বৃষ্টি শেষে রোদ পর্ব -১৭+১৮

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৭)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

কে*টে গেলো আরো কিছুদিন। কোনো কিছুই আগের মতো নেই আর। রিদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আজ মাস খানেক। একটা ঝড়ে মুহুর্তেই কতটা পর হয়ে গেছে সে।
স্যরি বলা উচিৎ ভেবে আরশি দু’এক বার যোগাযোগ করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। এরপর আর যোগাযোগ করার সাহস হয়ে উঠেনি। সাথে খুব রাগও হচ্ছে রিদকে নিয়ে। সামান্য একটা বিষয়কে কতটা বড়ো করে ফেলেছে সে। ফারুক তো তার ভাইয়ের মতোই। তাকেও ছোট বোনের মতোই সব সময় সাপোর্ট করে। রিদ চলে যাওয়ার পর থেকে এই দুই বছরে কোনো সমস্যা হলে ফারুক ভাই’ই তাকে হেল্প করেছে। তাহলে তার সাথে কথা বললে সমস্যা কোথায়? আজব!

আজ হটাৎ কলেজ ছুটির পর ইয়াশার সাথে দেখা। কিছুটা ভ্রু-কুচকালো আরশি। ফারুক ভাইয়ের তো ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষ। এখন কলেজে আসেনা প্রয়োজন ছাড়া। তবুও ইয়াশা কলেজের সামনে দাড়িয়ে কি করছে? তার চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। আরশিকে দেখেই তার কাছে এগিয়ে আসে। হয়তো এতক্ষণ আরশির জন্যই অপেক্ষা করছিল।

আরশির পাশে বসে কাঁন্না করছে ইয়াশা। আরশি কারণ জানতে চাইলে ইয়াশা জানায়, ফারুক তিন দিন আগে ব্রেকআপ করে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে তার সাথে। আরশি কিছুটা শান্তনা দিয়ে ব্রেকআপের কারণ জানতে চাইলে ইয়াশা বলে,
“আমি কিছু করিনি। হুট করেই সে বলে, আর রিলেশন রাখবে না। আমার দোষ কি সেটাও বলেনি। শুধু বলল, আমাকে নাকি এখন আর সহ্য হয় না তার। আমি অনেক কেঁদেও তাকে ফেরাতে পারিনি।”

আরশি কিছুটা ভেবে বলে,
“তো আপু, আমি আপনাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি?”
ইয়াশা চোখ মুছে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে,
“আপনি তাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন? আমার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিতে পারবেন?”
আরশি তাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
“আচ্ছা আমি ভাইয়াকে বুঝিয়ে চেষ্টা করবো আপনার সাথে মিট করিয়ে দিতে।”
ইয়াশা আবারও কেঁদে বলে,
“অনেক দিনের রিলেশন আমাদের। এই রিলেশন টিকিয়ে রাখতে ও যা যা বলেছিল সব মেনে নিয়েছিলাম। দু’বার,,,,,,,,

“”””””””””””””””””””””””””””””””

বাসায় বসে সন্ধায় ফারুককে কল দিল আরশি। একবার কল হতেই রিসিভ করে সে। আরশি কথা না বাড়িয়ে মেইন প্রসঙ্গে গিয়ে বলে,
“ভাইয়া, কালকে ফ্রি আছেন?”
“কালকে,,, হুম কেন?”
“একটু জরুরি দরকার ছিল। দেখা করা যাবে একটু?”

ফারুক কিছু না ভেবেই বলে,
“হুম, আমি নিজেই ভাবছিলাম কালকে তোমাকে দেখা করতে বলবো। যাক ভালোই হলো। কখন দেখা করতে হবে?”
“আমি তো এমনি বাসা থেকে বের হতে পারবো না। কলেজ ছুটির পর সেখানে দেখা করতে পারবেন?”
“আচ্ছা সমস্যা নেই, আসবো আমি।”

