#লাজুকপাতা
#পর্ব-১১
বাড়িতে কেউই পাশা মিয়ার সঙ্গে মনির সম্পর্ক মানতে রাজি নয়। বাবা নরম গলায় মেয়েকে যথেষ্ট বুঝালেন। কিন্তু তার বে*য়াদব মেয়ে কিছুতেই কিছু বুঝতে রাজি না। উল্টো বাবা, মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। মামাশ্বশুর আবারও আসলেন। এবার সঙ্গে মামীও। উল্লেখ্য, মামী আম্মাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। ওনার বাড়িতে আম্মা তেমন যান না। তবে নাবিদ কে উনি স্নেহ করেন। বিয়ের পর আমি আর নাবিদ যখন ওনাদের বাসায় গিয়েছিলাম তখন আম্মার সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হবার কথা বলেছিলেন। আম্মা ওনার কাছ থেকে কিছু গয়না এনেছিলেন। ফেরত দেবার সময় তার মায়ের দেয়া চেন টা দেয় নি। আম্মা নাকি অস্বীকার করেছেন চেনের ব্যাপার টা। সেই থেকে সম্পর্ক খারাপ।
মামীর মুখ টা উজ্জ্বল। ঘরে ঢুকতেই তার চাপা আনন্দ চোখে পড়লো। মনির আসন্ন সর্বনাশে সে বেজায় খুশি। আমাকে বলল,
“তোমার ননদের চয়েজ দেখছ জরী? মাছ বেঁচা বিয়াইত্তা ব্যটা ধরছে, হিহিহিহি! ”
আমি জোর করে একটু হাসতে চেষ্টা করলাম। তিনি চাপা গলায় বললেন,
“এক হোটেলে নাকি থাকছেও.. মানে বিয়ার আগের বাসর সাইরা আসছে। আল্লাহ গো!”
আমি চুপ করে রইলাম। এরা কেমন ধরনের আত্মীয় স্বজন! খারাপ সময়ে যে আত্মীয় রা খুশিতে টগবগ করে ফোঁটে তারা কী করে কাছের মানুষ হয়!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের জন্য ভালো মন্দ রাঁধতে হলো। আম্মার অবস্থা ভালো নয়, কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেবার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। চারদিক থেকে সবাই তাকেই দুষছে। নাবিদ আর মামা মিলে ঠিক করেছে মনিকে আটকে রাখবে। মামা অবশ্য প্রথমে প্রস্তাব দিয়েছিল তার বাসায় রাখবে। মামী সঙ্গে সঙ্গে অমত জানালো। মুখের উপর বলে দিলো এমন কলঙ্কিনী মেয়ে তিনি তার ঘরে রাখবে না।
মনিকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। মুক্তা দিনের বেলা আমার সঙ্গে থাকে। বেচারি এই ঘটনায় ঘাবড়ে গেছে ভীষণ। আমাকে বলল,
“ভাবী মনি আমাকেও ফাঁসাবে। আম্মা এরপর যারে পাবে তার কাছে আমার বিয়ে দিবে। ”
আমি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। পারিবারিক এতো জটিলতা কম বেশী আগেও দেখেছি। তবে আমার মনির জন্য মায়া হয়। পরী আপা বলে, মনির চোখে রঙিন চশমা লাগানো জরী। যা ওর এখন সোনা মনে হচ্ছে, পরে তা কাঠকয়লা মনে হবে। ও’কে আটকে রেখে ভালো করছে। আমার মেয়েটার জন্য মায়া হয়। আমি একদিন কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমাকে বলে,
“ভাবী আমাকে বাইর করনের ব্যবস্থা করেন। আপনার দুলাভাই আপনারে সোনার আংটি বানায়ে দিবে। ”
পাশা মিয়া ভদ্রলোক যে দুলাভাই বানিয়েছে সেটা বুঝতে আমার অবশ্য একটু সময় লাগলো।
আম্মা আমাকে বারন করে দিলেন ওর ঘরে যাবার জন্য। তিনি নিজে খাবার দিয়ে আসেন। যতবার খাবার দিতে যান ততবারই ঠাস ঠাস থাপ্পড়ের শব্দ পাওয়া যায়।
এতসব ঘটনায় জামিল ভাই ভীষণ খুশি। তিনি একেকবার একেকটা ঘটনা শোনেন আর হো হো করে হাসেন। একদিন আম্মাকে বললেন,
“আম্মা তোমার মাইয়া মাছ কুটতে পারে তো!”
