গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ১
– তোমার নাম?
– পিউ
– বয়স কত?
– একুশ বছর।
টেবিলের ওপাশে বসে থাকা অ্যালিস মুখ তুলে তাকালেন পিউয়ের দিকে। চশমার ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখেই আবার চোখ নামিয়ে নিলেন। বললেন,
– তোমার হাজব্যান্ডের বয়স কত?
– ছত্রিশ।
– তোমাদের বিয়েটা কি অ্যারেঞ্জড?
– নাহ, লাভ ম্যারেজ ছিল আমাদের।
– কিন্তু পুলিশের রেকর্ডে দেখাচ্ছে, এর আগে কোনো একটা ইন্টারোগেশনে তোমার হাজব্যান্ড পুলিশকে জানিয়েছিল তোমাদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জড।
– (নিশ্চুপ)
– কত বছর আগে বিয়ে হয়েছে?
– চার বছর।
– তুমি কি বিবাহিত জীবনে হ্যাপি?
– (নিশ্চুপ)
– তুমি কি আমাকে ডিটেইলস খুলে বলবে সেদিন কী হয়েছিল তোমাদের মধ্যে?
– আমার মোবাইলে থমাস ফোন করেছিল… আমার ফ্রেন্ড। ইউনিভার্সিটিতে আমরা একসাথে পড়াশুনা করি। আমাকে প্রায়ই ফোন করে। আমার হাজব্যান্ডের এটা পছন্দ না। সে চায় না, আমি থমাসের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখি।
– কেন? থমাস তোমাকে ফোন করলে তার প্রবলেম কী?
– থমাসকে নিয়ে তার স্পেসিফিক কোনো প্রবলেম নেই। সে চায় না আমার কোনো ফ্রেন্ড থাকুক। কেউ আমাকে ফোন করুক, এটা তার পছন্দ না।
– স্যরি, আমি ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলাম না। কেউ তোমাকে ফোন করলে সে পছন্দ করবে না কেন?
পিউ উত্তর দিল না। অ্যালিস ফ্রাঙ্কলিন, চুয়ান্ন বছর বয়সী স্কটিশ মহিলা বহু বছর ধরে সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে চাকুরি করেন। তার চাকুরি জীবনে এই পর্যন্ত যতগুলো কেস হ্যান্ডেল করেছেন তিনি, তার মধ্যে ইন্ডিয়ান বা এশিয়ান কাপল কেসগুলোতে এই ব্যাপারটা বেশ কমন দেখেছেন। একজন এশিয়ান পুরুষ কখনো একটা ছেলের সাথে তার স্ত্রীর বন্ধুত্ব হজম করতে পারে না। তেমনিভাবে একজন এশিয়ান নারীও স্বামীর পাশে কোনো মেয়েবন্ধুকে সহ্য করে না। এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে এরকম মনমানসিকতা খুবই কমন। সমস্যা হয়, যখন এই মানুষগুলো নিজেদের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসে, পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকতে শুরু করে। তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে তখন। পশ্চিমা কালচারের অনেক কিছুই তারা খুব সহজে অ্যাডাপ্ট করে নেয়। কিন্তু মনমানসিকতা পাল্টাতে পারে না। কেউ কেউ উদার হতে পারলেও বেশিরভাগের বেলাতেই দেখা যায় এশিয়ান মনমানসিকতা পুষে রেখে পশ্চিমা কালচারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে, একসময় বেধে যায় ধুন্ধুমার! এশিয়ান মনমানসিকতা আর পশ্চিমা নিয়মনীতির সংঘর্ষ চলে তখন। এই কেসটাও অনেকটা তেমন মনে হচ্ছে। সামনে বসে থাকা মেয়েটা আর্থিক দিক থেকে পুরোপুরি স্বামীর উপর নির্ভরশীল। একটা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে হয়েও জব করে না সে। হয়তো তার স্বামীর পছন্দ নয় সেটা। স্বামী তাকে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করার সুযোগ দিয়ে একদিকে যেমন উদার মনের পরিচয় দিয়েছে, অন্যদিকে ইউনিভার্সিটির অন্যসব ছাত্রছাত্রীদের সাথে স্ত্রীর বন্ধুত্বটাকে মেনে নিতে পারছে না। কী এক অদ্ভুত কমপ্লেক্স তাদের জীবনে!
