#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২৮
#মৌরিন_আহমেদ
পড়ার টেবিলে নিরস মুখে বসে আছে অনন্যা। আজকাল পড়তে বসতে তার ভালো লাগে না। একদমই না। মন পড়ে থাকে অন্য জায়গায়, অন্য চিন্তায়। হঠাৎ ‘ধপ’ করে বইটা বন্ধ করে দেয়। বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে উচ্চারণ করে,” ধ্যাত, কিছুই ভালো লাগে না!”
তারপর চেয়ার টেনে উঠে দাড়ায়। বিরক্ত মুখে হাঁটা লাগায় ব্যালকনির দিকে। এই রুমটা তার অসহ্যকর লাগছে। কেমন গুমোট, অস্থির করা ঘর! নিঃশ্বাস আটকে যায় প্রতিক্ষণে। কী করবে কিছু বুঝতে পারে না। জাগতিক কাজকর্মে মন নেই মন শুধু ওই “ধ্রুব” নামক ব্যক্তির চিন্তায়। বুঝতে পারে প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভুগছে সে। শুধুই ধ্রুবের বিরহে!
ব্যালকনিটাকেও আর ভালো লাগে না ওর কাছে। বাইরের উথাল পাথাল বাতাসে ঠিক মতো যেন শ্বাস নিতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে ফিরে আসে ঘরে। ধীর পায়ে রিডিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়। তাক থেকে একটা বই টেনে বের করে। সুন্দর মলাটের একটা বই। “হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম”। কভার পেজ উল্টাতেই বেরিয়ে আসে ভাজ করা একটা কাগজ। সেটা হাতে নিয়ে বইটাকে আবারও আগের স্থানে রেখে দেয়। দেয়ালে হেলান দিতে দিতে ভাজটা খুলতে থাকে। দৃশ্যমান হয় ধ্রুবের হাতের লেখা। এটা ধ্রুবের দেয়া প্রথম ও শেষ চিঠি। এর আগে বা পরে কোনো চিঠিই সে দেয় নি!
অনু চিঠিটা বারবার পড়তে থাকে। চিঠিটা বড় অদ্ভুদ, অধিকাংশই তার বোধগম্য হয় নি। প্রতিটা লাইনের শুরুতে কিছু সংখ্যা লাগানো। এর মানে কি? কোনো বিশেষ কিছু? কেমন খটকা লাগে ওর। চিঠিটা এর আগেও সে বহুবার পড়েছে। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্তই হয়ে গেছে। তবুও এই সংখ্যাগুলোর কোনো মানে খুঁজে পায় নি!
আজ হঠাৎ কী যেন মনে হলো ওর। চেয়ার টেনে আবারও নিজের জায়গায় বসে পড়ে। এখন মস্তিষ্ক তার সচল। দ্রুত গতিতে তার রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে। উত্তেজনায় হাত কাঁপতে থাকে। তবুও সাহস করে একটা প্যাড টেনে নেয় সামনে। চিঠির সংখ্যাগুলো পরপর লিখে।.. ০১৫৫..
আঁতকে ওঠে অনন্যা। এটা তো একটা নাম্বার! ১১ডিজিটের মোবাইল নাম্বার। তারমানে সংখ্যাগুলো অহেতুক লেখা হয় নি? এটা একটা টেকনিক? ধ্রুব ইচ্ছে করেই এমন চিঠি লিখেছে? নিজের কন্ট্যাক্ট নাম্বার দিয়ে গেছে?
হঠাৎ মাথা খারাপের মতো হয়ে যায় ওর। আর কিচ্ছু ভাবতে পারে না। দৌড়ে গিয়ে বিছানার কাছে যায়। কাঁথা-বালিশ সরিয়ে ফোনটা খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ তোলপাড়ের পর অবশেষে হাতের নাগালে পায় ওটা। ডায়ালারে গিয়ে চটপট ডায়াল করতে থাকে। নাহ্, কাগজ দেখার প্রয়োজন নেই তার। সংখ্যাগুলো তার মুখস্তই আছে!
উত্তেজনায় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ওর। বুকের ভেতর মাংসল পিণ্ড টা যেন স্পন্দিত হতে ভুলে যায়। শিরা-উপশিরায় চলমান রক্তকণা গুলোও যেন প্রচণ্ড শীতল হয়ে ওঠে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়, কিন্তু কাজ হয় না। হাঁপানি রোগীর মতো হা করে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। ফোনটা রিসিভ হলে কী বলবে সে? ভেবে পায় না। ধ্রুব কী ওকে চিনতে পারবে? জানে না সে।
অনন্যার তুমুল উত্তেজনার মাঝেই ফোনটা কেটে যায়। কারণ মোবাইল অপারেটর থেকে তখন জানিয়ে দেয়া হয়েছে, “আপনার কাঙ্খিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।.. sorry the number you are…” হঠাৎ হাত থেকে ফোনটা পরে যায় ওর। চোখের সামনেই মেঝেতে বারি খেয়ে কাঁচটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সেদিকে নিস্পলক চোখে তাকায়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা ছুঁতে গিয়ে নিজেও ধুপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। স্ক্রিনের ভাঙা কাঁচে হাত বুলায়। নিষ্প্রাণ চাহনির দুটি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’ ফোঁটা জল!