পরদিক কলেজ ছুটির পর দেখা হয় তাদের। লাঞ্চ টাইমে ফারুক একটা ভালো রেস্টুরেন্টে বসে বসে কথা বলতে চাইলে অসম্মতি জানায় আরশি। এমনিতেও এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। তাই কলেজের বড়ো দিঘিটার পাড়ে দাড়িয়ে কথা বলছে দুজন। আরশি ইয়াশার প্রসঙ্গে বলবে তার আগেই ফারুক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“তোমার টা পরে শুনবো। আগে আমি কেন দেখা করতে চেয়েছি তা শুনবে না?”
আরশি এতকিছু না ভেবে বলে,
“আচ্ছা বলুন।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দু’পা পিছিয়ে গেলো ফারুক। আচমকাই এক হাটু ভাজ করে বসে একটা ডায়মন্ডের রিং আরশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“তোমার মায়াবি চোখ দুটো আবদ্ধ করে ফেলেছে আমায়। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্তে আমি স্বর্গীয় সুখ অনুভব করি। ইদানিং কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার পুরো হ্যাপিনেস টাই তোমার মাঝে আটকে আছে। তুমিহীন নিজেকে শুন্য মনে হয় খুব। এ নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। আই থিংক,,, ওম,,,, আই ফিল লাভ উইথ ইউ। আই প্রমিস, কখনো তোমার স্বাধীনতায় বাধা হবো না। শুধু দিন শেষে আমায় একটু ভালোবাসবে, আমি এতটুকুতেই হ্যাপি থাকবো। মাথায় তুলে রাখবো তোমায়, আই প্রমিস।”

এক মুহুর্তের জন্য মুর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে আরশি। ফারুকের বলা সব কথা যেন মাথায় উপর দিয়ে যাচ্ছে। আরশি কিছুটা বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বলা,
“ভাইয়া, এসব নিয়ে মজা আমার একদম পছন্দ না।”
ফারুক পাল্টা বলে,
“এটা কোনো মজা নয়।”
“মানে!”
“মানে সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার হাতটি ধরে বাকিটা জীবন পাড়ি দিতে চাই। ডু ইউ লাভ মি?”

এবার যেন সত্যিই মাথা ঘুরে উঠলো আরশির। ফারুক ভাই এসব কি বলছে? সে তো আমার আপন ভাইয়ের মতোই ছিল। এবার আরশি কিছুটা রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“এসব কি বলছেন ভাইয়া? আপনাকে আমি নিজের ভাইয়ের মতোই মনে করতাম। তাছাড়া আপনার একটা গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বত্তেও আপনি কিভাবে আমাকে নিয়ে এসব ভাবতে পারেন?”

“গার্লফ্রেন্ড ছিল। এখন আর নেই। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার সাথে এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই আমার। তাছাড়া আমি মন থেকে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”

কিছুটা তাচ্ছিল্য হাসলো আরশি। অতঃপর বলে,
“কে কাকে ছেড়ে গেছে তা আমার ভালো করেই জানা আছে। আর এই ব্যাপারে কথা বলতেই আমি আপনার সাথে দেখা করেছি। অন্য কোনো কারণে না। ইয়াশা আপু আপনাকে সত্যিই মন থেকে ভালোবাসে। সে খুব সহজ সরল একটা মেয়ে। তাকে নিয়ে খেলার অধিকার আপনার নেই।”

এবার উঠে দাড়ায় ফারুক। ক্ষনিকটা কপাল কুচকে বলে,
“সে সব বলে দিয়েছে তোমাকে তাই না? বলেছিলাম বেশি বাড়াবাড়ি না করতে। এবার সে আমার আসল রুপ দেখতে পাবে।”
আরশি আচমকাই ফারুকের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
“আপনি কি করবেন তা আমার ভালো করেই জানা আছে।”
বলেই ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিলো দিঘির মাঝে। কয়েক সেকেন্ডে ঘটে যাওয়ায় স্থির দৃষ্টিতে দিঘির দিকে চেয়ে আছে ফারুক।

তখন ইয়াশা আরশিকে বলেছিল ফারুকের হু’মকির কথা। রিলেশন টিকিয়ে রাখতে দু’বার রুম ডেটে গিয়েছিল তারা। ফারুকের ফোনে ইয়াশার আপত্তিকর অনেক ছবি আছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যেগুলো নেটে ছেড়ে দেওয়ার হু’মকি দিয়েছিল সে। ইয়াশার কথায় আরশি ক্ষনিকটা অন্যদিকে ফিরে অতঃপর তার দিকে চেয়ে বলে,
“ছি আপু! এসব কি কখনো ভালোবাসা প্রমানের বা ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার মাধ্যম হতে পারে?”
ইয়াশা আবারও চোখের পানি মুছে বলে,
“তখন আমি বুঝতে পারিনি এতকিছু হয়ে যাবে। না বুঝেই নিজের এত বড়ো সর্বনাশ করে বসেছি। যা এখন বুঝতে পারছি।”