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অ্যালিস বললেন,
– প্লিজ কন্টিনিউ…
পিউ নিচু গলায় বলতে শুরু করল,
– আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে ফোন করে, এই নিয়ে প্রায়ই আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। সেকারণে আমি ওর সামনে কখনো ফ্রেন্ডদের ফোন রিসিভ করি না। সেদিন সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টার দিকে একটা অ্যাসাইনমেন্টের ব্যাপারে বারবার ফোন দিচ্ছিল থমাস। আমি ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার হাজব্যান্ড টের পেয়ে গেল। স্ক্রীণে থমাসের নাম দেখে সে কল কেটে দিল। নাম্বারটাও ব্লক করে দিল। ব্লক করার সময় সে কললিস্টে দেখেছে সেদিন দিনের বেলায় বেশ কয়েকবার আমার কয়েকজন ফ্রেন্ড কল করেছিল। আমিও কলব্যাক করেছিলাম। মূলত অ্যাসাইনমেন্টের ব্যাপারেই ফোনে কথা বলতে হয়েছিল। এই নিয়ে হালকা তর্কাতর্কি হচ্ছিল। সে আমার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিল খুব। থমাস তখন ল্যান্ডনাম্বারে ফোন করল। আমার হাজব্যান্ড ফোন রিসিভ করায় কথা না বলেই ফোন রেখে দিয়েছিল।
– ফোন রেখে দিয়েছিল কেন?
– আমিই মানা করেছিলাম খুব দরকার না পড়লে আমার ল্যান্ডনাম্বারে যেন কেউ কল না দেয়। কল করলেও আমার হাজব্যান্ড যদি রিসিভ করে, তাহলে যেন কথা না বলে।
– স্ট্রেঞ্জ! একটা মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। অথচ তার কোনো ফ্রেন্ড থাকতে পারবে না। তার কোনো ফ্রেন্ড তাকে কল করতে পারবে না। সাউন্ডস উইয়ার্ড!
– ও এরকমই…
– এটা খুবই খারাপ মেন্টালিটি, পিউ। তুমি একটা অ্যাডাল্ট মেয়ে। তোমার হাজব্যান্ড চাইলেই এভাবে তোমার উপর বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিতে পারে না।
– (নিশ্চুপ)
– ক্যারি অন…
– থমাস কিছুক্ষণ পরপরই ফোন করছিল। আমার হাজব্যান্ড বারবার কল কেটে দিচ্ছিল। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। আমি ওকে বলেছিলাম আমাকে ফোনটা দাও। তোমার সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলব স্পিকার অন করে। কিন্তু তাতেও রাজি হয়নি সে। উলটো বলল, এখন থেকে আমি মোবাইল ইউজ করতে পারব না। বাসার বাইরে যেতে পারব না। পড়াশুনা বন্ধ। যদি আমি তার কথা না শুনি, তাহলে সে আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবে।
– হোয়াট? দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবে?
– (নিশ্চুপ)
– তারপর?
– ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করি। তখন সে আমাকে বাধা দেয়। আমাকে টর্চার করতে শুরু করে।
– কীরকম টর্চার?
– অনেকগুলো থাপ্পড় মেরেছিল। হাত মুচড়ে ধরেছিল। আরেকটু হলে আমার হাতটাই ভেঙ্গে যেত।
– মাই গড! রীতিমতো ফিজিক্যাল টর্চার। তুমি পুলিশ কল করলে না কেন?
– তখন পুলিশ কল করার কথা মনে ছিল না আর সুযোগও ছিল না। ও কিছুতেই পুলিশ কল করতে দিত না।
– তারপর কী হলো?
– আমি কাচের বোতল দিয়ে ওর মাথায় বাড়ি দিয়েছিলাম। তখন সে আমার হাত ছেড়ে দেয়। আমি বাসার বাইরে চলে যাই। কিন্তু ও আমার পিছু নিয়েছিল। আমাকে জোরজবরদস্তি বাসার ভেতরে ঢোকাবার চেষ্টা করছিল। আমাকে টেনেহিঁচড়ে বাসার ভেতরে নিয়ে দরজা লক করে দিয়েছিল। দোতলায় নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। আমি চিৎকার করছিলাম খুব। ঠিক তখনই বাসায় পুলিশ এসেছিল। দরজায় নক করছিল বারবার। সেই মুহুর্তে আমি ওর হাতে কামড় দিই। তখন ও আমার হাত ছেড়ে দিলে আমি দৌড়ে গিয়ে পুলিশকে দরজা খুলে দিয়েছিলাম।
– তুমি এতক্ষণ যা বললে, তার সারমর্ম হচ্ছে, তুমি সেলফ ডিফেন্সের জন্য তোমার হাজব্যান্ডকে আঘাত করেছ। তার হাতে কামড় দিয়েছ। কারণ, সে তোমাকে ফিজিক্যালি টর্চার করছিল। আমি কি ঠিক বললাম?
