#My_First_Crush
#পর্ব-২৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
সদ্য ভোর। আলো ফোটার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবে। পাখিরা সকাল হবার বার্তা এই দিবে দিবেই। রাইয়ান ঘুমু ঘুমু চোখ জোড়া মৃদু খুলতেই দেখলো হৃদি তাকে ডাকছে সমানে। রাইয়ান নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ডাকলো, ‘হৃদি!’ হৃদি তার স্বভাবসুলভ নম্র হাসি মুখে এঁকে আঙ্গুল ঠোঁটে রেখে ইশারা করলো, ‘হুশ!’
গাড়ি ছুটলো রাস্তায়। একটি ক্যাব ভাড়া করে নিয়েছে তারা। রাইয়ান এখনো অজ্ঞাত। কোথায় যাচ্ছে জানে না। প্রশ্নের চাইতেও ভাবুক বেশি সে। ভাবনাটা হৃদিকে নিয়ে। সেই হাস্যজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল হৃদি। রাইয়ানের সাথে হাসছে, কথা বলছে। রাইয়ানের একবার মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। নয়তো কিভাবে সম্ভব?
হৃদিকে দেখে মনে হচ্ছে বিগত কয়েকদিনের সবকিছু সে ভুলে গেছে। কখনো তাদের মধ্যে নিরবতার দেয়াল এসে দাঁড়িয়েছিল তা এক গল্প ছিল মাত্র। রাইয়ান বেশি কিছু জিজ্ঞেসও করলো না, জানতেও চাইলো না। হৃদি তার সাথে আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে এতেই মন প্রসন্ন হয়ে উঠলো তার। গাড়ি ছুটলো দূরন্তর।
ক্যাব যখন এয়ারপোর্টের সামনে এসে থামলো তখন সত্যি সত্যিই চকিত হলো রাইয়ান। কৌতূহল গাঢ় হলো তার। এয়ারপোর্টে ঢুকতেই সে হৃদিকে টেনে জিজ্ঞেস করলো, ‘হৃদি এবার তো বলো কোথায় যাচ্ছি আমরা? এয়ারপোর্টে এসেছি কেন?’
হৃদি হেসে বলল, ‘জাদুর রাজ্যে।’
রাইয়ান বুঝতে পারলো না। হৃদি এগিয়ে গেলো। বিধায় পিছু যেতে হলো রাইয়ানকেও। চেকিং হবার আগে রাইয়ান হৃদিকে বলল,
‘আমি যাবো কিভাবে? আমি তো পাসপোর্ট টাসপোর্ট কিছুই আনিনি!’
হৃদি বলল, ‘ওহ হো! আমি সব কিছু নিয়েই এসেছি। আমাকে কি এতো বোকা মনে হয় তোমার? এগুলো না নিয়ে এয়ারপোর্টে আসবো।’
সবশেষে অরল্যান্ডোর বিমানে গিয়ে বসলো তারা। রাইয়ান এখনো বুঝতে পারলো না তারা অরল্যান্ডো কেন যাচ্ছে। হৃদি খুবই এক্সাইটেড। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে। রাইয়ান কৌতূহল সংযত রাখলো। পৌঁছাবার আগে আর জানার উপায় নেই। একঘন্টা আর কিছু সময় নিয়ে বিমান অরল্যান্ডোতে গিয়ে পৌঁছালো। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আবারো একটা ক্যাব নিলো হৃদি। কোথায় যাবে জানতে চাইলে সে ড্রাইভারকে স্মিত হেসে বলল, ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড।’
রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি দুচোখে পলক ফেলে একটু হাসলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। পথে ডিজনির থিম নিয়ে বড় একটি সাইনবোর্ড দেখতে পেলো রাইয়ান। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলো সেখানে। শুরুতেই নয়নাভিরাম একটি বৃহৎ হৃদ বা লেক। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা। ডিজনিওয়ার্ল্ডকে মাঝখানে রেখে সেটি মাইলের পর মাইল বিস্তৃত। এই হৃদ অতিক্রম করে ডিজনিওয়ার্ল্ডে যাবার উপায় দুটো। একদি ফেরি, অপরটি ট্রেন। হৃদ থেকে একশো ফুট উপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনেই হৃদি আর রাইয়ান উঠলো। নিচে থৈ থৈ পানি। তার মাঝে তৈরি করা ছোট ছোট দ্বীপ, ঝোপঝাড়, বন। পাঁচ মিনির পরেই ট্রেন পৌঁছে যায় ডিজনিওয়ার্ল্ডে। বিরাট তোরণে লেখা দেখা যায় ‘ম্যাজিক কিংডম।’
অসংখ্য মানুষ। চারপাশে গিজগিজ করছে। রাইয়ান হৃদিকে সাইডে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমরা এখানে এসেছি কেন হৃদি?’
