চন্দ্রাণী (৩৪)

0
331

#চন্দ্রাণী (৩৪)

আকাশ ভীষণ ঝকঝকে পরিষ্কার। টগর নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “মা,তোমার সারাজীবনের আক্ষেপ ছিলো বাবা এভাবে আমাদের সবাইকে রেখে চলে যাওয়া নিয়ে। দুজনেই ওই আকাশে খুব সুখে আছো নিশ্চয় এখন?
অথচ আমাকে দেখো!কি ছন্নছাড়া জীবন আমার।
আমার বাবার খু//নী কে আমি ধরতে পেরেছি মা। আইনের হাতবাঁধা মা,তা না হলে ওকে আমি এখানেই জ//বা///ই করে রেখে দিতাম।ওর বুকে পাঁচ সেকেন্ড ১০ রাউন্ড গু////লি করতাম।যার জন্য আমার রঙিন শৈশব বিবর্ণ হয়ে গেলো, জীবনের সব রঙ হারিয়ে গেলো তাকে আমি নিজ হাতে জেলখানায় পুরে রাখা ছাড়া কিছু করতে পারছি না।”

থানার বাহিরে একটা দোকানের সামনে বসে টগর আকাশ পাতাল ভাবছে।আগামী পরশু বাবুল দাশকে জেলখানায় নেওয়া হবে থানা থেকে।
টগরের ভাবনার মাঝে চন্দ্রর কল এলো।টগর কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার এখন।

চন্দ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজের রুমে। টগর কলটা কেটে দিলো!
চন্দ্রর বিশ্বাস হচ্ছে না। সকালেও তো কেমন অধিকার দেখিয়ে কথা বললো মা’য়ের সাথে। চন্দ্রর কেমন অন্য রকম লাগছিলো।

চন্দ্র বুঝতে পারছে না তার আসলে এখন কেমন রিয়্যাক্ট করা উচিত।এতো কিছু ঘটে গেছে চন্দ্রকে ঘিরে!

বাবুল কাকু!
ভাবতেই চন্দ্রর বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। আশ্চর্য, নিজের আসল বাবা মায়ের কথা যখন প্রথম শুনেছিলো তখনও তো চন্দ্রর বুকে এরকম হাহাকার জন্মায় নি তাদের জন্য। একটা বারের জন্য ইচ্ছে করে নি তাদের দেখার।অথচ যেই মানুষটা তার কেউ না,রক্তের সম্পর্ক না তার জন্য কেনো এরকম লাগছে?
এতটা ভালোবাসার তো কোনো দরকার ছিলো না। কেনো এরকম মায়ায় জড়িয়ে গেলো একটা মানুষ!

চন্দ্রর ইচ্ছে করছে একবার গিয়ে বাবুল কাকুকে দেখে আসতে।
ভালোবাসা অন্ধ,ভালোবাসা বধির,ভালোবাসা মূক।

চন্দ্র হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কিভাবে সে টগরের মুখোমুখি হবে?
যেখানে তার জন্যই টগরের বাবাকে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। চন্দ্রর মাথায় কিছু ঢুকছে না।নিজেকে নিজে কিছুতেই সামলাতে পারছে না।

রেহানা মেয়ের দরজার এপাশে হেলান দিয়ে বসে আছে। দুই চোখ দিয়ে শুধু জল গড়িয়ে পড়ছে।চন্দ্র,তার চন্দ্র।
সেই প্রথম যেদিন কাঁথায় মুড়িয়ে তালুকদার ছোট্ট পুতুলটাকে রেহানার হাতে তুলে দিয়েছিলো রেহানার মনে হয়েছিলো সারা ঘর বুঝি আলোয় ঝলমল করছে।
বুকের বাঁ পাশে যেখানটায় সারাদিন একটা শূন্য শূন্য অনুভূতি জন্মায় সেখানে কেমন পরিপূর্ণতার অনুভূতি হচ্ছে। রেহানার মনে হয়েছিলো দুনিয়ায় আর কি তার পাওয়ার বাকি নেই।
ছোট্ট পুতুলটার মুখে কি যে মায়া ছিলো। খিলখিল করে হাসছিলো রেহানার দিকে তাকিয়ে।

রেহানা মেয়ের নাকে চুমু খেয়ে বললো, “মা,এতো দেরি করলি কেনো মায়ের কাছে আসতে?আরো আগে কেনো এলি না মায়ের বুকে?তোকে পাওয়ার জন্য মা যে ১২ বছর সাধনা করে গেছি।মা’কে কষ্ট দিতে ভালো লাগে বুঝি?এই যে একবার এলি মা কিন্তু বাকী জীবন তোকে আর হারাতে দিবে না।মা বেঁচে থাকতে মা’কে ছেড়ে আর যেতে পারবি না।”

