অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.
সোমবারের সেমিফাইনালে দুই গোল নিজেদের দখলে নিয়ে জয়লাভ করে মরক্কানরা। সেমিফাইনাল ম্যাচ শেষেই ইসাম ফিরে যায় মরক্কোতে। কাল বাদে পরশু তার বিয়ের তারিখ। কিন্তু ফাতিহর অধিনায়ক হিসেবে ম্যাচ খেলাটা গুরুত্বপূর্ণ। সে ফাইনাল ম্যাচ শেষ করে, ইসামের বিয়ের দিন সকালে সে মরক্কো ফিরবে ফুল টিম সমেত।
__________
আজকে উরুগুয়ের বিপক্ষে মরক্কোর ফাইনাল ম্যাচ। বাংলাদেশ সময়ে এখন রাত ১.৫০ বাজে। টিভির সামনে বসে থাকা ল্যায়লার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মাঠে নামে দুই দল। টিভির স্ক্রিনে ফাতিহর চেহারা দেখতে পেয়েই ল্যায়লা সোজা হয়ে বসে। সোফায় থাকা পাতলা ব্ল্যাংকেটটা শরীরে আরেকটু টেনে নেয়।
ফাতিহকে বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। ম্যাচের স্ট্রেস। জাতীয় সংগীত পর্ব শুরু হওয়ার আগে সে স্টেডিয়ামে একটি দিকে তাকিয়ে সামান্য মুচকি হাসে। সাথে সাথে টিভির স্ক্রিনে দেখা যায় এক জোড়া মধ্যবয়সী যুগলকে। ল্যায়লা এদের চিনে। ফাতিহর মা বাবা। ফাতিহর আইডিতে উনাদের সাথে বেশ কয়েকটা ছবিই রয়েছে। ল্যায়লা ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” বেস্ট অফ লাক মাই সেভিওর। ”
__________
টান টান উত্তেজনা পূর্ণ ম্যাচ চলছে। খেলা শুরু হয়েছে ৩০ মিনিটের উপর হয়ে গিয়েছে। এখনো কোনো দল গোলপোস্টে একটি গোল করতে সক্ষম হয় নি। কিন্তু দীর্ঘসময় পার হওয়ার পর ৪০ মিনিটের মাথায় উরুগুয়ের পক্ষ হতে প্রথম গোলটি গোল পোস্টের ভিতর নিক্ষেপ করা হয়। সাথে সাথে মরক্কান প্লেয়ারদের চেহারায় হতাশার রেশ দেখা দেয়। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে থাকা ল্যায়লা স্ক্রিনে এই গোলের দৃশ্যটি দেখে মনের অজান্তেই বিরক্ত মিশ্রিত সুরে শিট বলে উঠে।
__________
সম্পূর্ণ পরিবারের সাথে বসে ইসামও ম্যাচ দেখছিলো। প্রতিপক্ষের গোল দেখেই সে হাইপার হয়ে যায়। ফিল্ডে না থেকেও সে ম্যাচের সম্পূর্ণ স্ট্রেস ফিল করতে পারছে। শুকনো গলায় লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কাজের মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” এক গ্লাস পানি এনে দেন আমাকে। ”
মহিলা সাথে সাথেই ব্যস্ত পায়ে পানি আনতে চলে যায়। ইসামের পাশে বসে থাকা হামিদ দাদা আড়চোখে নাতির চেহারায় চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করছেন। এতো চিন্তা তার নাতির এই ম্যাচ নিয়ে? উনি কখনোই প্রফেশন হিসেবে স্পোর্টস ম্যান হওয়াটা পছন্দ করতেন না। খেলা নিয়ে অহেতুক মাতামাতি তার বরাবরই অপছন্দ। কিন্তু তার বিরুদ্ধে গিয়ে ইসাম তার এই অপছন্দের প্রফেশনে জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে বহু ঝামেলা চলে তাদের পরিবারে। কিন্তু অবশেষে নাতির জেদের সামনে নত হয়ে তিনি মেনে নেন।
__________
উরুগুয়ের পক্ষ থেকে প্রথম গোলের ধাক্কা সামলিয়ে উঠার আগেই ঠিক হাফ টাইমের কিছু সেকেন্ড আগেই তারা আরেকটি গোল করে বসে। উরুগুয়ের প্লেয়ারদের উচ্ছ্বাসে স্টেডিয়াম যখন মুখরিত তখন মরক্কান প্লেয়ার এবং সাপোর্টারদের মনে ঝড় বইছে। হাফ টাইমের সময় শুরু হতেই ফাতিহ কঠিন মুখে মাঠ ছাড়ে।
