অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৪.
গভীর মনযোগে বিছানায় বসে মুভি দেখছে ল্যায়লা এবং নাহাল। টিভির স্ক্রিনে চলছে সিচ্চিন থ্রি সিনেমা। নাহাল বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
“ কি একটা বিরক্তিকর সিনেমা! চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেলো এখনো ভয়ংকর কোনো সিন আসে নি। এই মুভির থেকে তো ইসামের ঘুমন্ত চেহারা বেশি ভয়ংকর। “
নাহালের কথা শুনে ল্যায়লা হেসে দেয়। সে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলে উঠে,
“ আমার আর ধৈর্য্য হচ্ছে না এই সিনেমা দেখার। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি। তুমি একা ভয় পাবে না তো? “
নাহাল বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে,
“ তোমার আমার সাহস সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। “
ল্যায়লা হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়। নাহাল বিছানায় শুয়ে মুভি দেখতে থাকে। আচমকা তার মনে হয় বারান্দার দরজা থেকে কিছু একটা শব্দ হয়েছে। নাহাল পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো মুভি দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার সে বারান্দার দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পায়। এবার সে নড়েচড়ে উঠে। বুকে সাহস সঞ্চয় করে সে আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে যায়। চেহারা সামান্য ভীত দেখাচ্ছে তার।
অতি সাবধানে বারান্দার দরজা খুলে আশেপাশে তাকাতে নিয়েই সে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু সম্পূর্ণ চিৎকার দেওয়ার আগেই ইসাম তার মুখ চেপে ধরে। নাহাল চোখ বড় বড় করে একবার ইসামকে দেখছে তো একবার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফাতিহকে। ফাতিহ সৌজন্যমূলক হাসি হেসে রুমের ভেতরে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ ইঞ্জয় ইউর টাইম টুগেদার। “
কথাটুকু বলেই সে রুমে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়। ইসাম কুটিল হাসছে। নাহাল বিরক্ত হয়ে ইসামের পেটে ঘুষি মারে। ইসাম মৃদু চিৎকার দিয়ে নাহালকে ছেড়ে দেয়। নাহাল ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠে,
“ তুমি এখানে কি করছো? “
ইসাম ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ আস্তে কথা বলো। সবাই জেগে যাবে। “
নাহাল এবার মৃদু স্বরে রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আগে বলো তুমি এখানে কেন এসেছো? “
ইসাম এবার সামান্য হেসে নাহালকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“ আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। “
নাহাল ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ তাহলে ফাতিহ তোমার সাথে কেন এসেছে? “
“ কারণ ও নিজেও ওর বউকে মিস করছিলো। “
__________
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ল্যায়লা অবাক হয়। নাহাল কোথায় গেলো? বারান্দা থেকে মৃদু ফিসফিস কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই আওয়াজ শুনে ল্যায়লা বারান্দার দিকে পা বাড়াতে নিলেই নিজের কোমরে শীতল ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। আর কানের লতিতে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া। ল্যায়লা অস্ফুটে বলে উঠে,
“ ফাতিহ! “
ফাতিহ কোমল স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ আই ওয়াজ মিসিং ইউ। “
“ নাহাল দেখে ফেলবে। “
“ ও ইসামের সাথে বারান্দায় আছে। আর দরজা ভিতর থেকে লকড। “
ল্যায়লা এবার ফাতিহর দিকে ফিরে তাকায়। মজার ছলে বলে,
“ ওরা হয়তো তোমাকে বেশরম ভাবছে। “
“ আই ডোন্ট কেয়ার। “
ল্যায়লা ফাতিহকে তাড়া দেখিয়ে বলে,
“ আমাকে দেখা শেষ? এখন যাও। “
ফাতিহর মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে ল্যায়লাকে দেখতে ব্যস্ত। ল্যায়লা হাত বাড়িয়ে ফাতিহর এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে উদ্যত হয়৷ কিন্তু ফাতিহ মাঝপথেই তার সেই হাত থামিয়ে দেয়। ল্যায়লা লক্ষ্য করে ফাতিহ গভীর নেশাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বলবে তার আগেই ফাতিহ তার দুইহাত কোমরের পিছনে নিয়ে ধরে। এই মুহুর্তে এই নিস্তব্ধ পরিবেশ আর ফাতিহর দৃষ্টি দুটোই ল্যায়লার মনে তুফান সৃষ্টি করে। সাথে সাথে সে চোখ বুজে ফেলে।