হৃদি হেসে বলল, ‘শৈশবে ঝাপ দিতে।’
রাইয়ান বুঝতে পারলো না। হৃদি বলল,
‘তুমি না বলেছিলে তুমি তোমার শৈশব ঠিকমতো উপভোগ করতে পারোনি। তাই আজ আমরা টাইম মেশিনে করে শৈশবে ফেরত যাবো।’
রাইয়ান কনফিউজড হয়ে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি হেসে রাইয়ানকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। রাইয়ান বিস্মিত দৃষ্টিতে চারপাশ দেখতে লাগলো। বাচ্চাদের ভাবনার মতোই এতো এক স্বপ্নপূরী! মিকি মাউজ, মিনি মাউজ, টিংকা বেল, এলসা-আনা, রূপানজেল, স্নো হোয়াইট, সফিয়া, ডনাল্ড, সিন্ডারেলা, ডেইজি প্রভৃতি চরিত্রদের রূপকথার জগৎ। আর ক্যাসলগুলোর সৌন্দর্য তো চোখ ধাঁধানোর মতো। রূপকথার গল্পের বইয়ের পাতায় ঢুকে পড়েছে যেন তারা। সবকিছু একদম সেরকমই। বিস্ময় ভাঙার আগেই শুনতে পেলো এখন প্যারেড শুরু হবে। সবাই একটি যুৎসই জায়গা দেখে দখল করে বসে আছে। হৃদি আর রাইয়ানও গিয়ে দাঁড়ালো। ডিজনি জুনিয়রে দেখানো বিভিন্ন ক্যারেক্টার নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো প্যারেড। নাচে গানে বিভিন্ন অঙ্গিভঙ্গি করে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। টিংকার বেল আসতেই হৃদি একটা চিৎকার দিয়ে উঠে। রাইয়ান ঝট করে তাকায় হৃদির দিকে। পরক্ষণেই চোখ নেয় প্যারেডে। এই প্যারেড এক বিস্ময়কর ব্যাপার। না দেখে থাকলে ভাষায় বোঝানো মুশকিল। একে একে বিভিন্ন প্রিন্স প্রিন্সেস সাজ সজ্জা ধারী গান গাইতে লাগলো, নাচতে লাগলো। ফ্লউড এর উপর থেকে হাত ইশারা করে নাড়াতে লাগলো তারা। সবাইকে অভিভূত করে রেখে শেষ হলো প্যারেড। রাইয়ানের দিকে ঘুরে হৃদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন?’
রাইয়ান স্মিত হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’
‘বলেছিলাম না দারুণ লাগবে। দেখলে, কত সুন্দর সবকিছু। মাত্র তো শুরু। এখনও আরও অনেককিছু বাকি আছে।’
সত্যি বলতেই রাইয়ানের খুব ভালো লাগতে লাগলো। বহুদিন পর মনটা হালকা হয়ে এলো তার। যতোটা না এর জন্য তার চাইতেও বেশি হৃদির জন্য। হৃদি তার সাথে আবারও আগের মতো কথা বলছে এই ব্যাপারটাই সবথেকে প্রশান্তি দিলো রাইয়ানকে। রাইয়ানের মনে হতে লাগলো বিগত মাসটি একটি খারাপ স্বপ্ন ছিল। ঘুম ভাঙতেই এখন সে আবার বাস্তবে ফিরে এসেছে। এই তো এরকমই সব ছিল। কিচ্ছু বদলায়নি। আগের মতোই আছে জীবন। আগের মতোই হৃদি।
কিছুদূর এগোতেই তারা একটি বিল্ডিংয়ের সামনে লম্বা লাইন দেখতে পেলো। একটি কাঁচের বাক্সে করে কাঁচের জুতো রাখা আছে সেখানে। সিন্ডারেলার হারিয়ে যাওয়া জুতো। আরেকটু এগিয়ে একটা কক্ষে ঢুকতেই ওরা দেখতে পেলো সিন্ডারেলা। একদম পুতুলের মতো দেখতে হলেও পুতুল নয় কিন্তু। রক্ত মাংসের মানুষ। সিন্ডারেলার বেশে সেজে আছে। রাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে সিন্ডারেলা হৃদিকে বলল,
‘হি মাস্ট বি ইউর প্রিন্স চার্মিং!’
