অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২০.

0
334

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.

[ সতর্কতা : প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য। ]

সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর ল্যায়লা কতদিন হাসপাতালে থেকেছিলো তা তার অজানা। কিন্তু তার জ্ঞান ফেরার পর সে যখন চোখ খুলে তখন সর্বপ্রথম একজন নার্সকে কেবিনে দেখতে পায়। নার্স তার জ্ঞান ফিরেছে দেখে আমালকে সবার আগে কল করে। তখন মধ্যরাত ছিলো। আমাল নার্সকে জানিয়ে দেয় সে সকালে হাসপাতালে আসবে। এই পুরো ঘটনাটাই ল্যায়লার সামনে ঘটে। সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া ল্যায়লা সেদিন রাতে উপলব্ধি করে যে এই পৃথিবীতে সে কারো জন্যই গুরুত্বপূর্ণ না। কারো তার বাঁচা মরা দিয়ে কিছু আসে যায় না। নার্সের মুখে ল্যায়লা এ-ও শুনেছিলো যে আকস্মিক ট্রমা থেকে তার সিজার অ্যাটাক হয়েছিলো সেদিন সকালে।

পরেরদিন সকালে আমাল ও তার নতুন স্বামী ফারদিন আহসান হাসপাতালে ল্যায়লাকে দেখতে আসে। ফারদিনকে দেখেই ল্যায়লা বুঝে নেয় এই ভদ্রলোকটিই তার সৎ বাবা। ল্যায়লাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই লোকটা খুব সদয় ব্যবহার করে ল্যায়লার সাথে। কিন্তু এই পুরোটা সময় যার মুখে বিরক্তির ছাপ ছিলো সে আর কেউ নয় বরং আমাল। ফারদিন আমালকে জানায় হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার পর ল্যায়লাও তাদের সাথে তাদের বাসায় যাবে। আমাল বেশ কয়েকবার মানা করার পরও ফারদিন সেই মানা শুনেনি। সে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে চলে যায়।

আমাল বিরক্তি নিয়ে ল্যায়লার পাশে বসে এরাবিকে বলে উঠে,

” পুরোটা জীবন তুই আমার খুশির কলঙ্ক হয়েই থাকবি। তোর বাপ তোকে নিয়ে মরতে পারলো না? আমার নতুন সুখের জীবনের কাল হিসেবে তোকে রেখে গেলো। ”

ল্যায়লা কোনো উত্তর দিতে পারে না। সে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রয়। যেই বাবার কাছে সে অবহেলা ছাড়া কিছু পায় নি তার মৃত্যুর জন্য সে কাদবে নাকি নিজের এই দুর্ভাগ্যের উপর কাদবে তা তার বোধগম্য হয় না।

__________

ফারদিনের পূর্বে একজন স্ত্রী ছিলো। তার নাম ছিলো আনিকা। কিন্তু তাদের প্রথম সন্তান ইয়াসিরের জন্মের সময় সে মারা যায়। তারপর বেশ কয়েকবছর ফারদিন একাই থাকে। কিন্তু একটা সময় সে উপলব্ধি করে তার জীবনে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন রয়েছে। তখনই তার পরিচয় হয় আমালের সাথে।

ব্যবসার কাজে ফারদিনকে প্রায়ই দেশের বাহিরে ভ্রমণ করতে হয়। ইয়াসিরের জন্মের পর ফারদিনের মা-ই ইয়াসিরের দেখাশোনা করতো। কিন্তু উনি মারা যাওয়ার পর ফারদিন বাসার দাড়োয়ানের স্ত্রীকে পারমানেন্ট একজন কাজের মহিলা হিসেবে রেখে দেয়। তাই তিনি দেশের বাহিরে গেলেও ইয়াসিরের থাকতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না।

এতদিন কোনো সমস্যা না হলেও আমালকে বিয়ে করার পর থেকেই ইয়াসির ফারদিনের প্রতি বেশ ক্ষিপ্ত। এই নতুন সম্পর্ক যে কোনোভাবেই সে মেনে নিবে না তা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। কিন্তু ইয়াসিরের এই রাগকে ফারদিন কিংবা আমাল কেউই তেমন একটা পাত্তা দেয় নি।

আমাল বরং তার নতুন সংসারে আরো খুশি। না আছে তার বাচ্চা সামলানোর কোনো ঝামেলা। আর ফারদিনের সাথে সে-ও প্রায়ই দেশের বাহিরেই ঘুরেফিরে সময় কাটাতে পারবে। নিজের স্বাধীন জীবন ফিরে পাওয়ার খুশিতে সে ইয়াসিরের রাগকে তেমন একটা তোয়াক্কা করে নি কখনোই।

