#My_First_Crush
#পর্ব-২৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
একটা বৃহদাকার বট গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে হৃদি। তার হাতে একটা লিস্টের কাগজ। নজর সেদিকেই। হৃদি কাগজের পাতা উল্টানোর মধ্যেই একটা পাহাড়ি বাচ্চা মেয়ে এসে হৃদির জামার ওড়না ধরে টানতে লাগলো। হৃদি কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকালো। ঈষৎ ঝুঁকে মেয়েটিকে হেসে ইশারা করলো, ‘কি?’
মেয়েটি তার নিজস্ব ভাষায় হৃদিকে কিছু একটা বলল। হৃদি ঠিকমতো বুঝতে পারলো না। পাহাড়ি মানুষের ভাষাগুলো বুঝতে হৃদির ভারি অসুবিধা হচ্ছে। হৃদি কিছু বুঝতে পারছে না দেখে মেয়েটি হাত দিয়ে ইশারা করে বোঝালো। এবার হৃদি বুঝতে পারলো মেয়েটি আসলে তাকে গাছ থেকে তার প্লাস্টিকের বলটা নামিয়ে দিতে বলছে। যেটা খেলতে গিয়ে বেঁধে গিয়েছে গাছের পাতার ঝোঁপে। হৃদি বলটি নামিয়ে মেয়েটির হাতে দিলো। ঈষৎ হেসে মেয়েটির চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো। সেই সময়ে মুনিয়া এসে হৃদিকে বলল, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো? জাহিদ ভাই তোমাকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছে। লিস্টের সব কাজ দিনের মধ্যেই শেষ করতে বলেছে।’
হৃদি মাথা নেড়ে সায় দিলো। মুনিয়া চলে গেলে ফোনটা চেক করে সময়টা দেখে নিলো একবার। এখনো অনেকগুলো প্যাকেট বাকি। এগুলো সব বিতরণ করতে হবে। আর কয়টা ঘর বাকি আছে সেটা গণনা করার জন্য হৃদি এগিয়ে গেলো। পায়ে পায়ে বেজে তার জুতোর ফিতা গেলো খুলে। মুখে ঈষৎ বিরক্তিসূচক শব্দ করলো হৃদি। ওড়নাটা হাত দিয়ে সামলে পা থেকে জুতো খুলে হাতে নিলো। ফিতাটা আবার জায়গা মতো বসিয়ে পড়ে নিলো পায়ে। জাহিদ এগিয়ে এসে বলল,
‘কি খবর হৃদি? তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? এখনো তো সব কাজ শেষ হয়নি!’
হৃদি বলল, ‘একটা বাচ্চা পড়ে ব্যাথা পেয়েছিল জাহিদ ভাই। এজন্য ওকে ধরে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। সেকারণেই একটু দেরি হয়ে গেলো।’
মুনিয়া আড়ালে একটা মুখ ভেংচি দিলো। সবসময় মেয়েটা বেশি বেশি আদিখ্যেতা দেখায়। এখন ওর জন্য সবাইকে দেরি করতে হবে।
হৃদি বলল, ‘সরি জাহিদ ভাই!’
জাহিদ বলল, ‘না না ঠিক আছে। এখন কি কি বাকি আছে সেগুলো বলো। এখান থেকে পরদিন আবার আরেকটা লোকালয়ে যেতে হবে। তিন দিনের বেশি সময় আমি আর লাগাতে চাই না। ঠিক আছে?’