হৃদি ঝট করে রাইয়ানের দিকে তাকালো। সিন্ডারেলার দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃদু। ছবি তুললো সিন্ডারেলার সাথে। সিন্ডারেলা রাইয়ানকেও তাদের সাথে জয়েন করতে বলল। হৃদি, রাইয়ান আর সিন্ডারেলা মিলে ছবি তুললো একটা। বাইরে বেরিয়ে এলো। এরপর গেলো মিকি মাউজের সাথে দেখা করতে। এর জন্য লাইনে দাঁড়াতে হলো প্রথমে। অবশেষে মিললো সুযোগ। মিকি মাউজ বাড়ির দরজা খুলে হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলো। হৃদি তো সেই খুশি! ছোটবেলায় তার খুব পছন্দের একটা ক্যারেক্টার ছিল মিকি মাউজ। হৃদি কাছে যেতেই মিকি মাউজ তাকে হাগ করতে উদ্যত হলো। তার আগেই হৃদিকে ধরে ফেললো রাইয়ান। তাকে পেছনে টেনে কানে কানে বলল,
‘এই, কে না কে! ভেতরে ছেলেও তো হতে পারে।’
হৃদি জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তুমি কি এতক্ষণ ধরে সবকিছু এভাবেই ভাবছো? মানছি এরা সাজানো। কিন্তু এভাবে ভাবলে কি মজা পাবে?’
‘তাহলে কিভাবে ভাববো?’
‘অবশ্যই সত্যি ভাববে। এই যে দেখছো, এখন ভাবতে হবে এটা সত্যি মিকি মাউজই। তাহলেই তো মজাটা পাবে। ট্রাই করো।’
রাইয়ান উসখুস করে এগোলো মিকির দিকে। হঠাৎ মিকি এসে রাইয়ানের হাত ধরে বাচ্চাদের মতো নাচাতে থাকে। হাসতে থাকে হৃদি। কিছুক্ষণ বাদে হৃদিও যোগ দেয় ওদের সাথে। এবার সত্যিই ইনজয় করে রাইয়ান। বিদায় বেলায় মিকি রাইয়ানের গাল টেনে দেয়। সেই ছবিটা ঝট করে ক্যামেরায় তুলে ফেলে হৃদি। রাইয়ান বলতে থাকে, ‘হৃদি ডিলিট করো।’ হৃদি শুনে না।
ডিজনি ওয়ার্ল্ডে ব্যবস্থা করা আছে অনেক মন মাতানো রাইডের। একেকটির সামনে মানুষের বিশাল বিশাল লাইন। তার মধ্যে নৌকার একটি রাইড আছে। গল্পের বইয়ের মতো পাল তোলা ছোট ছোট নৌকা। একেকটিতে আটজন করে বসছে। একটি ইনডোর ঘরের মধ্যে তৈরি করা একটি স্বপ্নীল জগৎ। সেই জগতে বিচরণ করানো হচ্ছে এই নৌকার ভাসিয়ে। হৃদি ফার্স্ট পাস জোগাড় করে নিলো। ফলে তাড়াতাড়িই বসতে পারলো তারা রাইডে। কোন মাঝিমাল্লা ছাড়াই নৌকা আপনাআপনি চলতে শুরু করলো আর্টিফিশিয়াল নদীতে। রাইয়ানের মনে হলো তারা যেন দিন থেকে রাতে প্রবেশ করছে। সবকিছু সেভাবেই সাজানো। ক্যানেলের দু ধারে হাজার হাজার বিভিন্ন আদলে তৈরি পুতুল। নাচছে, গাইছে। অসাধারণ আলোকসজ্জা। চারদিকে বাজছে সুরের ঝংকার। ‘ইট’স এ স্মল ওয়ার্ল্ড’ গানটি বাজতে থাকে। রাইয়ানের চোখে স্পষ্ট বিস্ময়। সামনে যতো এগোতে থাকে ততোই যেন বাড়তে থাকে। এর মধ্যে পাশে উপরে তাকাতেই দেখতে পায় ম্যাজিক কার্পেট। অন্ধকার আকাশে যেন সত্যি সত্যিই ভাসছে। ছোট আরাবিয়ান প্রাসাদও দেখা যায় সেখানে। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। এতো এতো পুতুল! কোনটা রেখে কোনটা দেখবে! নৌকায় থাকা বাচ্চাগুলো আনন্দে চেঁচাতে থাকে। রাইয়ানের হুট করে মনে হয় সে যেন আসলেই শৈশবে ফিরে গেছে। সেই না পাওয়া অনুভূতিগুলো উপভোগ করছে। আর এই সব কৃতিত্ব একটি মানুষের।