__________

হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ পেয়ে আমাল ও ফারদিনের সাথে তাদের বাসায় আসে ল্যায়লা। বাসায় প্রবেশ করতেই তার দেখা হয় ইয়াসিরের সাথে। বয়স বুঝি ১৪ কিংবা ১৫ হবে। ল্যায়লাকে দেখেই সে বিরক্তি নিয়ে উপরে চলে যেতে নেয়। ফারদিন ইয়াসিরকে ডেকে ল্যায়লার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,

” ইয়াসির, ল্যায়লাও আজ থেকে আমাদের সাথে থাকবে। ”

ইয়াসির বিদ্রুপ করে বলে,

” হ্যাঁ। শুধু ও কেন আরো মানুষ এনে বাসায় উঠাও। আফটার অল এই বাসা এখন আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। ”

কথাটা বলেই ইয়াসির সেখান থেকে চলে যায়। আমাল ফারদিনকে বলে,

” আমি তোমাকে বলেছিলাম ল্যায়লাকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেই। শুধু শুধু ঝামেলা বয়ে ঘরে আনলে৷ ইয়াসিরের রাগ এখন আরো বেড়ে যাবে। ”

ল্যায়লা চুপচাপ নিজের মা’য়ের কথা শুনে মাথা নত করে। ফারদিন আমালকে সামান্য চোখ রাঙিয়ে বাসার কাজের মহিলা মিথিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” মিথিলা আপা, ল্যায়লাকে ওর রুমে নিয়ে যান। আর কিছু প্রয়োজন হয় নাকি সেদিকেও খেয়াল রাখবেন। ”

মিথিলা ল্যায়লাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরই ফারদিন আমালকে বলে,

” রাদিফের এই সুইসাইডের কারণে অলরেডি অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাকে। এই অবস্থায় ল্যায়লাকে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি ঝামেলা আরো বাড়াতে চাচ্ছো? ও যদি উল্টাপাল্টা কোনো স্টেপ নেয় সেটার জন্য দায়ী আমরা হবো। কারণ ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান এখন একমাত্র তুমি। এখানে আমাদের চোখের সামনে থাকলে অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। আর তাছাড়া তোমার কষ্ট করে ওর খেয়াল রাখতেও হবে না। মিথিলা আপা আছেন উনি দেখে রাখবেন। ”

আমাল বিরক্ত হয়। এই ল্যায়লা নামক আপদটা কখনো তার পিছু ছাড়বে না মনে হয়। কিন্তু আপাতত তার করারও কিছু নেই। ফারদিনের কথায় যুক্তি আছে। সে আবার কোনো পুলিশের ঝামেলায় ফাসতে চায় না। তাই এই ব্যাপারে সে আর কিছু বলে না।

__________

একই বাসায় এতগুলো মানুষের সাথে থাকার পরও ল্যায়লা একাই বড় হতে থাকে। ইয়াসির কখনোই তার সাথে কথা বলতো না। আমাল যেই দু’একটা কথা বলতো সেগুলোও ছিলো কেবল ধমক। ফারদিনই কেবল মাঝেমধ্যে তাকে কিছু প্রয়োজন কি-না এসব জিজ্ঞেস করতো। সেটার উত্তরে ল্যায়লা মাথা নেড়ে না বলতো।

প্রতি রাতে ল্যায়লা চোখ বুজলেই রাদিফের সেই ঝুলন্ত লাশ দেখতে পেতো। ভয়ে সে গুটিসুটি মেরে বালিশ কামড়ে পড়ে থাকতো। কারণ কেউ নেই যাকে সে নিজের ভয় সম্পর্কে বলতে পারবে। কেউ নেই যে তার পরোয়া করে।

__________

কেটে যায় চার বছর। ল্যায়লার বয়স তখন ১৪। বর্ষাকালের কোনো এক রাতে বসে সে স্কুলের পড়া পরছে। বাসায় কেউ নেই। ফারদিন আর আমাল দু তিন দিন আগেই দেশের বাহিরে গিয়েছে। ফিরবে সপ্তাহ খানিক পরে। মিথিলা আন্টিও রাতের রান্না করে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে গিয়েছে। ইয়াসির ভাই প্রায়ই রাতে দেরি করে ফিরে। তাই ল্যায়লা নিজের মতো ডিনার করে বসে বসে পড়ছে।

রাত প্রায় তিনটা বাজে। বাহিরের তুফানের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। পড়তে পড়তে ল্যায়লা কখন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই। আচমকা কাধে গরম নিঃশ্বাস টের পেতেই ল্যায়লার তন্দ্রাভাব কেটে যায়। সে সাথে সাথে চোখ মেলে পিছনে ফিরে তাকায়। ইয়াসির দাঁড়িয়ে আছে। ল্যায়লার দিকেই কেমন ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছে।

ল্যায়লার অস্বস্তি লাগে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। সে কি দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছিলো? হয়তো তা-ই হবে। নিজের মনের অজানা ভয়কে লুকিয়ে ল্যায়লা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে,

