#My_First_Crush
#পর্ব-১৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
ফ্লোরিডার মায়ামিতে রাতের শহরটা দেখতে অন্যরকমই সুন্দর। রাস্তাঘাটে আনাচে কানাচে জ্বলজ্বল করছে লাইটের আলো। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল দালানগুলোও প্রজ্বলিত হয়ে আছে রং বেরঙের আলোতে। রাতের নিকষ আলো অন্ধকারকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে এ যেন আলোরই মেলা। যা অন্ধকারকে আরো সুন্দর করে রাঙিয়ে দিয়েছে। এমনই এক হাইওয়ে ধরে গাড়িতে করে যাচ্ছি আমরা। রাইয়ান ড্রাইভ করছে আর আমি তার পাশের সিটে বসে আছি। আমরা যাচ্ছি মি. অ্যান্ড মিসেস ডেভিডের ওয়েডিং এনিভারসিরি অনুষ্ঠানে। শহরের মধ্যেই একটা হোটেল বুক করে আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। রাইয়ান তো আসতেই চাইছিল না। বলা বাহুল্য তাকে রাজী করাতে আমাকে অনেক কাঠখোর পোড়াতে হয়েছে। নেইবারদের ইনভিটেশন বলে কথা! না গিয়ে কিভাবে পারি! আর তার চাইতেও বড় কথা, আমি শুনেছি সেখানে কাপলদের জন্য অনেক স্পেশাল একটিভিটির আয়োজন করা হয়েছে। দারুণ মজা হবে! তাই তো, যেভাবেই হোক রাইয়ানকে রাজী করেই ছেড়েছি। আজ আমি পরেছি একদম হালকা বেগুনি রঙের লং গাউন। চুলগুলো পেছনে ফ্রান্স বেণী করে রাখা। সেখানে গোজা সাদা ছোট ছোট পাথরের ক্লিপ। গলার সাথে লাগানো খুবই সিম্পল পাথরের একটি নেকলেস৷ আর রাইয়ানের পরনে কালো ব্লেজার স্যুট। তাকে দেখতে খুবই হ্যান্ডসাম লাগছে। একদম জেন্টেলম্যান। তিনি যা পরেন তাকে ঠিক সব রঙেই মানিয়ে যায়। আমি গাড়ির জানালাটা নামিয়ে দিলাম। বাতাসে ছোট ছোট চুলগুলো আমার মুখের সামনে এসে উড়তে লাগলো। আমি হাত দিয়ে তা একটু সরিয়ে দিলাম। রাস্তার লম্বা দূরত্বও আমি বেশ উপভোগ করতে পারলাম। বুঝতে পারলাম, কেন সিনেমায় প্রিয় মানুষের সাথে রাতের শহরে লং ড্রাইভের ব্যাপারটা হাইলাইট করা হয়। যদিও আমাদেরটা লং ড্রাইভ হলো না। খানিক বাদেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের ভেতরে ঢুকলাম আমরা। মি. অ্যান্ড মিসেস ডেভিড আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন। রাইয়ান তাকে একটা বড় ফুলের তোলা দিয়ে উইশ করলো। আমরা ভেতরে গেলাম। খুব সুন্দর করে ভেন্যু সাজানো হয়েছে। হালকা সফট একটা মিউজিক প্লে করা রাখা। আমি আর রাইয়ান একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। আশেপাশে তাকিয়ে অনুষ্ঠানের সাজ সজ্জা দেখতে লাগলাম আমি। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের লোকই বেশি। অনেক চেনা পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমি হাসিমুখে তাদের হাই বলতে লাগলাম। রাইয়ান ওয়েটারের থেকে দুটো সফট ড্রিংকস নিলো। আমি রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাইয়ান ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঠোঁট চেপে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম তার দিকে।
তেমন সময় স্টেজে কাপলদের ডান্সের জন্য ডাকা হলো। মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আমার। আমি রাইয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তার হাত টেনে স্টেজে নিয়ে আসলাম তাকে। রাইয়ান আশেপাশে তাকিয়ে স্মিত হেসে আমার কোমরে এক হাত আরেক হাত আমার হাতে রাখলো। আমিও আমার এক হাত রাইয়ানের কাঁধে তুলে দিলাম। সবার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও স্লো মোশনে ডান্স করতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের অনেক নেইবার আমাদের কাছে চলে এলে তারা প্রত্যেকই আমাকে নাম ধরে ডাকতে লাগলো। আমিও তাদের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করতে লাগলাম। মিস. গোমজ আমাকে দেখে বললেন,
‘হেই হৃদি, তোমাকে খুবই মিষ্টি দেখতে লাগছে।’
আমি মৃদু হাসলাম। রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি তো দেখি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে পপুলার হয়ে গেছো। সবাই তোমাকে চেনে।’
ডান্সরত অবস্থায় রাইয়ান আমাকে হাত দিয়ে একবার ঘুরিয়ে আনলে আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘অবশ্যই।’
রাইয়ান ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘কিভাবে করলে?’
