বৃষ্টি শেষে রোদ পর্ব -০৩

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ৩)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

চিঠি হাতে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল আরশি। দুরুদুরু বুকে বেশ কয়েকবার অগন্তুকের চিঠিটা পড়ে নিল সে। সেই অগন্তুক কে জানার তীব্র কৌতুহল হানা দিয়েছে মনে।
আজ নতুন নয়। গত সাত মাসে এই বারান্দায় ২৬ টা চিরেকুট পেয়েছে সে। নিয়ম করে প্রতি সাপ্তাহে একটা চিঠি। বৃহস্পতি, শুক্র, শনি প্রতি সাপ্তাহে এই তিন দিনের মাঝে যে কোনো একদিন চিরেকুট আসে। নির্দিষ্ট কোনো দিন উল্লেখ নেই। তাই কখন এসে রেখে যায় তা বোঝার উপায় নেই। রিদকে একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল তার। কিন্তু সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও তাকে তার রুমে দেখে এসেছে। রাতে হসপিটাল থেকে ফেরার পর তিনি আর বাড়ি থেকেই বের হয় নি। তাহলে নিয়ম করে চিরেকুট রেখে যাওয়া ব্যাক্তিটা কে হতে পারে?

দুঃখজনক হলেও সত্য এই ছাব্বিশ টা চিরেকুটের মাঝে একটাতেও তার নাম উল্লেখ নেই। নেই তাকে জানার কোনো সূত্র। অগন্তুক হয়তো চাইছে তাকে ঘিরে তীব্র কৌতুহল সৃষ্টি হোক। বুক টিপটিপ করা অনুভূতি তৈরি হোক।

সাবিহার গলা শুনে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে রুমে ফিরে আসে আরশি। চিরেকুট টা লুকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বই গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। সাবিহা ব্যাগ কাধে আরশির রুমে প্রবেশ করে কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
“রেডি হতে এতক্ষন লাগে? কতক্ষণ ধরে এসে বাইরে অপেক্ষা করছি। জানিস না পরিক্ষার আগের দিনের ক্লাস কত গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাস শুরু হতে আর আধা ঘণ্টাও নেই। নির্ঘাত আজ তোর জন্য আমাকেও স্যার এর বকুনি খেতে হবে।”

আরশি ব্যাগ কাধে নিয়ে বলে,
“হয়ে গেছে আমার। সময় মতোই পৌছে যাবো, চল বের হই।”
,

পুরো রাস্তা বিষণ্ন মনে চুপচাপ ছিল আরশি। মনটা আজ সকাল থেকেই খারাপ। মামার বাড়ি থেকে বাসায় ফেরার পর ঘটে গেছে এক ঘটনা। বর্তমানে সেটা দুর্ঘটনা বললেও ভুল হবে না।

সকালে বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরই বাড়িওয়ালা এসেছিল ভাড়া নিতে। লোকটা অনেকটাই কর্কশ স্বভাবের। তাছাড়া এ মাসে টাকার সমস্যা থাকায় ভাড়া দিতে লেট হয়েছে কিছুদিন। যার কারণ স্বরুপ সকাল সকাল এসে অনেক কথা শুনিয়েছে।
ফলস্বরুপ আরশির বাবা রাগ করে তার কাছে থাকা ছয় হাজার টাকা বাড়িওয়ালার হাতে দিয়ে বলে, বাকিটা রাতে অফিস থেকে ফিরেই বাসায় পাঠিয়ে দিবে।

আরশির স্কুলের বেতন ও পরিক্ষার ফিস আজকে দেওয়ার কথা ছিল। এমন একটা ঘটনার পর সেও বাবার কাছে চাইতে আর সাহস করেনি। কারণ এই মুহুর্তে বাবার হাতে থাকা সব টাকাই বাড়িওয়ালাকে দিয়ে দিয়েছে সে। বিষণ্ন মনে চুপচাপ বেড়িয়ে যায় স্কুলের উদ্দেশ্যে।
,

স্কুলের সামনে পৌছেই ক্ষনিকটা অবাক হলো আরশি। গেটের সামনে কয়েকটা ছেলে দাড়িয়ে ছিল বাইক নিয়ে। তাদের মাঝে একজন ছিল রুহি আপুর হবু দেবর মানে ফারুক। আরশিকে দেখেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আরে বেয়াঈন কেমন আছেন?”