আরশি ফোনটা ফেলে দিলে ফারুক কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকে। অতঃপর বড়ো বড়ো চোখের দৃষ্টিতে আরশির দিকে চেয়ে বলে,
“এটা কি করলে তুমি? আমার এত দামি ফোন,,,”
ফারুকের কথার মাঝেই আরশি বলে,
“যত দামিই হোক। তা একজন মেয়ের ইজ্জতের চাইতে বেশি দামি না। আর আপনি কেমন মানুষ তা আমার জানা হয়ে গেছে। আসলে রিদ ভাইয়াই ঠিক বলেছিল। কু’কুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। আর কখনোই সামনা-সামনি দাড়িয়ে কথা বলা দুরে থাক, আমাকে কল বা মেসেজ করারও দুঃসাহস দেখাবেন না।”

বলেই চলে যেতে প্রস্তুত হলো আরশি। ফারুক রেগে আরশিকে কিছু বলতে যাবে তার মাঝেই রোহানের কণ্ঠ শুনে থমকে গেলো সে। পাশে ফিরে দেখে রোহান তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে এসে আরশির দিকে চেয়ে বলে,
“কলেজ ছুটি হয়েছে অনেক্ষণ হলো। কতক্ষন ধরে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছি। বের না হয়ে এখানে কি করছিস?”
আরশি রাগের মাঝে বলে,
“নিজের চরম ভুলের মাশুল দিচ্ছি।”

কিছু না বুঝে ভ্রু কুচকে তাকায় রোহান। আরশি নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলে,
“তুমি এখানে কি করছো ভাইয়া?”
“ফুপি এখন আমাদের বাড়িতে। তাই আমাকে পাঠালো তোকে নিয়ে যেতে।”
কিছু বললো না আরশি। রোহান এবার ফারুকের দিকে চেয়ে বলে,
“তো কি খবর ছোটভাই? ভালো আছো?”
ফারুক নিজের রাগ দমিয়ে রেখে কিছুটা গোমড়া মুখে বলে,
“হুম ভাইয়া ভালো। আপনি?”
“হুম ভালো। তো তুমিও চলো আমাদের সাথে?”
“না ভাইয়া, অন্যদিন। আজ কিছু জরুরি কাজ আছে আমার।”
বলেই হনহন করে হনহন করে হেটে চলে গেলো সে। রোহান কিছু না বুঝে তার দিকে চেয়ে থাকলে পাশ থেকে আরশি বলে,
“চলুন ভাইয়া, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“”””””””””””””””””””””””””””””””

রিদকে আর মেসেন্জার ওয়াটসএ্যাপ কোথাও এ্যাকটিভ দেখা যায় না। হয়তো সবগুলো বন্ধ করে দিয়েছে সে৷ আরশি যোগাযোগ করতে চাইলেও যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম রাখেনি রিদ।

আরশির এক ক্লাসমেট হ্যা’কিং-এ পারদর্শী। টাকার বিনিময়ে আইডি হ্যা’ক এবং হ্যা’ক হওয়া আইডি ঠিক করে দেয়। তাকে দিয়ে রিদের আইডিটা হ্যাক করে আরশি। মেসেজ অপশনে গিয়ে হুট করেই যেন চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। একটা আইডি থেকে রিদের কাছে অনেক গুলো ছবি পাঠানো হয়েছিল। প্রথমে সেদিন রাস্তা পার করে দেওয়ার ছবি টা। তারপর রেস্টুরেন্টের পিক। সেদিন তাদের সাথে ইয়াশা ও প্রীতি তারাও ছিল। অথচ পিক থেকে তাদেরকে ক্রপ করে কেটে নিয়ে শুধু আরশি ও ফারুক’কে দেখা যায় এমন পিক পাঠানো হয়েছে। এরপর আরো কিছু এডিট করা পিক। দেখে যে কেউই বলবে ফারুকের সাথে রিলেশনে ছিল আরশি।

অবাকের সাথে আরশির যেন এবার কান্না আসছে খুব। তার মানে এজন্য রিদ তাকে সেদিন বকাবকি করেছিল? আর সেও বুঝতে না পেরে উল্টো রিদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছিল।
এবার সেই আইডিটাও হ্যা’ক করালো আরশি। দেখে সেটা ফারুকের নাম্বার দিয়েই খোলা একটা ফেইক আইডি। তার মানে সবকিছু ফারুকই করেছিল? আর এমন একটা ছেলের জন্য রিদের সাথে এমন আচরণ করেছিল, যে মানুষটা তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো? তাকে সন্দেহ করতো না, বরং এসব থেকে আগলে রাখার জন্যই এমন করতো?
ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে আরশি। অনুসূচনায় যেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ।

