#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২
ওয়ালিমা শেষে বাড়ি ফাঁকা হলে বাবা ও মাকে ম্যানেজ করার জন্য তাদের ঘরে প্রবেশ করল নাদিফ। একটা মিথ্যে গল্পের শুরু, যার কোনো শক্ত খুঁটি নেই, অথচ আষ্টেপৃষ্ঠে তা জড়িয়ে আছে নিজের সাথে। অস্বস্তি, অপরাধবোধ ও অদৃশ্য কাঁটা ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে তাকে। এর থেকে মুক্তি পেতে ছটফট করছে সে। তা-ই যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের পথ ধরতে এইমুহূর্তে বাবা-মাকে বুঝানোটা জরুরী। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে?
ছেলেকে দেখে ওবায়দুর রহমান প্রসন্ন হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি বলেছিলাম না, এই মেয়েকে সবাই খুব পছন্দ করবে? একটা মানুষও বউমার খুঁত ধরতে পারেনি। যেমন শিক্ষা-দীক্ষা, তেমন আচরণ। তোর ফুপা-ফুপু, খালা-খালু এমনকি তোর চাচারাও বলেছেন, বউমা এই ঘরকে আলো করতে এসেছে।”
এটা একদম সত্যি যে আজ আত্মীয়স্বজনের একজনও নতুন বউকে নিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করার সুযোগ পাননি। তূর্ণা নিজেকে খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পেরেছে। অথচ তারা দু’জনে জানে, ভেতরে ভেতরে কী চলছে!
সুন্দর একটা অনুষ্ঠান মাটি যেন নাহয়, বাবা ও মায়ের এত কষ্টে যেন মরিচা না ধরে, সেজন্য কী পরিমাণ ধৈর্যের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে, এটা সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। অস্থির মনে শুধু অপেক্ষা করছিল, কখন এত ছোটাছুটি, হৈ-হুল্লোড় শেষ হবে আর কখন সে বাবার মুখোমুখি দাঁড়াবে।
নাদিফ ঠোঁটে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বাবার পাশে বসে বলল, “একটা কথা বলতাম তোমাকে।”
ওবায়দুর রহমান স্ত্রীর হাত থেকে পান মুখে পুরে, আয়েশ করে সেটা চিবোতে চিবোতে অনুমতি দিলেন, “বলে ফেল।”
নাদিফ মূলত পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পদে জব করছে। এজন্য নিতান্তই প্রয়োজন না হলে ছুটি সে নিতে পারে না। যার কারণে গ্রামে আসা হয় কম। এবার এই বিয়ের কারণে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছিল, কিন্তু সে-ই ছুটিটাও এখন আর কোনো কাজের না। আর এভাবে সবাইকে দেখাতে একঘরে, একসাথে থাকাটাও অশোভনীয়। গতকাল রাতটা যে কীভাবে কেটেছে! সে খানিকটা জড়োসড়ো কণ্ঠে বলল, “তোমরা তো জানোই আমার কাজের কত প্রেশার। এমনিতে ফ্লাটে সবকিছু আছে কিন্তু নতুনভাবে গুছাতে হবে আরকি। আমি চাইছিলাম, আগামীকালই যদি ঢাকায় চলে যাই…।”
“একা যাবি?”
প্রশ্ন করলেন নাদিফের মা মনোয়ারা বেগম। নাদিফ অসহায় ভঙ্গিতে গাল চুলকে হাসার চেষ্টা করল। ওবায়দুর রহমান বললেন, “নতুন বউ রেখে যাবে না কি! কিন্তু, তুই তো বলেছিলি, এক সপ্তাহের ছুটি…।”
“ছুটি তো আছেই… ওইযে ঘরদোর গুছানোর ব্যাপারটা!”
“আবার কবে আসবি?”
“ছুটি পেলেই আসব।”
“তুই তো বছরের আগে ছুটি নিতে চাস না। দুই ঈদে তোকে জোর করে গ্রামে ফেরাতে হয়। ও বেচারি যদি ওই জ্যামের শহরে বিরক্ত হয়ে যায়…!”
