গোপন বিয়ে পর্ব ১০

#গোপন_বিয়ে
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক


‘বিশ্বাস ঘাতকেরা একদিন ঠকে যায়,
সকাল বেলা চায়ের কাপে ঠোঁট স্পর্শ করে কথাটা বললেন ইমতিয়াজ ভাইয়া।
কথাটা খুব সাধারণ। কিন্তু এই সাধারণ এবং কমন কথাটা শুনেই মনে প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম আমি।
ইমতিয়াজ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,’নাতাশা, তোমার কাছে একটা কথা লুকিয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে এই কথাটা তোমার কাছে লুকাবার কোন কারণ নাই।’
আমি ভাইয়ার দিকে সহজ ভাবে তাকালাম।
ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন,’নাতাশা, বিন্দুর সাথে আমার একদিন দেখা হয়েছিল। কোথায় জানো?’
আমি বেশ অবাক হলাম।
বললাম,’কোথায়?’
ইমতিয়াজ ভাইয়া তার নিভন্ত গলায় বললেন,’একটা বস্তিতে। ওখানে আমরা একটা টিম গিয়েছিলাম স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য।’
‘তারপর?’
‘বিন্দুর সাথে আমি কথা বলতে পারিনি। কারণ ও আমায় দেখে লুকিয়ে গিয়েছিল। আমার সামনে সে আসেনি। কিন্তু ওর বিষয়ে অন‍্য একটা মেয়ের কাছে সবকিছু জানতে পেরেছি।’
‘কী জানতে পেরেছেন ভাইয়া?’
পুণম ওকে ছেড়ে চলে গেছে।মানে ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।আর এরপর সে বাসায়ও ফিরতে পারেনি।তার বাবা মা তাকে গ্রহণ করেননি। এরপর থেকেই সে এই বস্তিতে বসবাস করছে।’
‘বিন্দু কী আর সংসার করেনি?’
ইমতিয়াজ ভাইয়া বড় দুঃখ কাতর গলায় বললেন,’এই বস্তির মেয়েদের কেউ বিয়ে করে না!’
ইমতিয়াজ ভাইয়ার কথা শুনতে গিয়ে আমার চা ঠান্ডা হয়ে গেল কিন্তু এক চুমুক চাও আর খাওয়া হলো না। কিন্তু ইমতিয়াজ ভাইয়া ঠিকই কথা বলতে বলতে চা খেয়ে শেষ করে ফেললেন।
আমি ইমতিয়াজ ভাইয়াকে বললাম,’ভাইয়া, আপনার কী বিন্দুর জন্য দুঃখ হয় না?’
ইমতিয়াজ ভাইয়া কষ্টের হাসি হেসে বললেন,’না হয় না। বিন্দুর জন্য আমার দুঃখ হয় না। কিন্তু আমার ভালোবাসার জন্য আমার দুঃখ হয়। ভুল মানুষকে ভালোবাসার দুঃখ।’
ইমতিয়াজ ভাইয়ার চোখের দিকে তাকালে কষ্ট হয়। একজন সুঠামদেহী, শক্তিশালী পুরুষের চোখে জল মোটেও মানায় না। কিন্তু তারও যে মন আছে।কষ্ট আছে।সব কষ্ট সব সময় সবাই গোপন করতেও তো জানে না।
ইমতিয়াজ ভাইয়াকে আমারও বলতে ইচ্ছে করছিলো , ভাইয়া আমারও কষ্ট হয়। মানুষ হয়ে একটা কুকুরকে ভালো বাসার কষ্ট।’
ইমতিয়াজ ভাইয়া আমার দিকে সরল চোখে তাকিয়ে বললেন,’এইসব কষ্টের ভীড়েই বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে বের করতে হবে।নিজে যে ভুল করে এই কষ্ট পেয়েছো সেই ভুলে যেন অন্য কেউ পা না দেয় সেটুকু সতর্ক মানুষদের করতে হবে।’
আমি মনে মনে বললাম,’আচ্ছা।

