চন্দ্রাণী(১৪)

0
310

#চন্দ্রাণী(১৪)
আকাশের বুকে মেঘের আনাগোনা একটানা। শুভ্র বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলো বড় আপা আসছে।অনেকক্ষণ বাদে আপা বাড়ি আসলো।কে জানে কোথায় ছিলো!
চন্দ্র এসে আগে শর্মীর রুমে গেলো।শুভ্র ও গেলো সেখানে।
শর্মী চন্দ্রকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপা,আপারে নীলির এরকম হলো কেনো আপা?”

চন্দ্র শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। শর্মীর কেমন দমবন্ধ লাগছে।সকাল থেকে যদিও খুব একটা খারাপ লাগে নি সবার সাথে থাকায়।বাড়িতে এসে একা হতেই নীলির সাথে কলেজে আসা যাওয়ার কথা মনে পড়তেই শর্মীর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো।
কতো খুনসুটি করত দুজন একসাথে। এখন কে যাবে শর্মীর সাথে কলেজে?
এতোক্ষণ একা একা রুমে শর্মীর অসহ্য কষ্ট হচ্ছিলো। চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শুভ্র এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু ছোট আপাকে কাঁদতে দেখে নিজে এগিয়ে গিয়ে আপার হাত চেপে ধরলো। অবুঝ ছেলেটার চোখের কোণে জল।বোনকে কাঁদতে দেখে সে ও কাঁদছে।
চন্দ্র খানিক জিরিয়ে বললো, “তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেনো?”

শর্মী বললো, “আপা আমার খুব ভয় করছে।আমাদের গ্রামে এসব কি শুরু হয়েছে? আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এরপর আমিও মা//রা যাবো।”

চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আমার সোনা বোন।এরকম করে না।তুই ভুলে যাস কেনো তুই কার মেয়ে?তোর দিকে কেউ হাত বাড়াতে হলে ১০০ বার ভাবতে হবে তুই কার মেয়ে।”

শর্মী বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জানিস আপা,আমি ভেবেছিলাম এতো বড় লজ্জা বাবা মা জানার আগে আমি নিজেকে নিজে শেষ করে দিবো।আজ যখন আব্বা নীলির লা//শ দেখে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিলো তখন আমার বারবার মনে হচ্ছিলো যদি আমি ও এরকম করে ফেলতাম আব্বা কিভাবে আমার লাশ দেখতো?আব্বা কি নিজেকে সামলাতে পারতো? ”

চন্দ্র বললো,”এভাবে ভেঙে পড়িস না বোন।আমরা সবাই আছি।নীলির সাথে এরকম করেছে যে তাকে পুলিশ খুঁজে বের করবে।আজ না হয় কাল আসামি ধরা পড়বেই।”

শর্মী নিজেকে সামলে নিলো।

রেহানা মেয়েদের রুমে এসে দেখেন দুই মেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে।নীলির ব্যাপারটা নিয়ে যে ওরা আপসেট বুঝতে পেরে বললেন,”ভাই বোন তিনজনই এইখানে বসে রইছস।কয়টা বাজে?তোর বাপে এখনো ভাত খাইছে?তোরা খাইছস?”

চন্দ্র উঠে বললো, “চলো মা,আব্বা কই?”

রেহানা মুখ বাঁকিয়ে বললো, “কই আর থাকবে,তার কি কোনো পাত্তা আছে?গিয়ে দেখ কাচারি ঘরে কি করে। ”

শুভ্র গেলো বাবাকে ডাকতে।চন্দ্র আর শর্মী দুজনকেই রেহানা বললো টেবিল সাজাতে।
কাজে থাকলে মন খারাপ কমবে কিছুটা।

একটা কালো টি-শার্ট পরে টগর বের হলো। নিয়াজ কল দিয়েছে টগরকে।নিয়াজ বলেছিলো তালতলায় থাকবে সে।কিছু মাল ডেলিভারি দিতে হবে রাতে।

টগর শিস দিতে দিতে গেলো।মনে মনে হিসেব কষতে লাগলো আজকের ডেলিভারিতে কতো ইনকাম হবে।
কাজটা অবশ্য টগর বেশ উপভোগ করে। এখন পর্যন্ত একবার ও সে ধরা খায় নি।এরকম চ্যালেঞ্জ নিতে তার আনন্দই হয়।