আমি চুপ করে থাকেন। জামিল ভাই আবারও বলে,
“আম্মা তোমার আকাশী বাতাসী জামাই কী মাছ বেঁচে? ”
আম্মা রাগী গলায় বলেন,
“আমরা তোর কেউ না? মনি তোর কিছু হয় না? এতো ফূর্তি তোর! ”
জামিল ভাই আবারও হো হো করে হাসে। আর বলে,
“টাপুর, টুপুর আর ওদের মায়ের অভিশাপ। এই তো শুরু…
আম্মা ক্ষেপে যান। চিৎকার করে বলেন,
“কী করছি আমি? কিসের অভিশাপ? তুই কী ভালো মানুষ? সব খারাপ আমি করছি? তুই কিছু করস নাই? তোর বউ এই বাড়িতে থাকেনাই তোর জন্য। কোনো কাজ করতিস তুই! দুইটা বাচ্চা পয়দা কইরা তুই খালি ঘুমাইতি আর খাইতি। কোনো দায়িত্ব নিছস সংসারের! ”
জামিল ভাই আরও রাগারাগি করেন। নতুন কেনা ফিল্টার টা ফেলে দেন।
সন্ধ্যেবেলা নাবিদ এসে সব শুনে জামিল ভাইকে বলে,
“এখনো সময় আছে ভাইয়া। মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে। তোমার থেকে ভালো কিছু শিখতেছে না। ওরা অলরেডি অনেক কিছু দেখছে। আর কিছু দেখাইয়ো না। এখন ছোট তাই একটা চকলেট দিয়া বুঝ দিতে পারো। বড় হইলে তুমি তা আর পারবা না। ”
নাবিদের সঙ্গে জামিল ভাইয়ের সম্পর্ক মাখামাখি ধরনের না হলেও নাবিদের কথা শোনে। জামিল ভাই চুপ থাকেন।
নাবিদ সংসারের ঝামেলা নিয়ে অনেক চিন্তিত ইদানীং। আমাকে একদিন বলল,
“তোমার অনেক খারাপ লাগে তাই না জরী। ”
“কই না তো।”
“আমি জানি তোমার খুব খারাপ লাগে। এতো জটিলতা কারোরই ভালো লাগার কথা না। তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই সংসার আলাদা করতে বলতো। এখানেই তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। ”
আমি অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস লুকাই। সংসারের ঝামেলা, জটিলতা মায়ের কানে পৌছানোর পর সে প্রায় ই বলে আলাদা হয়ে যাবার জন্য নাবিদ কে বলতে।
আমারও একটা নিজের সংসারের বড্ড লোভ। নিজের ছোট একটা বাসা। বারান্দাভর্তি গাছ, ছোট ছিমছাম রান্নাঘর। সকালে একসঙ্গে খেয়ে আমরা বেরিয়ে যাব। দুপুরে ফিরেই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত থাকব। বিকেলের মধ্যে সব কাজ শেষ করে নাবিদের অপেক্ষায় থাকব।
এমন অন্যায় চাওয়া বোধহয় চাইতে নেই। তবুও কল্পনায় সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখি।
***
এইসব কঠিন দিনে বাড়িতে আরেক নাটক এসে উপস্থিত হলো। সেই নাটকের নাম শিল্পী আক্তার লাভলী। এক দুপুরে ঘরে দুজন বোরখা পরা মহিলা আর একটা বাচ্চা মেয়ে এলো। বাবাও বাড়িতে নেই। দোকানে কী একটা ঝামেলা চলছে সেই কারণে সেখানে গেছেন।
বাড়িতে শুধু আমরা মেয়েরা। ঘরে ঢুকেই আচমকা চিৎকার শুরু করলো।
“বইন.. বইনগো.. কই তুমিইইই…”
আম্মা দুপুরের খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। টাপুর টুপুর কেও অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি। চিৎকার শুনে আমরা দৌড়ে এলাম। দরজা খুলেছিল মুক্তা। ও দেখছি ভীত চোখে দেখছে। আম্মা বললেন,
“এই তোমরা কে?” এইভাবে ঘরে ঢুকলা ক্যান? ”
শিল্পী আক্তার লাভলীকে আম্মার পা ধরে মরা কান্না কাঁদতে লাগলো।
“খালাম্মা, আপনি এমন পাষাণ! আমার বইনডারে আটকায়ে রাখছেন! ওরে খালাম্মা আমার কইলজাডা ফাইট্টা যায়। গলা দিয়া কিছু নামে না।”
নিচতলার ভাবী আর নাজমা ভাবীও ছুটে এলেন নাটক দেখতে। অন্য যে ভদ্রমহিলা ছিলেন সে নাকি পাশা মিয়ার চাচী। সে গিয়ে মুক্তার ঘরের দরজা খুলে মনিকে বের করে আনলো। পাশা মিয়ার বউ এবার মনিকে জড়িয়ে ধরে তার মরা কান্না শুরু করছে।
“ও বইন গো, নিশির বাপ বিছান নিছে গো.. খালি কান্দে আর কয়, ওরা আমার কইলজাটা কাইট্টা নিয়া গেছে রে নিশির মা। আমি আর বাঁচুম না। আমি মরলে তোমার আর নিশির কি হইবো!”
আমি সবাই কে ফোন করলাম। এই নাটক খানিকটা চলল। আম্মার ধমকে কোনো কাজ হলো না। শিল্পী আক্তার লাভলী তার নাটক চালিয়ে গেল।
এই নাটকের মাঝখানে পাশা মিয়ার বউ বললেন,
“মেলা দূর থিকা আসছি। ভাত, তরকারি যা আছে দাও।”
আমি কঠিন গলায় বললাম,
“আপনার জন্য রান্না করে রাখছি সেটা কে বলল?”
ভদ্রলোক বুঝতে না পেরে নাজমা ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী কয়? ”
নাজমা ভাবী বললেন,
“ও কিছু বলে না, পুলিশ যা বলার বলবে। আমরা পুলিশ খবর দিছি।”
চলবে…
(বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা এবার ইবুকেও পাবেন। লিংক কমেন্টে।)