#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৮|
গাড়ি থেকে নেমে জুভান বলল,
‘তোমার বাবা হসপিটালে না?’
স্মৃতি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না, উনাকে ডাক্তার এখন বাসায় থাকতে বলেছেন।’
‘আচ্ছা। তোমাদের বাসা কি এখন এইদিকে নেওয়া হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ঐ যে ঐ বিল্ডিং টা।’
স্মৃতির হাতের ইশারার দিকে তাকিয়ে জুভান ছোট্ট করে বলল,
‘ওও, চলো তাহলে যাওয়া যাক।’
স্মৃতি আর জুভান সেই বিল্ডিং এ প্রবেশ করল। পুরনো দেখতে। দেয়ালের রং উঠে আছে। দরজা জানলা ফাটা। সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠে গেল তারা। স্মৃতি দরজায় নক করতেই একটা বিশ একুশ বছরের ছেলে এসে দরজা টা খুলে দিল। তাদের দেখে ছেলেটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। খুশ গলায় বলল,
‘আপু, দুলাভাই কেমন আছো তোমরা?’
দুজনেই হেসে জবাব দিল। তারপর তারা বাসার ভেতরে ঢুকল। ছেলেটা তখন মা মা বলে ডাক দিতেই বসার ঘরে একজন মধ্যবয়সী মহিলা এলেন। স্মৃতি আর জুভান কে দেখে মহিলাটার চোখ মুখ যেন উচ্ছল হয়ে উঠল। স্মৃতি মা বলে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। জুভান এসে সালাম করল। খুশ বিনিময় শেষে তাদের নিয়ে ভেতরের রুমে যাওয়া হলো, যেখানে একজন বৃদ্ধ মানুষ শায়িত অবস্থায় ছিলেন। মানুষটি কে দেখে স্মৃতি তার পাশে বসল। কোমল কন্ঠে বলল,
‘কেমন আছো, বাবা?’
ঐ মানুষ টা খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকালেন। মাথার উপর হাতের উল্টো পিঠ টা রেখে খুব ভালো করে স্মৃতির মুখটা দেখে বললেন,
‘ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?’
‘আমিও ভালো আছি বাবা। দেখো, তোমার সাথে কে দেখা করতে এসেছেন।’
লোকটি কাঁপা কাঁপা চোখে পাশ ফিরে জুভানের দিকে তাকাল। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘বাবা, ভালো আছো তুমি?’
‘জ্বি বাবা, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’
‘ঐ আল্লাহর দয়ায় আর তোমার টাকায় কোনোরকমে বেঁচে আছি আরকি।’
‘ছি ছি বাবা, এভাবে বলছেন কেন? আমার বাবার চিকিৎসায় আমি টাকা দিব না। এইতো আপনি আস্তে আস্তে সেরে যাচ্ছেন। একদিন দেখবেন, আবার আগের মতো উঠে বসতে পারছেন।’
‘হ্যাঁ বাবা, দোয়া করো। তোমরা এত কষ্ট করে এলে, যাও হাত মুখ ধুয়ে এখন খেতে বসো। গরিবের বাসায় বেশি কিছু নেই। শুধু ডাল ভাত খেয়েই পেট ভরতে হবে।’
‘সমস্যা নেই বাবা। ডাল ভাতই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’
জুভান বসে বসে আরো কিছুক্ষণ তার শ্বশুরের সাথে কথা বলল। সেই ফাঁকে স্মৃতি বাইরে গেল। তার পেছন পেছন ঐ বিশ একুশ বছরের ছেলেটিও বের হলো। স্মৃতি তাকে নিয়ে রান্নাঘরের কাছে গিয়ে বলল,
‘ঐদিকে কতটুকু কাজ এগুলো?’
ছেলেটি তার চোখের মোটা চশমাটা ঠেলে পেছনে নিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘পাচ্ছি না তো আপু। ঐ লোকটা কে এত খুঁজেও কোথাও পাচ্ছি না। তুমি কি কিছু ধরতে পেরেছ?’
‘না, তবে আমার ওদের উপর আজকাল খুব সন্দেহ হচ্ছে জানিস তো। ঐ লোকগুলোরও জমির প্রতি খুব লোভ, বিশেষ করে জুভানের। ওর যা ভয়ংকর রূপ আমি দেখেছি, মাঝে মাঝে তো এই ভেবে ভয় হয় ঐ না আবার…। কিন্তু আমি খুব করে চাই, উনি যেন না হয়। বিশ্বাস কর, এমনটা হলে আমি কখনোই উনাকে ক্ষমা করতে পারব না।’
‘তুমি দুলাভাই কে খুব ভালোবাসো, তাই না আপু?’