তালতলায় গিয়ে দেখে নিয়াজ আগেই দাঁড়িয়ে আছে। টগরকে দেখে এগিয়ে এলো।তারপর বললো, “এলাকা গরম এখন।সাবধানে মাল নিয়ে যাবি।”

টগর একটু ভালো করে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার কি মন খারাপ? ”

নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “বুঝতেছি না কিছুই কি হইতেছে।ইদানীং নকল মাল আসে একেক চালানে বুঝলি।কাস্টমার কমপ্লেইন করে। ওই দিকে আমার কাছে যিনি সাপ্লাই করে সে বলে সে ঠিক মাল পাঠায়।তাইলে সমস্যা হইতেছে কোন জায়গায় বুঝতেছি না।”

টগর এক সেকেন্ড ভেবে বললো, “আপনি আপনার পুরো সিস্টেম আবার ভালো কইরা চেক দেন ভাই।দলের মধ্যে দুই নাম্বারি করার মতো মানুষের তো অভাব নাই বুঝেন নাই?কেউ হয়তো গাছের ও খায়,তলার ও কুড়ায়।”

নিয়াজ চমকে উঠলো টগরের কথা শুনে। আসলেই তো!
এই বুদ্ধি তো তার মাথায় আগে আসে নি।
হইতে ও তো পারে তার লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে।

নিয়াজ চলে যেতে যেতে বললো, “রহিম শেখের ক্ষেতের বড় লাউ যেটাতে দেখবি নখ দিয়ে ত্রিভুজ আঁকা আছে।”

টগরকে একটা খাম দিয়ে নিয়াজ চলে গেলো। টগর আগের মতো খুশি মনে শিস দিতে দিতে লাউ কিনতে গেলো।
রহিম শেখের বাড়ি চেয়ারম্যান বাড়ির সাথে। চেয়ারম্যান বাড়ির কথা ভাবতেই টগরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। চন্দ্র মেয়েটা বেশ করিতকর্মা। দেখতেও বেশ!

ভাবতে ভাবতে নিজে নিজে আবার মুচকি হাসলো টগর। মেয়েটার কথা এতো বার কেনো ভাবছে সে?
দূর!

রহিম শেখের ক্ষেতের কাছে এসে দেখে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে রহিম চাচার বউ লিপি চাচীর পাশে।লিপি চাচী চন্দ্রকে বললো, “কত্তো দিন পরে তোমারে দেখছি আম্মা।ভালো আছো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “জি চাচী ভালো আছি।”

লিপি চাচী চন্দ্রর হাতে লাউ দিয়ে বললো, “না গো আম্মা,টাকা দেওন লাগতো না।এইটা তোমারে ভালোবাইসা দিলাম।”

চন্দ্র বললো, “না না চাচী,এই কথা বলবেন না।মা রাগ হবে যদি শুনে লাউয়ের দাম নেন নাই।”

লিপি চাচী হেসে বললো, “তুমি ভাবীসাবরে কইও এইটা চাচীর তরফ থাইকা উপহারের। তোমার মা’য় কতো দিন কতো কিছু দিছে,আমাগো কি সেই ক্ষেমতা আছে তোমাগো লাইগা কিছু করার।আইজ যখন সুযোগ আইছে আমার কথাখান রাখো আম্মা।”

চন্দ্র আর কিছু বললো না। ক্ষেতের সবচেয়ে বড় লাউটা তিনি চন্দ্রর হাতে দিলেন।

টগর চমকে উঠলো যখন দেখলো লাউয়ের উপর ত্রিভুজ চিহ্ন আঁকা।নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে টগরের।
চন্দ্রর সামনে না গিয়ে দ্রুত সরে গেলো সেই জায়গা থেকে তালতলায়। চন্দ্রকে এই পথ ধরেই যেতে হবে।ক্ষেতের আইল দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কাঁদার জন্য।

চন্দ্র কিছুদূর যেতেই দেখে টগর একটা গাছতলায় বসে আছে। মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে বললো, “আপনি? ”

টগর বিস্ময়ের ভান করে বললো, “আরে আপনি? কোথা থেকে?লাউ নিতে এসেছেন বুঝি?”