সৌজন্য মূলক ভাবে আরশিও বলে,
“জ্বি ভালো। আপনি?”
“এতক্ষন শুধু ভালো ছিলাম। এখন খুব ভালো।”
“কেন?”
“এই যে আপনার সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো, তাই। এটাকে কি সৌভাগ্য বলবো নাকি কাকতালীয় বলবো? বলুন তো।”

প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না আরশি। একবার হাত ঘরির দিকে চেয়ে বলে,
“আচ্ছা আমি এখন আসি। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে এখনই।”

বলেই ফারুককে কিছু বলার সুজগ না দিয়ে ভেতরে চলে গেলো আরশি। পুরো স্কুল অনেকটাই নিরব হয়ে গেছে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, এই লোকের সাথে আজাইরা কথা বলার কোনো মানে হয়?

হাটতে হাটতে সাবিহা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“ছেলেটা কে?”
“তোকে বললাম না গতকাল রুহি আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
“হুম।”
“আপুর হবু দেবর।”

সাবিহা কিছুটা ভেবে বলে,
“তাহলে তো সে এখানকার না। অন্য এলাকার ছেলে। এখানে কি করছে? নাকি তোকে ফলো করছে?”
আরশি কিছু না ভেবে বলে,
“জানি না।”

সাবিহা কিছুটা মুচকি হেসে বলে,
“মনে আছে, কয়েক মাস আগে নাহিদ্দা তোকে ডিস্টার্ব করতো দেখে রিদ ভাইয়া আর রোহান ভাইয়া এসে তাকে সবার সামনে কি থা’প্পর গুলোই না মারলো। রিদ ভাইয়ার চ’র গুলো খেয়ে বেচারার গাল দুটো ফুলে এমন হয়ে গিয়েছিল যে, এখনো ক্লাসের সবাই তাকে টমেটো বলে ক্ষেপায়। এখন এই ছেলেও যদি তোর পিছু নেয়, তাহলে নির্ঘাত তার কপালেও দুঃখ আছে।”

বলেই হেসে দিল সাবিহা। আরশি কিছু বললো না। ভয় হচ্ছে সত্যিই যদি এমন কিছু হয়, তাহলে অনেক বড়ো ঝামেলা হয়ে যাবে। কারণ কিছুদিন পর ফারুক তাদের আত্মিয় হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ক্লাসের সামনে এসেই স্যারের অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়লো দুজন।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

রুদ্র চৌধুরী বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাঈমুনা পাশ থেকে ডেকে বলে,
“আফা ফোন দিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে বাসায় গিয়ে পৌছেছে সে।”
“আচ্ছা।”
“তোমাকে নাকি ফোন দিয়েছিল। ফোন ধরো নি তুমি।”
“তখন ওয়াশরুমে ছিলাম। তাই ধরতে পারিনি।”

স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলে বেড়িয়ে গেলো রুদ্র চৌধুরী। হয়তো এই ব্যপারে আর কথা বলতে ইচ্ছুক না সে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিল মাঈমুনা। এদের ভাই বোনে সম্পর্ক টা কি সব সময় এমন গম্ভিরতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

অবশ্য এটারও একটা কারণ আছে। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। আরশির বাবা ও মায়ের বিয়েটা হয়েছিল ফ্যামিলির অবাধ্য হয়ে। আরশির বাবার আর্থিক অবস্থা দুর্বল দেখে বাবা ও দুই ভাই কেউই আরশির মাকে এমন ছেলের হাতে দিতে রাজি হয়নি। অতঃপর অন্যত্রে বিয়ে ঠিক করলে ফ্যামিলির অমতে লুকিয়ে বিয়ে করে নেয় তারা।

মেয়ের এমন কান্ড মেনে নিতে না পেরে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আরশির নানার। তখন সুস্থ হলেও তার দুমাস পর মারা যান তিনি। যার জন্য রিদের বাবা ও রোহানের বাবা দুই ভাই আজও মনে করে আরশির মায়ের জন্যই তাদের বাবা মারা গেছে।