– হ্যাঁ
– সে কি প্রায়ই মারধোর করে?
– না
– মেডিকেল চেকআপ করে তোমার শরীরে অনেক দাগ পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো মারধোর করার কারণে হয়েছে।
– (নিশ্চুপ)
– তোমার গলায় সেলাইয়ের দাগ কেন? কী হয়েছিল গলায়? তোমার হাতপায়ের দাগগুলোই বা কীসের?
– (নিশ্চুপ)
– এগুলোর জন্য তোমার হাজব্যান্ড দায়ী। তাই না? সে প্রায়ই তোমাকে ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি টর্চার করে।
– আগে মারত। বাংলাদেশে ছিলাম যখন।
– কেন মারত?
– (নিশ্চুপ)
– এখানে আসার পরে মারধোর করেনি?
– না। তবে প্রায়ই ক্ষেপে গেলে থাপ্পড় দেয়।
– তুমি জান, পুলিশ কল কে করেছিল?
– না।
– তোমার প্রতিবেশি। সে অনেকক্ষণ ধরেই তোমাদের ঝগড়া শুনতে পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে কাচ ভাঙ্গার শব্দ শুনে। তারপর দেখতে পায়, ড্রাইভওয়েতে তোমরা ধস্তাধস্তি করছ। তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাসার ভেতর। তখন তার মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল অনেক। এসব দেখে তোমার প্রতিবেশি পুলিশ কল করেছিল।
– (নিশ্চুপ)
– তোমার ফ্রেন্ড ক্যাথি এসেছিল তোমার জামিনে রজন্য। সে তার স্টেটমেন্ট দিয়েছে তোমার হাজব্যান্ডের বিপক্ষে। বলেছে, তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি টর্চার করে। তোমাকে কারো সাথে মিশতে দেয় না। সবসময় তোমাকে সন্দেহ করে। তার নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো তোমার উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়। কথাগুলো কি সত্যি?
– শারীরিকভাবে টর্চার বাদ দিয়ে বাকিগুলো সত্যি। এখানে আসার পর সে কোনোরকম মারধোর করেনি। খুব বেশি হলে থাপ্পড় দিয়েছে। তবে ঝগড়া হয় অনেক।
– থাপ্পড় দেয়াটাও একটা ফিজিক্যাল টর্চার, একটা ক্রাইম। তুমি এটাকে এত সহজভাবে নিচ্ছ কেন?
– (নিশ্চুপ)
– তোমার উপর ফিজিক্যাল টর্চার চলে, সেটা তোমার মেডিকেল রিপোর্টেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছে। তুমি কি কোনো কারণে মিথ্যে বলে তোমার হাজব্যান্ডকে পুলিশের হাত থেকে সেভ করতে চাচ্ছ?
– (নিশ্চুপ)
– দেখ পিউ, তুমি যদি তার বিরুদ্ধে আনা এসব চার্জ অস্বীকার করো, পরবর্তীতে তোমারই প্রবলেম হবে। তুমি সত্যিকারের বিপদে পড়লে পুলিশ তোমাকে হেল্প নাও করতে পারে। ভেবে দেখ। যে লোক তোমাকে এভাবে টর্চার করতে পারে, সে তোমাকে ভবিষ্যতে মেরে ফেলবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই কিন্তু…
– মারবে না…
– এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?
– (নিশ্চুপ)
– মানুষের সাইকোলজি কিন্তু খুব অদ্ভুত। মানুষ নিজেই তার নিজের সম্পর্কে গ্যারান্টি দিতে পারে না। সেখানে তুমি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছ, তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে না?
