#শেষ_বিকেলের_মায়া (৫)
নাস্তা করছিল রিহান। বাবার হঠাৎ আ ক্রম না ত্মক কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল। বিস্ময়ে হতবাক সে। যা ভেবেছিল তাই হচ্ছে।
“ড্যাড এটা তুমি কি করেছ? একবার আমাকে জিজ্ঞাসা তো করবে? তুমি জানো যে আমি বিয়ে করতে চাই না। তাছাড়া ইলাকে আমার পছন্দ নয়। তুমি এটা কি করলে?”
ইরফান জোয়ার্দার কোনো জবাব দিলেন না। নির্বিঘ্নে মুখে খাবার তুলে যাচ্ছেন। রিহানের ইচ্ছে হচ্ছে সবটা ভে ঙে ফেলতে। মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিসেস জোয়ার্দার খাবার টা টেবিলে রেখে চেয়ার টেনে বসলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”এমন কেন করছিস বাবা? তোর কি কাউকে পছন্দ? আচ্ছা আমরা তো শুধু তোকে বিয়েই করতে বলছি। আর তো কিছু বলছি না।”
“রুনা তোমার ছেলে কে বলে দাও এই মাসের মধ্যে ওর সাথে ইলার বাগদান হয়ে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে বিয়ে। আমি কামরুল কে ফোন করে বলে দিচ্ছি।”
রিহান বুঝতে পারল পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে চলেছে। হাত দুটো মুষ্ঠি বদ্ধ করে আবার ছেড়ে দিল। বুকে সাহস জুগিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,”আমি একজন কে ভালোবাসি ড্যাড। আর আমি ওকেই বিয়ে করব। কিন্তু ও এক বছর পর বিয়ে করতে চাচ্ছে।”
ইরফান সাহেব অবাক হলেন না। অতি ঠান্ডা মেজাজে বললেন,”বিয়ে টা তোমায় এই মাসেই করতে হবে। আমি তোমার পছন্দ মেনে নিয়েছি এবার তুমি ডিসিশন নাও কাকে বেছে নিবে। ইলা নাকি তোমার ভালোবাসা।”
ইরফান জোয়ার্দার উঠে চলে গেলেন। মিসেস জোয়ার্দার ও কথা বাড়ালেন না। রিহান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে কিয়া কে ফোন লাগাল। কিয়া কে বিষয় টা বলতেই হবে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রিহান। খোলা নীল আকাশে সাদা মেঘ গুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। না শেষ রক্ষাটা আর হলো না। কিয়া কে মানাতে ব্যর্থ রিহান।
কিয়ার কথা গুলো ভাবতেই বুক ভে ঙে মাতম উঠছে। পাঁজরে মেঘ জমে গেছে। কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। চোখ দুটো জ্বলছে। তীব্র ব্যাথায় পাষাণ হৃদয় টাকে এফোর ওফোর করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
“স্যার আজ অফিস যাবেন না?”
“হু যাব।”
“নাস্তা কি টিফিন বক্স এ দিয়ে দিব?”
“না কিছু করতে হবে না। তুমি এখন যাও রফিক চাচা।”
রফিক চাচা চলে গেলেন। রিহান পেছন ফিরে বেডে পড়ে থাকা ফোন টার দিকে তাকাল। ফারিহাকে সাজিয়ে গুছিয়ে হাজির করতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। অগোছালো , রাগি , বদমেজাজি ছেলেটা ও আজ ভীষণ অসহায়। চাইলেই সমস্ত টা বলে দেওয়া যেত। কিন্তু এখন কিয়া কিছু জানাতেই চাচ্ছে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে হৃদয়ে। এ কেমন ভালোবাসা এল তার জীবনে?
“ফাস্ট আসতে বলেছি মানে আসবে এত কথা কেন বল?”
“স্যার প্লিজ আমাকে আধ ঘন্টা সময় দিন।”
“হোয়াট তোমার বাসা থেকে এখানে আসতে বড় জোড় দশ মিনিট লাগবে। আধ ঘন্টা দিয়ে কি করবে?”
রিহানের ধমকে নুইয়ে গেল ফারিহা । হঠাৎ ফোন করেই বলল এখনি আসতে হবে। আধ ঘন্টা সময় চাওয়াতে ও রেগে গেল। কোনো কথাই শুনছে না। কল রেখে দিয়েছে রিহান। ফারিহার বুকের মধ্যে ধীম ধীম আওয়াজ হয়। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ডক্টর এর চেম্বারে এল সে।
“ডক্টর আমার মায়ের অবস্থা কেমন?”
