মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_২২ #মৌরিন_আহমেদ

0
308

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২২
#মৌরিন_আহমেদ

বেশ ক’টা দিন পর বাড়ি থেকে বেরোয় অনন্যা। যদিও যেতে চায় নি। তবুও কানিজের টানাটানিতে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়। কতদিন আর এমন ঘরবন্দী হয়ে থাকবে? কার ওপর অভিমান করে নিঃসঙ্গ, একা হয়ে থাকবে? যার ওপর অভিমান করবে সে কি জানবে ওর কোনো কথা? কোনদিন একবারের জন্য হলেও জানবে, ওর মন ছুঁয়েছে সে?

তাই ধ্রুবের উপর জমানো অভিমানগুলো জমিয়েই রেখেছে ও। কেউ জানুক বা না জানুক নিজের এই প্রিয় অভিমান, অকৃত্তিম ভালোবাসা নিয়েই থাকবে। কারণ সব কিছুই ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু যে মন ছুঁয়ে যায় তাকে কি কখনো ভোলা যায়? মন ছোঁয়া ব্যক্তি কে ভুলতে গেলে তো মনকেই ভুলে যেতে হয়। তা কী কেউ পারে?

ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রিকশা করে বাড়ি ফিরছিল অনন্যা। হঠাৎ গলির মোড়ে এসে কী যেন দেখে অবাক হয়ে যায় সে। ছয়তলা বিল্ডিংটার সামনে একটা মিনি ট্রাক দাড়ানো। তাতে একটা বাসার বিভিন্ন মালপত্র। এটা দেখেই মূলত অবাক হয়েছে ও। এ বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া আসছে না চলে যাচ্ছে সেটা বুঝতে সময় লাগে কিছুক্ষণ। দেখতে পায় একজন বৃদ্ধলোক বান্ডিল বান্ডিল বই এনে এনে তুলছেন ট্রাকে। মানে বাসা ছাড়ছেন।

ওর রিকশাটা জায়গাটা প্রায় ক্রস করেই ফেলেছিল। হঠাৎ কি যেন মনে হতেই রিকশাওয়ালাকে থামতে বলে। ভাড়া চুকিয়ে, ওনাকে বিদায় দিয়েই এগিয়ে যায় বৃদ্ধ লোকটার দিকে। উনি হয় তো নতুন কিছু আনার জন্য বিল্ডিংয়ের ভেতরে যাচ্ছেন। তাই একটু ইতস্তত করে বললো,

– এই যে, চাচা!

ডাক শুনেই ফিরে তাকান করিম চাচা। অপরিচিত মেয়েটা কে দেখে এগিয়ে আসেন উনি। নরম গলায় বললেন,

– কী মা? আমারে ডাকছিলা?

– ইয়ে… মানে.. আচ্ছা, এই জিনিসগুলো কার? কে বাসা বদলাচ্ছে? আপনি?

– জ্বে না।.. এইগুলান ধ্রুব বাবাজীর।.. চারতলার।

ধ্রুবের নামটা শুনেই হঠাৎ একশ ওয়াটের বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল অনন্যার মুখ্। অবাক হয়ে বললো,

– ধ্রুব?

– হ্যাঁ, ওনারই জিনিসপাতি… আইজ বাসা ছাড়তেছেন উনি…

বাসা ছাড়ার কথা শুনেই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে ওঠে অনন্যা। ধ্রুবকে যখন খুঁজে পেল তখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে? এটা কেমন কথা? বিস্ময়ে ঠিক মতো কথা বলতে পারে না ও। কাঁপা কাঁপা গলায় কোনমতে বললো,

– বা- বাসা.. ছাড়ছেন…কে- কেন? কো-..কোথায় যাবেন?

– এখন তো ঢাকায় যাওয়ার কথা। বাবাজি তো তাই কইছে…

– ধ্রুব সাহেব বাড়িতে নেই? ওনাকে একটু ডেকে দিবেন?

– সে তো বাড়িতে নাই। ঢাকায় গেছেন মেলাদিন হইলো।….

– ও!

অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে অনন্যা। মনে মনে ভাবতে থাকে, ধ্রুব তাহলে মিথ্যে বলে নি? তার আসল নামই তবে ধ্রুব? তবে বাড়িওয়ালা কেন ভুল বললো? আর ও যদি চলেই যায় তাহলে অনন্যার কী হবে? ওতো এখনো ওকে নিজের ভালোবাসার কথাটাই জানাতে পারে নি! তবে কী কিছুই জানাতে পারবে না ধ্রুবকে? ওর হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসা হৃদয়েই থেকে যাবে? খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বললো,

– আমি তাহলে আসছি। ভালো থাকবেন।..

বলেই ফিরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। চাচাও চলেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু কী যেন মনে পড়তেই ফিরে ডাকলেন ওকে। বললেন,

– কিন্তু আপনার নামটা তো কয়া গেলেন না? নাম কি আপনের?

নাম? নাম বলে আর কি হবে? মনে মনে ভাবে ও। অস্পষ্ট স্বরে বললো,

– অনন্যা।

– অনন্যা? অনামিকা আবেদীন?

চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে চাচার। অনন্যা ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। হঠাৎ খুশির ঝলক দেখা যায় চাচার মুখে। উনি পরনের শার্টটার বুক পকেটে হাত ঢুকাতে ঢুকাতে বললেন,

– আমি আপনেরেই তো খুঁজতেছি কয়দিন ধইরা।.. কই আছিলেন আপনি? লন.. লন.. এইটা বাবাজি আপনেরে দিতে কইছে।.. নেন..

বলেই হাত বাড়িতে একটা কাগজ এগিয়ে দেন অনন্যার দিকে। অনন্যা চরম অবাক হয়ে কাগজটা হাতে নেয়। ধীর পায়ে নিজের বাড়ীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। ধ্রুব ওকে চিঠি দিয়েছে? ওর জন্য রেখে গেছে? তার মানে ওকে না বলে নিরুদ্দেশ হয় নি সে? মনে রেখেছে বলেই এই ক্ষুদ্র চিরকুট?

আর তর সইতে পারে না অনন্যা। দ্রুত পায়ে হেঁটে চলতে থাকে। রুমে গিয়েই চিঠিটা খুলবে ও। তারপর কানিজকে কল দিয়ে বলবে ওদের খোঁজাখুঁজি ব্যর্থ হয় নি!
__________________________________________________________
প্রেয়সী__

শূন্য পনের বার তোমার কথা ভেবেছি,
পাঁচশো তেত্রিশ বার কল্পনায় তোমার মুখ ছবি এঁকেছি
ছয়শ আটচল্লিশ বার ওই লজ্জারাঙা মুখশ্রীর প্রেমে পড়েছি
অবশেষে ঊনত্রিশ বার নিজের এই অবাধ্য মনকে মানিয়েছি।
নামহীন ক্ষুদ্র এ সম্পর্কের কোনো পরিণতি আমার জানা নেই। এখনই ফিরে যাওয়ার তাড়া পড়েছে। তাই ফিরে চলেছি। ভালো থেকো…

ধ্রুব_____
__________________________________________________________

চিরকুটটা পড়ে অবাক হয়ে যায় অনন্যা। এসব কি লিখেছে ধ্রুব? শেষের কথাগুলো সহজ এবং বোঝার মতো হলেও প্রথম দিকটা কেমন এলোমেলো! ওর কথা ভাবে, কল্পনায় ছবি আঁকে, আবার প্রেমেও পড়ে, সবই ঠিক আছে। কিন্তু এর সাথে এরকম সংখ্যা যোগ করার মানে কি? এটা কোন জাতের চিঠি? ঠিক মানে বুঝতে পারে না অনন্যা। কিন্তু সব চিন্তাকে ছাপিয়ে ধ্রুব যে সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা জেনেই মুষড়ে পড়ে।

বিকেলে কানিজকে আসতে দেখা গেল অনন্যাদের বাড়িতে। সাথে একজন সুন্দরী রমণী। বয়সে কানিজের দু’ তিনবছরের বড় হবে। জোহরা বেগম দরজা খুলে ওদের দেখেই বললেন,

– আরে কানিজ? কী খবর?

