অচিত্তাকর্ষক পর্ব -০৯

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৯|

সন্ধ্যার দিকে স্মৃতি কে বাসায় নামিয়ে দিয়ে জুভান কোথায় যেন গেল। স্মৃতি আর তাকে জিজ্ঞেস করল না কিছু। সে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেল নাস্তা বানাতে। তখন রান্নাঘরে তার শাশুড়ি মা ও এলেন। তিনি এসে গম্ভীর সুরে বললেন,

‘তা, তোর বাবার কী অবস্থা? আর কতদিন চলবে উনার চিকিৎসা?’

‘আগের থেকে ভালোই। তবে সামনে আরেকটা অপারেশন আছে। ডাক্তার বলেছেন, ঐ অপারেশনের পর আরো বেশি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

স্মৃতির কথা শুনে তিনি মুখ বাঁকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন,

‘এর আগেও একটা হয়েছে। লাখ খানেকের মতো টাকা লেগেছে। সবটাই তো আমার ছেলে দিয়েছে। এখন আবার একটা। এখনও নিশ্চয়ই সব টাকা আমার ছেলেই দিবে?’

স্মৃতি তার শাশুড়ি মায়ের দিকে ঘুরে তাকাল, বলল,

‘টাকা তো দিতেই হবে মা। আপনার ছেলেকে আমি বিয়ের আগে এই শর্ত রেখেই বিয়ে করেছিলাম যে বিয়ের পর আমার বাবার চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব উনাকে নিতে হবে। উনিও আমার সেই শর্ত মেনেই আমাকে বিয়ে করেছেন। তাহলে এখন আর এসব বলে কী হবে মা? শর্ত যখন দিয়েছি, সেটা তো তখন মানতেই হবে তাই না?’

‘তুই খুব চালাক। তোর আসলে লোভ হলো আমাদের সম্পত্তির উপর। এত টাকা তো জীবনে হয়তো চোখেও দেখিসনি। তাই এখন এসব দেখে আর লোভ সামলাতে পারছিস না। তা না হলে কি আর এত অপমানের পরেও এই বাড়িতে পড়ে থাকতি, কবেই চলে যেতি। কিন্তু ঐ যে লোভ, লোভের কারণে ছাড়তে পারলি না কিছু।’

স্মৃতি হাসল তার শাশুড়ির কথা শুনে। বলল,

‘তাও ভালো যে আমি লোভে পড়ে অন্তত আপনাদের মতো মানুষ মা/রি না।’

‘এই কী বললি তুই?’

মারিয়াম আহমেদ ভীষণ ভাবে ক্ষেপে গেলেন। এমন ভাবে স্মৃতির দিকে তাকিয়ে আছেন যেন অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিযুগল তার এখনই বেরিয়ে পড়বে। স্মৃতি পুনরায় আর কোনো জবাব দিল না। মারিয়াম আহমেদ বেশ খানিকক্ষণ ভাষণ দিলেন। তার সেই ভাষণ কে স্মৃতি পাত্তাও দিল না। সে একটা চায়ের কাপ উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাকি দুটো নিয়ে জারার রুমে চলে গেল।

‘আসবো, জারা?’

জারা শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,

‘হ্যাঁ ভাবি, এসো না।’

স্মৃতি দু কাপ চা নিয়ে জারার রুমে প্রবেশ করল। একটা চায়ের কাপ জারার দিকে বাড়িয়ে বলল,

‘নাও, তোমার জন্য মশলা চা বানিয়েছি।’

জারা তৎক্ষণাৎ খুশি হয়ে গেল। মশলা চা তার প্রিয় বলে কথা। গরম গরম চা গলাধঃকরণ করে বলে উঠল,

‘উমম, যা হয়েছে না। উফফ ভাবি, এত মজা করে কী করে বানাও বলতো?’

স্মৃতি হেসে তার পাশে বসল। বলল,

‘ঐ হয়ে যায় কোনোরকমে।’

‘তোমরা নাকি আজকে আংকেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে। কেমন আছেন উনি এখন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, আগের থেকে ভালো।’

‘আস্তে আস্তে আরো ভালো হয়ে উঠবেন, দেখো।’

‘হুম, দোয়া করো।’

জারার সাথে অল্প কিছুক্ষণ চা আড্ডা দিয়ে স্মৃতি তার রুমে গেল। রুমের দরজা টা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে সে তার আলমারিটা খুলল। বিদেশ থেকে আনা ব্যাগগুলো জুভান এখনও খুলেনি। এইগুলো কোনোটাই কি চাবি হবে? আর হলেও সে এখন এই ব্যাগগুলো খুলবে কীভাবে। খুললেই জুভান বুঝে যাবে। স্মৃতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কী করা যায়। হঠাৎ তার মনে হলো, একটা উপায় আছে। ব্যাগগুলো খুলে চেক করে আবার আগের মতো প্যাক করে ফেললেই হবে। একটু গুছিয়ে করতে পারলেই জুভান আর টের পাবে না। এইটুকু রিস্ক তাকেই নিতেই হবে, এছাড়া আর কোন উপায়ও যে নেই।

