#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১৫
#মৌরিন_আহমেদ
সময় একটা বিচিত্র বিষয়। এর সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। আমি সেই কঠিন কাজ সমাধা করার ঝক্কিতে যেতে চাইনা। যাবো না। শুধু বলবো, সময় চিরবহমান। তার এই বহমানতায় কেটে গেছে বেশ ক’টা দিন।
আজকাল ধ্রুবের সাথে বেশ ঘন ঘনই দেখা হয় অনন্যার। প্রায়ই দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে গল্পগুজব করে। ধ্রুবের অদ্ভুদ অদ্ভুদ কথা আর থিওরি শুনে হেসেই খুন হয়ে যায় অনু। ওর চালচলন, আচার ব্যবহার সবকিছুতেই এক অন্যরকম ছোঁয়া পায় যেন। বারবার বিমোহিত হয়ে প্রেমে পরে যায় ওর!
শেষবারের মতো বস্তিতে ঘুরতে এলো ধ্রুব। আজ এখানে তার শেষ দিন। এরপর আর এখানে আসবে না ও। কারণ আজকের রিপোর্ট পাঠানোর পর আর কোনো বিশেষ কাজ থাকবে না ওর। তাই আর আসার দরকারও পরবে না!
বস্তিতে ভাড়া করা সেই টিনের ঘরটায় বসে আছে ধ্রুব। কিছুক্ষণ হলো এসেছে তবুও মালেকের সাথে দেখা হয় নি ওর। মিনারা অবশ্য খবর দিয়ে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চলে আসবে। তাই নিজের কাজ করছে ও। কাঁধের ব্যাগটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন একটা বের করে আনলো। কালো রঙের ছোট্ট একটা জিনিস! সেটা হাতে নিয়ে অন্যরকম একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেটাই দিকে।
হঠাৎ মিনারা কে দেখা গেল। সে চুপটি করে দরজার ওপাশে দাড়িয়ে আছে। ধ্রুব সেটা খেয়াল করতেই চট করে ‘চিপ’টা লুকিয়ে ফেললো হাতের মুঠোয়। অন্য হাত তুলে ইশারা করলো,
– আয়, ভেতরে আয়!
অনুমতি পেয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো মেয়েটা। মিষ্টি করে হেসে বললো,
– ভাইজান,ভালো আছেন?
– হ্যাঁ,খুব। তুই?
– আছি…
বলেই মলিন হাসলো। কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। হয় তো ভাবছে বলা ঠিক হবে কি না। অদ্ভুদ একটা দ্বিধায় পড়ে গেল যেন। অপ্রতিভ চাহনি দিয়ে বললো,
– আপনার কি কিছু লাগবো?
– না রে।.. কেন কিছু বলবি?
মাথা নাড়ে মেয়েটা। আশেপাশে তাকিয়ে খুবই সন্তপর্নে বলে,
– আপনি আমারে একটা সাহায্য করবেন, ভাইজান?.. আমারে আমার গেরামে পৌঁছায় দিতে পারবেন?
ধ্রুব অবাক হয়ে তাকায়। ধীরে ধীরে বলে,
– হঠাৎ বাড়ি যেতে চাস?.. কিছু হয়েছে?
– মায়ের খুব অসুখ.. আমারে দেখবার চায়। ওস্তাদরে কইছি কিন্তু যাইতে দেয় নাই!.. কাইল আবার আমারে কামে পাঠায় দিবো.. তখন তো আর যাইতে পারুম না… আমারে গেরামে পাঠায়া দেন না গো, ভাইজান! মায়ের খুব অসুখ। আমি যাইতে চাই…
মেয়েটা হঠাৎ পা আঁকড়ে ধরে ওর। অদ্ভুদ একটা মায়ায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ধ্রুব। ওদের মা আছে, ঘরে ফেরার ইচ্ছে আছে। তাড়া আছে, টান আছে। ওর মা নেই, কিচ্ছু নেই! জগতের কোনো কিছুতেই ওর তাড়া নেই।
ধ্রুব খুব চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। অবাক চাহনিতে মিনারার মুখের দিকে তাকায়। গত কয়েক দিন নিয়মিত যাতায়াতের ফলে মিনারার সাথে ওর সখ্যতা গড়ে উঠেছে বেশ ভালো। ওই লাজুক, ভীতু মেয়েটা ওকে ‘ভাইজান’ বলে সম্বোধন করে। এ কয়েকদিনে ওকে অনেক সাহায্য করেছে মেয়েটা। ড্রাগ ডিলিংয়ের জায়গাটার খোঁজ ওই এনে দিয়েছে। বস্তিতে কখন কি হয়, কে যায়, আসে, সব কিছুরই একটা খবর ওকে দিয়েছে মিনারা। তাতে বেশ উপকারই হয়েছে ওর!