বছর দুয়েক পরে মায়েক কথা রাখতে বোনকে মেনে নিল তারা। তবে সম্পর্কটা এখন আর আগের মতো নেই। ভাই বোনের ভালোবাসার সম্পর্কটা রুপ নিয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সম্পর্কে। মা বলে গিয়েছিল যা হওয়ার হয়েছে, ভাই বোনের মাঝে যেন দ্বিতীয় বার সম্পর্ক ছিন্ন না হয়। সেই কারণেই হয়তো আজও ভালো থাকার অভিনয় করে তারা। তবে সম্পর্ক খুব একটা ভালো, এমনটাও না।
এই কারণে আরশি ও আরিশা দুজন ভাগ্নী হয়েও মামাদের আদর খুব একটা পায়নি তারা। সম্পর্ক টা শুধু মাত্র দায়িত্বের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

এদিকে তৃতীয় ক্লাসের সময় রবিউল স্যার হাতে একটা খাতা নিয়ে ক্লাস রুমে প্রবেশ করে। যদিও তিনি ক্লাস নেয় না। স্টুডেন্ট ভর্তি, বেতন, উপবৃত্তি এসবেরই হিসেব রাখেন। তবুও সবাই তাকে রবিউল স্যার বলেই চেনে।

টেস্ট পরিক্ষার আগে এটাই লাষ্ট ক্লাস। আর এখনো আট জনের বকেয়া পরিশোধ করা বাকি। তাই খাতায় খুঁজে খুঁজে একে একে সবার নাম বলছেন তিনি। নাম শুনোই একজন একজন করে দাড়াচ্ছে। ভয়ে চোখ বুঁজে রইল আরশি। কখন যেন তার নাম বলে তাকেও দাড় করায়? ক্লাসে শতাধিক স্টুডেন্টের মাঝে মাত্র আট জনের বকেয়া বাকি। তাই তাদেরকে দাড় করানো হচ্ছে। বাকি সবাই তাদের দিকে তাকাচ্ছে। আর তাদের মাঝে আরশিও একজন হবে। কি লজ্জার বিষয়।

এ প্রথম বার এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতির শীকার হতে হচ্ছে তাকে। সবই ঐ বাড়িওয়ালা বুড়োটার জন্য। এই মুহুর্তে তাকে ধরে তার মাথায় যে কয়টা চুল অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। যারা যারা দাড়াচ্ছে তাদের দিকে বাকি সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে। সে যখন দাড়াবে তার দিকেও হয়তো সবাই এমন করে তাকাবে৷ ভাবতেই কাঁন্না পাচ্ছে আরশির।

কিন্তু রবিউল স্যার আরশির নাম বলল না। আট জনের নাম বলে খাতা বন্ধ করে নিল। তার মানে আট জনের মাঝে আরশি নেই। তাদের মাঝে দু’জন অনুপস্থিত ছিল। বাকি ছয়জনকে অফির রুমে যোগাযোগ করার জন্য বলেছে।

রবিউল স্যার চলে যাওয়ার জন্য অনেকটাই অবাক হলো আরশি। সেও তো বকেয়া পরিশোধ করতে পারেনি। তাহলে তাকে দাড় করায়নি কেন? এতক্ষন লজ্জা জনক পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়ে ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ডটা যেন স্থির হতে শুরু করেছে।

ছুটির পর কৌতুহল নিয়ে রবিউল স্যারের সাথে দেখা করে সে। বকেয়ার বেপারে জানতে চাইলে তিনি বলে,
“ক্লাস শুরু হওয়ার পর রিদ এসে তোমার সব বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছে।”

আরেক দফা অবাক হয় আরশি। সব সময়ই ছোট বড়ো সব বিপদের মাঝেই কোথা থেকে যেন এই মানুষটা তার পাশে এসে হাজির হয়ে যায়। আবার সব সমস্যা সমাধান করে কোনো কিছু না বলেই নিরবে চলে যায়। সব কিছু কিভাবে বুঝে যায় তিনি? খবর পায় কোথায়? আজব মানুষ!

To be continue……………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here