__________
” আরেক গ্লাস পানি এনে দাও। ”
ইসামের কথাটা শুনতেই আশেপাশের সবাই তার দিকে তাকায়। এই প্রথম গোল থেকে দ্বিতীয় গোলের মাঝে ১৩ মিনিটের ব্যবধানে ইসাম ১৩ গ্লাসেরও বেশি পানি খেয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কাজের মহিলা রীতিমতো পানি আনার জন্য আসা যাওয়া করতে করতে ক্লান্ত। ইসামের আদেশ পেতেই সে আবার ছুটলো পানি আনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এবার সে আর গ্লাসে করে পানি নিয়ে ফিরে নি। বরং বড় একটা ২ লিটারের পানির বোতলে করে পানি নিয়ে এসেছে। ইসাম এক দন্ড সেই বোতলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
” ভালো করেছো। ”
কথাটা বলেই সে ডগডগ করে আবার পানি খাওয়া শুরু করে। মুহুর্তেই সে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটে পালায়। ইসামের মা নিজের স্বামীর কানে কানে বলে,
” তোমার ছেলে তোমার মতো হয়েছে। টেনশনের সময় ইচ্ছেমতো পানি খাবে পরে ওয়াশরুমে দৌড়াদৌড়ি করবে। ”
ইসামের বাবা আদিল সাহেব থমথমে মুখে বসে রয়। মনে মনে বলে,
” না পেলাম বাপের কাছে ইজ্জত, আর না বউ দেয় সম্মান। ধ্যাৎ! ”
__________
হাফ টাইম শেষ হয়েছে। শেষ ৪৫ মিনিটের খেলা শুরু হয়েছে। মাঠে নামার কিছুক্ষণের ব্যবধানেই উরুগুয়ে আরেকবার গোল করতে নেয়। কিন্তু মরক্কান গোলকিপার বাজপাখির মতো সেই গোল রুখে দেয়। স্টেডিয়ামের সকলের মুখে দেখা যায় স্বস্তির আভাস। কিন্তু স্বস্তি নেই মরক্কান প্লেয়ারদের মনে। জিততে হলে কেবল প্রতিরোধ করাই যথেষ্ট নয় এই মুহুর্তে। তাদের দরকার তিনটা গোল।
বল পায়ে গোলপোস্টের কাছাকাছি আসতেই ফাতিহ গোলপোস্ট বরাবর বলে লাথি মারে। মুহুর্তেই সম্পূর্ণ স্টেডিয়াম গোল বলে চেঁচিয়ে উঠে। উল্লাসে মেতে উঠে সম্পূর্ণ টিম। খুশি লেপ্টে রয় দূর কোনো দেশে বসে থাকা ল্যায়লার মুখেও।
কেবল শান্ত হতে পারে না ইসাম। তার চেহারায় এখনো আতংক। হামিদ দাদা আড়চোখে নাতিকে দেখে সুধায়,
” তোমার দল গোল করেছে। মুখটা এখনো বাংলোর প্যাঁচার ন্যায় করে রেখেছো কেন? ”
ইসাম বলে,
” তিনটা গোল হওয়ার আগে টেনশন কাটবে না। ”
আদিল ব্যঙ্গ করে বলে,
” এরকম সিরিয়াসনেস যদি বাপের ব্যবসার প্রতি দেখাতি তাহলে আজকে তোর বাপের কাধে এতো কাজের বোঝ থাকতো না। ”
ইসাম তার বাবার কথাকে পাত্তা দেয়না। কিন্তু হামিদ দাদা বলে উঠে,
” তা বাছাধন, তুমি এতো বছর কাজ করে বাপের কোন বোঝটা হালকা করেছো? তোমার ছেলে তা-ও নিজে যা করে তার প্রতি মনোযোগী। কিন্তু তুই তো এক নাম্বার কাম চোর। এই বুড়ো বয়সে এসেও এজন্য এখনো আমার সব ব্যবসা দেখে রাখতে হচ্ছে। আশা করছি ইসাম আর নাহালের বিয়ের পর একটা নাতি পাবো আমি। যে আমার দায়িত্ব নিজের কাধে নিতে পারবে। ”
নিজের পিতার সূক্ষ্ণ অপমানে আদিল সাহেব চুপসে যান। কিন্তু ইসাম ব্যস্ত মনে খেলা দেখতে দেখতে বলে,
” আজকের ম্যাচটা যদি আমরা জিতি তাহলে তুমি যতটা নাতি চাও ততটা এনে দিবো আমি দাদা। তুমি চাইলে সম্পূর্ণ ফুটবল টিম রেডি করে দিবো। ”
