাবে?”

“ওনার সাথে আমার কথা হয়েছিল। আমার মনে হয়, উনি আজ সারাদিন ধরে না খেয়ে আছেন।”

“তাহলে ভেবে দেখো, কেউ সারাদিন ধরেও না খেয়ে থাকে, আর তুমি তিনবেলা খেতে পাও, তারপরও তোমার কত আক্ষেপ।”

“এটা বলতে পারছো, কিন্তু এটা বলতে পারো না, কেউ তিনবেলাই মাছ-মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে।”

রাত্রির মনে হলো শ্রাবণীর সঙ্গে তার আর কথা বাড়ানো অনুচিত। সে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। মাথা থেকে এখনও টিউশনি হারানোর যন্ত্রণাটা যাচ্ছে না। সে কাউকে জানায়নি তার টিউশনিটা চলে গেছে।
রাত্রির চোখ লেগে এসেছিল ঘুমে, এরই মধ্যে মোবাইলের কলের শব্দ তাকে জাগিয়ে দিলো। মোবাইল হাতে নিয়ে আদিলের নাম দেখতে পেল। সে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকলো ওই নামের দিকে এবং শেষে কল কেটে নাম্বারটা ব্লক করে দিলো। এই ব্লক চিরদিনের জন্য। রাত্রি চোখ বুজলো। চেষ্টা করলো ঘুমানোর। কিন্তু ঘুম তার চোখে আর নামলো না।

___________________

উপর তলার ভাড়াটিয়া নুরজাহানের কথা শুনে মিথিলা আর বসে থাকতে পারলো না। সে একের পর এক কটূক্তি করেই চলেছে। বিষয়টা থেকে প্রিয়ারা সরে আসতে চাইলেও নুরজাহান শুধু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই কথা বলছেন। উপায় না দেখে মিথিলাকে আসতেই হলো। সে এসেই বললো,
“আমি ডিভোর্সি তাতে আপনার এত কী সমস্যা? আমি আমার বাবার ঘরে থাকছি, আপনার ঘরে তো থাকছি না, তাহলে এত কেন সমস্যা আপনার? আপনি জানেন কেন আমার ডিভোর্স হয়েছিল? না জেনে এতকিছু বলেন কেন? আপনারা মনে করেন একটা মেয়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে মানে সেখানে দোষটা অবশ্যই মেয়েরই। না, দোষ শুধু মেয়েদের থাকে না। মেয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। আপনাদের মতো মানুষরাই মেয়েটাকে দোষী বানিয়ে দেন।”

মিথিলা হাঁপাচ্ছে এক সঙ্গে এত কিছু বলতে গিয়ে। তার কণ্ঠস্বর ছিল অস্বাভাবিক মাত্রার উচ্চ। যাতে রাত্রির ঘুম ভেঙে গেল। সে ধরফড়িয়ে উঠে আসলো বসার ঘরে। নুরজাহানের মুখ চুপসে গেছে। সে কিছু বলতে পারছে না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মিথিলার দিকে। মিথিলার চোখ ফেটে এক ফোঁটা নোনা অশ্রু নেমে গেল। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কষ্টে তার বুকের ভিতর অদৃশ্য যন্ত্রণার হাহাকার হচ্ছে। সে প্রায় দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো।
নুরজাহান কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
“আমি যাই ভাবি।”

নুরজাহান চলে যায়। তবে রাত্রি কিংবা প্রিয়ারা কেউই নিজেদের জায়গা থেকে নড়তে পারে না। তারা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। যেন দুটো পাথরের মূর্তি। রাত্রিরও ভীষণ কষ্ট হয়। পারিবারিক সম্পর্কগুলো এমনই। এখানে একজনের ব্যথায় অন্য জন ব্যথিত হয়। একজনের কষ্ট অপর মানুষগুলোর জন্যও যন্ত্রণাদায়ক। প্রিয়ারা রাত্রির চোখে পানি দেখে পরিবেশ হালকা করতে বলে,
“তুমি টিউশনিতে যাবে না?”

“আমি টিউশনিটা হারিয়েছি!”
বলে রাত্রি রুমে চলে যায়।
প্রিয়ারা স্তম্ভিত হয়ে যান।

(চলবে)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here