ধ্রুবের চাহনি দেখে মেয়েটা তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
– আমারে যাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দিবেন না?.. আমার যে ঐখানে যাওয়া খুব দরকার!.. ভাইজান, কিছু কন না কেন? আমারে পাঠায় দিবেন না?..
থতমত খেয়ে যায় ধ্রুব। আমতা আমতা করে বললো,
– আব্… হ্যাঁ.. হ্যাঁ। তোকে পাঠিয়ে দেব। তোকে আমিই সাথে নিয়ে যাবো। কিন্তু… কিন্তু…
হঠাৎ চুপ করে যায়। কথাটা আর শেষ করে না। কী যেন ভাবার পর বলে,
– আচ্ছা, তোদের কাজে পাঠাবে কখন? কখন যাবে? জানিস কিছু…
– সেইটা তো কয় নাই.. জানি না.. তয়, সবারে তো বিকালে কইরাই নিয়া যায়। তাইলে…
– ঠিক আছে। আপাদত তুই নিজের কাজে যা… কালকে আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো। এখন যা…
মিনারা খুশি হয়ে মাথা নেড়ে চলে যায় ঘর থেকে। ও যাওয়ার পর পরই কে যেন ঘরের দরজায় এসে দাড়ায়। অনুমতি নিয়ে বলে,
– ভাই, আসবো?
ধ্রুব মাথা তুলে দেখে মালেক দাড়িয়ে আছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– জ্বি, জ্বি.. আসেন।
মালেক এগিয়ে এলো। ধ্রুব ফর্মালিটি করে কয়েকটা কথাও সেরে নিল।। ঘর ভাড়াটাও হাতে গুঁজে দিল একসময়। ভাড়া নিয়ে খুশি মনে চলে যেতে লাগলো মালেক।
ওকে যেতে দেখেই হঠাৎ কি যেন মনে পড়লো ধ্রুবের। দ্রুত পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো সেই ‘ চিপ’টা। মালেক ততক্ষণে দরজার কাছে চলে গেছে। ও পিছন থেকে চিপটা ওর পিঠ বরাবর ছুড়ে মারে। নিশানা পাক্কা। চিপ ঠিক তার পিঠের মাঝে গিয়ে আটকে গেল। লাল রঙের একটা ছোট্ট লাইট জ্বলেই বন্ধ হয়ে যায় সাথে সাথেই। মানে জিনিসটা কাজ শুরু করেছে। ভেবে মনে মনে হাসলো ধ্রুব।
পিঠে পড়েছে ভেবে হঠাৎ চমকে উঠলো মালেক। ততক্ষনাত দাড়িয়ে গিয়ে বাঁ হাতটা পিঠের দিকে বাড়িয়ে দেয়। হাত দিয়ে সারা পিঠে পরোখ করে দেখে কি পড়লো। সেটা দেখে ধ্রুব একটু অবাক হয়ে বললো,
– কি হয়েছে, ভাই? any problem?
– না, পিঠে কি জানি পইড়লো..
– ও! টিকটিকি ভাই, টিকটিকি.. ওই যে দেখেন…
মালেক তাকিয়ে দেখলো সত্যি সত্যিই ওর পায়ের কাছে একটা টিকটিকি আছে। সেটা দ্রুত পায়ে আবারও গিয়ে দেয়ালে উঠে গেল। ঘরের ছাদ থেকে পড়ে গেছে ভেবে আর কিছু বললো না সে। চুপচাপ চলে গেল। ভাগ্যিস! টিকটিকি টা ছিল! উফ্! জোর বাঁচা বেঁচে গেছি! ভেবেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
ব্যাগ ঘাড়ে বেরিয়ে এলো ধ্রুব। দ্রুত ঘরের পশ্চিম দিকে চলে এলো। এখানে একটা টিনের বিশাল দোচালা ঘর আছে। তার পেছনের একমাত্র জানালায় গিয়ে উঁকি দিলো ও। কিছু কী দেখা যায়? এই নিকষ কালো নিরন্ধ্র অন্ধকার ভেদ করে কিছুই দেখা যায় না। অনেকটা পরিত্যাগ্ত একটা ঘর। অথচ রাতের আঁধারে এই ঘরই হয়ে ওঠে সবচেয়ে রমরমে!
ধ্রুব খুব দ্রুত এবং ক্ষিপ্ততার সঙ্গে ব্যাগে হাত ঢুকায়। আরেকটা চিপ বের করে লাগিয়ে দেয় জানালার টিনে। তারপর আর একটুও সময় নষ্ট নয়। চট করে দৌড়ে যায় নিজের ঘরের দিকে। সেখানে তালা ঝুলিয়ে চাবিটা মিনারার কাছে দিয়ে বলে,
– আমি যাচ্ছি। একেবারে কাল আসবো তোকে নিতে। তুই রেডি থাকিস!