নাদিফ তড়িঘড়ি বলে উঠল, “একদমই বিরক্ত হবে না। আমি তোমাদের বউমাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব।”
বাড়ির বউ চাকরি করবে? তা-ও নতুন বউ? বউকে দিয়ে যদি চাকরি করাতেই হয়, তাহলে ঘর-সংসার সামলানোর জন্য কে থাকবে? মনোয়ারা বেগম অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন, “বউমা চাকরি করবে?”
“বসে থেকে কী করবে? কাজেকর্মে মনোযোগ থাকলে সময় কেটে যাবে।” নাদিফ বলল।
“না না বাবা, তোর এই কথায় সায় দিতে পারলাম না। এত শখ করে বউমা আনলাম ঘরে, ঘর আলো করার জন্য। এখন তুই আমার ঘর অন্ধকার করে বউমাকে দিয়ে চাকরি করাতে চাইছিস! এ আমি মানতে পারব না।”
কী ফ্যাসাদে পড়া গেল? নাদিফ মাকে বুঝাতে বলল, “মা… চাকরি করা তো দোষের কিছু না। আমি নিজেই ছুটি পাই না। গ্রামে আসা-যাওয়া করি না। দেখা গেল, আমার চাকরির দোহাই দিয়ে তোমার বউমা কোনোভাবে অসন্তুষ্ট! তখন?”
“কথা তো মন্দ বলিসনি। কিন্তু…।”
“কোনো কিন্তু নয় মা। অনুমতি দিয়ে দাও। আমরা ছুটি পেলে আসব।”
মনোয়ারা বেগম খানিকটা মন খারাপ করে রুম ত্যাগ করলেন। ওবায়দুর রহমান বললেন, “সাথে নিতে চাইছিস নে, তবে একটু খেয়াল রাখিস। নতুন সম্পর্ক। অপরিচিত জায়গা। বউমার মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে।”
“কোনো ব্যাপার না। আমি সব সামলে নেব।”
“ঠিক আছে। কাল কখন যেতে চাইছিস?”
“আগামীকাল বিকেলে। সকালে একটা কাজ আছে এখানে। এরপর…।”
“আমি বরং বেয়াই-বেয়াইকে আবার আসতে বলি? আজ রাত এখানে থেকে কাল মেয়েকে বিদায় দিয়ে যাবেন।”
“হম…। বলতে পারো।”
বুকভরে শ্বাস নিয়ে বাবা-মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো নাদিফ। দরজায় সামনে গিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল, ভেতরে যাবে কি না। এরমধ্যেই তার মাকে রুম থেকে বের হতে দেখে চিন্তা বেড়ে গেল! মা কী বলতে এসেছেন?
মনোয়ারা বেগম ছেলেকে বললেন, “একবার গেলে তো সহজে গ্রামে ফিরবি না। ভেবেছিলাম, বউভাতের আয়োজনটা বড়ো করে করব, সেটাও করতে দিবি না। এখন যা, বাজার থেকে মাছ-মাংস নিয়ে আয়। আজ বউমা রান্না করবে।”
নাদিফ হতবাক হয়ে বলল, “মাছ-মাংস আনতে হবে কেন? ফ্রিজে নেই?”
“নতুন বউকে দিয়ে রান্না করালে, সবকিছু নতুন করে করতে হয়। তুই যা তো, বাজার নিয়ে আয়। আর বউমার জন্য দামী একটা উপহার নিয়ে আসবি।”
ঘাড় নেড়ে ঘরে প্রবেশ করে ধাক্কা খেল নাদিফ। তার দুই বোন দু’দিক থেকে মাঝখানে একটা পুতুলকে আগলে নিয়ে গল্প করছে। তাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে দু’জনেই বেরিয়ে গেল। তূর্ণা পড়ে গেল অস্বস্তিতে।
নাদিফ অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। মোবাইল ও মানিব্যাগ হাতে নিয়ে প্যান্টের পকেটে ভরে শুধু জানতে চাইল, “মা বলছেন, নতুন বউয়ের জন্য কিছু একটা গিফট আনতে। এমনিতে আপনার কী পছন্দ? শাড়ি, জুয়েলারি অথবা অন্যকিছু?”