– (নিশ্চুপ)
– যাই হোক, এসব তুমি পুলিশের সাথে ডিল করো। আমি শুধু আমার ডিউটি করতে এসেছি। আমি তোমাকে এখন একটা ব্রিফ দিচ্ছি। পুলিশ অন দ্য স্পট তোমাকে অ্যারেস্ট করেছে, কারণ, তোমার হাজব্যান্ড সিরিয়াসলি ইনজুরড ছিল। তাকে ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিতে হয়েছে। তোমার আর তোমার ফ্রেন্ডের স্টেটমেন্ট পাবার পর পুলিশ তোমার জামিনের ব্যবস্থা করেছে। তোমার প্রতিবেশীও তোমাকে পক্ষে স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সে প্রায়ই তোমাদের ঝগড়া শুনত এবং ঝগড়ার পর তোমাকে বাগানে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে দেখত।
– (নিশ্চুপ)
– কোর্টে তোমার নামে একটা কেস উঠেছিল। অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেস। কিন্তু তোমাকে সবকিছু থেকে ফাইনালি রিলিজ দেয়া হয়েছে তোমার হাজব্যান্ডের স্টেটমেন্টের জন্য। সে তোমার নামে কোনো কমপ্লেন করেনি। বলেছে, তুমি তাকে আঘাত করতে চাওনি। পুরো ব্যাপারটাই অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। তবে, ঝগড়ার ব্যাপারটা স্বীকার করেছে। বলেছে, তুমি রাগ করে বাসা থেকে চলে যাচ্ছিলে। আর সে তোমাকে ফেরাতে চাচ্ছিল। আরো বলেছে, তোমার মেন্টাল প্রবলেম আছে। তুমি মাঝেমধ্যে অ্যাবনরমালের মতো আচরণ করো। তাই সে তোমাকে একা ছাড়তে চায়নি। তার এই স্টেটমেন্ট পাবার পর পুলিশ তোমাকে সাইকোলজিস্টের কাছে রেফার করেছিল মেন্টাল চেকআপের জন্য। রেজাল্টে জানা গিয়েছে, তোমার কোনো মেন্টাল ডিসঅর্ডার নেই। তবে, তুমি মেন্টালি ইমম্যাচিউরড। তোমার শারীরিক বয়স একুশ হলেও মানসিক বয়স চৌদ্দ কী পনেরো বছর। আর তাছাড়া তোমার পাস্ট লাইফের ব্যাপারেও অনেক অসংলগ্ন কথা বলেছ পুলিশকে। আমাকেও অনেক প্রশ্নের উত্তর দাওনি। এগুলো তোমার জন্য টু মাচ নেগেটিভ। তুমি কি বুঝতে পারছ?
– (নিশ্চুপ)
– আমি এই কেসে তোমার লিগ্যাল অ্যাডভাইজর হিসাবে কাজ করছি। যেহেতু, তোমার বয়স কম এবং হাজব্যান্ড ছাড়া তোমার এখানে আর কোনো ফ্যামিলি নেই। তাই, আমি কিছুদিনের জন্য তোমার লিগ্যাল গার্ডিয়ান হিসাবেও কাজ করব। আমার সাজেশন তোমাকে মানতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। ফাইনাল ডিসিশনটা তুমি নিজের ইচ্ছামতো নিতে পার।
– (নিশ্চুপ)
– বয়সের এত ডিফারেন্সে একটা সম্পর্ক মেইনটেইন করা খুব টাফ। আর যেহেতু তোমাদের সম্পর্কটা খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গিয়েছে, সেহেতু আমি তোমাকে সাজেস্ট করব, লইয়ারের কাছে গিয়ে ডিভোর্সের ফাইল খোলার জন্য। লইয়ার তোমার হাজব্যান্ডকে তোমার পক্ষ থেকে সেপারেশন লেটার পাঠাবে। এক বছর তোমাদের সেপারেট থাকতে হবে। শুধু সেপারেট থাকাই নয়, আরো কিছু ব্যাপার খুব কেয়ারফুলি মেইনটেইন করতে হবে। যেমন, ভুলেও তুমি তার সাথে যোগাযোগ করবে না। ফোন, ইমেইল, ইন্টারনেট, ফেস টু ফেস মিটিং সবকিছু বন্ধ থাকবে। কোনো দরকার হলে তুমি তোমার লইয়ারকে জানাবে। লইয়ার তোমার হয়ে কাজ করবে। তাকে কোনোরকম সুযোগ দেবে না তোমার কাছে আসার অথবা তোমার সাথে যোগাযোগ করার। আমার ধারণা, তোমার হাজব্যান্ড ডিভোর্সের নোটিশ পাওয়ামাত্রই তোমার সাথে যে কোনো মুল্যে যোগাযোগ করতে চাইবে। তোমাকে ম্যানিপুলেট করতে চাইবে। তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে সেজন্য।
– (নিশ্চুপ)
– আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, তোমার কারেন্ট অ্যাড্রেস যেটা, তুমি সেখানেই থাকবে। বাড়িটা তোমার নামে, তাই তোমার হাজব্যান্ডকে ওই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেবে না পুলিশ। তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে যেন সে কোনোভাবেই বাড়ির আশপাশে বা তোমার ত্রিসীমানায় না থাকে। খুব সম্ভব শহর চেঞ্জ করতে বলা হবে তাকে। সেটা ডিপেন্ড করবে কোর্ট অর্ডারের উপর। তেমন কিছু হলে তোমার হাজবেন্ড ডিভোর্সের আগ পর্যন্ত এই শহরে আসতে পারবে না। একান্তই কোনো দরকার থাকলে লইয়ারের মাধ্যমে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স জোগাড় করতে হবে তাকে। ইন দ্য মিন টাইম, তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি মাসে তার স্যালারির অর্ধেকটা তোমার অ্যাকাউন্টে চলে আসবে। এ ব্যাপারে তার এমপ্লয়ারকে নোটিশ দেয়া হবে। সেপারেশনের এক বছর সে তোমার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। সরকারি ফান্ড থেকেও তুমি প্রতি মাসে একটা অ্যামাউন্ট পাবে। এভাবে এক বছর চলার পর কোর্ট তোমাকে আর তোমার হাজব্যান্ডকে নির্দিষ্ট তারিখে অ্যাটেন্ড করতে বলবে। তারিখটা চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিবে। সেদিনই তোমাদের ডিভোর্স ডিক্লেয়ার হয়ে যাবে। যদি এর মধ্যে তোমার হাজবেন্ড কোনো অবজেকশন জানায়, তাহলে এভিডেন্সসহ জানাতে হবে। সে তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করবে। ডিভোর্স ফাইল ক্যানসেল করার চেষ্টা করবে। তাই তোমাকে কেয়ারফুল থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন তোমার দিক থেকে কোনোরকম সাড়া না পায়। আমি কি বুঝাতে পারলাম?
– হ্যাঁ।
– এবার বল, তুমি কি ডিভোর্স ফাইল খুলতে ইচ্ছুক?
– হ্যাঁ।
– ফাইন, তোমার লইয়ার পেপারওয়ার্কস রেডি করে তোমার সাইন নেবে আগামীকাল। তোমার কি আর কোনো প্রশ্ন আছে?
– আমার হাজব্যান্ড কেমন আছে এখন? কী অবস্থা ওর?
– এখনো আইসিইউতে আছে সে। মাথার আঘাতটা অনেক সিরিয়াস।তবে কাচের টুকরোগুলো বের করা হয়েছে। এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে।
– আমি কি ওর সাথে একটু দেখা করতে পারি?
– আমার মতে, সেটা করা উচিত হবে না।
– প্লিজ…
– কেন দেখা করতে চাচ্ছ? আর ইউ ফিলিং সিম্প্যাথেটিক টু হিম?
– (নিশ্চুপ)
– ফাইন, তুমি চাইলে দেখা করার ব্যবস্থা হবে। তবে সেটা সেপারেশন লেটার পাঠাবার আগেই। তুমি চাইলে আজ বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে দেখা করতে পার।
– থ্যাংকস।
ভিজিটিং আওয়ারে পিউ হাসপাতালে গেল জুনায়েদের সাথে দেখা করতে। কিন্তু ডাক্তার দেখা করার অনুমতি দিলেন না। রোগীর অবস্থা উঠানামা করছে। বিশেষ করে পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকে অবস্থার অবনতি হয়েছে। ব্লাড প্রেসার, হার্টবিট সবই অস্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। তাই তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তবু আইসিইউর বাইরে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে রইল পিউ। চলে আসার সময় লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যালিস বললেন,
– অল্পের জন্য তুমি বেঁচে গিয়েছ। তোমার হাজব্যান্ড মারা যেতে পারত। মারা যাবার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। তোমার কপাল ভালো সে সারভাইভ করতে চেষ্টা করছে। তা না হলে খুনের দায় চাপত তোমার উপর। যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতো। তোমার নামে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেস হয়েছিল। তুমি খুবই লাকি যে তোমার হাজব্যান্ডের জ্ঞান ফিরেছিল। আর সে পুলিশকে স্টেটমেন্ট দিতে পেরেছিল। নইলে কেস উইথড্র হতো না। আর তোমাকে যতদিন না তার জ্ঞান ফেরে, ততদিন জেলে থাকতে হতো। আর যদি তখনই মারা যেত, তাহলে তুমি পুরোপুরি ফেঁসে যেতে। (চলবে)