একটু একটু করে যেই পুতুলটাকে ভালোবাসা দিয়ে রেহানা বড় করে তুলেছে। ভীষণ সন্তর্পণে সব সত্যি লুকিয়ে গেছে যার থেকে।সে কিনা আজ জেনে গেলো সে রেহানার মেয়ে নয়।
কি করছে চন্দ্র রুমের ভেতর? ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে নিশ্চয়। মায়ের কাছে চলে যাবে বলে!
জন্ম না দিলে কি তাহলে মা হওয়া যায় না?
এতো বছর ধরে লালন পালন করেও কি তাহলে রেহানা চন্দ্রর মা হতে পারলো না?

যদি তাই হয় তবে এই পৃথিবীর উপর রেহানার এক আকাশ সমান অভিমান জন্মাবে।শাড়ির আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে রাখা দুই পাতা ঘুমের ঔষধ শক্ত করে চেপে ধরলো রেহানা।কিছুতেই তিনি বেঁচে থাকতে মেয়েকে চলে যেতে দিবে না।
মেয়েকে বাঁধা ও দিবে না রেহানা।মেয়ে যদি এই বাড়ি ছেড়ে যায় তবে তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে যাবেন।

শর্মী অনেকক্ষণ ধরে মা’কে দেখছে। শর্মীর কেমন অনুভূতি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। একসাথে এতো সত্যি জানার পর শর্মী প্রতিক্রিয়া জানাতেই ভুলে গেছে।
সব কিছু বাদ দিয়ে মা’য়ের এভাবে ভেঙে পড়াটা শর্মীকে ভাবাচ্ছে।
শর্মীর একটুও হিংসে হচ্ছে না,বরং মনে হচ্ছে আপাকে আরো বেশি ভালোবাসা দেওয়া উচিত যাতে আপা কখনো তাদের ছেড়ে না যায়।
শর্মী ভাবতে পারছে না আপা চলে গেলে কি হবে।
মা’কে কে সামলাবে?
বাবাকে কি বুঝাবে?
আপা একটা মানুষ সবকিছু কতো সুন্দর করে সামলে নিতে জানে।

হুট করে শর্মীর মনে হলো,”আচ্ছা, আপা সবাইকে তো এতো সুন্দর করে সামলে নেয় সবসময়। কিন্তু আপাকে কে সামলায়?আপার কেমন লাগছে?”

শর্মীর কান্না আসছে, কিন্তু কান্না করতে পারছে না সে।

শর্মীর ছোট চাচী নিপা এলেন। রেহানাকে আলুথালু বেশে বসে থাকতে দেখে বললো, “কিগো ভাবী!ঘটনা কি শুনতেছি!এতো কিছু ঘটে গেছে কোনো দিন ও তো আমাদের বুঝতে দেন নি।”

রেহানা ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিপা আবারও বললো, “চন্দ্র কি আছে?না-কি নিজের মা’র কাছে চলে গেছে ভাবী!
আহারে! অযথা এতো আদর যত্ন দিয়ে পালছেন,থাকবো না গো ভাবী।
পালা পাখির জ্বালা বেশি। ”

শর্মী উঠে এসে বললো, “চাচী,ভালো কিছু বলার থাকলে বলেন। এসব খোঁচা দেওয়ার কথা বলার জন্য অন্য জায়গায় যান।আমাদের ঘরে এসব কথা বইলেন না।”

নিপা ভেংচি দিয়ে বললো, “মা’গো,এখনো কতো পিরীতি!
কার লাইগা পিরীতি দেখাস রে শর্মী?তোর তো বোইন না ও।
যতই আদর দেখাস দিনশেষে লাথি মারবো তোগো বুকে।পর পরই হয়,আপন হয়না কোনো দিন।
বুকের চামড়া কোনো দিন পিঠে আসে না,পিঠের চামড়া কোনো দিন বুকে না।”

শর্মী রাগান্বিত হয়ে বললো, “বুকের চামড়া পিঠে আসুক বা না আসুক চাচী,আপনি আর আমাদের ঘরে আসবেন না আজকের পর থেকে।আমার আপা যদি আমাদের বুকে লাথিও মারে তাও সে আমার আপা।আমার বড় বোন।আর একটা বার এরকম কোনো কথা বললে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না চাচী।”