হৃদি আর মুনিয়া দুজনেই মাথা নাড়লো। ওদের গ্রুপের আরো কয়েকজন এসে যোগ দিল সেখানে। হৃদি তাদের সাথেই এগিয়ে গেলো।
___________________________________________________
হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ট্রলিতে করে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো রাইয়ান। তার গায়ে একটা ধূসর রঙের জ্যাকেট। চোখে সানগ্লাস। মুখ ক্লিনশেভ। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই একটা ভ্যাপসা গরম গায়ে ধাক্কা দিলো রাইয়ানের। এতো ভীড়! রাইয়ান আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বোধ হবার পর এই প্রথম বাংলাদেশে আসা হলো তার।একটা রাজনৈতিক নেতার আজ দেশে ফেরার কথা বলে পুরো এয়ারপোর্টের বাইরে গিজগিজ করছে মানুষে। দূর্ভাগ্যক্রমে সেই ভীড়ের মধ্যে পা পড়লো রাইয়ানের। বের হবার কোন পথ খুঁজে পেলো না। মানুষের ধাক্কায় আপনাআপনিই ঠেলতে ঠেলতে চলে এলো একদম রাস্তায়। একটা ব্যাগ কাঁধে আর লাগেজ টেনে নিয়ে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইলো রাইয়ান। এমন সময় একটা বাস আসতে দেখে উঠে পড়লো সেটাতেই। উঠেই পড়লো আরেক বিপত্তিতে। একটা বাসে যে এতো যাত্রী উঠতে পারে তা রাইয়ানের ধারণারও বাইরে। বসার একটা সিটও খালি নেই। দাঁড়িয়েও আছে অনেক মানুষ। আর এদিকে বাস থামিয়ে একের পর এক যাত্রী উঠিয়েই যাচ্ছে কন্ট্রাক্টর। বাসের প্রথমে দাঁড়িয়েও ঠেলতে ঠেলতে একদম পেছনে চলে গেলো রাইয়ান। চাপা পড়লো মানুষের মাঝে। একটু নড়ারও জায়গা নেই। একেকজনের গায়ের সাথে একদম লেপ্টে আছে সে। আর বোগলের ঘামের দুর্গন্ধ! রাইয়ানের মনে হলো এই বুঝি পেট থেকে সব বেরিয়ে আসবে। সেই অবস্থাতেই বাসের ঝাঁকুনিতে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে পড়তে লাগলো রাইয়ান। অতিষ্ট হয়ে রাইয়ান একসময় চেঁচিয়েই উঠলো,
‘এই বাস থামাও।’
বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো রাইয়ান। উপর থেকে তার ব্যাগগুলো ছুঁড়ে মারা হলো নিচে। রাইয়ান অবাক হওয়ার মতো তাকিয়ে রইলো। কন্ট্রাক্টর বিরক্তি মুখ নিয়ে বাসের দরজায় ধাক্কা দিলে বাস চলে গেলো। রাস্তা থেকে ব্যাগগুলো তুলে ঝাড়া দিয়ে নিলো রাইয়ান। কাঁধে নিয়ে আবারো চলতে শুরু করলো। জায়গাটা একটা বাজারের মতো। চারদিকে অনেক দোকানপাট আর খাবারের হোটেল। ফুটপাত জুড়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ভ্যানগাড়ি। আর এতো এতো মানুষ! হাঁটতে গেলে কাঁধে কাঁধে ধাক্কা লেগে চলে যায়। রাইয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। স্বল্প জনসংখ্যার ফ্লোরিডায় থাকা রাইয়ানের মনে হলো বাংলাদেশের সব মানুষ কি ঢাকাতেই থাকে? গরমে ঘামে ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে গেলো রাইয়ান। তার মনে হলো সে চুলোর উপর বসে আছে। এতো গরম কিভাবে হতে পারে! তার ফর্সা মুখ একদম লাল হয়ে রইলো। রাইয়ান এগোতে লাগলো। রাস্তাঘাট অপরিষ্কার। ফেলা দেওয়া প্যাকেট, বোতল আরো অন্যন্যাদি সব রাস্তার মধ্যেই পড়ে আছে। জায়গায় জায়গায় কফ থুথু ফেলা। দেখে দেখে হাঁটতে হাঁটতে রাইয়ানের মুখের অবস্থার বারোটা বেজে গেলো। রাস্তার একপাশে দেখলো আবর্জনার স্তুপ। গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার মতো। নাক কুঁচকে এগোতে লাগলো রাইয়ান। একটা বাসের পাশ দিয়ে যেতেই জানালা দিয়ে একটা মহিলা গড়গড় করে রাস্তায় বমি করে দিলো। একটুর জন্য বেঁচে গেলো রাইয়ান। তারও বমির মতো মুখ উল্টে এলো। রাইয়ানের মুখ করুণ হয়ে উঠলো। ভাবতে লাগলো এ কোথায় এসে পড়েছে সে?