মিনিট খানেক অতিবাহিত হয়। ফাতিহর তরফ থেকে কোনো প্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে ল্যায়লা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। সাথে সাথে ফাতিহ নিজের অশান্ত চিত্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একহাতে ল্যায়লার দুই হাত কোমরের পিছনে নিয়ে ধরে রেখেছে এবং আরেক হাত ল্যায়লার গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। বিস্মিত ল্যায়লাকে নড়চড় করার সুযোগ না দিয়েই তার অধর ছুঁয়ে দেয় ফাতিহ৷
প্রথমে কয়েক সেকেন্ড ল্যায়লা বিস্মিত থাকলেও পরক্ষণে সেও সাড়া দেয়। ফাতিহ ল্যায়লাকে ছেড়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে এলোমেলো নিঃশ্বাস ফেলছে।
“ পালিয়ে বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকলে তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো মিসেস ফাতিহ আরাব। বিয়ে করেছি লুকোচুরি খেলার জন্য না। যতো পালানোর চেষ্টা করবে তত আরো আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়বে। “
কথাটুকু বলেই ব্যাকুল ফাতিহ পুনোরায় ল্যায়লার ঠোঁটে ডুব দেয়।
__________
হাম্মাম দিনের মতোই হেনা পার্টিও মূলত মহিলাদের একটা অনুষ্ঠান। হেনা পার্টির জন্য ল্যায়লার নানু বাড়ি বেশ জাক জমক ভাবে সাজানো হয়েছে। ল্যায়লা আজকে সাদা গাউন এবং তার উপর একটা সবুজ কাফতান পরিধান করেছে।
মেহেদী দেওয়ার জন্য কয়েকজন আর্টিস্টও এসেছেন। তারা প্রথমে ল্যায়লার হাতে মেহেদী দিয়ে দিবে তারপর একে একে বাকিদের দিয়ে দিবে।
মেহেদী মরক্কানদের কাছে কেবল একটি ঐতিহ্যবাহী উলকি নয় যা কয়েকদিনের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যাবে। এটা মরক্কানদের কাছে খুবই প্রতীকী। মেহেদী মূলত উর্বরতা, সৌন্দর্য, মন্দ দৃষ্টি থেকে সুরক্ষা, একটি ঐশ্বরিক আর্শীবাদ এবং একটি উদযাপনের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অনুষ্ঠানে অবিবাহিত নারীরাও হাতে মেহেদী লাগায় নিজের জীবন সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশ্যে। একে আল ফাল বলা হয়।
__________
সন্ধ্যা প্রায় শেষের দিকে। লিভিং রুমের একপাশে মখমলের কাপড় দিয়ে ঢাকা সোফায় বসে ল্যায়লা নিজের হাতের মেহেদী দেখছে। বাকিরা এখন কেউ কেউ মেহেদী দিচ্ছে আর কেউ কেউ নাচ গানে ব্যস্ত। মহিলারা সকলেই একপাশে গল্পে মশগুল। আচমকা সাউন্ড বক্সের গান থেমে যায় আর রুমের সকল লাইট নিভে যায়।
সকলেই ব্যস্ত চোখে আশেপাশে তাকাতে থাকে। ল্যায়লার মামী সুইচবোর্ড চেক করার জন্য উঠে যেতে নিবে এমন সময়ই বাড়ির বাহির থেকে মিউজিকের শব্দ ভেসে আসে। সকলেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। ল্যায়লার মামাতো বোন দৌড়ে গিয়ে বাড়ির দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথে একদল যুবক নাচানাচি করতে করতে ভেতরে প্রবেশ করে।
এই যুবকদল কারোই অপরিচিত নয়। এরা মরক্কান জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা। সকলেই শার্ট প্যান্ট পড়ে সম্পূর্ণ জেন্টালম্যান গেটাপে রয়েছে। এই সকলের মাঝে দুজনকে দেখে ল্যায়লা সবথেকে বেশি অবাক হয়। প্রথম জন তার ফাতিহ এবং দ্বিতীয় জন তার শশুর। ফাতিহর মা ফাতিমা বেগমের চক্ষু ইতিমধ্যে চড়াক গাছ রূপ ধারণ করেছে। একে তো তার ছেলে এভাবে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে নাচতে নাচতে শশুর বাড়ি মেহেদী অনুষ্ঠানে এসে উঠেছে। আর তার স্বামীও ছেলের সাথে যোগ দিয়ে কি ঢেই ঢেই করে নাচছে!
লিভিং রুমের মাঝখানটা ইতিমধ্যে ফাতিহদের দখলে। তারা সকলেই নাচতে ব্যস্ত। প্রথমে সকলে অবাক হলেও এখন সবাই বেশ উপভোগ করছে। যারা মেহেদী হাতে দেয়নি এখনো তারাও তালি বাজাচ্ছে। ফাতিহ নাচতে নাচতে ল্যায়লার কাছে এসে তাকেও বলে উঠে আসতে। প্রথমে ল্যায়লা নাকোচ করলেও পরে নিজ থেকেই উঠে আসে। তাকে এবং ফাতিহকে ঘিরে চারিদিকে সকল পুরুষরা এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে গানের তালে হাত নাচাচ্ছে। ল্যায়লার হাতে মেহেদী থাকায় সে সাবধানে কেবল এই মুহুর্তটা উপভোগ করছে। ফাতিহ বিষয়টা বুঝতে পেরে আচমকা ল্যায়লাকে একটানে পাজাকোলে তুলে নেয়।
মুহুর্তেই চারিদিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। ইসাম সহ আর বেশ কিছুজন শিষ বাজিয়ে উঠে। আচমকা সবার সামনে এভাবে কোলে তুলে নেওয়ায় ল্যায়লা লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছে। ফাতিহ সেই লজ্জাকে তোয়াক্কা না করে ল্যায়লাকে নিয়ে ঘুরতে শুরু করে আর কানে কানে বলে উঠে,
“ এখন তোমার মেহেদীও নষ্ট হবে না আর উপভোগেও ব্যাঘাত ঘটবে না। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]