তূর্ণা নতমুখে জবাব দিল, “আমার কিছু লাগবে না।”
“লাগবে না, এটা তো মাকে বুঝাতে পারব না।”
“আমাকে ঋণী করবেন না, প্লিজ। কিছু লাগবে না।”
আর কিছু জানার আগ্রহ না দেখিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল নাদিফ। ওর খুব ইচ্ছে ছিল, নতুন বউয়ের জন্য স্পেশাল কিছু একটা কিনবে, যেটা একদমই আলাদা। সেই অনুযায়ী বিয়ের ঠিকঠাক হওয়ার পরই একটা দামী জিনিস গড়িয়ে নিয়েছিল, যার কোনো মূল্যই আর নেই। আর এটা দেয়াও এখন লজ্জাজনক! যেখানে সম্পর্কটাই গড়ে উঠেনি, সেখানে উপহার তো আদিখ্যেতাস্বরূপ।
নাদিফ চলে যাওয়ার পনেরো মিনিট পরই তূর্ণার নম্বরে কল এলো। মিথ্যুকটার নম্বর দেখে রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না। ফোন হাতে তুলে চট করে ব্লক করে দিতে চাইল। এমন সময় ম্যাসেজ এলো, “তোমার বর তো খুব ভালো মনে হচ্ছে। একদিনের তোমার প্রতি দরদ উথলে উঠেছে। কাল কোর্টে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। ও আমাকে কী ভেবেছে, আমি ওর হুমকিধামকি ভয় পাব? আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব না। সারাজীবন কলঙ্ক নিয়ে বসে থাকো।”
এমন ম্যাসেজ দেখে রাগে শরীর জ্বলে উঠল তূর্ণার। গতকাল রাতেই নাদিফকে নম্বর দিতে হয়েছিল, এরপর সে যত কথা বলেছে, সবটাই সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে। এবং কালকের মধ্যে ডিভোর্সের কাজ সম্পন্ন করতে চাইছে।
তূর্ণা কিড়মিড় করতে করতে রিপ্লাই দিল, “তুই না দিলে আমার কীসের এত ঠ্যাকা পড়ল রে হারামি? আমি তোকে ডিভোর্স দেব। কালই। সে তুই কোর্টে থাক বা না থাক। আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।”
“অনেক সাহস হয়ে গেছে দেখছি। সব ওই পাতানো বরকে পেয়ে, না? হা হা, বিয়েটাই তো হয়নি! বলব এসব কথা মানুষকে? বলব, তোমার বাবা-মাকে? তুমি একটা বেশ্যা!”
“কুত্তার বাচ্চা আর একটা বাজে কথা বললে তোর নামে আমি মামলা করব। আই স্যোয়ার, তোর এমন অবস্থা করব যে, দুইদিনে তুই চোখে অমাবস্যা দেখবি!”
“তা-ই? কীভাবে করবে শুনি?”
“সেসব না জেনে তুই শুধু এটা জেনে রাখ যে, আমার জীবনে তোর মতো জানোয়ারের আর কোনো অস্তিত্ব নাই। আর তোর বাচ্চাটাও আমার পেটে নাই।”
এইটুকু বলে ঝটপট নম্বরটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে তূর্ণা। নাদিফ খুব করে বুঝিয়েছে, “ওই ছেলেটার সাথে একদম মিনমিনে আচরণ করে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করবেন না। সাহস রেখে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করবেন। দেখবেন, ঘুঘু ফাঁদে ঠিকই আটকে যাবে! আর বাচ্চার ব্যাপারটা… ওকে মিথ্যে বলবেন। বলবেন যে, আপনি এ্যাবরশন করিয়ে নিয়েছেন।”
নাদিফের কথা অনুযায়ী তূর্ণা সেটাই করছিল। অন্তত এতে যদি অসভ্যটা একটু দমে যায়। সারাদিন মন-মেজাজ কত ভালো ছিল! দিল সবকিছুর বারোটা বাজিয়ে। মন খারাপ করে পরনের শাড়ি পালটে, হাতমুখ ধুয়ে সব সাজ মুছে ফেলল সে। সাধারণ একটা থ্রিপিস পরে, ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে, চুপ করে বসে থাকল।
নাদিফের দুইবোন টুপ করে ভেতরে ঢুকে গেল। দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে তূর্ণা বলল, “কিছু বলবে?”