স্মৃতি আলমারির ভেতর থেকে বড়ো কাপড়ের ব্যাগ টা নিচে নামাল। ব্যাগ খোলার আগে তার মনে হলো, একবার জুভান কে কল দিয়ে জানা উচিত সে কোথায় আছে। হুট করেই যদি আবার বাসায় চলে আসে তখন আরেক বিপদ বাঁধবে। তাই সে জুভান কে কল দেয়। জুভান জানায়, তার বাসায় ফিরতে আরো ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। এই মূখ্য সুযোগটাকেই এবার তার কাজে লাগাতে হবে। স্মৃতি ব্যাগের পাশে চেইনের স্কস্টেপ টা আস্তে করে খুলল। তারপর চেইন টা খুলে দেখল ভেতরে অনেক কাপড় চোপড়। স্মৃতি আস্তে করে ভেতরে হাত দিয়ে সাইডের পকেটে চাবি আছে কিনা খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ হাতড়িয়ে সে সেখান থেকে একটা ছোট্ট চাবি পেয়েও গেল।

মনে একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল তার। চাবি টা নিয়ে আলমারির ডানদিকের লকারটার কাছে গেল সে। মনে মনে খুব করে দোয়া করে চাবিটা লকে লাগাল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে সেটা ঘুরিয়ে দেখল খুলে কিনা। দুবার প্যাঁচ ভাঙতেই স্মৃতির মনে হলো তৃতীয়বার গিয়ে হয়তো খুলে যাবে। বিস্তীর্ণ মনে একগুচ্ছ আশার আলো যেন দেখতে পেল। কিন্তু তৃতীয়বার ঘুরানোর আগেই সে তার দরজায় কারোর যেন ধিরিম ধিরিম শব্দ শুনতে পেল। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল স্মৃতি। সে তাড়াহুড়ো করে চাবিটা নিয়ে ব্যাগে রেখে ব্যাগটা আগের মতো গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল। ততক্ষণে দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম। স্মৃতি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। মারিয়াম আহমেদ বজ্র কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ম/রে গিয়েছিলি নাকি? দরজা খুলতে এত লেইট হলো কেন?’

স্মৃতি আমতা আমতা করে বলল,

‘ওয়াশরুমে ছিলাম মা।’

‘ওয়াশরুমে গেলে কি রুমের দরজা লাগিয়ে যেতে হয়? ওয়াশরুমের দরজা নেই, যত্তসব।’

‘আপনার কিছু লাগবে মা?’

শাশুড়ি মা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,

‘তোমার শ্বশুর এসেছেন। উনার জন্য রং চা বানাও গিয়ে, যাও।’

স্মৃতি কথাটা শুনে মনে মনে ভাবল, “এইটুকু একটা কথার জন্য দরজা ভেঙে ফেলা লাগে, অদ্ভুত!”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নেমে গেল। তার শাশুড়ি মাও তার পেছন পেছন গেলেন। রান্নাঘরে ঢুকে বললেন,

‘আদা দিয়ে কড়া করে চা বানাবি।’

স্মৃতি মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা মা।’

নয়টার দিকে জুভান বাসায় ফিরল। স্মৃতি রান্নাঘরে তখন রাতের খাবার বানাচ্ছে। জুভান আর তাকে না ডেকে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। গায়ের শার্টটা খুলে সে ডিভানের উপর রেখে আলমারির কাছে গেল। আলমারি খুলে টাওয়াল আর টি শার্ট টা নিয়ে ফিরে তাকাতেই হঠাৎ তার মনে হলো তার লকারের লকটা উল্টো হয়ে আছে। সে কাছ থেকে দেখল সেটা। হ্যাঁ, সত্যিই লকটা ঘুরে আছে। তারমানে কেউ এটা খুলতে চেয়েছিল। সে আসার পর তো একবারও এই লকার খুলেনি। তাহলে কে, স্মৃতি? কিন্তু ও এই লকার খুলে কী করবে? এই লকারে ওর কী প্রয়োজন?

জুভান তখন আর বেশি কিছু না ভেবে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

রাতে খেতে বসে মারিয়াম আহমেদ আবারও ন্যাকা কান্না জুড়ে বসলেন। তিনি নাক টেনে টেনে জুভান কে বললেন,

‘জানিস বাবা, তোর বউ আজকে আমাকে কি বলেছে? বলেছে যে, আমরা নাকি লোভের কারণে মানুষ মা/রি। দেখেছিস বাবা, ও কত বড়ো বেয়াদব। কেউ তার শাশুড়ি মা কে এভাবে বলে, বল তো?’

জুভান ভ্রু জোড়া কুঁচকে স্মৃতির দিকে তাকাল। স্মৃতি মাথা নুইয়ে ধীর গলায় বলল,

‘মা আমাকে লোভী বলেছিলেন তাই..’

‘তাই তুমি এই কথা বলবে? আমরা লোভের জন্য মানুষ মা/রি? এই কথা তুমি কী করে বলতে পারলে স্মৃতি?’

স্মৃতি জবাব দিতে পারল না। মারিয়াম আহমেদের মুখে তখন যুদ্ধ জয়ের হাসি। জুভান আর কিছু না বললেও তার বাবা স্মৃতি কে অনেক কথা শুনালেন। জুভান উনাকে একবার থামালও না। স্মৃতি আর সহ্য করতে না পেরে নিজের রুমে গিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। ক্ষণিক বাদে রুমে জুভান এল। এসে দেখল স্মৃতি পাশ ফিরে শুয়ে আছে। জুভান তার পাশে বসল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমার লকার কেন খুলতে চেয়েছিলে স্মৃতি?’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here