চন্দ্র হেসে বললো, “হ্যাঁ, মা পাঠালো একটা লাউ নিতে। ”

টগর হেসে বললো, “আপনাকে দেখে কিন্তু বুঝা যায় না আপনি যে গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে।দেখলে মনে হয় অন্যরকম। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “কেমন? ”

টগর বললো, “না কিছু না।”

চন্দ্র বুঝতে পারলো টগর কিছু লুকাতে চাইছে।তাকে এই লোকটার সাথে ভাব জমাতে হবে।তাই আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে বললো,”আমাকে কি খুব খারাপ মেয়ে মনে হয়? ”

টগরের আর ধৈর্য কুলাচ্ছে না এসব ঢং করে কথা বলতে। অথচ এখন উপায় নেই।এই মেয়ের সাথে ধৈর্য ধরে কথা বলতেই হবে।হাতের লাউটা আদায় করতে হবে।

টগর মনে মনে ভাবলো আমার এতো খারাপ দিন কবে এলো যে একটা লাউয়ের জন্য একটা মেয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হচ্ছে!

মুচকি হেসে বললো, “সত্যি বলতে আপনাকে দেখতে মনে হয় ভীষণ অহংকারী, মানে চেয়ারম্যানের মেয়ে একটা অন্যরকম ভাবসাব। অথচ আপনার সাথে মিশলে বুঝা যায় আপনি কতটা অমায়িক। ”

চন্দ্র মনে মনে বললো, “আমি অমায়িক না কি তা বুঝবে যেদিন কালসাপ হয়ে ছোবল দিবো।”

মুখে বললো, “একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে এবার। এতটা ও না যতটা বলছেন।”

দুজন হাঁটতে লাগলো। চন্দ্র টগরের সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত আর টগর ব্যস্ত চন্দ্রকে অন্যমনস্ক করতে। কথায় কথায় টগর চন্দ্রকে নিজের বাড়ির দিকে নিয়ে গেলো।কিছুটা গিয়ে চন্দ্রর মনে হলো ভুল রাস্তায় চলে এসেছে।
টগরকে সেই কথা বলতে টগর বললো, “এতটা পথ যখন চলে এসেছেন তখন না হয় আরেকটু চলুন।আপনি আজ আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন,আমি না হয় আপনাকে একটু কফি করে খাওয়াবো।”

চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “না না,তা লাগবে না। অন্য কোনো দিন হবে।”

টগর নাছোড়বান্দা। মুখে কৃত্রিম অভিমান ফুটিয়ে তুলে বললো, “বুঝেছি, আপনার আমাকে ঠিক ভালো লাগছে না।অসুবিধা নেই।”

চন্দ্র লজ্জিত হয়ে বললো, “আরে না না,তা হবে কেনো?আচ্ছা চলুন।”

টগর মুচকি হাসলো। কাউকে কনভিন্স করার গুণ তো তার সেই স্কুল লাইফ থেকে আর একটা মেয়েকে সে কনভিন্স করতে পারবে না?

চন্দ্র মনে মনে ভাবলো,”ছেলেটা কি আমাকে একটু একটু পছন্দ করতে শুরু করেছে? আমার সম্পর্কে ওর ধারণা কিছুটা বদলাচ্ছে। ”

চন্দ্রর হাতের লাউটা টগর হাতে নিয়ে বললো, “কতোক্ষণ ধরে বয়ে বেড়াবেন এই বোঝা?আমার কাছে দিন এবার।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। টগরের জানে পানি এলো।আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো লাউয়ের গায়ে খুব সুক্ষ্মভাবে কাঁ//টা চিহ্নটা দেখা যাচ্ছে।

নির্ঝর কুসুমপুরের ২০-২৫ বছর আগের ফাইল নিয়ে বসেছে।এই গ্রামের সব হিস্ট্রি তার জানতে হবে।সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে সাধারণত ক্রাইম বেশি হয়ে থাকে।এখানেও সেইম।
দেখতে দেখতে একটা তথ্য জানতে পারলো নির্ঝর। আর জেনে বেশ অবাক হলো।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ @রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here