নাজিফা বলল, “ভাবী, ফুচকা খাবে?”
“এখন? কোথায় পাবে?”
“রাস্তার মোড়ে দোকান বসেছে। নিয়ে আসব?”
“তোমাদের ভাইয়া বকবে না তো?”
“ধুর… ভাইয়া তো বাজারে গেছে। দুই ঘণ্টার আগে ফিরবে না।”
“আমি কিন্তু ঝাল খাই। প্রচুর ঝাল দিয়ে আনবে। ঠিক আছে?”
দুইবোন আবার দৌড় দিল। এরা দুটোই যমজ। নাজিফা ও নাদিরা। দুইবোনের কাণ্ডকারখানা এই ঘরকে এত প্রশান্তিময় করে রাখে! মনে হয়, ওরা আছে বলেই ঘরে এত আনন্দ, এত শান্তি। একদিনের মধ্যে দুটোতে তাকে আপন করে নিয়েছে, মায়ায় ফেলে দিয়েছে। অথচ ওরা জানেও না, এই সম্পর্কটাই মিছে!
***
চলবে…
#লাস্ট_স্টেশন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩
বড়ো সাইজের একটা বোয়ালমাছ এনেছে নাদিফ। সাথে দুই কেজি গোরুর গোশত ও কয়েক ধরনের সবজি। আবার মায়ের কথা অনুযায়ী উপহার হিসেবে এনেছে দুটো নতুন শাড়ি, চুড়ি, মেহেদী, চিপস্, চানাচুরসহ কয়েক ধরনের আচার। চাচাতো ভাইদের বিয়ের পরদিন তারাও এভাবে বউয়ের জন্য একগাদা স্ন্যাকস নিয়ে আসত। এরপর সবার সামনে বউয়ের আঁচলে সেগুলো ঢেলে দিত।
নাদিফ সবকিছু টেবিলের উপর রেখে দিল। দুইবোন সাথে সাথে তূর্ণাকে টেনে নিয়ে এলো। আহ্লাদী কণ্ঠে নাদিরা বলল, “জলদি এসে দেখো, ভাইয়া কতকিছু নিয়ে এসেছে।”
দু’জনের টানে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হলো তূর্ণা। ক্লান্ত শরীরকে প্রশান্তি দিতে মাত্রই ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে, একগ্লাস পানিতে চুমুক দিচ্ছিল নাদিফ। তারমধ্যে একদম সাদামাটা পোশাকের তূর্ণাকে দেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কী নিয়তি দু’জনের। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা তার বউ হতে পারত! তাকে ঘিরে সব আয়োজন হতে পারত! অথচ…
নাজিফা ভাইকে তাড়া দিয়ে বলল, “এদিকে আসো তো একটু।”
এরপর টেবিলের উপর রাখা একগাদা স্ন্যাকস ও শাড়ি, চুড়ি একসাথে হাতে তুলে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়াও, আমি ক্যামেরা অন করছি। এ্যাই, নাদিরা… ভাবীর ওড়নার একপাশটা মেলে ধর সামনে।”
টুপ রেখে ওড়নার একমাথা সামনে তুলে ধরল নাদিরা। তূর্ণা অস্বস্তি নিয়ে বলল, “এসবের কী দরকার?”
“খুব দরকার। আমার ভাইয়া তোমার দায়িত্ব নিচ্ছে যে, এটা আমার সেলিব্রেট করব না? মা-বাবা, জলদি এসো। দূরে আছো কেন?”