– খবর ভালো, আন্টি। তুমি কেমন আছো?

– আমি ভালো আছি। আয়, ভেতরে আয়। তোর সাথে এটা কে রে? তোর কে হয়?

বলেই অবাক চোখে মেয়েটাকে দেখতে লাগলেন। বেশ লম্বা-চওড়া সুন্দরী রকমের মেয়ে! চোখে কেমন হাসি হাসি চাহনি। কানিজ ওর দিকে একবার তাকিয়ে বললো,

– ও হলো আমার ফুপিন। বলেছিলাম না,usa থাকতো? পরশু দেশে এসেছে…

ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই জবাব দেয় কানিজ। ওর ফুপিনকে ড্রইং রুমে বসিয়ে রেখে ডাকতে যায় অনন্যাকে।

– অনু, এই অনু! কই রে তুই?

ডাকতে ডাকতেই ঘরে ঢুকে যায় কানিজ। দেখতে পায় বিছানার ওপর বসে আছে অনন্যা। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে তাকিয়ে আছে নিজের হাতের দিকে। ওর হাতে ওটা কী? সাদা কাগজ বলে মনে হচ্ছে না? কানিজ ধীর গলায় ডাকে,

– অনন্যা?

হঠাৎ ঘুম থেকে মানুষ যেমন চমকে যাওয়া ভঙ্গিতে তাকায় সেরকম করলো ও। কিছুটা হকচকিয়ে যাবার মতো করে বললো,

– কে?.. ও, কানিজ! আয়, ভেতরে আয়। বোস..

ওর হঠাৎ কী হলো ভেবে পায় না কানিজ। ধ্রুব হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর এই অবস্থা। প্রথম প্রথম বুঝতে পারে নি ধ্রুবের প্রতি ওর এই আগ্রহের কারণ। এখন বুঝতে পারে। কতোটা গভীরভাবে চাইলে একটা ছেলেকে এমন পাগলের মতো ভালোবাসা যায়!

কানিজ ধীর পায়ে হেঁটে বিছানায় ওর পাশে গিয়ে বসে। আলতো করে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,

– কী হয়েছে, অনু?

ও কেমন নিষ্প্রভ চাহনিতে মুখ তুলে তাকায়। চেহারাটা কেমন মলিন। মুখের দু’পাশে ঝুলে আছে অবিন্যস্ত রুক্ষ চুল। মেয়েটা মুখে কিছু বলে না। হাত বাড়িয়ে কাগজটা এগিয়ে দেয় কানিজের দিকে। ও অবাক চোখে কাগজটার দিকে তাকায়। সেটা হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। প্রথমেই চোখ যায় পৃষ্ঠার শেষ অংশের নামটার উপর। সেখানে লেখা “ধ্রুব”। হঠাৎ এক চিলতে হাসির ঝিলিক ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটের কোণায়। তারমানে ধ্রুব নিখোঁজ হয় নি! কিছু হলেও খোঁজ আছে!

চিরকুট টা পড়ার পরেই নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো আঁধার এসে ঘনায় কানিজের মুখে। ও মন খারাপ করে অনন্যার পানে চায়। তার কোমল গাল দুটিতে এখন অশ্রুধারা বইছে। ফর্সা নাকের ডগাটা কান্নার দরুণ লাল হয়ে গেছে। সে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর।

হঠাৎ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ে কানিজ। আলতো করে ওর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর চেপে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অস্থির কন্ঠে বলে,

– কাঁদছিস কেন, পাগলী? ও চিঠি ভুয়া। ধ্রুব হারায় নি। ও আছে এ শহরেই.. কোথাও যায় নি..

– মিথ্যে সান্ত্বনা কেন দিচ্ছিস তুই? আমি জানি ও নেই। ও নেই! ও বলে গেছে ও নেই। ও নিজ ঠিকানায় ফিরে গেছে… আর আসবে না। কোনদিনও না!

#চলবে——-

[অনেকদিন ধরে গল্প দেই নি, তাই সময় পেয়ে আরও একটা পর্ব দিয়ে দিলাম… হ্যাপি রিডিং..🙂]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here