নৌকার রাইড থেকে বের হয়ে তারা আরো একটি রাইডে চড়ে। তার নাম ‘সেভেন ডুয়ার্ফস মাইন ট্রেন।’ সেই সাত বামনের রাজ্যের আদলে তৈরি। রাইডটি একটি রোলার কোস্টার রাইড। রাইয়ান আর হৃদি শক্ত করে বসে থাকে। রোলার কোস্টার চলতে শুরু করে। এই দুম করে স্পিডের সাথে উপরে উঠে পড়ে আবার সাথে সাথেই ঠাস করে নিচে পড়তে থাকে। শরীর থেকে প্রাণ বের হয়ে যায় যায় অবস্থা। কিন্তু বের হয় না। শুরু হয় রাইয়ান আর হৃদির গগনবিদারী চিৎকার। সাথে এক চাপা আনন্দ। দারুণ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। পাথর বসিয়ে তৈরি পাহাড়ের গায়ে গায়ে আঁকাবাকা রাস্তার উপর দিয়ে চলতে থাকে রোলার কোস্টার। কখনো জঙ্গলে, কখনো ঢুকে যায় পাহাড়ের মধ্যকার গুহার ভেতরে। সেখানে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকে সহস্র হীরা-মানিক, কোহিনূর। দেখা যায় গল্পের বামুনদের। একটি কুড়াল হাতে সেগুলো খোদাই করছে যেন তারা। সুরের সাথে সাথে নড়ছে। তারপর আবারো সেই চড়াই উৎরাই। জীবনে প্রথমবার রাইয়ান আসলেই প্রাণ খুলে হাসে। এতো এতো আনন্দ, বেঁচে থাকার সঠিক অনুভূতি উপলব্ধি করে। আরো অনেক অনেক আনন্দকর মুহুর্ত কাটায় তারা। কালারফুল ক্যান্ডি খাওয়া, তারপর জিভ বের করে দেখা, বাবলস উড়ানো। স্বপ্নের মতো কাটতে থাকে দিনটি। রাইয়ান একটা ক্যামেরা নিয়ে আশেপাশের ছবি তুলতে থাকে। সিন্ডারেলার নয়নাভিরাম নীল ক্যাসলের দিকে ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে এনে তাক করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা হৃদির দিকে। জুম করে। তারপর আস্তে করে একটা ক্লিক। চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে চেক করে ছবিটা। আলতো করে হৃদির দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। যেই হাসিতে ফুটে উঠে এক লুকায়িত আবেগ।
রাত হতেই সেখানকার আলোকসজ্জা দেখার মতো দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকা আলো। রাজপ্রাসাদ ধারণ করে আরেক সৌন্দর্য। শোনা যায় একটুপরই ক্যাসলের পেছন থেকে ফায়ারওয়ার্ক্স শুরু হবে। সবাই একটি জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। হৃদি আর রাইয়ানও গিয়ে দাঁড়ায় প্রাসাদের সামনে। ম্যাজিক কিংডমের লাইটগুলো আস্তে আস্তে কমিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে একটা শব্দ তুলে আকাশে ফুটে আতশবাজি। তারপর একের পর এক ফুটতেই থাকে। শুরু হয় রাতের আকাশে রং বদলকারী আলোর কারসাজি। সেই আলোতে মুহুর্তে মুহুর্তে কখনো গোলাপি, কখনো নীল, কখনো সবুজ এভাবে বিভিন্ন রং ধারণ করতে থাকে প্রাসাদটি। সে এক অন্যরকমই দৃশ্য। রাইয়ান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে থাকে। জীবনে সে ফায়ারওয়ার্ক্স অনেক দেখেছে। কিন্তু এতো সুন্দর ফায়ারওয়ার্ক্স কখনো দেখেনি। তার চোখ যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ে। আজ সারাদিনের সব সুখ মৃদু সুর তুলে মনে। এমন সময় হৃদি পাশ থেকে আস্তে করে ডেকে উঠে, ‘রাইয়ান!’