টানা দু’দিন ধরে চেষ্টা করেও রিদের সাথে এক সেকেন্ডের জন্যও যোগাযোগ করতে পারেনি আরশি। মায়ের ফোন থেকে কল দিলেও রিসিভ করছে না। হয়তো বুঝতে পেরেছে কে এত কল দিচ্ছে।
তাই বাধ্য হয়ে রিদ’দের বাড়িতে এসেছে আজ সকালে। রুমকি বলেছিল, বাসায় প্রতিদিন ফোন দেয় ভাইয়া। সবার সাথে কথা হয়। নিশ্চই আজ মামি বললে ফিরিয়ে দিবে না রিদ। বেশি না, শুধু এক মিনিট সময় পেলেও নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবে এই আশায়। আর তার বিশ্বাস, সে ক্ষমা চাইলে রিদ কখনোই তাকে ক্ষমা না করে থাকতে পারবে না। কারণ রিদের দুর্বলতা আরশি, এটা সে ভালো করেই জানে।

সন্ধায় বাসায় ফোন দেয় রিদ। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মা হাসি মুখে বলে,
“আরশি এসেছে আজ সকালে। এখন তুই ফোন দেওয়ার পর থেকেই আমার সাথে বসে আছে। বললো তোর সাথে নাকি কথা বলবে।”

তীব্র আশা নিয়ে মামির দিকে তাকালো আরশি। তবে বুকটা ধুকপুক করছে খুব। খুব চেনা মানুষটাকে মনে হচ্ছে সবচেয়ে অচেনা। যার সাথে মন খুলে কথা বলতো, তার কথা ভাবতেই যেন আজ শব্দ ভান্ডারে কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না সে।

মামি মুচকি হেসে পূনরায় রিদকে বলে,
“এই নে কথা বল তার সাথে।”
মাঈমুনা চৌধুরি ফোনটা আরশির হাতে দেওয়ার আগেই রিদ স্বাভাবিক গলায় বলে,
“এখন পড়াশোনায় অনেক চাপ আম্মু। একটু আগে ক্লাস করে ফিরেছি, খুব ক্লান্ত লাগছে৷ পরে ফোন দিব তোমায়। ভালো থেকো।”

বলেই ফোন কেটে দিল রিদ। শ্রাবনের কালো মেঘের ন্যায় অন্ধকার হয়ে গেলো আরশির চেহারা। রিদ আজ তার সাৎে কথা বলতেও ইচ্ছুক না? মুহুর্তেই চোখ টলমলে হয়ে উঠেছে তার। যেন এখনই বৃষ্টি নামবে দু’চোখ জুড়ে। মুশলধারে বৃষ্টি। আচ্ছা, এই বৃষ্টি শেষে রোদের দেখা মিলবে তো? নাকি এই রোদ টা তার স্বপ্নই থেকে যাবে?

To be continue…………….#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৮)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

কেটে গেলো আরো অনেকদিন। ফাইনালি দেশে ফিরেছে রিদ। ছেলে এত বছর পর ফিরে আসছে দেখে বাড়িতে উৎসবের কমতি নেই যেন। মাঈমুনা চৌধুরি নিজ হাতে ছেলের জন্য তার পছন্দের সব খাবার রান্না করেছে সকাল থেকে। আরশিকে বলেছিল রিদের ঘরটা যেন পরিষ্কার করে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। কারণ তার ধারণা ফ্যামিলির পর রিদ সবার থেকে বেশি যাকে পছন্দ করে সে হলো আরশি। কেউ একটা না বুঝলেও মা হয়ে সে এটা খুব ভালোভাবেই বুঝে।
তাই আরশি সব কিছু গোছগাছ করে রেখেছে শুনলে নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে সে। মা তো আর জানে না আরশির প্রতি তার ছেলের মাঝে তীব্র অভিমান জমেছিল অনেক আগেই।