আমি বললাম, ‘ম্যাজিক।’
রাইয়ান হেসে ফেললো। আমি বললাম,
‘যা বুঝলাম প্রথমবার হলেও আমি বেশ ভালোই ডান্স করতে পারি।’
রাইয়ান ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘ওটা তো আমি আগেই জেনেছি।’
আমি মৃদু মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘তুমি আবারো ঐ কথা উঠাচ্ছো!’
রাইয়ান তাড়াতাড়ি সিরিয়াস হয়ে বলল,
‘মুখ ঠিক করে রাখো। ছবি তুলছে।’
আমি ঝটপট স্বাভাবিক হয়ে মুখ হাসিখুশি করে রাখলাম। পরক্ষণেই রাইয়ানের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলাম রাইয়ান মিথ্যা বলেছে। আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম রাইয়ানের দিকে। হঠাৎ আমার পায়ে ব্যাথার মতো লাগলো। মুখে মৃদু শব্দ করে উঠলাম আমি। রাইয়ান আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে?’
তারপর আমাকে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে একটা টেবিলে বসালো। আমি মানা করলাম। রাইয়ান শুনলো না। আমার পা থেকে হাইহিল খুলে দেখলো পা লাল হয়ে ফুলে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এসব পরে যখন তুমি কম্ফোর্ট ফিল করো না তাহলে পরো কেন?’
আমি হড়বড় করে বললাম ‘সমস্যা নেই। আজকে তো অমন উঁচু পরিনি। এতটুকুতে আমি ম্যানেজ করতে পারি।’
রাইয়ান বাইরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হাতে এক জোড়া স্নেকার্স নিয়ে। আমার পায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাগ্য ভালো গাড়িতে আমার এক জোড়া স্নেকার্স ছিল। একটু বড় হবে। কিন্তু এখনের মতো এটাতেই চালিয়ে নাও।’
রাইয়ান আমার জুতোর ফিতা লাগিয়ে দিতে লাগলো। আমি হাসিমুখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। জুতা পরা শেষ হলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে দেখালাম তাকে। আমার পায়ে তার সাইজ অনেক বড় দেখাতে লাগলো। তবুও চলবে। এমন সময় স্টেজে কাপলদের জন্য একটা গেমের কথা বলা হলো। গেমের তিনটা ধাপ থাকবে। শেষ পর্যন্ত যে বেশি স্কোর নিয়ে টিকে থাকবে তাদেরকে বেস্ট কাপলের পুরষ্কার দেওয়া হবে। আমি খুব এক্সাইটেড হয়ে পড়লাম। রাইয়ান আমার অবস্থা দেখে বলল, ‘কি? আমরা কিন্তু খেলছি না। এসব আমি কখনো খেলিনি।’
আমি মুখ করুণ করে বললাম, ‘আমিও তো খেলিনি। একারণেই তো খেলা উচিত। মজা হবে অনেক। প্লিজ রাইয়ান!’
‘কিন্তু তোমার না পায়ে ব্যাথা।’
‘ইশ! এতটুকুতে আবার কি হয়! আমার তো এখন কিছু লাগছেও না। প্লিজ চলো না রাইয়ান!’
শেষমেশ রাইয়ান আমার জোরাজুরিতে পরে রাজী হলো। আমরা সবাই গিয়ে এক সারিতে দাঁড়ালাম। প্রথম ধাপে গেম হলো হাজবেন্ডরা একটা ঝুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর ওয়াইফরা অনেক দূর থেকে সেই ঝুড়িতে বল ছুরে মারবে। হাজবেন্ডরা সেই বল ঝুড়ি নিয়ে ক্যাচ করার চেষ্টা করবে। যার ঝুড়িতে যত বেশি বল হবে তার স্কোর তত বেশি। একসময় গেম শুরু হলো। আমি বল ছুড়ে মারতে লাগলাম। রাইয়ান ঝুড়ি নিয়ে ক্যাচ করার চেষ্টা করতে লাগলো। কয়েকটা বল নিচে পড়লেও বেশ অনেকগুলো বলই ঝুড়িতে জায়গা পেলো আমাদের। স্কোরও পেলাম ভালো। অনেকেই প্রথম রাউন্ডে বাদ পরে গেলো। আমরা দ্বিতীয় রাউন্ডে গেলাম। আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এক্সাইটেড হয়ে পড়লাম। রাইয়ান প্রথমে মানা করলেও এখন মনে হচ্ছে সেও গেম টা বেশ ইনজয় করছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ওয়াইফদের চোখ একটা কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো। আর সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করানো হলো হাজবেন্ডদের। এক্ষেত্রে পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকে ওয়াইফকে তার হাজবেন্ড শনাক্ত করতে হবে। এই রাউন্ডেও অনেকে ভুল শনাক্ত করে ব্যর্থ হলো। আমি ঠিকই আমার রাইয়ানের ঘ্রাণ শুঁকে এক সেকেন্ডেই তাকে চিনে ফেললাম। তাকে চিনতে পারবো না আমি!এও কখনো সম্ভব! আমরা সহ আরো দুটি কাপল ফাইনাল রাউন্ডে গেলো। আমি লাফিয়ে উঠে রাইয়ানের সাথে হাইফাইভ করলাম।