ঘরের ভেতর কিছু পরে যাওয়ার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন জোহরা। দরজায় হাত রেখে ঠেলা দিতেই বোঝেন তা ভেতর থেকে আটকানো। উত্তেজিত গলায় চিৎকার করেন,
– অনু, এই অনু!.. কী হয়েছে তোর? মা আমার, দরজা খোল!.. দেখ, আমি এখানে আছি। তোর মা তোর কাছে আছে.. দরজা খোল, মা। লক্ষ্মী সোনা, দরজাটা খোল!
ভীষণ জোড়ে করাঘাত করতে থাকেন উনি। অনু ঝাপসা চোখে সেদিকে তাকায় কিন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়ার শক্তি পায় না। হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। ঝাপসা চাহনিতে আরেকবার দরজার দিকে তাকাতেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে!
__________________________
হাতে একটা লম্বা লাঠি আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হিল ট্রেকিংয়ে বেরিয়েছে দুই তরুণ। বর্ষণ আর প্রদোষ। এখন হেঁটে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি জঙ্গল ধরে। জঙ্গলটার গা ঘেঁষেই একটা পাহাড়। তার ওপরেই আছে একটা গ্রাম। আদিবাসীদের গ্রাম। পর্যটকদের উদ্দেশ্য সে গ্রাম হলেও তারা সেদিকে যাবে না। এই পাহাড় ঘেঁষেই এগিয়ে যাবে আরেকটু সামনে।
হঠাৎ কথা বলে ওঠে প্রদোষ,
– আর কদ্দুর হাঁটবো আমরা? অনেক তো হলো।..
– তোর কী মনে হয়, আমরা ট্রাভেল করতে বেরিয়েছি?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে বর্ষণ। ও থতমত খেয়ে বললো,
– না.. মানে.. আজ তো অনেকটা চলে এসেছি, চল্ না। রিসোর্টে ফিরে যাই? কিছু একটা খেয়ে-দেয়ে..
– তো রিসোর্ট থেকেই এতোটা রাস্তা আপনি আবার কী করে আসবেন? প্লেনে চড়ে?.. না আপনার শ্বশুড় হেলিকপ্টার পাঠাবে?.. বেশি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ না করে জোড়ে হাঁটা লাগা… যতো তাড়াতাড়ি পৌঁছাবো ততোই লাভ!..
বর্ষণের ধমক খেয়ে চুপসে যায় প্রদোষ। মুখটা হাওয়া বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো মুখটা করে বললো,
– তুই সবসময় এমন করিস কেন?.. তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে দৌড়ে দৌড়ে যাবো না কী?
– দরকার হলে তাই যাবো। চল্… নে এগো।
বলেই নিজের মতো এগিয়ে যেতে থাকে ও। প্রদোষ হঠাৎ কী যেন ভেবে দাড়িয়ে যায়। মৃদু গলায় বললো,
– বর্ষণ, শোন না..
একটু দূরে এগিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরায় বর্ষণ। দেখতে পায় প্রদোষ দু’ হাত কোমড়ে রেখে ‘হা’ করে শ্বাস নিচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে বললো,
– কী রে, দাড়িয়ে গেলি, কেন?
– একটু শ্বাস নেই, দোস্ত…
– আচ্ছা, হয়েছে। এখন চল্!
– কী? নাহ্,
হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে সে। বর্ষণ অবাক গলায় বললো,
– না কেন? তুই যাবি না?
– আব্ হ্যাঁ, যাবো। কিন্তু..
– কিন্তু কী?
– একটু পর।.. এখন একটু কিছু খেয়ে নেই না, দোস্ত? বেশি না মাত্র দুইটা স্যান্ডউইচ আর একটা বার্গার,প্লিজ?
– এইটা তোর কাছে মাত্র?!
– প্লিজ, দোস্ত। না করিস না!..
বিরক্ত মুখে সায় জানায় বর্ষণ। কাছেই একটা ছায়া ঘেরা জায়গায় বসে পড়ে। ব্যাক প্যাক থেকে পানির পটটা বের করতে করতে চারপাশ দেখে নেয়।
সূর্য এখন হেলে পড়েছে। ছায়া হয়ে গেছে দ্বিগুণ। মানে দুটো কী তিনটা বাজে। হাতে সময় আছে আর তিন ঘন্টা। সন্ধ্যা নামার আগেই রিসোর্টে ফিরে যেতে হবে। মনে মনে পুরো হিসেবটা কষে ফেলে বর্ষণ। এ প্রজেক্টে সে একা আসেনি, সাথে এসেছে প্রদোষ। যেখানে সব প্রজেক্টেই ওকে একা পাঠানো হয়। যাতে একা একা নির্বিঘ্নে কাজ সেরে ফিরে আসতে পারে। তাতে সময় একটু বেশি লাগে বটে তবে সমস্যা হয় না। কিন্তু দু’ জন এলেই বাঁধে ঝামেলাটা!