“স্থিতিশীল বলা যেতেই পারে। তবে আপনি তো জানেন আপনার মায়ের কন্ডিশন কেমন। প্লিজ ইমিডিয়েটলি ভালো ট্রিটমেন্ট করান। আদার ওয়াইস মা কে হারাতে হবে।”
ফারিহা কিছু বলতে পারল না। রিহান টাকা না দিলে কি করে ট্রিটমেন্ট করাবে সে? ঘড়ির দিকে তাকাল। অলরেডি ৩ মিনিট লেট। হাতে সময় নেই। ছুটতে লাগাল মেয়েটি। মিনিট বারো পরে রিহানের বলা রেস্টুরেন্টে পৌছাল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে আশে পাশে চোখ বুলাল। কর্ণারের টেবিলে রিহান কে দেখতে পেল। রিহানের সামনে যেতেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠের স্বর ভেসে আসল।
“পুরো ৫ মিনিট লেট। এত সময় ধরে রাস্তায় বসে ক্যারাম খেলছিলে?”
ফারিহা নত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। রিহান উত্তর না পেয়ে আরো রেগে গিয়ে বলল,”তোমার কাছে টাইমের ভ্যালু না ই থাকতে পারে বাট আমার আছে গট ইট?”
ধমকের চোটে ফারিহার চোখে নোনা জল চলে এল। সে কি ইচ্ছে করে লেট করে এসেছে? চোখ বন্ধ করে পানি আটকে কাঁপা স্বরে বলল,”ইয়েস স্যার।”
দু হাতে মাথা চেপে ধরল রিহান। ছেলেটার মাথা ঠিক নেই। এত এত টেনশনে কি করে মাথা ঠিক থাকবে? মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। রিহান চুপ। ফারিহা একই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। যেন কোনো পাথরের মূর্তি ।
“সিট ডাউন।”
ফারিহা বসল। রিহানের হঠাৎ নরম হয়ে যাওয়াতে খানিকটা অবাক হলো। তবু ও সোজা হয়ে বসে রইল সে। কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছে নেই।
“আসলে আমি প্রচন্ড টেনশনে আছি। আপাতত তোমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। যদি বাই এনি চান্স তুমি কিছু ভুল করে ফেল তাহলে আমি শেষ হয়ে যাব ফারিহা। প্লিজ মন দিয়ে কাজ টা করবে।”
“জি স্যার। আমি মন দিয়ে কাজ করব।”
“আচ্ছা।”
মিনিটের মধ্যে দু কাপ কফি এসে গেল। হালকা শীতের রাতে ধোঁয়া উঠা কফি দেখে ও খেতে ইচ্ছা হলো না ফারিহার। অবহেলায় কফি কাপ টা পড়ে রইল। রিহান কফি কাঁপে চুমুক দিয়ে ফারিহাকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে বলল।
“ফাস্ট অফ অল একটা কথা মনে রাখবে আমার মম আর ড্যাড কোনো ভাবেই যেন তোমার আমার সিক্রেট বিষয়টা আঁচ করতে না পারে। আমাদের সম্পর্ক টা কি হবে সেটা তো তুমি জানো?”
বুঝদার মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকাল ফারিহা। রিহান একটা ছবি বের করে দিল। এখানে ওর মা বাবার ছবি রয়েছে। তাদের সম্পর্কে কিছু কথা বুঝাল। ফারিহা প্রতিটা কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। রিহানের কথার বাইরে একটা কথা ও বলল না। বরং কথা গুলো কে ভালো মতো মাথায় সেট করে নিল।
“আমাদের সম্পর্ক টা সবার সামনে স্বাভাবিক থাকবে। দ্যাটস লাইক আ হ্যাপি কাপল। আর আমার মম ড্যাড চাইবে ফাংশন করতে বাট তুমি নাকোচ করবে। তুমি বলবে তুমি চাও আপাতত ছোট একটা আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ে টা সম্পূর্ন করতে। আর এক বছর পর বড়ো করে গেট টুগেদার করতে। গট ইট?”
“জি স্যার।”
“ও হ্যাঁ আমার মম ড্যাড জানবে তুমি এতিম খানায় বড় হয়েছ। আই মিন তোমার মম আর ড্যাড…..”
ফারিহা রিহানকে থামিয়ে দিল। সে এ কথা শুনতে পারবে না। কারণ তার বাবা না থাকলেও তো মা জীবিত আছেন। রিহান নিজে ও চুপ হয়ে গেল। মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, “নাউ ওকে। তাহলে চলো যাওয়া যাক?”