ভাইয়ের প্রশ্নে থমকে যায় স্মৃতি। সাহস নেই তার। আজ ভালোবাসি বললে, কাল যদিই সেই ভালোবাসাকেই নিজের হাতে কতল করতে হয়। সেটা সে কখনোই সহ্য করতে পারবে না। আসল সত্যি টা খুঁজে বের না করার পর্যন্ত না সে শান্তি পাবে আর না সে তার ভালোবাসাও স্বীকার করতে পারবে।
স্মৃতি গভীর নিশ্বাস ছাড়ে। ভাই কে বলে,
‘তুই ঐদিকে তোর চেষ্টা চালিয়ে যা। আর এইদিক টা আমি দেখছি। একবার যদি জুভানের ফাইলের লকারের চাবি টা পেতাম তাহলে অনেক টা ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু আমি ঐ চাবিটাই পাচ্ছি না।’
‘পেয়ে যাবে। দুলাভাইয়ের ব্যাগ আর আলমারিতে ভালো ভাবে খুঁজ, দেখবে ঠিক পাবে।’
‘আচ্ছা। আমি আবার খুঁজব। আর শোন, আমরা যাওয়ার পর তুই আন্টি আর আংকেল কে খুব সাবধানে উনাদের বাসায় নিয়ে রেখে আসবি।’
‘তুমি কোনো চিন্তা করো না আপু, এইদিক সামলানোর জন্য আমি আছি।’
স্মৃতি নিশ্চিন্ত হলো। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে সে আর জুভান বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে স্মৃতি ঐ বৃদ্ধ লোককে ত্রিশ হাজার টাকা দিল। দশ হাজার টাকা দিল তার ভাইকে। তারপর তারা রওনা দিল তাদের গন্তব্যে। শহরে পৌঁছে জুভান বললো,
‘চলো, বের যখন হয়েছিই তখন ডাক্তারও দেখিয়ে আসি।’
ডাক্তারের কথা শুনে স্মৃতির মুখখানা চুপসে গেল। চোখে মুখে ছেয়ে এলো হতাশা। সে গম্ভীর গলায় জুভান কে বলল,
‘এখন আবার ডাক্তারের কাছে কেন? বাসায় যাই না প্লিজ।’
‘উঁহু, কালকে কী কথা হয়েছিল ভুলে গেলে নাকি? এখন আগে ডাক্তার দেখাব তারপর আমরা বাসায় যাবো, বুঝেছো।’
স্মৃতি যে পুনরায় কিছু বলবে সেই সাহস আর সে পেল না। মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল সে। জুভানের গাড়ি গিয়ে থামল একেবারে একটি হসপিটালের সামনে। সে নেমে স্মৃতির পাশে দরজা টা খুলে দিয়ে বলল,
‘নামো।’
স্মৃতি নেমে দাঁড়াল। জুভান গাড়ি টা পার্ক করে এসে স্মৃতি কে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। রিসিপশন চেক করে তারা একজন গাইনী বিশেষজ্ঞের কাছে গেল।
জুভান মহিলা ডক্টরটিকে সবকিছু খুলে বলল। ডক্টর বললেন, আগে স্মৃতির কিছু টেস্ট করাবেন। ও যদি শারিরীক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয় তবেই তারা বাচ্চা নিতে পারবে। আর সেই টেস্ট করানোর জন্য তিনি স্মৃতি কে নিয়ে আলাদা একটা রুমে গেলেন। সেখানে যাওয়া মাত্রই স্মৃতি ডক্টর কে বলে উঠল,
‘ডক্টর, আমি এখনই বাচ্চা নিতে চাই না।’
ডক্টর অবাক হলো খুব। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘কেন, কোনো সমস্যা?’
‘না, তবে আমি এখন বাচ্চা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত না। আর এই কথাটা আমি কোনোভাবেই আমার হাজবেন্ড কে বোঝাতে পারছি না। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। প্লিজ, আমায় সাহায্য করুন।’
ডক্টর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আমি কীভাবে সাহায্য করব?’
‘বেশি কিছু না, আপনি শুধু আমার হাজবেন্ড কে গিয়ে বলবেন যে আমি এখনই মা হওয়ার জন্য শারিরীক ভাবে প্রস্তুত না। আমার আরো কিছুদিন সময় লাগবে।’
‘সরি, আমি মিথ্যে বলতে পারবো না। আমি আপনাকে টেস্ট করাবো তারপর টেস্টের রিপোর্ট যা আসবে আমি সেই অনুযায়ীই কথা বলবো।’
‘প্লিজ ডক্টর, এইটুকু সাহায্য তো আপনি করতেই পারেন। প্লিজ।’
কোনোভাবেই বুঝিয়ে সে ডক্টর কে রাজি করাতে পারল না। শেষে সে রেগে মেগে টেস্ট না করিয়েই ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। সোজা সে জুভানের কাছে গিয়ে বলল,
‘ডক্টর বলেছেন, সবকিছু ঠিক আছে। আমরা বেবি নিতে পারবো।’
জুভান খুশি হয়ে গেল। সে আবার কেবিনের ভেতরে যেতে নিলেই স্মৃতি তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ডক্টরের ফি দেওয়া হয়নি তো।’
‘ঐ যে উনার পি.এ এর কাছে দিয়ে দিলেই হবে।’
হসপিটাল থেকে বেরিয়েই হাফ ছেড়ে যেন বাঁচল স্মৃতি। কিন্তু ঝামেলা তো রয়েই গেল। এই বাচ্চার ব্যাপার টা এখন সে জুভানের মাথা থেকে কীভাবে দূর করবে সেটাই ভাবছে। একবার যদি এসবের ঝামেলায় ফেঁসে যায় তাহলে আর তার উদ্দেশ্য পূরণ করা হবে না। সে তখন আর কোনোভাবেই তার বাবার খু*নী কে খুঁজে বের করতে পারবে না।
চলবে…