গাড়ির আওয়াজ শুনেই ঘর থেকে বেড়িয়ে আশে সবাই। গাড়ি গেট পেড়িয়ে বাড়ির সামনে এসে থামলো। রিদ গাড়ি থেকে নামতেই মাঈমুনা চৌধুরি এগিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। বাবার সাথে আগেই কথা হয়েছে। কারণ বাবা আর রোহান মিলে তাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করেছে।

রুমকিও এগিয়ে আসে ভাইয়ার সামনে। উপস্থিত সবাইকে দেখলেও কয়েক সেকেন্ড অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল রিদ। সবার আড়ালে দাড়িয়ে থাকা আরশি ভালোই বুঝতে পারলো রিদের এই অনুসন্ধানী দৃষ্টির মানে। নিজেকে সে দৃষ্টি থেকে লুকাতে চেয়েও ব্যর্থ হলো সে। রিদের চোখাচোখি হতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। বুকের ভেতর যেন বয়ে গেলো এক তীব্র ঝড়ো হাওয়া।

এতক্ষণ লুকানো দৃষ্টিতে সকলের পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে ছিল আরশি। প্রথম দু’বছর সুন্দর ভাবে চললেও একটা ঝড়ের পর মানুষটার সাথে একটু কথা বলারও সুজুগ পায়নি সে। দুরুত্ব টা বেড়ে গেলো আকাশ সমান।

এত বছর পর রিদ ভাইয়ের মুখটা সামনে আসতেই বুকটা ধুকপুক করছে তার। ইচ্ছে করছে সবার মতো সেও ছুটে গিয়ে রিদ ভাইয়ার সামনে দাড়াতে। অতিতের মতো কোনো দ্বিধাহীন ভাবে হাস্যজ্জল মুখে মুগ্ধ নয়নে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে।

কিন্তু সেই সাহস যে একটুও অবশিষ্ট নেই তার। কোন মুখে মানুষটার সামনে দাড়াবে সে? এত কিছুর পর নিশ্চয়ই রিদ ভাই তার মুখও দেখতে চাইবে না।

আরশির দিকে চোখ পড়তেই এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রিদ। আরশির পাশে ঠিক পেছনটাই দাড়িয়ে আছে ফারুক। ছেলেটাকে আজও আরশির পাশে সহ্য হচ্ছে না রিদের। এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে আশে-পাশের সব কিছু এলোমেলো করে ফেলতে। তবুও নিজের পুরো ক্রোধকে সামলে নিল সে। দু’য়েক সেকেন্ড তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতঃপর একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ঘরের দিকে হাটা ধরলো চুপচাপ।

চোখ বুঁজে নিল আরশি। স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল ওভাবেই। বুকের ভেতর শুরু হলো বিষাদের তীব্র ঝড়। আজ মানুষটা তার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেও না পর্যন্ত। অথচ এক সময় প্রেয়সীকে এক নজর দেখার জন্য হলেও কোনো অজুহাত সাজিয়ে তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়ে যেতো। এখন যেন একটা ঝড়েই বদলে গেলো সব কিছু।

পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই ছলছল করা চোখ দুটি হাত দিয়ে মুছে নিল আরশি। অতঃপর পেছন ফিরে তাকাতেই ফারুক কিছুটা আফসোস ভঙ্গি করে আরশিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” চচচচচচ,,,,, ইশ,,,,, পাত্তাই দিল না আজ। অবশ্য দেওয়ার কথাও না। বাইরের দেশে এত বছর চারপাশে ফরেনার মেয়ে দেখে এখন তোমাকে ভালো না লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না। ফরেনারদের স্বাদ পেলে তোমাকেই বা মনে রাখবে কেন? বরং তুমিই বোকার মতো তার অপেক্ষায় নিজেকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছো। যার কোনো ভিত্তি নেই। সো সেড মাই ডিয়ার,,,,,”

ফারুক’কে পেছনে দেখে ক্ষনিকটা চমকালো আরশি। একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে এতকিছুর পরও পেছনে ঘুরঘুর করে। ফারুকের এমন কথায় রাগে গা জ্বলে উঠলো আরশির। পরপর কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলে,
“সবাইকে নিজের মতো মনে করেন আপনি? যে নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বত্বেও অন্যের সুন্দর সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছেন একটু একটু করে। তাছাড়া চরিত্রহীন শব্দটাতো আপনার নামের পেছনেই ভালো মানায়।”