রাইয়ান অভিভূত দৃষ্টি নিয়ে পাশে তাকায়। হৃদি মিষ্টি হেসে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে!’
রাইয়ান কিছুই বলে না। নির্নিমেষ তাকিয়েই থাকে। আতশবাজির বাহারী আলো আভা ফেলেছে হৃদির চোখেমুখেও। সেই আভার রেশ ধরেই আরো এক অপার্থিব জগতের সন্ধান পায় রাইয়ান। একটা দুটো শব্দ তুলে মাথার উপরে এখনো ফুটছে ফায়ারওয়ার্ক্স। হাজার হাজার লোক হারাতে থাকে রাতের আকাশের আলোকসজ্জায়। আর রাইয়ান হারায় হৃদির চোখের মায়ায়।
___________________________________________________
ডিজনিওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়ে ফ্লাইট নিয়ে মায়ামি ফিরে আসে রাইয়ান ও হৃদি। এরপর সরাসরি বাসায়। আজকের দিনটির কথা ভাবতে ভাবতেই বাসায় ঢুকে লাইট অন করতেই আরেকটি চমক পায় রাইয়ান। ঘরভর্তি মানুষ। সবাই এক যোগে বাঁশি বাজিয়ে, বেলুন ফাটিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলে উঠে রাইয়ানকে। রাইয়ান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনে এরকম চমক কখনো পায়নি সে। রাইয়ানের বন্ধু, কলিগ, নেইবার সবাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। পুরো বাসা বেলুন দিয়ে সাজানো। বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে রাইয়ান পাশে তাকাতেই দেখে হৃদি নেই। এমন সময় ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!’ এর একটা মৃদু সুর ভেসে আসে কানে। সেই অনুসরণে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় একটি তিন তলা কেক হাতে নিয়ে হৃদি হাসিমুখে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। রাইয়ান অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। হৃদি কেকটি এনে মাঝখানের টেবিলে রাখে। রাইয়ানের এক পুরনো বন্ধু এসে টেনে নিয়ে যায় তাকে। এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পায় রাইয়ান। সবার কথার প্রতিউত্তরে হেসে ধন্যবাদ জানাতে থাকে। তবুও বারবার তার চোখ শুধু খুঁজে ফিরে হৃদিকে। এরকম ভাবে বার্থডে সেলিবেট কখনো হয়নি তার। সবসময় সবকিছু খুব ছিমছাম ভাবেই কেটেছে। রাইয়ানের খুব ভালো লাগতে থাকে। পুরো বাড়ি মুখরিত হয়ে আছে মানুষের হাসি কথায়। কতো পুরনো বন্ধুদের সাথেও দেখা। সবাই আজ এসেছে শুধু রাইয়ানের জন্য। অনেক অনেক মজা করতে থাকে সবাই। কম কথা বলা ছেলেটার মুখ থেকে আজ হাসি সরছেই না। সবাই অনেক অনেক গিফট দেয় রাইয়ানকে। দাদীমার পায়ে ব্যাথা থাকায় তিনি আসতে পারেন না। কিন্তু ভিডিও কল দিয়ে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানায় রাইয়ানকে। রাইয়ানের চোখেমুখে আজ নির্মল হাসি। এর মাঝে একজন কেক কাটার কথা তুলতেই রাইয়ানকে নিয়ে দাঁড় করানো হয় মাঝখানে। কিন্তু কেক কাটার জন্য ছুরি খুঁজে পায় না। একটা হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। হৃদি চিন্তিত মুখে বলতে থাকে, ‘একটু আগেও তো হাতে ছিল, কোথায় যে রাখলাম!’