বিকেল বেলা আমি আর ইমতিয়াজ ভাইয়া বসে বসে পরিকল্পনা করছিলাম কীভাবে বাবা মার কাছে ফিরে যাবো। তাদের কাছে গিয়ে কী বলবো!
আর তখন হঠাৎ করে কেউ দরজায় প্রবল নাড়ে।
দরজা খুলতেই আমি মুহূর্তে স্তিমিত হয়ে পড়ি।নিতুল আর ওর মা এসেছে। সঙ্গে পুলিশ। একজন দারোগা আর দুজন কনস্টেবল।
ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন,’আপনারা?’
দারোগা তার গমগমে গলায় বললেন,’আপনার নামে অভিযোগ আছে।নিতুল সাহেবের স্ত্রীকে আপনি অপহরণ করেছেন।’
‘মানে?’
ইমতিয়াজ ভাইয়া অবাক হওয়া গলায় বললেন।
দারোগা বললেন,’মানে টা আদালত বুঝাবে। আপনাকে এখন আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।’
আমি তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’না, ইমতিয়াজ ভাইয়া তো আমায় অপহরণ করেননি।
নিতুল আমায় বের করে দিয়েছিলো বাড়ি থেকে। তারপর আমি এসে ভাইয়ার বাসায় উঠেছি।’
দারোগা আমায় ধমক দিয়ে বললেন,’চুপ করুন আপনি। লজ্জা করে না নিজের পেটে সন্তান রেখে স্বামী ছেড়ে অন্য পুরুষের সাথে এসে সময় কাটাতে!’
নিতুল তখন চোরা হাসি হাসছিলো। আমি স্পষ্ট দেখেছি।
ইমতিয়াজ ভাইয়া তখন দারোগার প্রতি রেগে গেলেন। তিনি বললেন,’নাতাশাকে নিয়ে একটা মন্দ কথাও বলবেন না।ও আমার বোন হয়।’
নিতুলের মা তখন বলে উঠলো,’স‍্যার, মিথ্যে বলছে ও। ভাই বোনের নাম করে দুজনের প্রেমের সম্পর্ক। ‘
নিতুলও তার মায়ের সাথে যোগ দিলো।
দারোগা বললেন,’নিজের বউকে সামলে রাখতে পারেন না! নিয়ে যান বাসায় নিয়ে যান।’
নিতুল এবার দারোগাকে অনুনয় করে বললো,’স‍্যার, ওকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করবেন বুঝলেন। ইচ্ছা মতো শিক্ষা দিয়ে দিবেন।’
দারোগা নিতুলকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
তারপর ইমতিয়াজ ভাইয়ার পবিত্র দুটো হাতে হাতকড়া পরিয়ে বাসা থেকে বের করে নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠার সময় ইমতিয়াজ ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন।তার চোখ তখন জল ছলছল। আমার কী যে কষ্ট লাগলো তার চোখের দিকে তাকিয়ে। আমি তখন শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। ইমতিয়াজ ভাইয়া ওখান থেকেই জোর গলায় বললেন,’নাতাশা,সত‍্যের বিনাশ কেউ করতে পারে না। আমি খুব দ্রুত ফিরে আসবো। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি নিতুলের সাথে যেও না। তুমি তোমার বাবা মার কাছে ফিরে যাও।আর আমার জন্য তোমার কিছুই করতে হবে না। আমার অনেক বন্ধু আছে।তারা খবর পেয়েই আমায় ছাড়িয়ে নেয়ার ব‍্যাবস্থা করবে।’
ইমতিয়াজ ভাইয়ার এইসব আদিক্ষেতাকে হয়তো দারোগা সন্দেহের চোখে দেখলেন।তাই তিনি তার লাঠি দিয়ে ইমতিয়াজ ভাইয়ার পিঠে শক্ত করে আঘাত করলেন।আর ইমতিয়াজ ভাইয়া তখন ব‍্যাথায় কঁকিয়ে উঠলেন।নিরাপরাধ একটা মানুষ আমার জন্য এতো কষ্ট পাচ্ছে!জেলে যাচ্ছে। ভাবতেই নিজের প্রতি কেমন ঘেন্না হচ্ছে। কিন্তু আমি কী করবো এখন?

ওরা ইমতিয়াজ ভাইয়াকে নিয়ে চলে গেছে। তারপর নিতুল আমার হাত টেনে ধরে বললো,’আসো।’
আমি ওর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারলাম না। একজন পুরুষ শক্তির সাথে কী করে পেরে উঠি আমি!
কিন্তু কথা তো বলতে পারি। আমি ওর দিকে এবার ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বললাম,’তুই আমার কী হোস যে তোর সাথে আমি যাবো?’
‘স্ত্রী।’
আমি থুউক করে একদলা থুথু ওর মুখের উপর ছিটিয়ে দিয়ে বললাম,’তুই আমার ছাই হোস।তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক ছিন্ন করেই সেদিন আমি চলে এসেছি।’
নিতুল এবার আমার চুল টেনে ধরে বললো,’বললেই হলো।তোর কথায় সব হবে?তোর বাবা মা এসে আগে বলুক। তাদের বলতে হবে কেন তোর ডিভোর্স প্রয়োজন!’
রাগে প্রচন্ড ভাবে কাঁপছি আমি। আমার ইচ্ছে করছে নিতুলকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে। কিন্তু পারবো তো না আমি তার সাথে!
নিতুলের মা এবার বললো,’মান সম্মান থাকতে ঘরে চলো মা। মানুষ হাসাইও না।’
আমি অট্টহাসি হেসে বললাম,’আপনার মানসম্মান আছে নাকি আবার?’
আমার মুখে এমন কথা শুনে নিতুলের প্রচন্ড রাগ পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার তলপেটে জোরে এক লাথি বসিয়ে দিলো।আর আমি ব‍্যাথায় কঁকিয়ে উঠে একেবারে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম। আমার চোখ তখন কেমন ঘন আঁধার হয়ে এলো। পৃথিবীকে মনে হলো এ যেন কোন বৃহৎ‌আকারের ফুটবল।ঘুরছে। প্রচন্ড রকম ঘুরছে।সে ঘুর্ণির ভেতর আটকে গেছি আমি। আমিও ঘুরছি। প্রচন্ড রকম ঘুরছি। আমি কী করে রেহাই পাবো এই ঘূর্ণির কবল থেকে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here