ইসামের কথা শুনে উপস্থিত সবার কান লজ্জায় গরম হয়ে আসে। খেলার ধ্যানে এই ছেলের মাথা গিয়েছে পুরো। আদিল সাহেব কপাল চাপড়ে মনে মনে বলে,
” বেশরম ছেলে কোথাকার। ”
__________
বাকি আছে শেষ ১০ মিনিট। ইতিমধ্যে মরক্কানরা দুটো গোল করে ফেলেছে। দুই দলের স্কোর এখন সমান সমান। হাফ টাইমের পরে যেনো খেলার মোড়ই ঘুরে গিয়েছে। দ্বিতীয় গোলটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছিলো মরক্কান মিড ফিল্ডার হিশাম আমরাবাতের।
আর বাকি ৭ মিনিট। উত্তেজনায় ল্যায়লার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু তার শীতল হয়ে যাওয়া শরীরকে আরেকটু উত্তেজিত করে দেওয়ার জন্য ফাতিহর এসিস্টে নোরদিন আবৌকের করা শেষ গোলটিই যথেষ্ট ছিলো। ল্যায়লা সাথে সাথে খুশিতে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে। বড় টিভির স্ক্রিনে ফাতিহর হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভূতির সাগরে ভেসে যায়। নিজের অজান্তেই কখন যে সে টিভির স্ক্রিনের কাছে এসে একহাতে ফাতিহকে ছুঁয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে তা টের পায় না। সামান্য হেসে বলে উঠে,
” বলো তো মন? কার জয়ের খুশিতে তুমি উন্মাদ হয়ে পড়েছো? মরক্কান জাতীয় ফুটবল দলের নাকি সেই দলের অধিনায়কের? ”
__________
ইসাম নিজের দলের জয়ের খুশিতে নিচে প্রচুর হৈ হুল্লোড় করে অবশেষে নিজের রুমে ফিরে এসেছে। ফোন হাতে সবার আগে সে নিজের দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইন্সটায় একটি শুভেচ্ছাবার্তা শেয়ার করে। পরপরই ফাতিহকে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে বলে উঠে,
” কি ব্রো? ম্যাচ তো জিতে গেলি। এবার বন্ধুর বিয়েতে আসবি না? তাড়াতাড়ি দেশে আয় শালা। ”
” তোমার বন্ধু আসুক আর না আসুক আমি কিন্তু এসে পড়েছি। ”
পিছন থেকে আচমকা মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ইসাম ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে। সাথে সাথে সে দেখে বারান্দায় নাহাল দাঁড়িয়ে। অনেকটা চোরের মতো ছদ্মবেশে আছে সে। নাহালকে দেখেই ইসাম বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রয়। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
” তুমি এখানে কিভাবে? ”
নাহাল রুমে এসে আরাম করে বিছানায় বসতে বসতে বলে উঠে,
” সন্ধ্যায় না বলছিলে আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে? তাই এসে পড়লাম। ”
ইসাম বিস্ময় নিয়ে নাহালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” উহু। বাসায় কিভাবে প্রবেশ করলে সিকিউরিটি ভেদ করে? ”
নাহাল বেশ দায়সারা স্বরে জবাব দেয়,
” আমার দুই দেবর আছে না? তারা তোমার বারান্দার সাথে মইয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। আর গার্ডও ওরা সামলেছে। ”
নাহালের কথা শুনে ইসাম বিষম খায়। মাথায় হাত দিয়ে সে বলে উঠে,
” কি ডেয়ারিং রে বাবা! ”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]