এমন সময় একটা ভারী কন্ঠ শোনা যায়, ‘তোমরা কি সবাই এটা খুঁজছো?’
মুহুর্তের জন্য পিনপতন নিরবতা। সবাই সামনে তাকায়। লং কোর্ট পরিধিত একজন মধ্যবয়স্ক লোককে দেখা যায়। হাত বাড়িয়ে কেক কাটার ছুরিটা দেখাচ্ছে সে। বিস্মিত রাইয়ান নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠে, ‘বাবা!’
ভদ্রলোক মৃদু হাসে। অমায়িক সে হাসি। দু হাত বাড়িয়ে রাইয়ানকে ডাকে সে। রাইয়ানের কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। মনে হয় এই কাছে গেলেই বুঝি ঘুমটা ভেঙে যাবে। তবুও রাইয়ান এগোয়। কিভাবে পা অগ্রসর হতে থাকে সে নিজেও জানে না। নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাইয়ানের বাবা দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাইয়ানকে। প্রগাঢ় মায়ার সেই বন্ধন। রাইয়ানের চোখের কোনে পানি এসে পড়ে। তার মনে পড়ে না শেষ কবে কেঁদেছিল সে। শক্ত, বুদ্ধিমান, বিবেকী মানুষটাও আজ আবেগী হয়ে উঠে। বাবাকে বহু বছর পর কাছে পেয়ে রাইয়ান আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। ভেতর থেকে উথলে আসে আবেগ। বাবার স্নেহের স্বাদ বুঝি এমনই। সবাই অম্লান নয়নে দেখতে থাকে বাবা ছেলের মিলনের দৃশ্য। রাইয়ানের বাবা রাইয়ানের কাছে ক্ষমা চায়, এতদিন এভাবে দূরে দূরে থাকার জন্য। স্ত্রী বিয়োগের যন্ত্রণা ভোলার চেষ্টায় সে কখনো রাইয়ানের কথা চিন্তাও করেনি। প্রকৃতির মাঝে ধর্না দিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছে এই জীবন সংসার থেকে। শেষ যখন সেন্ট এলিয়াস পর্বতে আরোহন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই একটি খাম পায় সে। যেটি পাঠিয়েছিল হৃদি। মূলত রাইয়ানের অপ্রকাশিত অনুভূতি লেখা কিছু কাগজ একদিন হৃদির হাতে এসে পড়ে। বাবাকে নিয়েও লেখা কিছু কাগজ আলাদা করে রাখতো সে। সেই ছোট বাক্সটাই পেয়ে যায় হৃদি। লেখাগুলো অনেকটা চিঠির মতো। বাবার জন্য রাইয়ানের আকুতিগুলো ফুটে উঠে সেই লেখায়। সেগুলো দেখে হৃদির মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। দাদীমার থেকে ইনফরমেশন নিয়ে এরপর হৃদি সেই ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ করে। তার মাধ্যমেই সেই ছোট বাক্সটি রাইয়ানের বাবার কাছে পাঠায়। নিজের ছেলের এমন আবেগঘন লেখা পড়ে রাইয়ানের বাবা তার ভুল বুঝতে পারেন। এতদিন ছেলেকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত রাখার জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন। যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত একটা মানুষের থেকে নিজের দাদীর কাছে রাইয়ান খুব ভালোভাবেই থাকবে ভেবে যে দূরান্তের পথে তিনি পা দিয়েছিলেন সেখান থেকে এবার বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফলস্বরূপ আজ তিনি রাইয়ানের সামনে।