অবশেষে একটা খালি সিএনজি দেখে তার কাছে এগিয়ে গেলো রাইয়ান। ঠিকানা বলে সিএনজি ঠিক করে উঠতেই যাবে শো করে তার পাশ দিয়ে একজন দৌড়ে গেলো। রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে হাতের দিকে তাকাতেই দেখে তার কাঁধ ব্যাগটা নেই। রাইয়ানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সামনে তাকিয়ে সেই চোরকে উদ্দেশ্য করে রাইয়ান ‘এই, এই’ বলে চেঁচাতে লাগলো। একটা চায়ের দোকানের সামনে দেখলো দুজন পুলিশ বসা। রাইয়ান গিয়ে তাদেরকে বলল, ‘আমার ব্যাগটা ঐ লোকটা নিয়ে গেছে। প্লিজ কিছু করুন।’
পুলিশদের মধ্যে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। ভুঁড়িওয়ালা পুলিশটা আস্তে ধীরে পাশের জনকে বলল,
‘যা গিয়ে দেখতো।’
সেই পুলিশ একটু দৌড়ে আগালো। আগের পুলিশ রাইয়ানকে এককাপ চা দিতে বলল। রাইয়ান বিভ্রান্তি মুখ নিয়ে বসে চা খেতে লাগলো। তার দৃষ্টি রইলো রাস্তার দিকেই। কিছুক্ষণ বাদে দৌড়ে যাওয়া পুলিশটা ফিরে এসে বলল, ‘চিপায় চইল্যা গেছে স্যার। আর ধরা যাইতো না।’
আগের পুলিশটা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল,
‘ভাগছে।’
রাইয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাদের সামনে দিয়ে চোর দৌড়ে চলে গেলো আর তারা এখানে আরামে বসে আছে। আবার তেমন চেষ্টাও করছে না। রাইয়ান যেখানে থাকে সেখানে তো গাড়ি চালাতে চালাতে স্পিড একটু বেড়ে গেলেও পেছন পেছন পুলিশের গাড়ি এসে পরে। রাইয়ান অবাক স্বরে বলল,
‘আপনারা গাড়ি নিয়ে ঐ চোরের পিছু নিচ্ছেন না কেন?’
সেই পুলিশটা থু করে রাস্তায় গলার কফ ফেলে বললেন,
‘ঐটা আর পাওয়া যাবো না। ঐটায় এখন কোন গলিতে ঢুইকা পড়ছে তার ঠিকাছে! তা, কি ছিল ব্যাগে? টাকা পয়সা অনেক ছিল নাকি?’
‘জ্বি না। আমার জামা কাপড় ছিল শুধু।’
‘জামা কাপড়ের জন্য ওমন উতলা হইয়া উঠছেন! কি মিঁঞা আপনি!’
‘আমার সব ব্রান্ডেড জামা কাপড়!’