আরশি খুব রাগ থেকে অপমান করতে চাইলেও ফারুকের মাঝে কোনো অপমানিত হওয়ার ভাব দেখা গেলো না। বরং মুখে হাসি টেনে বলে,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আজ এত বছর পর এসেও তোমার দিকে ভালো করে ফিরেও তাকাচ্ছে না।”

আরশি নিজের রাগ ধরে রাখতে না পেরে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি। আর সফলও হয়েছেন। এত কিছু করেও শান্তি হয়নি আপনার? আমার জীবনটা নরক করে তুলেছেন। রুহি আপুর দেবর না হলে এখনই আপনাকে সবার সামনে জু’তা পেটা করে এ বাড়ি থেকে বের করতাম।”

ফারুক অপমানিত হওয়ার বিপরীতে আবারও হেসে দিল। তার এমন বেহায়াপনা দেখে অসহ্য চহুনিতে ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো আরশি। জীবনে এমন বাজে বিহেব সে কারো সাথে করেনি। আর না দেখেছে এমন বেহায়া মানুষ। লোকটাকে দেখলেই তীব্র ঘৃণা থেকে চলে আসে এসব। তবুও তার যেন একটুও লাজ লজ্জা নেই। এত অপমানের পরও ফারুক বেহায়ার মতো হেসে পেছন থেকে বলে,
“কেউ একজন কিন্তু এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এখনো তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।”

“””””””””””””””””””””””””””””””

রিদ আসবে বলে আজ লাল রঙের একটা শাড়ি পরেছিল আরশি। সাথে ম্যাচিং করে হাতে লাল কাচের চুড়ি। রুহি আপুর বিয়ের সময় রিদ বলেছিল, লাল শাড়িতে আরশিকে খুব বেশিই মানায়। দেখতে একদম বউ বউ লাগে।
রিদ মুখে হাসি রেখে এসব বললেও সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল আরশি।

আজ এত বছর পর ফিরেও সারা দিনে আর একবারের জন্যও আরশির দিকে তাকায়নি রিদ। অথচ অন্য সবার সাথেই হাসি মুখে কথা বলেছে।
বিষণ্ন মনে রুমে বসে আছে আরশি। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় সে। দেখে আরিশা আপু তার ছেলে রামিমকে কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।

আরশির বিষণ্নতা যেন প্রকাশ না পায়, তাই স্বাভাবিক ভাব করে হাস্যজ্জল মুখে আরিশা আপুর দিকে এগিয়ে গেলো সে। দু’হাত বাড়িয়ে রামিমকে কোলে নিতে চাইলে আরিশা আপু শান্ত গলায় বলে,
“পরে নিস, আগে রিদ তোকে কেন ডেকেছে দেখে আয়।”

বুকটা যেন ধুক করে উঠলো আরশির। রিদ ভাইয়া তাকে ডেকেছে, এটা যেন এক মুহুর্তের জন্য বিশ্বাস হতে চাইছে না তার। ভুল শুনেছে ভেবে পূনরায় আরিশা আপুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কে ডেকেছে আপু?”
“বুঝেও না বোঝার ঢং করবি না একদম।”

আপুর এমন সোজাসুজি কথায় চুপ হয়ে গেলো আরশি। হার্ট যেন তীব্র গতিতে বিট করছে এটা ভেবে, রিদ তাকে কেন ডাকলো হুট করে? কি বলবে সে? এত কিছুর পর সে মানুষটার সামনে দাড়ানোর সাহস টুকু অবশিষ্ট নেই তার। চিন্তার ছাপ ও অসহায়ত্ব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার মাঝে। তীব্র কৌতুহল নিয়ে আরিশা আপুর দিকে চেয়ে কাঁপা স্বরে বলে,
“সে কেন ডেকেছে আপু?”

আরিশা আপু রামিমকে খাটে শুইয়ে দিয়ে এক পাশে বসে বলে,
“বলেনি আমাকে। শুধু এতটুকুই বললো, তোকে যেন বলি দু’মিনিটের মধ্যে তার সামনে যেতে।”

চোখ দুটো বুঁজে নিল আরশি। অজানা এক ভয়ে শরির যেন অবশ হয়ে আসছে। এক সময় নিজের ভাবা মানুষটার সামনে আজ কেন নিজেকে এতটা অসহায় মনে হচ্ছে বোঝার ক্ষমতা নেই তার। শুধু এতটুকুই বুঝতে পারছে, মানুষটার সামনে কিছুতেই স্থির হয়ে দাড়াতে পারবে না সে। কিছুতেই না।

To be continue,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here