বাবাকে ফিরে পাওয়ার পেছনেও কৃতিত্বটা হৃদির জেনে রাইয়ান আবেগি চোখে তাকিয়ে থাকে অদূরে সবার মাঝে দাঁড়ানো হৃদির দিকে। হৃদি স্মিত হাসে। রাইয়ানের চোখের পলক পড়ে না। এ কেমন মানুষ হৃদি? কেউ কারো জন্য এতোটাও করতে পারে! আজ সকাল থেকে একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়ে যাচ্ছে সে রাইয়ানকে। জীবনের বেস্ট দিন উপহার দিয়েছে। সব না পাওয়া গুলো পূরণ করে দিয়েছে। এতো সব আয়োজন করেছে শুধুমাত্র রাইয়ানের জন্য। এই পর্যন্ত সবথেকে বেস্ট বার্থডে এটা রাইয়ানের। আর এই সবকিছু শুধু হৃদির জন্য। শুধুই হৃদি।
রাইয়ানের বাবা রাইয়ানকে নিয়ে কেকের সামনে আসে। ছেলের হাতে তুলে দেয় কেক কাটার ছুরি। বাবার দিকে তাকিয়ে রাইয়ানের চোখেমুখে খুশি চিকচিক করতে থাকে। আস্তে আস্তে কেক কাটে রাইয়ান। সবাই ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ বলে উইশ করে উঠে। রাইয়ানের কলিগ বেন্থা সবার উপর পার্টি স্প্রে করে দেয়। সবাই ফেনায় ভুত হয়ে উঠে। একটি হাসি ঝংকারের মুহুর্ত সৃষ্টি হয়। হয়ে পরে ক্যামেরায় বন্দি। কিছু মজাদার গেমও খেলে তারা। রাইয়ান আর হৃদির নেইবার মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ডেভিড কাপল ডান্স করতে যায়। কিন্তু সেখানেও তাদের লেগে যায় ঝগড়া। মিস্টার ডেভিড নাকি নাচের সময় অন্য আরেকটা মহিলার দিকে তাকিয়েছিল। সেটা নিয়েই শুরু হয় তাদের খুনসুটি। সবাই হাসতে থাকে তাদের দেখে। অনেক অনেক মজা করতে থাকে সবাই। সবাই যখন নিজেদের মধ্যে ইনজয় করায় ব্যস্ত তখন সুযোগ বুঝে হৃদির সাথে কথা বলতে যায় রাইয়ান। টেবিলের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা বার্থডে ক্যাপগুলো গুছিয়ে রাখছিল হৃদি। এমন সময় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ইতস্তত করতে করতে রাইয়ান আসে সেখান। আস্তে করে ডাকে,
‘হৃদি!’
হৃদি পাশ ফিরে বলে,
‘হুম?’
রাইয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই হৃদি বলে উঠে, ‘থ্যাংক ইউ বলবে তো? খবরদার! থ্যাংক ইউ বললে কিন্তু সত্যি সত্যিই রাগ হবো।’
হৃদি মোলায়েম হাসে। রাইয়ানও মৃদু হাসে সাথে। এরপর আস্তে আস্তে বলে,
‘আরেকটা কথাও বলার ছিল।’
‘বলো।’
‘আসলে আমি…..
এমন সময় রাইয়ানের কথার মাঝে বেন্থা চলে আসে সেখানে। কাটা পড়ে যায় রাইয়ানের কথা। বেন্থা রাইয়ানের পিঠ চাপড়ে বলে,
‘আজকে তো তোমার বাসা একদম গিফটে ভরে গেছে রাইয়ান। তো তোমার ওয়াইফ তোমাকে কি গিফট দিলো?’
রাইয়ান আলতো সুখানুভূতির দৃষ্টিতে হৃদির দিকে তাকায়। হৃদি চোখ নামিয়ে স্মিত হাসে। বেন্থার কথার উত্তর দিতে জিশান এসে বলে,
‘হৃদি তো মনে হয় সকাল থেকেই একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়ে চলেছে। এটাই কি গিফট নয়!’