‘আচ্ছা যান, এখন ওগুলা মাথা থিকা ঝাইরা ফেলান। ভালো হইছে আপনি আবার ঐ চোরের পিছু নিতে যান নাই। এদের আবার গ্যাং থাকে। একলা পাইলে ছুরি ঢুকায়ে পেট ফুটা করে দেয়।’
রাইয়ান আঁতকে উঠলো। কি সাংঘাতিক! ভুঁড়িওয়ালা পুলিশটা তার ভুঁড়ির উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘আচ্ছা আমরা এখন উঠি। চায়ের বিলডা দিয়া দিয়েন।’
রাইয়ান ভোঁতা মুখ করে চায়ের বিল দিতে গেলো। টাকা দিতে গিয়ে দেখলো তারা এতক্ষণ যে মালাই চা খেলো সেই চায়ের উপর দোকানদার টিস্যু দিয়ে কৌশলে দুধের সর বানাচ্ছে। এবার মাথায় সত্যি সত্যিই একটা চক্কর দিয়ে উঠলো রাইয়ানের।
___________________________________________________
(রাইয়ান)
হৃদি বাংলাদেশে এসেছিল তার ফুপির বাসায়। ফুপির সাথে তাদের কোন যোগাযোগ না থাকলেও হৃদির মায়ের পুরনো টেলিফোনবুকে তার ফুপির একটা নাম্বার ছিল। যেটা হারিয়ে ফেলেছিল হৃদির মা। হৃদির বাবা মায়ের মৃত্যুর পর একদিন বাড়ি ঠিক করতে গিয়ে সেই ফোনবুকটা হাতে আসে হৃদির। কিন্তু কখনো সেই নাম্বারে ফোন দেওয়া হয়নি তার। যত্ন করেই রেখে দিয়েছিল শুধু। এরপর বাংলাদেশে আসার কথা ভেবেই সাহস করেই সেই নাম্বারটায় ফোন দেয় হৃদি। ফোন রিসিভ করে তার ফুপির ছেলে। অনেক বছর পর হৃদির কথা হয় তাদের একমাত্র অবশিষ্ট আত্মিয়ের সাথে। সেখান থেকেই হৃদি জানতে পারে তার ফুপিও আর বেঁচে নেই। দেঢ় বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোকে মারা গেছেন। তবে জীবিত থাকতে তিনি সবসময় তার সন্তানদের বলে গিয়েছেন যদি কখনো তার ভাইয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয় তবে অবশ্যই যেন তারা যত্ন করে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখেন। হৃদির ফুপির পালিয়ে বিয়ে করার পর একপ্রকার অভাবের মধ্যেই ছিলেন তারা। তার স্বামীও তখন ছিল পুরো বেকার। তখন হৃদির বাবাই হৃদির দাদার থেকে লুকিয়ে বোনকে বিদেশ থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। সে কথা ভুলেনি হৃদির ফুপি। এরপর তার স্বামীর ছোট একটা চাকরি হয়। হৃদির দাদা মারা যাবার পরও কিছুদিন যোগাযোগ ছিল তাদের। কিন্তু এরপর ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলায় আর ফোন নাম্বারও হারিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের পথ ছিন্ন হয়ে যায়। যা এতদিন পর আবারও সম্ভব হয়। তাদের সাথে যোগাযোগ করেই হৃদি বাংলাদেশে আসে। তারা থাকে মালিবাগে। সবারই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত।কিছুদিন তাদের সাথেই থেকে ফুফাতো ভাইয়ের সাহায্যে হৃদি একটা বড় এনজিওতে ছোট খাটো একটা চাকরি পায়। বাংলাদেশে এসে হৃদি বুঝতে পারে এদেশে চাকরি পাওয়া আসলে কতটা কঠিন৷ তবুও নিজের আমেরিকার গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট আর ইংরেজি ভাষার দক্ষতার জোরেই এই চাকরিটা পেতে সক্ষম হয় হৃদি। বিশ হাজার টাকা বেতন। হৃদির একার জন্য অবশ্য এতটুকুই যথেষ্ট। এনজিওতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে হৃদি।
এ সব তথ্যই খুঁজে বের করি আমি। জেরিন আমাকে টেক্সট করে হৃদির ফুফাতো ভাইয়ের ঠিকানাটা দিয়েছিল। এর চেয়ে বেশি জানা ছিলো না জেরিনেরও।