একজন একজন করে সবাইকে ডেকে আনল নাজিফা। এরপর হাতের মোবাইলের ক্যামেরা অন করে দু’জনের থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
নাদিরা ওড়না ধরে রেখে বলল, “ভাইয়া আমি ধরে আছি। তুমি সবকিছু ভাবীর আঁচলে ঢেলে দিয়ে বলো, আজ থেকে আমি তোমার সব দায়িত্ব নিলাম। বলো, বলো, জলদি বলো।”
নাদিফ চাপা শ্বাস ছেড়ে বলল, “পড়ে যাবে।”
“কিছুই পড়বে না। ঢালো তো! আমি ধরেছি, দেখছ না?”
“ওড়না ছিঁড়ে যায় যদি?”
“ধুর… ছিঁড়ে গেলে নতুন একটা এনে দিবে।”
“তা-ও ঢালতেই হবে?”
“শুধু ঢালবে না, বলবেও।”
“ওসব বলতে পারব না। এগুলো গ্রামের সব অদ্ভুত সিস্টেম।”
“অদ্ভুত হোক আর যাই হোক, তুমি এখন ভাবীর দায়িত্ব নিয়ে তাকে ভরসা দিবেই দিবে।”
নাদিফ বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওদের এই পাগলামিকে সায় দিচ্ছ কেন?”
মনোয়ারা বেগম হাসিমুখে বউমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “হোক পাগলামি… তা-ও তুই একবার বলে ফেল।”
দু’জনের মনের কথা কেউ জানেন না আর এসব বুঝানোও যাবে না। উপায়ন্তর না পেয়ে হাতের সবকিছু আলগোছে তূর্ণার ওড়নায় ঢেলে দিল নাদিফ। উপরে দিল শাড়ি ও চুড়ি। তাতেই অতিরিক্ত ওজনের ঠ্যালায় পড়ে ওড়না নিচের দিকে পড়তে যাচ্ছিল। দু’হাতের ঝাপটায় সবকিছুকে বাঁচিয়ে নিল সে। এরপর রসকষহীন গলায় বলল, “এগুলো আপনার।”
নাজিফা ছবি তোলার পাশাপাশি ভিডিয়োও করছিল। সে দূর থেকে বলল, “হবে না ভাইয়া, সুন্দর করে বলো!”
তূর্ণাও সবার মাঝখান থেকে যেতে পারছে না। আবার ওড়নায় থাকা সবকিছু সরাতেও পারছে না। ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি নিয়ে সবার সঙ্গ দিচ্ছে।
নাদিরা চেঁচিয়ে উঠল, “ভাইয়া বলছ না কেন?”
দুই বোনের জোরাজুরিতে নাদিফ টিকে থাকতে না পেরে বলল, “আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আমার।”
নাজিফা ফোঁসফোঁস করে বলল, “আপনিআজ্ঞে কী ভাইয়া? তুমি করে বলো! ভাবী কত কিউট ও স্যুইট একটা মেয়ে। আর তুমি কি না আপনি বলে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ! এক্ষুণি তুমি বলো।”
নাদিফ হাত বাড়িয়ে বোনের মাথায় ঠোকর দিয়ে বলল, “তোর মাথা। সর এখন।”
“বাবা দেখলে, তোমার ছেলে আমার মাথায় ব্যথা দিল!”
এরপর তূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবী, এক্ষুণি এর বিচার করো। নাহলে আমি ভাত খাব না।”
না পেরে এবার ফিক করে হেসে ফেলল তূর্ণা। ওড়নায় থাকা সমস্ত কিছু ফের টেবিলের উপর রেখে বলল, “ভাত খেতে হবে না। পাস্তা খাবে চলো।”
নাদিরা আনন্দিত কণ্ঠে জানতে চাইল, “তুমি বানাবে?”