ও প্রতি উত্তরে কিছু বলার আগেই দ্রুত প্রস্থান করে সেখান থেকে।
________________________
বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে অনন্যা। বাম হাতটা ঘাড়ের নীচে রেখে হেড সাইডে হেলান দেয়া। দৃষ্টি তার বাতায়ন পানে। উদাসী মুখে কি যেন ভাবছে ও!
অন্যদিকে খাটের অপর প্রান্তে বসে ওর দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে কানিজ। চোখ মুখ কুঁচকানো। ও যে ইতিমধ্যেই অনুর উপর অসীম রাগ করে ফেলেছে তা বোঝা যাচ্ছে ওর কথায়। ও ক্ষেপে গিয়ে বললো,
– তুই কি উল্টাপাল্টা কথা বলছিস, অনু! মাথা কি কিছু ঠিক আছে না ওই ধ্রুবের জন্য পুরাটাই গেছে?
ও একবার কানিজের মুখের দিকে তাকায়। বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে আগের স্থানে। সেটা খেয়াল করতেই যেন আরও রেগে উঠলো কানিজ,
– কথা না বলে মৌনব্রত শুরু করেছিস কেন? তুই কি বলবি আমায়, তোর মাথায় এখন কি চলছে?
– কিছু না।
বেশ নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয় অনন্যা। তাতে তেঁতে উঠে ও,
– কিছু না তো এতক্ষণ কী বললি আমায়?
– চেঁচাস না, কানিজ! সুস্থিত হ। বাবা বাসায়।..
জয়নাল আবেদীনের নাম শুনে কিছুটা ধাতস্থ হয় কানিজ। কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে থাকে,
– দেখ, অনু। এতদিন তুই যা কিছু বলেছিস, আমি মেনেছি। ধ্রুবের সাথে কথা বলেছিস, যোগাযোগ রেখেছিস.. সব ঠিক আছে, আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু ওকে তুই ভালবাসবি, প্রেম করবি, বিয়ে এই সব কী অনু!.. তুই তো ঠিক মতো জানিসই না ও আসলে কে!.. একটা বাউন্ডেলে-লাফাঙ্গা ছেলে, কাজ কারবার নেই.. এমনি একটা ছেলে.. যে কি না…
– তুই কেন আমার কথা বুঝতে চাস না, কানিজ? আমি ওকে সেই শুরু থেকেই ভালোবেসেছি.. তাই তো এতো কাছে আসা, যোগাযোগ। আর যাকেভালোবাসি, তাকে সেটা বলবো না? এটা কি বলিস তুই!
– বেশ, বলতে চাস বলবি!.. কিন্তু তার আগে তুই আমাকে বল, আসলে তোর প্ল্যানটা কি?.. কি করতে চাস তুই? শুধু টাইমপাস রিলেশন? না একেবারে বিয়ে?
– কেন, বিয়ে!.. আর এটা কোনো কথা বললি?.. আমি করবো টাইম পাস রিলেশন? ইউ নো ইয়ার, আই অ্যাম ইন লাভ উইথ হিম! বিয়ে না করে কি করবো! আমি কি থাকতে পারবো, ওকে ছাড়া?
– আরে গাধী, বিয়ে বিয়ে করে যে লাফাচ্ছিস.. তোর বাপের কথা ভেবেছিস?… আঙ্কেলের মতো একটা মানুষ ঐরকম একটা ভ্যাগাবন্ড ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে?
প্রতি উত্তরে কি বলবে ভেবে পায় না অনন্যা। ওর কথাগুলো তো হারে হারে সত্যি! তবুও যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে,
– তুই আগেই কেন অতশত ভাবছিস?.. আগে প্রোপজ করি, চুটিয়ে প্রেম করি কিছুদিন, তারপর না হয় বাবাকে ম্যানেজ করবো।..
– ম্যানেজ করবি? আঙ্কেলের সামনে দাড়াতেই তো তোর হাঁটু কাঁপে.. আর তুই ওনাকে ধ্রুবের জন্য ম্যানেজ করবি?..
– আব্.. আমিই ম্যানেজ করবো সেটা তোকে কে বললো?.. নিজের বিয়ের কথা কেউ কখনো নিজেই বলে না কি?.. বলবে তো.. মামু বা মা.. না হয় তু.. তুই! তুই বলবি!..
– আমি?.. অসম্ভব! আর যাই হোক, আঙ্কেলের সামনে ঐ ছেলের কথা বলতে যেতে পারবো না!..
– কানিজ!..
– না..
বলেই হাত নেড়ে নেড়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় কানিজ। মানে সে কোনোভাবেই রাজি নয় এ ব্যাপারে অনুর বাবার সাথে কথা বলতে। অনন্যা কি করবে ভেবে পায় না। করুণ স্বরে বললো,
– এই শোন না!
– উহুম, পারবো না। আমি যাচ্ছি তুই থাক…
#চলবে——-