নিপা এভাবে অপমানিত হবে ভাবতে পারে নি।ভেবেছিলো আগুনে একটু ঘি ঢালবে কিন্তু এখানে যে তাকেই ভস্ম করে দেওয়া হবে তা তার মাথায় আসে নি।মুখ কালো করে নিপা চলে গেলো।

রুমের ভেতর থেকে চন্দ্র সবকিছু শুনতে পেলো। আশ্চর্য হলো এই ভেবে যে মানুষের চিন্তাভাবনা এতো নিচু কেনো?
যারা তাকে এতো বছর ধরে বড় করেছে তাদের কি-না সে ছেড়ে চলে যাবে?
চন্দ্রর তো একবার ও এই কথা মনে আসে নি যে এরা তার কেউ না।

চন্দ্র দরজা খুলতেই দেখে মা দরজার সামনে কেমন উদভ্রান্তের মতো বসে আছে। মা’কে কখনো চন্দ্র এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে নি।
সহ্য হলো না চন্দ্রর মায়ের এই রূপ।হাটু গেঁড়ে মায়ের পাশে বসলো। মায়ের চিবুক ছুঁয়ে বললো, “মাগো,আমার মা তুমি। আমার মৃত্যু পর্যন্ত আমি এক বাক্যে বলে যাবো আমার মা তুমি।
এই পৃথিবীর সব মানুষ এই কথার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেও আমি জানবো আমার মা তুমি।
তোমাকে মা বলে মানলে যদি আমার উপর মৃত্যুদন্ড জারি করা হয় তবুও আমি বলবো আমার মা তুমি।
যদি বলা হয় তোমাকে মা বলে মানার কারণে আমার উপর নেমে আসবে কোনো মহাপ্রলয়,তবে সেই মহাপ্রলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ও আমি চিৎকার করে বলবো তুমি আমার মা।তুমি, তুমি, তুমি,রেহানা তালুকদার আমার মা।
তুমি কোনো দিন ভেবো না তোমার মেয়ে তোমাকে ছেড়ে যাবে।
যদি কখনো তোমার মেয়ে তোমাকে ছেড়ে যায় তবে সেটা যাবে তোমার চন্দ্রর নিথর দেহখানা মা।বেঁচে থাকতে এই চন্দ্র জানে শুধু তুমি আমার মা।আমি তোমার এই কোল ছেড়ে কোথাও যাবো না মা।”

রেহানা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলো।তার খাঁখাঁ করতে থাকা বুকখানায় প্রাণ ফিরে এলো।
এতো ক্ষণ মনে হচ্ছিলো প্রচন্ড জলতেষ্টায় প্রাণটা ছটফট করছিলো,চন্দ্রর মুখের কথা সেখানে অমৃত বর্ষণ করলো যেনো।

মেয়ের দুই গালে রেহানা চুমু খেতে লাগলো। শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি তোর মা, শুধু আমি তোর মা।জন্ম না দিলে বুঝি মা হওয়া যাবে না?তুই আমার সন্তান, তুই আমার মেয়ে,তুই আমার সবকিছু মা।তুই প্রথম দিন কোলে এসে আমার জীবন গুছিয়ে দিয়েছিস আবার তোকে হারিয়ে ফেললেই আমি এলোমেলো হয়ে যাবো।”

চন্দ্র রেহানাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

কানিজ একটা ভাড়া বাসার দ্বিতীয় তলায় বসে বসে একটা খাম খুলছে।খাম খুলতেই কতগুলো ছবি বের হয়ে এলো।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে কানিজ তাকিয়ে রইলো ছবির দিকে। পরম মমতায় ছবির মেয়েটার মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আমি তোর নাম রেখেছিলাম সোনালি। তোর বাবা মা রেখেছে চন্দ্র।মা’রে ওরা তোর নাম যথার্থই রেখেছে। এরকম চাঁদমুখ যার তার নাম চন্দ্র না হলে তার সাথে বুঝি চরম অন্যায় হতো।
তোকে একবার দেখার জন্য সেদিন সব জেদ ভুলে গিয়ে নিয়াজের মৃত্যুর দিন সেই বাড়ি গিয়েছিলাম।
তুই কি কখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারবি মা?আমার কোনো সাহস, মনোবল নেই তোর মুখোমুখি হবার।আমাদের কখনো দেখা না হোক মা,তুই ভালো আছিস,বেঁচে আছিস এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। ”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here