“হ্যাঁ…। যদি মা অনুমতি দেন।”
ফোন-টোন রেখে তিনজনে মিলে রান্নাঘরে ছুটল। নাজিফা সদ্য আনা মাছ-মাংস সরিয়ে রেখে, সবজিগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। নাদিরা হাতে-হাতে তূর্ণাকে এটা-সেটা এগিয়ে দিল। নাদিফ দূরেই একটা সোফায় বসে আছে… তার চোখ একদিকে ব্যস্ত থাক চাইলেও নিজের নির্লজ্জ আচরণের জন্য নিজেই বিরক্ত হয়ে ঘরে ছুটল।
তূর্ণা প্রথমে পাস্তা রান্না করে সবার হাতে তুলে দিল, এরপর চা বসাল। কয়েক মিনিটের মধ্যে চা হয়ে গেলে, সবাইকে চা দিয়ে একটা ট্রে-তে পাস্তা ও চা সাজিয়ে নিয়ে নাদিরাকে বলল, “এটা তোমার ভাইয়াকে দিয়ে এসো।”
নাদিরা আলসেমি করে বলল, “তুমি যাও না, ভাবী। আমার কত পড়া আছে।”
“ওহ, আচ্ছা। তুমি পড়তে যাও।”
এরপর নাজিফাকে ডেকে বলল, “তুমি নিয়ে যাও। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল তো!”
নাজিফা মাথা চুলকে বলল, “আমি না ভেজা কাপড় এনে ওগুলো হ্যাঙ্গারে ঝুলাতে ভুলে গেছি। ওগুলো ঝুলিয়ে আসি? তুমি নিয়ে যাও।”
দুই বোনের মতিগতি কিছুই বুঝল না তূর্ণা। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দুটোই ভেগে গেল। সে আড়চোখে শ্বশুর-শাশুড়ির দিকে নজর দিল একবার। ওনারা কী সুন্দর গল্প করছেন। কিছু একটা নিয়ে হাসছেনও। মুরব্বি দু’জনকে বিরক্ত করার সাহস পেল না। মাথার ওড়না ঠিকঠাক করে নিজেই ট্রে হাতে নিয়ে নাদিফের রুমের দিকে ছুটল। ওটা আসলে নাদিফেরই রুম… নিজেদের না!
প্রথমে দরজায় আস্তে শব্দ করল তূর্ণা। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে সবকিছু টি’টেবিলের উপর রেখে বলল, “চা রেখে গেলাম।”
নাদিফ কোনো উত্তর দিল না। ফোনের মধ্যে চোখ ডুবিয়ে রাখল। চা ও পাস্তার দিকে তাকিয়ে নিজের দুর্ভাগ্যকে একগাদা বকে দিল!
তূর্ণা দরজা পর্যন্ত এগিয়েছিল সবে। নাদিফ পিছন থেকে বলল, “আপনি খেয়েছেন?”
“এইতো… এখন খাব।” দাঁড়িয়ে থেকে উত্তর দিল তূর্ণা।
“এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
“না…। সমস্যা কী হবে? সব ঠিক আছে।”
তখনকার আসা ফোন ও ম্যাসেজের কথা কিছুই বলার সাহস পেল না তূর্ণা। এইটুকু কথা বলে ঝটপট সরে গেল।
দুইবোনকে একসাথে ফের রান্নাঘরে দেখে তূর্ণা বলল, “শেষ পড়াশোনা? ঘর গুছানো?”
নাদিরা বোয়ালমাছ দেখিয়ে বলল, “মাছ…! মাছ কাটা বাকি তো। এটা কেটে ফেলো আগে, তারপর পড়ব।”
মনোয়ারা বেগমও ছুটে এলেন রান্নাঘরে। ফ্লোরে বটি রেখে, তূর্ণাকে বললেন, “মাথাটা কাটবে শুধু। বাকিটা আমি করে নেব। পারবে তো?”
তূর্ণা সায় জানাল, “জি মা, পারব।”
নাজিফা ভাইকে টেনে এনেছে আবার। মাছ কাটা হবে আর সবাই উপস্থিত থাকবে না? ছবি তুলে, ভিডিয়ো করে, সবাইকে দেখাতে হবে তো, নতুন বউ মাছ কাটছে!