” ইয়াসির ভাইয়া, আমি খাবার ফ্রিজে রেখেছিলাম। তোমার খিদে পেলে ফ্রিজ থেকে বের করে ওভেনে দিয়ে গরম করে খেয়ে নাও। ”

ইয়াসিরের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ল্যায়লা নাকে একটা উটকো গন্ধ টের পায়। গন্ধটা কিসের তা সে আন্দাজ করতে পারে। তার জানামতে ইয়াসির ভাইয়া বদমেজাজি এবং বেপরোয়া হলেও কখনো ড্রিংক করে বাসায় ফিরতে দেখে নি। ল্যায়লা পরে যায় বিপাকে। সে আবার বলে উঠে,

” তুমি চলে যাও। আমি ঘুমাবো। ”

ইয়াসির এতক্ষণে মুখ খুলে।

” আমার বাসায় থেকে আমাকেই চলে যাওয়ার কথা বলার সাহস কোথা থেকে পাও তুমি? আমার যখন যেখানে মর্জি যাবো। ”

ইয়াসির যে হুশে নেই তা বুঝতে পেরে ল্যায়লা মিথিলা আন্টি আর তার স্বামী ওবায়দুল আংকেলকে কল করার জন্য যেতে নেয়। তখনই সে নিজের হাতে টান অনুভব করে। ল্যায়লা তাকিয়ে দেখে ইয়াসির তার হাত ধরে রেখেছে। রাগান্বিত স্বরে তাকে বলে উঠে,

” আমার নামে নালিশ করতে যাচ্ছো আব্বুর কাছে? এতো বড় সাহস? ”

ল্যায়লার মন হঠাৎ করে কু ডাকতে থাকে। বাহিরের এই অলুক্ষণে ঝড় তার উপর ইয়াসির ভাইয়ার এমন আচরণ। কি করবে সে? মাথা কাজ করে না তার। কিছু করবে তার আগেই সে দেখে ইয়াসির তার গায়ে অসভ্যের ন্যায় হাত দিচ্ছে। সাথে সাথে ল্যায়লা হতভম্ব হয়ে যায়। এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন সে কখনো হয় নি। এরকম অবস্থায় কি করা উচিত তা-ও তার বাচ্চা মস্তিষ্কে আসে না৷ ভয়ে আতংকে চিৎকার করা শুরু করলেই ইয়াসির তাকে থাপ্পড় দিয়ে বিছানায় ফেলে দেয়। ল্যায়লার শরীর যেন ভয়ে আর থাপ্পড়ে অবশ হয়ে আসে। সে বিছানায় পড়ে দেখতে থাকে ইয়াসির তার আলমারি খুলে কতগুলো স্কার্ফ বের করে সেগুলো দিয়ে তার মুখ, হাত-পা বাধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ভয়ে ল্যায়লার বুক কাপছে। সে সাহায্যের জন্য আবার চিৎকার করতে নিবে তখন মনে পড়ে যে তার সাহায্য করতে আসবে এমন কেউই পৃথিবীতে নেই। ল্যায়লা কি করবে বুঝতে না পেরে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে সাহায্যর জন্য। পাশাপাশি ছোটার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু আবার নিজের শরীরে নোংরা ছোঁয়া অনুভব করতেই তার হাত পা শীতল হয়ে শান্ত হয়ে যায়। তার জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখ ফেটে জল পড়ছে।

আল্লাহ হয়তো তার ডাক শুনে সেদিন। তাইতো ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ানোর আগেই ইয়াসির জ্ঞান হারায়। কিন্তু যতদূর ল্যায়লা অভিজ্ঞতা করেছে তাতেই তার কিশোরী মন বিষিয়ে উঠেছে একদম। নিস্তেজ চোখ জোড়া তার মাথার উপর সিলিং ফ্যান এর দিকে নিবদ্ধ। সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা অনুভব করায় ল্যায়লা ফ্যান বন্ধ করে রেখেছিলো। সেই বন্ধ ফ্যানেই এই মুহুর্তে সে তার বাবার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পাচ্ছে। ভ্রম হচ্ছে তার। ল্যায়লা সেই লাশের দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। সাথে সাথে সে দেখতে পায় ইয়াসিরকে। কেমন এক বিভৎসকর হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আতংকে ল্যায়লা আবার চোখ মেলে তাকায়। পাশে ইয়াসির আর সিলিং এ তার বাবার লাশ।

ল্যায়লার মনে হচ্ছে তার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন এক এক করে ছিড়ে যাচ্ছে। তার হাত পায়ে ঝাঁকুনি শুরু হয়। পাঁচ মিনিটের মতো খিঁচুনি দিয়ে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বেঁধে রাখা মুখ দিয়ে সাদা ফ্যানা বের হতে শুরু হয়। দ্বিতীয় বারের মতো তার সিজার অ্যাটাক হয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here