ফারিহা উঠে দাঁড়াল। রিহান কপাল কুঁচকে বলল,”কফিটা খেলে না কেন? এটা তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। ওয়েট আরেকটা অর্ডার করছি।”
“স্যার।”
“হুম?”
“এখন আর কিছু লাগবে না। আপনার অনুমতি থাকলে আমি এখন ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম।”
“ওকে চলো।”
“স্যার আমি একাই…।”
“নো মোর ওয়ার্ড। ফলো এন্ড কাম উইথ মি।”
ফারিহা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। কাঁধে ব্যাগ ঝুঁলিয়ে রিহানের পেছন পেছন চলতে লাগল। তাদের বাহ্যিক গন্তব্য একই হলেও ভেতরে গন্তব্য পুরোপুরি ভিন্ন।
গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে রিহান বলল, “হোয়াট ইজ দিস ফারিহা? তোমার বাসা তো এই দিকে তাহলে উল্টো দিকে কেন যেতে বলছ?”
“মা হসপিটালে আছেন।”
“হোয়াট! কি হয়েছে ওনার?”
“সব সময় যা হয়। মুখ দিয়ে র ক্ত বমি হচ্ছিল। তাই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যালাইন পুস করে দেওয়া হয়েছে।”
“ওহ মাই গড। আগে কেন বললে না? সিট!”
ফারিহা মাথা নিচু করে রাখল। রিহান গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। মুহূর্তেই হসপিটালের কাছে গাড়ি এসে থামাল। ফারিহা ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে চলে গেল। রিহান ভ্রু কুঁচকে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে পার্কিং এ পার্ক করে নিল। মোটামুটি মানের হসপিটাল এটা। রিহান আশে পাশে তাকিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল।
“খালা এখন মা ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ রে মা। ঠিক ই আছে। তবে খুব বেশি ভালো নেই। সব সময় যা হয়।”
“মা এখন কেমন লাগছে তোমার?”
মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাটা বলল ফারিহা। খালা সিট থেকে উঠে চোখের পানি আড়াল করলেন। মেয়েটার জন্য বড্ড কষ্ট হয় ওনার। এই টুকু নি মেয়ের জীবন টা কেমন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বাবাকে হারিয়েছে এখন মা ও সেই পথে।
“মা তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে বড়ো ডক্টর দেখাব আমি। একদম চিন্তা করবে না কেমন?”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মায়ের হাত টা ধরে চুমু খেল। মুখ টা রুগ্ন শুকনো। মনে হচ্ছে কত দিন পেটে কিছু পড়ে নি।
“মা তোমার ক্ষুধা লেগেছে?”
মা মাথা ঝাঁকালেন। ফারিহা চোখের কার্নিশ থেকে পানি মুছে উঠে দাঁড়াল। খালাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,”আমি খাবার নিয়ে আসি। আপনি একটু মায়ের পাশে বসুন।”
খালা মাথা ঝাঁকালেন। ফারিহা ঝড়ের গতি তে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
“উফ দিলে তো হাতের মধ্যে ব্যথা।”
ফারিহা জড়সড়ো হয়ে দাঁড়াল। কেবিন থেকে বের হয়ে মোর নিতেই রিহানের সাথে ধাক্কা লেগে গেল।
“চোখ কোথায় রাখো? হাত টা বোধহয় মচকে গেছে।”
“ভেরি সরি।”
“হয়েছে, ফরমালিটিস এর প্রয়োজন নেই।”
ফারিহা মাথা ঝাঁকাল। মাথায় হঠাৎ করেই এক প্রশ্ন আসল। স্যার এখানে কি করছেন?
“স্যার আপনি এখানে?”
“এসেছিলাম তোমার মম কে দেখতে।”
“ও। আচ্ছা স্যার আপনি তাহলে ভেতরে গিয়ে বসুন। আমি একটু আসছি।”
“না ঠিক আছে। আমি ও তোমার সাথে যাচ্ছি। অন্য একদিন তোমার মম কে দেখব।”
ফারিহা মাথা ঝাঁকাল। রিহান ফারিহা কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে আসল। প্রয়োজনীয় খাবার কিনে দিল। ফারিহা বারন করে নি। বারন কেন করবে কিংবা কোন মুখে করবে?
ছেলেটার থেকে টাকা তো নিতেই হচ্ছে। আর এই সামান্য খাবারে কি আসে যায়? হুট করেই ভীষণ খারাপ লাগছে ওর। প্রবল আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষটাও মাঝে মাঝে নিচু হয়ে যায়। ভাগ্য বড়ো বিচিত্র।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
পর্ব (৬)
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=308763428351225&id=100076527090739&mibextid=2JQ9oc