এরপর শুরু হলো তৃতীয় রাউন্ড। শুরুতেই আমাদের আলাদা করে সবার হাতে একটা কাগজ দিয়ে শুন্যস্থান পূরণ করতে বলল। পূরণ করা শেষ হলে কাগজটা জমা নিয়ে নিলো তারা। এরপর একে একে কাপলদের মুখোমুখি বসিয়ে মাঝখান থেকে একজন হোস্ট একে অপরের পছন্দ অপছন্দের জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো। প্রত্যেকের জন্য পাঁচটা প্রশ্ন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি কাপলের হাতে আছে দশ নাম্বার। আমাদের আগে যে দুই কাপলকে প্রশ্ন করা হলো তারা কেউ কেউ পাঁচের মধ্যে চারটা, তিনটা আবার দুইটা এরকম সঠিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো। শেষমেশ পালা এলো আমাদের। রাইয়ান ওপাশ থেকে আর আমি এপাশ থেকে এসে মুখোমুখি চেয়ারে বসলাম। প্রথমে প্রশ্ন করা হলো আমাকে। হোস্ট আমাকে উদ্দেশ্য করে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো,
‘তো চলুন মিসেস হুদি এবার শুরু করা যাক।’
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। হোস্ট প্রশ্ন করলো,
‘মি. রাইয়ানের পছন্দের রং কি?’
আমি রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে উত্তর দিলাম, ‘ব্লাক।’
‘মি. রাইয়ানের পছন্দের খাবার?’
‘লাজানিয়া।’
‘মি. রাইয়ান কিসের ঘ্রাণ সবথেকে বেশি অপছন্দ করেন?’
‘কাপর চোপরে নেপথলিনের ঘ্রাণ। উনি খুবই অপছন্দ করেন।’
‘মি. রাইয়ানের পছন্দের কাজ কি?’
‘গিটার বাজানো।’
‘পছন্দের ফুল?’
‘হোয়াইট লিলি।’
এক নিঃশাসে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেললাম আমি। এবং পাঁচটার মধ্যে পাঁচটাই সঠিক বললাম। সবাই ইমপ্রেসড হয়ে হাত তালি দিলো। উইনার হওয়ার ধাপে সবার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেলাম আমরা। এবার রাইয়ানের পালা। হোস্ট সবার প্রথমে কঠিন প্রশ্নটাই রাইয়ানকে করলো,
‘মিসেস হৃদি কিসের ঘ্রাণ সবথেকে বেশি অপছন্দ করেন?’
রাইয়ান কিছুক্ষণ ভেবেও কিছু বলতে পারলো না। আমি ঈষৎ ঠোঁট ফুলিয়ে হেসে ফেললাম। হোস্ট দ্বিতীয় প্রশ্নে চলে গেলো। ‘মিসেস হৃদির ফেভারিট কাজ কি?’
রাইয়ান এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলো না। সবাই একটা আফসোসের সুর তুললো। এরপর তৃতীয় প্রশ্ন,
‘মিসেস হৃদির পছন্দের ফুল?’
রাইয়ান ইতস্তত করতে লাগলো। এবার আমার মুখের হাসিও ধীরে ধীরে মলিন হতে লাগলো। খানিক অবাক হলো চোখের দৃষ্টি। হোস্টের কন্ঠের এক্সাইটমেন্টও সরে গিয়ে নেতিয়ে পড়লো। সে ধীর গলায় প্রশ্ন করতে লাগলো,
‘পছন্দের খাবার?’, পছন্দের রং?’
তিনি একে একে প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন। রাইয়ান কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলো না। হুট করেই সবাই একদম নিশ্চুপ হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ রাইয়ানই প্রথম যে তার পার্টনারের সম্পর্কে কোন কিছুই জানে না। সেই রাউন্ডে অন্য আরেক কাপল উইনার ঘোষিত হলো। অনুষ্ঠান শেষ হলে যে যার মতো চলে যেতে লাগলো। চলে আসলাম আমরাও৷ হুট করেই পরিবেশটা কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠলো। গাড়িতে ফেরার পথেও দুজনের মধ্যে কেউ কোন বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। দুজনেই একদম নিশ্চুপ।
চলবে,