আঁশ যেহেতু নেই, এত ঝামেলাও নেই। প্রথমে মাছটা পরিষ্কার করে, টোলে বসল তূর্ণা। দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে মাছ তুলতে গিয়ে টের পেল, এটার যথেষ্ট ওজন। হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনোমতে মাথা আলাদা করে দিল। অমনি নাজিফা ও নাদিরা হৈচৈ করে উঠল।
ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসেছিল নাদিফ। সবার সামনে থেকে সরে যাওয়া সন্দেহের সৃষ্টি করবে, তা-ই না চাইতেও সবকিছু উপভোগ করতে হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ তার হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠল। চাচাতো ভাইয়ের বউ কল করেছে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, “নতুন বউ? কী আর করবে? মাছ কাটছেন উনি। দেখবে? না না… এইমুহূর্তে ভিডিয়োকল দেয়া যাবে না। বেচারি লজ্জায় পড়ে যাবে।৷ নাদিরাকে ছবি পাঠাতে বলছি, দাঁড়াও।”
রক্তাক্ত হাতটা ধুয়ে শাশুড়ির কাছাকাছি টোল পেতে বসল তূর্ণা। মনোয়ারা বেগম সম্পূর্ণ মাছ কেটে, বড়ো বড়ো পিস করে, বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে রান্না করতে হবে। এরপর গোরুর গোশত ও সবজি দেখিয়ে কয় পদের রান্না হবে সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।
নাদিফ তখনও বকবক করছে। হাসছে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না, এই নাটুকে বিয়ে তার মনে কোনো প্রভাব ফেলেছে। উলটে… এই বিয়ে, বউ, বউভাত থেকে শুরু করে… সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি ব্যাপার সে উপভোগ করছে। তার কথা ও কাজে এসব স্পষ্ট! যদিও সবটাই লোকদেখানো, তবুও সবকিছুকে এভাবে দেখতে ও বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে তূর্ণাকে।
দুই ননদ ও শাশুড়ির সাহায্যে রান্নার ঝামেলা খুব দ্রুততার সাথেই শেষ করে ফেলল তূর্ণা। তাকে একা কিছুই করতে হয়নি। সব মশলা করেছে নাদিরা, নাজিফা সবজি কেটেছে আর সে শুধু কড়াইতে ফেলে মাছ ভেজেছে, মাংস কষিয়েছে। এইটুকুতেই যথেষ্ট ঘেমে গেছে সে।
নতুন বউকে ঘামতে দেখে মনোয়ারা বেগম বললেন, “ঘেমে গেছো বউমা। পরনের জামা পালটে নাও গিয়ে। বাকিটুকু আমি করে নেব।”
তূর্ণা অসম্মতি জানিয়ে বলল, “আমি পারব মা, অসুবিধা নেই।”
“যাও তো, অনেকক্ষণ ধরে এখানে আছো। নাদিফের কিছু লাগবে কি না দেখে আসো। এরমধ্যে আমি টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিতে পারব।”
ফোনে কথা বলতে বলতে কোন ফাঁকে যে নাদিফ এখান থেকে সরে গেছে টের পায়নি তূর্ণা। এখন তার প্রসঙ্গ আসাতেই একরাঁশ অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুম পর্যন্ত এলো। নাদিফ নেই। হয়তো বারান্দায় আছে। ওখান থেকে শব্দ আসছে।
অসময়ে গোসল করে, পরনের জামা বদলে ফেলল তূর্ণা। ভেজা চুল মুছে, মাথার ওড়না ঠিকঠাক করে, মুখে সামান্য ক্রিম ছোঁয়াতে গিয়েই খেয়াল করল, বারান্দার দরজায় নাদিফ দাঁড়িয়ে আছে। কোনোভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল সে? বুঝতে পারল না। নিজের অযাচিত সন্দেহ ভেবে পাত্তা দিল না। যার মন ও মস্তিষ্কে অন্য কেউ… সে তার দিকে তাকাবে না কি! ধুর…
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তূর্ণা বলল, “আপনার ভালোবাসার মানুষটার নাম কী?”