এই যেমন এবার সাথে এসেছে প্রদোষ। ব্যক্তিগত ভাবে ওর কাজের প্রতি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় না, মন দিয়েই সব কিছু করে। মাথায় বুদ্ধিও আছে সেরকম। কিন্তু খাওয়ার প্রতি সে অসম্ভব দূর্বল! একটু পর পর খেতে না পারলে তার চলেই না। অথচ কাজের জন্য কোথাও গেলে কিছুক্ষণ পর পর খাই খাই করলে তো আর হয় না! কাজে ব্যাঘাত হয়, দেরি হয়। সেটা ওকে কী করে বোঝায়?
ভাবতে ভাবতেই উঠে দাড়ায়। পাশে তাকিয়ে দেখে প্রদোষ মাত্র তার বার্গারটা শেষ করেছে। বললো,
– হলো তোর খাওয়া? এখন চল্, এগোই?
– কী বলিস? সবে তো বার্গার খেলাম। স্যান্ডউইচ টা খেতে হবে না? ইউ নো ইটস মোর ডেলিসিয়াস অ্যান্ড মোর নিউট্রেসস…
কিছু না বলে মুখটা শুধু বাঁকা করে বর্ষণ। অন্য দিকে তাকায়। ব্যাক প্যাক আর লাঠিটা রেখেই একা একা হাঁটতে থাকে। না সে এগোবে না, শুধু একা একা হেঁটে বেড়াবে।
একটু দূরে এগোতেই একটা টিলার কাছে পৌঁছে যায় ও। ধীর পায়ে টিলার উপরে উঠতেই চোখে পড়ে অন্য একটা জিনিস। ওপাশে সবুজ শস্যের ক্ষেত নয়, লাল টকটকে ফুলের ক্ষেত! সবুজ সবুজ গাছের ডগায় ফুটে আছে লাল লাল ফুল। বেশ খানিকটা জুড়েই সে ক্ষেত। কেউ যে খুব যতনে জঙ্গলের ভেতর এসে এই চাষ করেছে সেটা বোঝাই যায়। ও চারপাশে ভালো করে তাকায়। যেখানটায় দাড়িয়ে আছে তার ঠিক অপর প্রান্তে, ক্ষেতের সীমানায় বিশাল একটা গাছ। সম্ভবত পাকুড় গাছ। নয় তো ওই জাতেরই জংলী কোনো গাছ হবে হয় তো। কিন্তু, কিন্তু, তার পাশে ওটা কী? কাঠের ঘরমনে হচ্ছে না? তার মানে কি.. হাতের কাছে বাইনোকুলার টা খুঁজতে থাকে সে। কিন্তু খুঁজে পায় না। মনে পড়ে ওটা তো ব্যাক প্যাকেই রয়ে গেছে!
ধীর পায়ে টিলা থেকে নামে। সন্তর্পনে কিন্তু অনেকটা দৌড়ের গতিতেই ছুটে আসে প্রদোষের কাছে। সে এখনো বসে বসে স্যান্ডউইচই গিলছে। ওকে ছুটতে দেখে বলে,
– কী রে, কী হয়েছে? পাগলা কুত্তায় ধাওয়া করছে? না বোলতার চাকে ঢিল ছুড়ছিস?
– প.. পপি..
দৌড়ের কারণে হাঁফাতে হাঁফাতে জবাব দেয় বর্ষণ। ও খানিকটা অবাক হয়ে বললো,
– পপি? মানে ঢাকাই নায়িকা পপি?.. সে এই বনে-বাঁদাড়ে কী করবে? আশ্চর্য!
কথা শুনে বিরক্ত হয়ে ওঠে বর্ষণ। এগিয়ে এসে ওর পেটে একটা চিমটি কাটে। তারপর ওর মোটা মাথায় একটা গাট্টা মেরে রাগ দেখিয়ে বললো,
– তোর পেটটা যেমন মোটা, মাথাও তেমনি মোটা!.. ওরে বলদা! নায়িকা পপি না, ওখানে পপির চাষ হচ্ছে!..
– কোথায়? তুই সত্যি দেখেছিস তো?..
– আবার জিগায়!.. আরে, ঐ তো সামনেই…
– তাই না কি! চল্, চল্।
বলেই স্যান্ডউইচ রেখে উঠে দাড়ায় প্রদোষ। বর্ষণের দেখিয়ে দেয়া পথে আগে আগে যেতে থাকে। আর ওর পিছু পিছু বর্ষণ।
#চলবে——-