সেই ঠিকানা মোতাবেক আমি পৌঁছাই হৃদির কাজিনের বাসায়। সবকিছু একটু জটিল বলে তাদের থেকে হৃদির খবর বের করতে একটু বেগ পেতে হয় আমার। তবে অবশেষে সব খবরই পেতে সক্ষম হই। তাদের থেকেই জানতে পারি হৃদি এই মুহুর্তে আছে সিলেটে। অফিস থেকে একটা ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে কয়েকদিনের জন্য তাকে যেতে হয়েছে। কিছুদিন পর ফিরে আসবে। কিন্তু সেই কদিনের জন্য আর তর সয় না আমার। মন তো চায় এক্ষুণি ছুটে যাই হৃদির কাছে। তার সামনাসামনি হই। দুচোখ ভরে তাকে দেখি। বহুদিন পর আমার কর্ণ গহ্বরেও পৌঁছাক হৃদির মিষ্টি কণ্ঠ। যার জন্য এতদিন ধরে চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি আমি।
আমি সেদিনই সিলেটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। কিন্তু সিলেটে গিয়ে বুঝতে পারি এখনো হৃদি অবধি পৌঁছাতে আমার অনেকটা পথ বাকি। কারণ এতো বড় শহরে হৃদি কোথায় আছে আমি জানে না। সে রাতটা অজ্ঞাত থেকেই কাটাতে হয় আমাকে। সারা রাত ঘুম আসে না। বিছানায় এদিক ওদিক করে নির্ঘুম সময় কাটাতে থাকি হোটেলের বদ্ধ কামরায়। অপেক্ষার প্রহর খুব দীর্ঘ মনে হয়। একসময় সকাল হয়। আমি বেরিয়ে পড়ি হৃদিকে খোঁজার অভিযানে। টাকা দিয়ে এ ব্যাপারে একটা দক্ষ লোক ঠিক করি। হৃদির অফিসের থেকে খবর বের করে জানতে পারি কোন একটি পাহাড়ি এলাকাতেই আছে তারা। গাড়ি দিয়ে সারাদিন ছুটতে থাকি এদিক ওদিক। তবুও হৃদি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। প্রতিটা মুহুর্তে এতোটা অসহায় বোধ হতে থাকে! একই শহরে দুজন আছি। অথচ তার নাগাল পাচ্ছি না। মানুষের পর মানুষ ধরে ঘুরে ঘুরে অবশেষে সঠিক অবস্থানটা জানতে পারি। তখন শেষ বিকেল। হৃদি আর বাকিরা যে বাসা নিয়ে আছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই আমি। হৃদি তখন সেখানে ছিল না। একটা বাচ্চা ছেলে হৃদি পর্যন্ত আমাকে পৌঁছাতে আমার সাথে যায়। আমার বুকের মধ্যে ধকধক করতে থাকে। একেকটা সেকেন্ডও ঘন্টার মতো মনে হয়। বাচ্চাটার পেছনে পেছনে একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠি আমি। বাচ্চাটি হাত দিয়ে সামনে ইশারা করেই চলে যায়। সামনে তাকাতেই আমি থমকে যাই। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের ধোঁয়াশার সামনে একটা সরু গাছের নিচে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে হৃদি। তার পরনে সাদা রঙের সেলোয়ার কামিজ। বাতাসে পিঠ জুড়ানো খোলা চুলের সাথে সাথে ওড়নাটাও মৃদু মৃদু উড়ছে। আমার কল্পনা নয়। সব বাস্তব। আমার চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে হৃদি। আমার মনে হলো আমার হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেছে। গলার কাছটায় জমে আসছে সমস্ত আবেগ। থমকে আসে পুরো পৃথিবী। এমন সময় হৃদি আনমনে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখ পড়ে আমার দিকে। একটা ধাক্কার মতো খায় সে। নিজের চোখকে হয়তো বিশ্বাস হয় না। গলা দিয়ে নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বের হয়,
‘রাইয়ান!’
আমি ঝড়ের বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরি হৃদিকে। অনেকদিন বাদে যেন দম নেবার স্বাদ পাই। অশান্ত মনকে প্রশান্তি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবেই যেন নিজের শরীরে প্রাণ ফিরে পাই আমি।
চলবে,