হৃদি এবার মৃদু হেসে বলল, ‘তা কি করে হয়! সবাই যখন গিফট দিচ্ছে আমাকেও অবশ্যই দিতে হবে। আমি বাদ থাকবো কেন? আমার গিফটটা আমি দিবো সবার শেষে।’
বেন্থা বলল, ‘সারপ্রাইজটাই যেহেতু এতো দারুণ। গিফট টা তো মনে হয় ধামাকা কিছু হবে।’
হৃদি মৃদু হাসে। রাইয়ানের জন্য এই সারপ্রাইজগুলোর পরিকল্পনা সে অনেক আগে থেকেই করে রেখেছিল। মাঝখানে এই অপ্রত্যাশিত যাই হলো তার জন্য সে এতদিনের প্রস্তুতি মাটি করতে চায়নি৷ তাই আজকের জন্য পেছনের সব কথা ভুলে হৃদি শুধু রাইয়ানের জন্মদিনটাই স্মরণীয় করতে চেয়েছে। দিতে চেয়েছে রাইয়ানকে সবটুকু খুশি।
___________________________________________________
গতরাতে অনেক রাত পর্যন্ত জন্মদিনের আয়োজন চলায় অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে রাইয়ান। তার উপর সারাদিনের ছোটাছুটিও তো ছিলোই। সবাই চলে যাওয়ার পর কখন যে লিভিং রুমের সোফার উপর চোখ লেগে ঘুমিয়ে যায় সে খেয়ালও নেই। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। চোখ খুলেই নিজেকে আবিষ্কার করে সোফায়। গায়ে একটা চাদর দেওয়া। চাদরটা দেখেই খানিক অবাক হয় রাইয়ান। পুরো বাসায় পিন পতন নিস্তব্ধতা। গতরাতে বার্থডে পার্টির জন্য যে এলোমেলো অবস্থা ছিল তাও নেই। সবকিছু একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পরিপাটি ও গোছানো। রাইয়ান চোখ ডলে উঠে বসে। সামনের টেবিলের উপর একটা কাগজ মোড়ানো দেখতে পায়। রাইয়ান কাগজটা মেলতেই দেখে তার লোন সম্পূর্ণ শোধ হয়ে গেছে এমন একটি রশিদ টাইপের কাগজ। রাইয়ানের ভ্রু সংকুচিত হয়। হুট করেই মানে বুঝতে পারে না। সে দ্রুত যায় রুমে। গিয়ে দেখে হৃদি নেই। ওয়াশরুম, কিচেন পুরো বাসা খুঁজে দেখে কোথাও হৃদি নেই। এমনকি হৃদির কোন জিনিসপত্রও নেই। বুঝতে আর কিছু বাকি থাকে না রাইয়ানের। সে সেই অবস্থাতেই খালি পায়ে দ্রুত চলে যায় বাইরে। লিফট না থাকায় সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে থাকে। বিল্ডিং থেকে বেরোতেই দেখা হয় মি. ডেভিডের সাথে। রাইয়ানকে এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে দেখে ডাক দেয়। রাইয়ান তাকে জিজ্ঞেস করে হৃদিকে দেখেছে কিনা। সে উত্তর দেয় হৃদিকে লাগেজপত্র নিয়ে একটি ক্যাবে করে যেতে দেখেছিল সে। রাইয়ান আর এক মুহুর্তের জন্যও দাঁড়ায় না। ছুটে যায় হাইওয়ের দিকে। পাগলের মতো ডাকতে থাকে, ‘হৃদি! হৃদি!’ করে।
এলোমেলো বেশে খালি পায়ে ব্যস্ত শহরের রাস্তায় প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে রাইয়ান। তিনমুখী রাস্তার এক মোড়ে এসেই থমকে দাঁড়ায়। চারপাশে অসংখ্য গাড়ি আসছে যাচ্ছে। কোলাহলে রাইয়ানের দম বন্ধের মতো মনে হয়। চোখেমুখে ভয়ানক শঙ্কা। ব্যগ্র হয়ে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে সে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে উঠে, ‘হৃদি!’
গাড়ির হর্নের শব্দে ফিকে হয়ে পরে রাইয়ানের ডাক। জলদস্যুর হাতে সর্বস্ব হারানো ধু ধু মরুভূমিতে ছটফট করা একদম নিঃস্ব পথিকের মতো দেখায় তাকে। হৃদি নেই! কোথাও নেই! ভালোবাসার মানুষটির কোন ইচ্ছে অপূর্ণ না রাখার তাগিদে এভাবেই নিজেকে সরিয়ে হৃদি দিয়ে যায় রাইয়ানকে জন্মদিনের শেষ উপহার।
চলবে,