থতমত খেয়ে গেল নাদিফ। যার জীবনে এই ভালোবাসা শব্দটা নিয়ে কোনো রমণীর আগমন ঘটেনি কোনোদিন, কখনও কোনো মেয়েকে দেখে… মন রাঙানোর স্বপ্ন দেখেনি দুটো চোখ… জীবন সাজানোর আগ্রহ পায়নি… সেখানে সেই না আসা ভালোবাসা ও অদেখা স্বপ্ন নিয়ে কী বলবে?
উত্তর না পেয়ে তূর্ণা বলল, “কী হলো? তার নামটাও কি জানতে পারি না?”
নাদিফ পানসে মুখে বলল, “নাম? মাহিরা… মাহিরা খান।”
এইটুকু বলে তূর্ণার মেজাজ আন্দাজ করতে চাইল নাদিফ। তাকে কোনোপ্রকার রিয়্যাক্ট করতে না দেখে অবাক হয়ে গেল।
তূর্ণা খুশিমনে বলল, “খুব সুন্দর নাম। ছবি আছে?”
ফেঁসে গেল নাদিফ! এবার ছবি কোত্থেকে দেখাবে? পছন্দের অভিনেত্রীর নাম বলে তো ভালোই বিপদে পড়া গেল।
তূর্ণা তাড়া দিল, “একটা ছবিই তো দেখতে চাইছি! দেখান না।”
নাদিফ গুগলে ঢুকে মাহিরা খানের একটা ছবি স্ক্রিনে এনে, তূর্ণার চোখের সামনে রেখে বলল, “দেখুন।”
তূর্ণা দেখল। অবাক চোখে তাকাল। এরপর বলল, “ইশ, কী সুন্দর উনি! এত সুন্দর মেয়েকে কেউ ডিভোর্স দেয়?”
বিস্মিত চোখে নাদিফ বলল, “আপনি কি কোনো ধরনের ড্রামা কিংবা মুভি দেখেন না?”
সহজ-সরল স্বীকারোক্তির সাথে তূর্ণা বলল, “ধুর… ড্রামা আর মুভি দেখে কী কাজ? ওগুলোতে ভালো কিছু কখনওই দেখায় না। সারাক্ষণ হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা আর মারামারি তো আছেই… বাপরে বাপ। ওগুলো দেখার ধৈর্য্য আমার নাই।”
“তাহলে কী দেখেন?”
“কার্টুন। ডোরেমন। টম এ্যান্ড জেরি। ডোরা। বেন-টেন। মোটু-পাতলু। মিকি মাউস। এগুলো দেখি। এছাড়াও… মাঝেমধ্যে হিন্দি গান-টান শুনি।”
“কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম চিনেন না?”
“না…। ওদের চিনে আমার কাজ কী? মুভিই যেখানে দেখি না, সেখানে নাম তো আমার সিলেবাসের বাইরে।”
নাদিফ কপালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কতক্ষণ চুপ থেকে হুট করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, “ড্রামা ও মুভি দেখা খুব খারাপ। জীবনে এসব দেখবেন না, ঠিক আছে? এগুলো দেখলে, মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে যায়।”
তূর্ণা কপাল কুঁচকে নিয়ে বলল, “আশ্চর্য! আপনি হাসছেন কেন? এখানে হাসির কী পেলেন?”
উত্তর দিলে বিপদ, এই ভয়ে নাদিফ এবার মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকল। খানিকক্ষণ পর তূর্ণার রাগী চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চাদের সাথে কার্টুনই যায়… আরও বেশি বেশি কার্টুন দেখা উচিত আপনার। আর মুভি-টুভি থেকে দূরে থাকা উচিত। শুনুন… ভুল করেও কোনো ধরনের মুভি দেখবেন না। বাংলা, হিন্দি যেমন না, পাকিস্তানি তো আরও আগে না। এসব কিন্তু ভালো কিছু শেখায় না।”
***
চলবে…





